ডেস্টিনি ও ডেস্টিনেশন শব্দদুটি ব্যুৎপত্তিগতভাবে আত্মীয় হইলেও বাজার অর্থনীতির যুগে তাহাদের সে আত্মীয়তা ঘুচিয়া গিয়াছে। বাজার মানুষের ডেস্টিনি নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারিলেও তাহাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত কোনও ডেস্টিনেশনে পৌঁছিতে পারিবার টোপ গিলিতে বাধ্য করিতে সক্ষম হইয়াছে। স্বভাবে যাযাবর মানুষের যত্রতত্র অবাধ বিচরণে বাজারের লোকসান বৈ লাভ নাই, তাই দেশে দেশে সীমান্তসুরক্ষাবাহিনীর নিশ্ছিদ্র প্রহরা। ভিসাপাসপোর্টপারমিটের কাগুজে বাঘগুলি আছে বলেই না ট্রাভেল এজেন্সিগুলির রমরমা! নয়তো কি আর মানুষে চাইলেই বেরিয়ে পড়তে পারে না যেদিকে দুচোখ যায়!
আমি কদাচিত কোথাও সহজে পৌঁছিয়াছি।
গন্তব্য ঠিক করিতে গেলে প্রাথমিকভাবে যাহা প্রয়োজন, তাহা হইল প্ল্যানিং। যদিচ পরিকল্পিত ভ্রমণের চাইতে কদর্য বস্তু কমই আছে। আগেভাগে ছকিয়া রাখা রাস্তায় মেপে পা ফেলিবার মত পাপ (বা পাপেটিং) করিতে আমার বাধে। নেশন/ডেস্টিনেশন, দুইই স্বরূপে বায়বীয়। প্রচলিত ধারণামাত্র। তথাপি উহাদের পসার মন্দ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তথা যাবতীয় প্রতিষ্ঠান যতকাল টিকিয়া থাকিবে, ততদিন ইহাদেরও বোলবালা থাকিবে সন্দেহ নাই। যাহা জনগণের চোখের মণি, তাহা আমার চক্ষুশূল। আমি এনার্কিস্ট। ধর্মকর্মে মতি নাই। শেক্ষপীর আমার দীক্ষাগুরু, লেডি ম্যাকবেথ বাল্যসখী। আমি অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী। তাই যাহা চোখে দেখি নাই, কিন্তু আছে বলিয়া বিশ্বাস করি, তাহার আকর্ষণে ঘরছাড়া হই বারম্বার। পথের নেশায় পথে নামি, আকছার পথ হারাই, পূর্বকৃত ভুল হইতে শিক্ষা লইতে অপারগ আমি হন্যে হয়ে খুঁজিয়া বেড়াই সোনার হরিণ। হিমালয়ের মায়াবনে তাহার দেখা পাই অবরেসবরে, যদিও তাহাকে ধরিয়া আনিয়া গৃহবন্দী করিবার পণ অকারণ মনে হয়, বরং জলেজঙ্গলে তাহার সন্ধান করা ঢের সুখের। এই অনুসন্ধিৎসা আমাকে গভীরতর আত্মানুসন্ধানে প্রবৃত্ত করে। প্রতিবার আমি নিজের সম্পর্কে নূতন দু’চারকথা জানিয়া ফিরি।
পথও আসলে একধরণের শৃঙখল। যে পথিক, সে পথের তোয়াক্কা করে না। সবটাই পথ, বা কোনওটাই নয়। তুমি কে হে বলিয়া দিবে কোনটা পথ, কোন দিকে যাইতে হইবে, কত দূর গেলে মিলিবে সরাইখানা, কতটা হাঁটিলে পরে জুটিবে বিশ্রাম?
বাজার কিন্তু সবটুকু বলিয়া দিতে চায়, ম্যাপ আঁকিয়া, হিসাব কষিয়া তোমার সুবিধা করিয়া রাখে যাহাতে তুমি প্রশ্ন করিবার সুযোগটুকুও না পাও। এদিকে তুমিও সমস্ত উত্তর হাতের মুঠোয় পাইয়া মহাখুশি। কারণ তুমি নিশ্চিন্ত। তুমি জানো কোথায় মিলিবে দানাপানি, কোথায় রয়েছে সাচ্ছন্দ্যের বন্দোবস্ত। পথের হদিশ তোমার হাতের মুঠোয়, মুঠোফোন জানে তোমার চেকইন চেকাউটের খতিয়ান... তাহলে তুমি কে? বাজার অর্থনীতির অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়া ট্যুরিস্টমাত্র? কেন তুমি মার্কোপোলো হইলেই বা কি? তোমার ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠপূর্বক বাজার নিজে আসিবে উটের মত পাহাড়ের নীচে! শাইলকের বাণিজ্যবিস্তার হইবে, অথবা আলেক্সান্দ্রীয় সাম্রাজ্যবিস্তার। কি লাভ? তারচে’ বরং নিজেকে জানিয়া লও। সূর্যের সহিত, অপরিচিত জলহাওয়ার সহিত সমীকরণগুলি বুঝিয়া লও। অনেক তো বাঁধা পথে হাঁটিলে, ড্রিম ডেস্টিনেশনে পৌঁছিয়া ফিরিয়াও এলে, আপন ভাগ্য জয় করিতে পারিলে কি? সে নাহয় নাই হল, ভাগ্যজয় দিগবিজয় অপেক্ষা কঠিন। নিদেনপক্ষে পথিমধ্যে নিজের মুখোমুখি হইলে কি?
ইহাই ভ্রমণের উদ্দেশ্য, নিজেকে জানা।
যে লোকালয়ে তোমার বাস, গ্রামে বা নগরে, যেখানে তোমার সামাজিক পরিচিতি বিদ্যমান, সেইখানে তুমি পিঞ্জরাবদ্ধ শের। অনিশ্চয়তা বিহীন সেই কৌমজীবনে তুমি আবাল্য অভ্যস্ত। অতএব তোমার হারাইবার ভয় নাই। চিন্তা নাই। এই চিন্তার অভাব তোমার পরিধি নির্ণয় করে, তোমাকে সীমার মাঝে বাঁধিয়া ফেলে, ক্রমে তুমি অসীমকে ভুলিয়া যাও, নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করিতে করিতে জন্মসংসারের নাগপাশে আবদ্ধ হইয়া গোলকধাঁধায় ঘুরিয়া মর। মুক্তির স্বাদ যে ভুলিয়াছে, মোক্ষ তাহার রুচিবে কেমনে?