বঙ্গাল
আমি আসামে জন্মেছি এবং এখানেই বড় হয়েছি। এখন আমি এখানেই একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ করি। আমার বেশিরভাগ বন্ধুরাই অহমিয়া। ছোটবেলায় আমি কখনই মনে হয় নি যে আমি আসামের অন্য যে কোন মানুষের থেকে কোনভাবে আলাদা। আমাকে কারোর কারোর থেকে দেখতে একটু আলাদা, এটার কথা অবশ্য ধরি নি। আমার বাবা-মা বাড়িতে বাংলায় কথা বলেন যেখানে অধিকাংশের ভাষা হল অহমিয়া। দুটো ভাষাতে আমি স্বাভাবিকভাবেই সড়্গড় ছিলাম। আজকের কথা বলতে পারি না, কিন্তু সেই ছোটবেলায় অনেকেই ভাবতেন আমার মাতৃভাষা অহমিয়া। আবার আমি ভাষাটা কত ভালো বলি সেই নিয়ে অনেকেই আমার খুব প্রশংসা করতেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ, ওই যে বললাম, আমি এখানেই জন্মেছি আর বন্ধুরাও এখানকারই।
তবু একটু বলি। আমার স্কুলে অহমিয়া পড়তে একদম ভালো লাগত না। হিন্দিও তথৈবচ। বাংলা আমার স্কুলে পড়াত না। আমি কোনক্রমে ভাষাগুলো পড়তে শিখেছিলাম। ইংরাজী মিডিয়ামে পড়ার দৌলতে আর সবার আগে ইংরাজী অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার দৌলতে, আমি ইংরাজীতেই সবথেকে স্বচ্ছন্দ।
খুব সম্ভবতঃ আমি যখন পনের- ষোল বছরের, তখন আমাকে কেউ প্রথমবার বঙ্গাল বলে। বাড়িতে বাবা মাকে হ্যাটা দিতে বঙ্গাল বলতেন, তাই কথাটা আমার চেনা ছিল। বাবা যখন মা কে কথাটা বলতেন তাতে একটু ছোট করার ইচ্ছে থাকলেও খুব একটা বিদ্বেষ মিশে থাকত না। কথাটার মানে নিয়ে তখন ভাবিও নি। কিন্তু যখন কথাটা আমাকে বলা হল, হুলের খোঁচাটা বুঝলাম। তারপর থেকে যখনই কেউ আমাকে বঙ্গাল বলত, প্রতিবারই আমি খোঁচাটা অনুভব করতাম। অনেকদিন আমি জানতাম না কথাটার প্রকৃত অর্থ কী। পরে জানলাম যে পূর্ব পাকিস্তান/ পূর্ব বাংলার মানুষদের চলতি কথায় বঙ্গাল বলে। ধীরে ধীরে বন্ধুমহলে আরও বেশি করে কথাটা শুনতে শুরু করলাম। আমার সেখানে নিজেকে খুব অসহায় লাগত - আমি সেই সব বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে লাগলাম। বাঙ্গালী হয়ে জন্মানোটা যেন একটা জন্মগত অসুবিধা আর আমার সেটা নিয়ে কিছুই করার নেই। আমার ভয় করতে শুরু করল আবার কে কোথায় বঙ্গাল বলবে। শব্দটাকে ঘেন্না লাগত। এমনকি বঙ্গাল বলার জন্য একবার এক বন্ধুর কলার টেনে ধরেছিলাম। অবশ্য সে আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল বলেই সেটা করতে পেরেছিলাম। এখনও কথাটা কখনো সখনো শুনলেই আমার গা জ্বালা করে।
কয়েকবছর আগেও আমি খুব বোকা আর অকর্মা ছিলাম। আমার বাবা-মার অবশ্য উড়িয়ে ঝুড়িয়ে দেওয়ার মত বিশেষ কিছু ছিল না আর আমারও সেদিকে বিশেষ মতি ছিল না। ২০১৬ তে সৌভাগ্যবশতঃ আমি হিউমান রাইটস ল নেটওয়ার্কে ইন্টার্ন করার সুযোগ পাই। এই সংস্থাটি গরীব মানুষদের খুব স্বল্প মুল্যে বা বিনা মুল্যে আই্নি সহায়তা দেয়। আমার আইন পড়াশোনার তখন দ্বিতীয় বছর। কাজের জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগত। অনেক বেড়াতে পারতাম আর সবসময়ই কিছু না কিছু করার থাকত। মাঝে সাঝে আমি ক্লায়েন্টদের সমস্যার সমাধান করতে পারতাম – বড্ড ভালো লাগত।
আমার এক সিনিয়র বিদেশি ট্রাইব্যুনালে অনেক মামলা লড়তেন। প্রথমদিকে আমি এই কেসগুলোর কথা জানতাম না, পরে ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুবাদে সেগুলো সম্বন্ধে অবহিত হই। ওঁর ক্লায়েন্টের স্রোত কখনো থামত না। এঁরা সব সমাজের একেবারে নিচের তলার মানুষ। জানলাম যে এঁদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন নিয়ে ট্রাইব্যুনাল চলছে। ক্রমে ক্রমে আমি ট্রাইব্যুনাল কীভাবে কাজ করে তার খুঁটিনাটি জানলাম। আর এখন আমি জানি যে ওঁরা হলেন সর্বত্র ধাক্কা খাওয়ার পাত্র । এই ট্রাইব্যুনালগুলো আপাতদৃষ্টিতে আসামকে বিদেশিমুক্ত করার জন্য খুব প্রয়োজন এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের জন্য নিতান্তই জরুরি। প্রায় ৪৫৮০০ কেস গত পঁচিশ বছরে বিদেশি ট্রাইব্যুনালের কাছে গেছে। এখন ১.৮ লাখের বেশি কেস ট্রাইব্যুনালের কাছে জমে আছে।
কিভাবে ট্রাইব্যুনাল কাজ করে সেকথা আমি বলব। আমার মতে, আজকের আইনব্যবস্থা আসলে লাখে লাখে মানুষের মানবিক মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার একটা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি – কেন একথা বলছি তাও বলব। এক এক করে বলছি।
প্রথম ধাপ হল একজন মানুষকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা। বর্তমানে এই সন্দেহ জানানোর কোন স্বচ্ছ পদ্ধতি নেই। আগেকার যে ১৯৮৩ সালের অবৈধ অভিবাসী ( ট্রাইব্যুনালের দ্বারা নির্ধারিত) আইন (Illegal Migrants (Determination by Tribunals) Act, 1983) ছিল, তাতে যে কোন মানুষ অবাধে অন্য কারোর বিরুদ্ধে সন্দেহ জানিয়ে আবেদন করতে পারতেন। শুধু একটা এফিডেবিট লাগত আর লাগত ট্রাইব্যুনালের দশ টাকা ফি।
কেন্দ্রীয় সরকারেরও ক্ষমতা আছে সন্দেহভাজন মানুষকে অবৈধ অভিবাসী( নির্ধারণ) ট্রাইব্যুনালে হাতে তুলে দেওয়ার বা refer করার। কেন্দ্রীয় সরকার এই ক্ষমতাটি জেলাগুলির বর্ডার পুলিশের সুপারিন্টেনডেন্টকে হস্তান্তর করেছে। এই ক্ষমতা প্রয়োগের আগে একটাই দায়িত্ব আছে – সন্দেহভাজন মানুষটিকে ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর আগে তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত করতে হবে। গোটা পর্বে এটা একটা সত্যতা নির্ধারক ধাপ হিসেবেই ছিল, কিন্তু বাস্তবে সেটা একটা ভুয়ো তদন্তের বেআইনি কারবারের আখড়া হয়ে উঠেছে। শত শত মক্কেল আমাকে বলেছেন যে তাঁদের নিয়ে কখনো কোন ঠিকঠাক তদন্ত হয় নি। আর আমি যে অজস্র সন্দেহভাজন মানুষকে দেখেছি তাঁরা কেউই কখনো তাঁর বিরুদ্ধে করা একটি সত্যিকারের তদন্তে সাক্ষ্য দেন নি। তবু এখনো এই সব তদন্তের বিরুদ্ধে কোন টুঁ শব্দও শোনা যায় না।
জালাল শেখ
২০১১-১২ নাগাদ জীবিকার সন্ধানে জালাল গৌহাটিতে আসেন। তিনি একটা সাইকেল রিক্সা ভাড়া নে্ন আর গৌহাটির ভাঙ্গাগড় এলাকায় সপ্তাহখানেক সওয়রি নিয়ে ঘোরেন। একদিন একজন অসুস্থ রোগী সওয়ারি জোটে – তিনি গৌহাটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে যাবেন। রোগা মানুষটি জালালকে রিক্সা ক্যাম্পাসের ভিতরে, একদম হাসপাতাল বিল্ডিঙ্গের দরজার সামনে নিয়ে যেতে বলেন। জামাল তাই করে্ন। কিন্তু বেরিয়ে আসার সময় ক্যাম্পাসের ভিতরে যে ভাঙ্গাগড় থানার পুলিশ চৌকি আছে, সেখানকার লোকেরা তাঁকে ধরে। পুলিশেরা জালালকে রিকশা ক্যাম্পাসের ভিতরে আনার জন্য ধমক দেয় আর একজন তাঁর থেকে ফাইন হিসেবে হাজার টাকা চায়। জালালের কাছে টাকা ছিল না। পুলিশেরা জালালকে ভোটার পরিচয় পত্র আনতে বলে। জালালকে সেই পুলিশচৌকিতে রিকশা রেখে ভোটার পরিচয় পত্র নিয়ে আসতে হয়। পুলিশেরা এরপর সেই ভোটার পরিচয় পত্রের একটা কপি জমা রেখে দেয় আর জালালকে ছেড়ে দেয়। জালালকে তার নাগরিকত্ব নিয়ে কোন প্রশ্নই করা হয় নি।
এর অল্পদিন পরেই জালাল গৌহাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান কাজের জন্য। একদিন তিনি কামরূপের ২ নং বিদেশি ট্রাইব্যুনালের থেকে নোটিস পা্ন যে তাঁকে ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজিরা দিয়ে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। হাজির না হলে, কোর্ট তাকে বাদ দিয়েই এক তরফা মামলা চালিয়ে যাবে। এর মানে হল, ট্রাইব্যুনাল তাঁর কথা না শুনেই তাকে বিদেশি বলে ধরে নেবে । জালালের কোন উপায় ছিল না। তিনি নির্দিষ্ট দিনে কোর্টে হাজির হন, নিজের পক্ষে একজন উকিলকেও নিয়োগ করে্ন। উকিলকে মোটে চার হাজার টাকা দিতে পারেন তিনি। তাঁর আর কোন টাকা ছিল না। জালালের উকিল তার তরফে ট্রাইব্যুনালের কাছে একটি লিখিত আবেদন জমা দেন এবং বারে বারে কোর্টের কাছে বিভিন্ন কারণে সাময়িক মুলতুবি ( অ্যাডজর্নমেন্ট) চান। জালাল কিছুই জানতেন না। তিনি নিরক্ষর। প্রত্যেক নির্দিষ্ট দিনে তিনি খালি দেখ্তেন তাঁর উকিলবাবু এজলাসে যাচ্ছেন আর বেরিয়ে আসছেন আর জালালকে পরের হাজিরার দিন বলছেন। এই রকম প্রতিটি দিনে উকিলবাবু জালালের থেকে আরও টাকা চান। জালালের আর টাকা নেই ,তাই তিনি টাকা দিতেও পারেন না। এই রকম চলতে চলতে উকিলবাবু অ্যাডজর্নমেন্ট চাওয়াও বন্ধ করেন আর ট্রাইব্যুনাল একতরফা মামলা শেষ করে জালালকে বিদেশি ঘোষণা করে। প্রথমে তো জালাল কী হয়েছে তাই বোঝেন নি,যতক্ষণ না তাঁকে সব কিছু পরিস্কার করে বোঝান হয়। এবার তিনি একটি আসন্ন গ্রেপ্তারির মুখোমুখি। এই সময়, আরও যে হাজার হাজার লোক ট্রাইব্যুনালের সামনে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য হাজিরা দিচ্ছেন, তাঁদেরই একজন জালালকে একজন উকিলের কথা বলেন। ইনি এই রকম সব “বিদেশি”দের হয়ে পয়সাকড়ি ছাড়াই লড়ছেন। এই উকিল হলেন দেবস্মিতা ঘোষ।
জালাল দেবস্মিতার কাছে যান। আমাকে তাঁর মামলাটি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর কেসের রেকর্ডের সার্টিফায়েড কপি বের করার পরে, আমি অবাক হয়ে দেখি যে দুই মাসের মধ্যে জালালের বিরুদ্ধে দুটি অনুসন্ধান করা হয়েছিল। আশ্চর্যজনক হল এই যে উভয় ক্ষেত্রেই তদন্তকর্তা একই মানুষ আর দুটো তদন্তেরই লক্ষ্য জালালের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান । কিন্তু দুটি তদন্তের মূল গল্প আলাদা, যদিও দুটিতেই জালালের দশটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে। আমি যখন জালালকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন যে পুলিশ কখনোই তাঁর আঙুলের ছাপ নেয় নি এবং তাঁর নাগরিকত্ব সম্পর্কিত কাগজপত্রও কখনই চায় নি! তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে কোন জিজ্ঞাসাবাদও কখনোই করেনি। আর এই রিপোর্টে যাঁরা তাঁর সম্পর্কে এত কিছু বলেছেন, তাঁদেরও তিনি চেনেন না।
আমি খুব শিগগিরই বুঝলাম যে এটা একটা পুরো জাল মামলা। আমি জালালের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে দশ লাখ টাকা দাবি করে এবং তদন্ত কর্মকর্তা্র বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চেয়ে একটি উচ্চাভিলাষী পিটিশন হাইকোর্টের কাছে দাখিল করলাম। আমি জালালের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের একতরফা আদেশ (ex-parte order ) বাতিল করার জন্যও অনুরোধ করেছিলাম। দেবস্মিতা মামলাটি লড়েন এবং হাইকোর্ট শুধু একতরফা আদেশ (ex-parte order) বাতিল করে জালালকে তার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। ব্যস এই টুকুই। হাইকোর্টই যখন জাল তদন্ত নিয়ে উদ্বিগ্ন নন, তখন অবশ্যই ট্রাইব্যুনালও তা হবেন না।
এটা এমনই একটা ঘটনা যেখানে একই থানায় একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুটি ভিন্ন অনুসন্ধান করা হয়েছে। অন্য অনেক মামলা আছে যেখানে আলাদা আলাদা থানায়, অন্য থানার তদন্তের কথা না জেনে, একই লোকের নামে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। এখানে এটা সম্ভব হয়েছে কারণ তদন্তটি সত্যিই ঘটে নি। যদি সত্যিই জিজ্ঞাসাবাদ করা হত, তাহলে যাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত, তিনি অন্তত তাঁর বিরুদ্ধে অন্য তদন্তের কথা তদন্তকর্তাকে জানাতেন।
বর্তমানে, আইএমডিটি অ্যাক্টটি অসাংবিধানিক ঘোষণার পর ( ব্যক্তির বেআইনি বসবাস প্রমাণের দায়টি রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া এবং তারপর রাজ্যগুলি নাকি সে বাবদে সন্দেহভাজনদের প্রতি বড়ই শিথিল সেই অজুহাতে ) সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে তদন্তের পদ্ধতির বিষয়ে একটি ধোঁয়াশা রয়েছে। তবুও আসাম সীমান্ত পুলিশ বিভাগ সন্দেহভাজনদের সম্পর্কে প্রায়শই তাদের না জানিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তদন্তের কথা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জানালেও, নিজের কাগজপত্রগুলি তদন্তকারীদের কাছে দেখানো অর্থহীন। তদন্তগুলি শুরুই হয় একটি রেফারেন্স তৈরির উদ্দেশ্যে এবং সেই তদন্তে আদতে কোন অনুসন্ধান হয় না।
রেফারেন্স
একবার যখন একটি রেফারেন্স তৈরি করা হয়, ট্রাইব্যুনাল তখন যে ব্যক্তির নামে সেটি তৈরি হল, তাকে একটি নোটিস পাঠায়। এখন কিছু ট্রাইব্যুনাল (যেমন মরিগাঁ জেলার ট্রাইব্যুনালটি ) নিয়ম তৈরি করে নিয়েছে যে রেফারেন্স সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সকল সদস্যদেরও বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করার হবে। এখন, বিদেশিদের ট্রাইব্যুনাল ১৯৬৪ সালের বিদেশি আইন (Foreigners’ Order 1964) মেনে চলে। এই অর্ডারটি ট্রাইব্যুনাল কীভাবে কাজ করবে সেটা বলে দেয়। অর্ডারটি ট্রাইব্যুনালের কাজকর্মের ধারা নিয়ে শুধু কিছু সীমিত ক্ষেত্রেই বিধান দেয় – বাকি সব ক্ষেত্রেই এটি ট্রাইবুনালকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাগরিকত্ব নিয়ে একটা সুষ্ঠু মতামতে পৌঁছানর জন্য নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবনের স্বাধীনতা দেয়।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে এই ব্যবস্থাটা ভয়ানক। ট্রাইব্যুনালগুলি সিভিল কোর্টের মতো সিস্টেম স্থাপন করেনি আর যে ট্রাইব্যুনালের পদ্ধতিগত দিকগুলি এখনো পুরোপুরি শক্তপোক্তভাবে খাড়া হয় নি – তার উপরেই কিনা নাগরিকত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ! এমনকি ট্রাইব্যুনালের কিছু কিছু লিখিত পদ্ধতিও তীব্র অবাস্তবতার কারণে অনুসরণ করা হয় না।
এখন নোটিস জারি করার বিষয়ে বলতে হলে, এ বাবদে আইনটি স্পষ্ট যে, যেহেতু ট্রাইব্যুনাল কেবল যার নামে রেফারেন্স তারই নাগরিকত্ব নিয়ে মতামত দিতে পারে, তাই শুধুমাত্র যে ব্যক্তির নামে রেফারেন্স তৈরি করা হয়েছে তার বিরুদ্ধেই নোটিস দেওয়া যাবে। সেই যুক্তিতে এক ব্যক্তির নামে রেফারেন্স তৈরি হলে, তার পুরো পরিবারকে নোটিস দেওয়ার প্রথাটিই অবৈধ। তার উপর একই পরিবারভুক্ত হলেও পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে অন্য সদস্যের নাগরিকত্বের ভিত্তি আলাদা হতেই পারে। ধরুন, পাঁচজনের একটি পরিবারে, বাবা ১৯৬৬ সালে ভারতে চলে আসেন এবং ১৯৭০ সালে বিয়ে করেন। তাদের তিনটি সন্তানদের মধ্যে, প্রথম সন্তানটি ১৯৭৪ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৮২ সালে এবং তৃতীয়টি ১৯৮৯ সালে জন্মায়। এই ক্ষেত্রে, পিতার নাগরিকত্ব নির্ধারণ হবে নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৬ এ অনুযায়ী (Section 6A of the Citizenship Act) , মায়ের নাগরিকত্ব তার নিজের বাবার / মা এর নাগরিকত্ব / আবাসিক অবস্থার উপর নির্ভর করবে এবং সে হয় জন্মসুত্রে নাগরিক হবে বা তার নাগরিকত্ব নির্ভর করবে নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৬এ অন্তর্ভুক্ত আসাম অ্যাকর্ডের নিয়মগুলোর উপর । নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৩(১) অনুসারে প্রথম দুই সন্তানের নাগরিকত্ব নির্ধারিত হবে আর তৃতীয় সন্তানের নাগরিকত্ব ধারা ৩(২) (Section 3(2) of the Citizenship Act ) এর উপর নির্ভর করবে। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত তাঁর পরিবারের বাকি সকলের নাগরিকত্বের বিষয়ে মতামত তৈরির জন্য যথেষ্ট নয় এবং এর ফলে প্রতিটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা তদন্ত প্রয়োজন। শুধুমাত্র, এই ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক তদন্তের ভিত্তিতেই একটি ব্যক্তির নাগরিকত্ব সম্পর্কে মতামত দেওয়া হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী একটি রেফারেন্স তৈরি করা যেতে পারে। এবং এই ধরনের একটি রেফারেন্সের ভিত্তিতে, একটি ট্রাইব্যুনাল শুধুমাত্র সেই রেফারেন্সের সঙ্গে জড়িত বিশেষ ব্যক্তির নাগরিকত্বের উপর একটি মতামত দিতে পারে।
নোটিস
একবার নোটিস জারি করা হলে, সন্দেহভাজন মানুষটি (এখানে proceedee হিসাবে উল্লেখ করা হল) ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হতে বাধ্য হয় নাহলে তার তরফের যুক্তি না শুনেই তাকে বিদেশি ঘোষণা করা হবে। কোনরকম শুনানি ছাড়া যে আদেশ পাস হয় তাকে বলে একতরফা আদেশ ( ex-parte order ) । এখন ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হওয়ার জন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আইনজীবী নিয়োগ করতে হয়। ১৯৬৪ সালের বিদেশি আইন (Foreigners’ Order, 1964) যে আইনজীবি ছাড়াই একজনকে ব্যক্তিগতভাবে হাজিরা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে – এই কথাটা এখানে তোলা একরকম নির্বোধের যুক্তি। ট্রাইব্যুনালের যাঁরা মাথা, তাঁরা সবাই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা । সন্দেহভাজন মানুষটির (proceedee ) উত্তরটি একটি লিখিত বিবৃতি হিসেবে চাওয়া হয়। তার সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রথমত একটি হলফনামার আকারে নেওয়া হয় এবং তাঁকে সরকারী আইনজীবীর জেরার মুখোমুখি হতে হয়। ট্রাইব্যুনালের সদস্যরাও তাঁকে ভারতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ আইন, ১৮৭২ এর ১৬৫ ধারা (Section 165 of the Indian Evidence Act, 1872) অনুসারে যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন। কোনও অশিক্ষিত দুর্বল মানুষের পক্ষে উকিলের সাহায্য ছাড়াই এগুলোর মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়।
কাজেই আইনজীবীর সাহায্য নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। খুব সামান্য কয়েকজন আইনজীবী আছেন যাঁরা বিদেশিদের আইনের সব ক'টি দিক ভালভাবে জানেন। এমনকি গুয়াহাটিতেই, আমি নিয়মিতভাবে এমন সব আইনজীবীর সংস্পর্শে আসি, যারা নাগরিকত্বের মূল আইন আসলে কী বলে, তাই জানেন না। আমি অনেক ত্রুটিপূর্ণ আদালতের রায়ও দেখেছি। ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ তারিখের অনেক পরে জন্মেছেন এমনকি যারা ভারতেই জন্মেছেন, এমন সব লোকজনকেও ট্রাইব্যুনাল ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যায়ের বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে শুধুমাত্র তাঁদের বাবা-মা রা ওই সময়ের মধ্যে অন্য দেশ থেকে এখানে এসেছেন বলে। { নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-এর ৬এ (৩) Section 6A(3) of the Citizenship Act, 1955 } এমনকি এমন কিছু “বিদেশি” কে আমি বিদেশিদের আঞ্চলিক নিবন্ধন অফিসের কাছে নিবন্ধভুক্ত হতে সাহায্য করেছি।
একজন আইনজীবীর পেশাগত পারিশ্রমিক সম্পর্কে বলতে হলে, একজন ভাল আইনজীবী যে সস্তা হবেন না সেটা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু বিদেশিদের ট্রাইব্যুনালের মামলায় জড়ানো সাধারণ মানুষগুলির জন্য, কোন আইনজীবীই সুলভ নন। এও দেখেছি যে কিছু আইনজীবী অন্য অর্থনৈতিক স্তরের মক্কেলদের থেকে যে পারিশ্রমিক দাবী করেন, তার তুলনায় এই মানুষগুলির থেকে বেশি পারিশ্রমিক দাবি করছেন। এর কারণ শুধু এই যে এই আইনজীবীরা অন্যথায় পেশাগতভাবে খুব প্রতিষ্ঠিত নন এবং খুব গোদা ভাবে বললে, অসহায় পেয়ে এঁদের শোষণ করে দুটো পয়সা উপার্জনের সুযোগ হাতছাড়া করেন না। প্রায়ই, এঁদের মক্কেলরা তাঁদের অপরিহার্য জিনিসপত্র বিক্রি করে আইনজীবীদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন। নিজের জমি বিক্রি করে আইনজীবীর পয়সা মেটাচ্ছে এমন মানুষও আমি দেখেছি। সাধারণতঃ এই মক্কেলরা নিজেদের মামলাগুলি মেটানর জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন – এ তো যে-সে মামলা নয়, খোদ নাগরিকত্বের প্রশ্ন। এর প্রভাব খুবই ভয়াবহ, বিশেষতঃ এখানে ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীন অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আইনজীবীদের টাকা মেটাতে না পারায় আত্মহত্যা করেছেন এমন মানুষের কথাও পড়েছি। ধুবড়ি জেলার অবলা রায় এমনই একজন মানুষ। ইনি একজন কোচ- রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ, দিনমজুরী করে সংসার চালাতেন। এঁর স্ত্রী ডি-ভোটার হিসেবে চিহ্নিত হন আর ট্রাইব্যুনালের কাছে নিজের নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য ডাক পান। স্ত্রীর পক্ষে দাঁড়ানর জন্য কোনো আইনজীবীর খরচ বহনের সামর্থ্য অবলার ছিল না – তাই তিনি আত্মহত্যা করেন। তারপর আছেন গোপাল দাস, উদালগুড়ি জেলার একজন কৃষক, যিনি নিজের ডি- ভোটার তকমা ঝেড়ে ফেলতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। {মিত্র এন। (জুলাই ১০, ২০১৮); “No money to prove his wife’s citizenship, Assam man kills self”; The Times of India }.
এ বাবদে আরেকটা বড় খরচ হল নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিপত্র জোগাড়ের খরচ। কিভাবে একজনের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা যায়? নিজের পূর্বপুরুষদের অস্তিত্ব এই রাজ্যে প্রমাণ করা গেলে হয়। এবার কিভাবে এই অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়? ভোটার তালিকায় পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণের মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে। কোথায় এক দশকের পুরানো ভোটার তালিকা পাওয়া যায়? এই ধরনের ভোটার তালিকা পাওয়াই যায় কিন্তু ১৮৭২ সালের ভারতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনের (Indian Evidence Act, 1872) সরকারী নথি সম্পর্কিত বিধানগুলির অনুসারে নথির যাথার্থ্য প্রমাণের জন্য, এই ভোটার তালিকাগুলির প্রত্যয়িত অনুলিপিগুলি ( certified copy) জমা দিতে হবে। নির্বাচনী নথির প্রত্যয়িত অনুলিপি সংগ্রহ করার জন্য, আবার একজন আইনজীবী লাগবে, যিনি নিজের জন্য এবং নির্বাচন অফিসের কর্মচারীদের জন্য পারিশ্রমিক নেবেন । অনেক ট্রাইব্যুনাল ব্যক্তির নাগরিকত্বের দাবী সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য বিভিন্ন ভোটার তালিকার প্রায় সাত থেকে আটটি প্রত্যয়িত অনুলিপি চান এবং প্রতিটির খরচ, গড়ে, ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। সুতরাং প্রায় ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকার ধাক্কা।
ট্রাইব্যুনালের আরেকটি খরচ হল সরকারী দপ্তরে ফাইল চলাচল জনিত খরচ। আমাদের কোর্ট এবং ট্রাইব্যুনালের কিছু কর্মীর সঙ্গে কাজ করাটা একটা ব্যথার জায়গা। কোন মামলার নথির প্রত্যয়িত অনুলিপি চাইলে, আপনাকে একটা মোটা টাকা খরচ করতে হবে। আমি একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জানি, যারা প্রত্যেক মামলায় জড়ান ব্যক্তিকে (proceedee) প্রথম হাজিরাতেই একটি জামিন নিতে বলে। এবার সেই ট্রাইব্যুনালে জামিননামা নিষ্পন্ন করানোই এক ব্যয়সাধ্য কাজ।
ট্রাইব্যুনালে মামলা সাময়িকভাবে মুলতুবি রাখার আবেদন খুব সাধারণ ঘটনা। কখনও আইনজীবী তাদের পারিশ্রমিক পান নি, কখনও অভিযুক্ত ব্যক্তি সব নথি জোগাড় করে উঠতে পারে নি আবার কখনও অভিযুক্ত তাঁর মামলা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন নন। কিছু ট্রাইব্যুনালে এই ধরনের মুলতুবির আবেদনের জন্য শত শত টাকা জরিমানা (বা খরচ) প্রয়োগ করা শুরু করা হয়েছে এবং যাকে নিয়ে মামলা তিনি (proceedee) এই ধরনের খরচ দিতে বাধ্য।
ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজিরা দিতে গিয়ে মামলায়-জড়ান মানুষটি (proceedee) যে উপার্জনের সুযোগ হারায় সেকথাও মাথায় রাখা দরকার। এই সব মানুষেরা প্রায়ই ছোটখাটো কাজ করেন এবং ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে গিয়ে দিনের মজুরিটি পান না, এর উপর আছে যাতায়াতের খরচ। তার উপর, ট্রাইব্যুনালের মামলায়-জড়ান মানুষটি যে সব সাক্ষীদের আনেন তাঁদের খরচ আছে। এই সব সাক্ষীরা আসেন বিভিন্ন জেলা থেকে ( সাধারণতঃ তাঁদের দেশের গ্রাম থেকে ) আর তাঁদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচও মামলায়-জড়িয়ে-পড়া মানুষটিকে দিতে হয়।
অতএব বিদেশি ট্রাইব্যুনালে মামলার খরচ, কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই, প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে দশ হাজারের গুণিতক আর বেশির ভাগ সময়ই তার অনেক বেশি। আর যেসব মামলা হাইকোর্ট অবধি নিয়ে যেতে হয়, তার জন্য কমপক্ষে লাগে এরকম অনেক অনেক দশ হাজার।
মামলা (Proceeding)
এবার আসুন একটু ট্রাইব্যুনালের আসল কাজকর্ম দেখা যাক। আমাদের সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট এবং তাদের আধিকারিকরা যতই সংবিধানের আদর্শকে সবার উপরে জায়গা দিন না কেন, বিদেশী ট্রাইব্যুনালগুলি প্রায়শই সাম্প্রদায়িকতার সীমানা ঘেঁষে কাজ চালায়। মামলায় জড়ান মানুষদের বেশির ভাগই হিন্দু বাঙালি এবং মুসলিম বাঙালি - অবশিষ্টরা হলেন কোচ রাজবংশী, গারো, হাজং ও আসামি মুসলমান। এঁদের জিজ্ঞাসা করা হয় প্রপিতামহ এবং প্রপিতামহী কে ছিলেন, কোথায় থাকতেন, তাঁদের ক'টি সন্তান এবং অনেকক্ষেত্রে জানতে চাওয়া হয় এই সন্তানদের প্রত্যেকের কখন জন্ম হয়। তারপর আসে ঠাকুরদা, ঠাকুমার প্রসঙ্গ এবং একই ধরণের প্রশ্ন করা হয় , এমনকি ঠাকুরদার ভাই বোনের নামও জানতে চাওয়া হয়। তারপর পিতামহের সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় এবং মাঝে মাঝে তাঁদের বাবা-মায়ের জন্মের বছরও জানতে চাওয়া হয়। তারপর জিজ্ঞাসা করা হয় কখন তাঁর বাবা-মার বিয়ে হয় এবং কখন তাঁর প্রতিটি ভাই-বোন জন্মগ্রহণ করেন। এটাও আশা করা হয় যে মানুষটি সঠিকভাবে জানবেন যে তাঁর পূর্বপুরুষরা কে কোথায় থাকতেন এবং কখন কোথা থেকে সেখানে এসেছিলেন । এবং তাঁর দেওয়া এই সব তথ্য সাক্ষীদের জবাবের সঙ্গে মেলা চাই এবং এ বাবদে কোন অমিল হলে তার পরিণতি ভয়াবহ।
মামলায়-জড়ান মানুষটি আর সাক্ষীরা বেশির ভাগ সময়ই অশিক্ষিত এবং অজ্ঞান - এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাঁদের পক্ষে একটা প্রায় অসম্ভব কাজ। ফলে তাঁরা অনভিপ্রেত ভুল করেন এবং সেই ভুল তাঁদের ভাগ্য নির্ধারণ করে।
এবং শুধু যে মুখের কথা সংগতিপুর্ণ হলেই হবে তা নয়, সেই কথার সঙ্গে ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া সব নথিপত্র মিলতে হবে। একটা খুব সাধারণ গরমিলের জায়গা হল ভোটার তালিকায় থাকা বয়স। খুব কম সময়েই, ভোটার তালিকার বয়স একজন ভোটারের সত্যিকারের বয়স হয়। ভোটার তালিকার বয়স এতটাই ভুলভাল হয় যে অনেক সময় ভোটারের বয়স তার বাবা-মার বয়সের থেকে বেশি বলে দেখায়। তারপরে বিভিন্ন নথির মধ্যে সামান্য নামের হেরফেরের সমস্যা আছেই। এটা মুসলমানদের মধ্যে খুব সাধারণ – অনেকেরই বিভিন্ন নথিতে আলাদা আলাদা পদবী থাকে। এইসব গরমিল প্রায়শই একজন সত্যিকারের নাগরিককে বিদেশি হিসেবে ঘোষণা করার কারণ।
আটক-দশা (Detention)
এবার দেখা যাক যে যাঁকে বিদেশি ঘোষণা করা হল, তাঁর কপালে কী হল। তাঁকে আটক-শিবিরে রাখা হবে। আসামে কোন আটক-শিবির নেই। কিন্তু রাজ্যের জেলগুলির অংশবিশেষ আটক-শিবির হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং বিদেশীদের এখানে রাখা হয়। এবং তাঁরা এখানেই থাকেন কারণ ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে কোন বিতাড়ন চুক্তি নেই। এই সব শিবিরে বহু মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় এবং এই শিবিরগুলির ভিতরে কি চলে সে সম্বন্ধে বাইরের মানুষ খুব কম জানেন। হর্ষ ম্যান্ডারের একটি সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে লেখা একটি নিবন্ধ আটক-শিবিরের ভিতরের পরিস্থিতি নিয়ে লেখা প্রথম লিখিত বিবরণী। (https://scroll.in/article/883936/assam-citizens-register-detention-centres-for-foreigners-offer-a-glimpse-of-the-looming-tragedy)
আটক শিবিরের পরিস্থিতি বিষয়ে বুঝতে হর্ষ মন্দার, ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের সংখ্যালঘুদের এক বিশেষ নিরীক্ষক, দুটি আটক-শিবির পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার মানুষদের অবস্থা নিয়ে একটি মর্মভেদী নিবন্ধ লেখেন। তাঁর ভাষায়, আটক-শিবিরগুলি বৈধতা এবং মানবিকতা দুদিক দিয়েই অন্ধকার সীমায় অবস্থিত। উনি লক্ষ্য করেছেন এই সব বিদেশি বলে চিহ্নিত মানুষগুলির বেশির ভাগই শুনানি-বিহীন একতরফা আদেশের (ex-parte order) বলে বন্দী হয়েছেন। যারা নোটিস পেয়েছেন আর ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আইনজীবীদের নিয়োগ করার জন্য নিজের যেটুকু সামান্য সম্পত্তি ছিল তা বিক্রি করে দিয়েছেন , এমনকি অনেক ধারও করেছেন। এই আইনজীবীরা ঠিকঠাক যোগ্য ছিলেন না বা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ক্ষতি করেছেন। যারা এক-তরফা আদেশের (ex-parte order) বলে বন্দী আছেন, তাঁদের সম্বন্ধে তিনি বলেন যে “একটি মানবিক গণতন্ত্র হিসেবে, আমরা ধর্ষণ বা খুনের মত জঘন্য মামলায় অভিযুক্তদেরও আইনগত সাহায্য দিই, অথচ এক্ষেত্রে কোন অপরাধ না করেই মানুষগুলো আটক-শিবিরে পচছে কারণ আইনি পরিষেবার খরচ তাদের সামর্থ্যে কুলায় না। ”
মন্দার বলছেন, এই আটক-হওয়া মানুষদের অবস্থা বন্দীদের থেকেও খারাপ। তিনি ক্যাম্পের একটি দুঃখজনক বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে দেখিয়েছেন যে এঁরা অন্যান্য "নাগরিক বন্দীদের" তুলনায় কেমন অনেক বেশি বিধি নিষেধের মধ্যে থাকেন। কোকড়াঝাড় কারাগারের নারী বন্দীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, এই মহিলাদের প্রায় এক দশকের মধ্যে একটি মোটামুটি ৫০০ বর্গ মিটারের ঢাকা জায়গার বাইরে বেরোতে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এই আটক-হওয়া মানুষদের অধিকার সম্পর্কে কেন্দ্র বা রাজ্যের থেকে কোন নির্দেশিকা বা নির্দেশ নেই। আসাম জেল ম্যানুয়ালের দ্বারা এই আটককেন্দ্রগুলি পরিচালনা করা হয়। রাজ্য আটক-কেন্দ্র ও কারাগারের মধ্যে বস্তুতঃ কোন তফাত করে না , এবং জেল কর্তৃপক্ষ আটক-হওয়া-মানুষ আর কোন অপরাধের-দায়ে-অভিযুক্ত বা দোষী-প্রমাণিত-হওয়া কারাবন্দীদের মধ্যে বেছে বেছে আসাম জেল ম্যানুয়ালের বিধিগুলোর প্রয়োগ করেন। জেল-নিয়মের আওতায় থাকা বন্দীরা প্যারোল বা কাজ-করে-মাইনে পাওয়ার মত যে সব সুবিধাগুলি পান, সেগুলোর থেকে এই আটক-হওয়া মানুষেরা বঞ্চিত।
পুরুষ, নারী ও ছয় বছরের উপরের ছেলেদের তাদের পরিবার থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটি বলে যে কীভাবে এই নির্বিচারে, অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাবন্দীদের মত অবস্থায় আটক করে রাখা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। প্রতিবেদনটি আরও জানায় যে আসন্ন NRC র ( যা কিনা সম্ভবতঃ লাখ লাখ মানুষকে রাজ্যহারা করবে) প্রেক্ষিতে কিভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার, বিশেষতঃ সব থেকে পবিত্র সংবিধানের আর্টিকল ২১ দ্বারা সুনিশ্চিত করা যে অধিকার, বিপন্ন। এই সব রাজ্যহারা মানুষদের নিয়ে কী করা হবে, সে বাবদে ভারতের কোন নীতি নেই।
সুতরাং, আটক শিবির সম্পর্কে সত্যিগুলো বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রিপোর্টে অনেককিছু আছে এবং পরিস্থিতির গভীরতা বোঝার জন্য, আমি আন্তরিকভাবে চাই যে সবাই এই নিবন্ধ এবং পূর্ণ রিপোর্টটি পড়ুন, অবশ্য রিপোর্টটি যদি আদৌ প্রকাশিত হয়।
একতরফা আদেশের (ex-parte order) বলে বা অন্য কোন ভাবে আটকই হোক, এই আটকা-পড়া মানুষদের সামনে একমাত্র আইনি প্রতিকারের যে রাস্তাটি খোলা, সেটা হল হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা। আগেও যেটা বলা হয়েছে, হাইকোর্টে মামলা চালানোর খরচ সাধারণতঃ দশ হাজারেরও বেশি গুণিতক এবং মাঝে মাঝে সেটা লাখেও গিয়ে ঠেকে। কাজেই যতই দৃঢ় আইনী যুক্তি থাকুক বা ট্রাইব্যুনালের রায় যতই ভুলে ভরা হোক, বহু মানুষ সামর্থ্যের অভাবে হাইকোর্ট অবধি পৌঁছানর সুযোগ পাবেন না। এই ধরনের মানুষ, সকল সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখলে, হয়তো সত্যিকারের নাগরিক –কিন্তু তাদের সেটা প্রমাণ করার সুযোগ নেই।
দিলীপ বিশ্বাস
এবারে, দিলীপ বিশ্বাস, তার স্ত্রী ও দুই নাবালিকা কন্যার মামলা সম্পর্কে বলি। দিলীপ বিশ্বাস মাওং গ্রামে একটি কুঁড়েঘরে একটা ছোট চা, বিস্কুট আর পুরী সব্জির দোকান চালান। তার গ্রামের মোড়ল প্রায়ই তার দোকানে আসেন আর বিনা পয়সায় খেতে চান। একদিন, দিলীপ বিশ্বাস বিরক্ত হয়ে মোড়লকে বিনামূল্যে খাবার দিতে অস্বীকার করে্ন এবং দুজনের মধ্যে একটি ঝগড়া হয়। এর প্রতিশোধ নিতে, মোড়ল স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সীমান্ত বিভাগের একজন ইন্সপেক্টরের সাথে ঘোঁট বাঁধেন এবং ফলতঃ একটি জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ বেরোয়। দিলীপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তদন্তের একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয় এবং সেটি জমা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দিলীপের বিরুদ্ধে মরিগাঁও-বিদেশিদের ট্রাইব্যুনালে একটি রেফারেন্স তৈরি করা হয়। ট্রাইব্যুনাল, শুধু দিলীপ বিশ্বাসের নামে নোটিশ জারি করার পরিবর্তে, তার স্ত্রী ও সন্তানদেরও জড়িয়ে নোটিশ জারি করে। দিলীপ ও তার পরিবার দেরিতে নোটিসটি পেয়েছিলেন – হাজিরা দেওয়ার যে তারিখ উল্লেখ করা ছিল তার ঢের পরে। তাঁরা যখন ট্রাইব্যুনালে যান, ততদিনে তাঁদের বিরুদ্ধে একটি এক-তরফা আদেশ ( ex-parte order ) জারি করা হয়ে গেছে। দিলীপ তখুনি ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং একজন স্থানীয় উকিলকে নিয়োগ করেন। উকিল হাইকোর্টে আবেদন করে ওই এক-তরফা আদেশকে (ex-parte order ) নাকচ করান এবং দিলীপ ও তার পরিবার রেফারেন্সের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দেন। একই আইনজীবী তাঁদের হয়ে মামলা লড়েন এবং হারেন। আমার মতে, রায়টি ভুল ছিল এবং উকিল মামলার যুক্তিগুলি খুব দুর্বলভাবে পেশ করেছিলেন। কিন্তু আইনি পরিষেবার জন্য, উকিল দুই লাখ টাকার উপর পারিশ্রমিক নেন। দিলীপ তার নিজের সমস্ত জমি, এমনকি তাঁর ভাইয়েরও কিছু জমি বিক্রি করে সেই টাকা মেটান। এবং শেষে, তাঁর পুরো পরিবার আটক-শিবিরে যান এবং ২০১১ সাল থেকে সেখানেই তাঁরা রয়েছেন। দিলীপকে গোয়ালপাড়া জেলে রাখা হয়, তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যা কোকড়াঝাড় জেলে রয়েছেন। কোন উপায়ে দিলীপের ভাই ২০১৭ সালে মানবাধিকার ল নেটওয়ার্কের কথা জানতে পারেন এবং তাদের কাছে সব কথা বলেন। ট্রাইব্যুনালের আদেশটি এখন গৌহাটি হাইকোর্টের সামনে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে কিন্তু আটক ব্যক্তিদের এখনও জেলে থাকতে হচ্ছে। প্রথম দিন জামিন দেওয়া হয় নি এবং মামলাটি আবার তালিকায় ওঠে নি এখনো।
তাহলে?
একজন আমাকে বলেছেন যে আসামে বিদেশীদের সম্বন্ধে অহেতুক ভয় ( xenophobia) বহুল প্রচলিত। হতেও পারে, নাও হতে পারে। তবে এখানে যে একটা বিশেষ দেশ বা বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি চাপা বিদ্বেষ আছে সেটা সত্যি। তার তলায় আছে একটা অমঙ্গলের সংকেত। কেউ কেউ হয়তো এর কারণও বোঝেন, তবু মোদ্দা কথাটা হল হাজার হাজার নির্দোষ মানুষ ভুগছেন। তাঁদের বেদনা কমাবার কোন ক্ষতিপুরক উপায় আমাদের হাতে নেই। সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে কোন কথা না বললেও, শুধুমাত্র এই সংক্রান্ত যে আইনগত প্রক্রিয়া সেটাই প্রশ্নের মুখে। ট্রাইব্যুনালের কাজের ধারা আর এর সদস্যদের মতামত একের সঙ্গে অন্যের মেলে না। সিভিল কোর্ট এবং হাইকোর্টের বিপরীতে, ট্রাইব্যুনালের কাজের ধারা এখনো তত প্রতিষ্ঠিত নয় এবং তুলনায় অর্বাচীন। এবার আমাদের সিস্টেমের মধ্যের গরমিলের জন্য কে ক্ষতিপূরণ দেবে? বিদেশিদের ট্রাইব্যুনালে নাগরিক হিসাবে নির্ধারিত ব্যক্তির মাসের পর মাস মামলা চালানোর খরচ এবং যে মানসিক যন্ত্রণা, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? একজন অভিবাসী শ্রমিক যাকে তার কেরালায় চাকরি ছাড়তে হল এবং কোন চাকরী ছাড়াই বহু মাস আসামে থেকে যেতে হল শুধু বিদেশী ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে চলা মামলার শেষ দেখার জন্য, তাকেই বা কে ক্ষতিপূরণ দেবে? এই সমস্ত সমস্যাগুলির একটি চূড়ান্ত সমাধান হয়তো নাও থাকতে পারে এবং কেউ কেউ এও বলতে পারেন যে বিদেশী সনাক্তকরণ এই মুহূর্তে নিতান্ত প্রয়োজন – তবু আমাদের রাজ্য নিদেনপক্ষে মানুষের জন্য কিছুটা উদ্বিগ্ন হতে পারে।
ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে সকল ব্যক্তির জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই মৌলিক অধিকার থেকে জন্ম নিয়েছে একগুচ্ছ মানবাধিকার যার মধ্যে পড়ে মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহারের অধিকার, একটি ন্যায্য তদন্তের অধিকার এবং আইনি প্রতিনিধিত্বের অধিকার। মনে হচ্ছে এই অধিকারগুলি ঘোরতর বিপদের মুখে এবং লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বিচারকরা কেন গরীব, অশিক্ষিত লোকদের এত খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখছেন? এটা তো সত্যি যে, ভোটার তালিকাতে প্রচুর ভুল রয়েছে। ভোটার তালিকার বয়সের তথ্যের ভুল খুবই সাধারণ আর সেই ভুলটা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার জন্যেই সত্যি। ভোটার তালিকা তো কখনোই বয়সের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয় না। একটা আপাত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ভুল যদি হয়ও তাহলেও সেটা নির্দোষ গরীব মানুষের জীবনটা ঘেঁটে দেওয়ার দিকে হোক, ভুল করেও যেন মানবিক সাবধানতা দেখান না হয়ে যায়।
হাইকোর্টের একটি সাম্প্রতিক আদেশ বলেছে যে রেস জুডিকাটার বিধান (principle of res judicata) বিদেশী ট্রাইব্যুনালের কাজকর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এটি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছে। এর মানে কেন্দ্রীয় সরকার একটি ট্রাইব্যুনালের মতামতে সন্তুষ্ট না হলে , একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আরেকটি রেফারেন্স আনতেই পারবে। এমনকি কর্তৃপক্ষ কেন আগের ট্রাইব্যুনালের আদেশ মানছেন না যে বিষয়ে কোন কারণ দেখানর নির্দেশও আদেশটিতে দেওয়া নেই। অথচ নিজের বক্তব্যের বিপরীতে গিয়ে এই আদেশে এও বলা আছে যে যদি একবার একজন বিদেশী বলে নির্ধারিত হন, তাহলে তাকে আবার রেফার করার কোন প্রয়োজন নেই। তার মানে ট্রাইব্যুন্যালের রায় যদি যাকে রেফার করা হল, তার পক্ষে যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আবার রেফারেন্স তৈরি করা যাবে, যা কিনা রেস জুডিকাটার নিয়মের এবং প্রচলিত রিট আবেদনের বিরোধী। কিন্তু যদি একবার কাউকে বিদেশী ঘোষণা করা হয়, তাহলে তার হাতে শুধু মাত্র হাইকোর্টে রিট আবেদন করার রাস্তাই খোলা থাকে।
আমি অনেক সময়ই ভয় পাই বা রেগে বা হতাশ হয়ে থাকি। আমার মাও। মা বলেন যে তিনি এখানেই জন্মেছেন এবং সারা জীবন একটি ট্রাইব্যুনালে ( মোটর অ্যাক্সিডেন্ট ক্লেম ট্রাইব্যুনাল ) কাজ করেছেন। উনি খুবই জোর দিয়ে বলেন যে উনি ওঁর অফিসের সবচেয়ে পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। আমি বড় হওয়ার সময় মাকে রোজ অফিসের কাজ বাড়ি নিয়ে আসতে দেখেছি – তাই আমি ওঁর কথায় বিশ্বাস করি। মা খুব কম অফিস কামাই করতেন, বলতেন ওঁকে ছাড়া অফিস চলবে না আর মানুষের ভোগান্তি হবে। আজকে আমি আশা করছি যে উনি কোন বিদেশী ট্রাইব্যুনালের থেকে হাজিরা দেওয়ার এবং নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিস পাবেন না। আমি আশাবাদী যে মা নোটিস পাবেন না কারণ আমরা তো সত্যি সত্যি গরীব নই। আমি সত্যি বলছি, আমরা অসহায় এবং ভীত এবং সেটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
অহোম সাহিত্য সভা সম্প্রতি মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানিয়েছে যে যারাই এই রাজ্যে বসবাস করবেন তাদের অহমিয়া জানা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। ভাল। আমার ব্যাঙ্গালোরের বন্ধুরা নালিশ করে যে সেখানকার স্থানীয় লোকেরা তারা কন্নড় বলে না বলে তাদের অপছন্দ করে। আমরা কি তাহলে ইঁটের বদলে পাটকেল ছুঁড়বো?
আমি কাজের জন্য রাজ্যের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। সবসময় আমি আমার পদবী বলতে ভয় পাই। কারণ তারা বিচার করে। যখন মানুষ জানে যে আমার পদবী 'দে', আমি কেমন মনে হয় যে আমি আর এই রাজ্যের মানুষ নই, যদিও আমি সারা পৃথিবীর অন্য কোনও জায়গার সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানি না। এটা অত্যন্ত দুঃখের।
আমি একজনের ভাষার প্রতি ভালোবাসা, তার ভাষা ও ভাষার ইতিহাস বিষয়ে গভীর জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমি এও বিশ্বাস করি যে এই ভালোবাসা বা জ্ঞান, নিজেকে এই গোটা বিশ্বজগতের মধ্যে একটি বিশেষ অঞ্চলের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছের থেকে আলাদা। পরেরটা আমার কাছে মানসিক সংকীর্ণতা। মানবতার স্বার্থে, সবাইকেই এই দুটি আলাদাভাবে শনাক্ত করতে শিখতে হবে। জর্জ কার্লিনের কথায়, "অহঙ্কার এমন কিছুর জন্য তোলা থাকুক যা আপনি আপনার নিজের সাফল্য বা আপনি নিজে অর্জন করেছেন, জন্মের দুর্ঘটনা বাবদ পাওয়া কিছুর জন্য নয় '।
এই অমানুষিকতার সমাধান জানা নেই। তবে যেটা করা যায় সেটা হল মামলা লড়ার জন্য অর্থসংগ্রহ। সবাই যদি যে যার নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী সাহায্য করেন তাহলে হয়ত আইনজীবিরা এই অসহায় মানুষগুলোর হয়ে আদালতে লডতে পারেন। এমন কি করা অসম্ভব?