ছবিঃ লেখক
তখন শীত যাই যাই করছে। মরা অজয় বা চরাময় অজয় বয়ে চলেছে তিরতির করে। তারই পাশে ‘প্রাণের বাগান’। ‘প্রাণের বাগান’ যার নাম, সেটা আসলে মৃত মানুষদের সমাধিক্ষেত্র। পায়ের নীচে কত যুগের কত কত মানুষ যে বসে আছেন কে জানে। এখানে, বসিয়ে সমাধি দেওয়া হয় বৈষ্ণব ধর্মীয়দের। এই প্রাণের বাগানেই লিয়াকত আলির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আর সেই প্রথম পরিচয়েই, নিজের কাছে নিজে একটা বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম।
বাউল-ফকিরদের তিন দিনের এক উত্সবে প্রাণের বাগান তখন জমজমাট। মনসার থানের পাশে এক গাছতলায় এক দল কিশোরকিশোরী হইহই করছে। দুপুরে খাওয়ার পর গানবাজনা তখন বন্ধ। বড়রা বিশ্রাম নিচ্ছে। এক শহুরে মা বলে উঠলেন, ‘ইস্, কী যে করছিস তোরা সব এই ধুলোময়লায়!’ বাচ্চারা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এক জিনস, ফুল শার্ট পরা ‘বুড়ো’ লোক মিটিমিটি হাসতে হাসতে সেই মা-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ধুলোকে ময়লা বলছেন কেন?’ আমার শহুরে শিক্ষা সেই মায়ের শাসনে চমকায়নি। চমকালাম লিয়াকত আলির ওই প্রশ্ন শুনে। এ ভাবেই লিয়াকত আলির সঙ্গে পরিচয়। শহুরে মানুষের অভিজ্ঞতায় ধুলো আর ময়লা এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু প্রকৃতি যেখানে এখনও ‘আধুনিকতা’র ছোবলে ক্ষতবিক্ষত নয়, সেখানকার ধুলো যে ময়লা নয়, সেটা লিয়াকতই প্রথম শিখিয়েছিল আমাদের অনেককে।
ঠিক এই শিক্ষাটাই লিয়াকতদার হয়েছিল বিয়ের পর। বউ-এর কাছে। লিয়াকতদার স্ত্রী সোফিয়া ফকির জালাল শাহ-র মেয়ে। এঁদের পূর্বসূরী ইরান থেকে এ দেশে এসেছিলেন। বিয়ের পর দুবরাজপুরের ফকিরডাঙাই লিয়াকতের ‘ঘর’। বাউল-ফকিররাও তো ঘর বাঁধেন, অবিরাম চলার ফাঁকে। আপাতদৃষ্টিতে সে ঘর আমাদের আর পাঁচটা ঘরের মতোই। কিন্তু অন্তর্বস্তুতে সে একেবারে আলাদা।
লিয়াকত আলি কি বাউল? তিনি কি ফকির? একজনের প্রশ্ন শুনে লিয়াকতদা একবার হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। ফকিরের দেহটাই শুধু তাঁর নিজের। আর কোনও কিছুকে তিনি তাঁর নিজের জিনিস বলে আগলে রাখেন না। এই যে ভবের মেলায় এত বাউল-ফকির ঘুরে বেড়াতে দেখো, এঁদের কথা-গান-পোশাক দেখেই এঁদের বাউল-ফকির ভেবে বোসো না। বলেছিলেন লিয়াকত। এঁদের একটা বড় অংশ শুধুই শিল্পী। যে দেহতত্ত্বের গান এরা করেন, তা স্রেফ গায়ক হিসেবেই। এর তত্ত্ব এঁরা জীবনে, যাপনে অনুশীলন করেন না। আবার এক দল ফেরেব্বাজও এঁদের মধ্যে আছেন। বলতেন লিয়াকত।
এখানে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। আমি নিজে অনেক বাউল-ফকির সঙ্গ করেছি বা তাঁদের মেলায় মেলায়, আস্তানায় আস্তানায় ঘুরে বেড়িয়েছি, এমনটা একেবারেই নয়। অনেককে গত কয়েক বছরে ‘কাছ থেকে দেখেছি’ মাত্র। কথা শুনেছি। গান শুনেছি। কখনও কখনও নানা বিষয়ে আলোচনাও করেছি। আর এই নাগরিক রাস্তাতেই, অজয়ের পাড়ে, এক প্রাণের বাগানে, এক আরশিনগরে লিয়াকতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বন্ধুত্ব হয়েছিল। হয়েছে নানা বিষয়ে আদানপ্রদানও। বলাই বাহুল্য, সেটা প্রধানত ছিল এক তরফা।
বিচিত্র জীবন লিয়াকতদার। বীরভূমের বাতাসপুরে এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম। ছাত্র বয়েসেই লিয়াকতের চলন, লিয়াকতের ভাবনাচিন্তা গতানুগতিক আর পাঁচজনের থেকে আলাদা হয়ে যায়। স্কুল-কলেজ-চাকরি-ব্যবসা-জমিজমা-উপার্জন-সংসারের বাঁধা গত ভেঙে বেরিয়ে পড়েন, এমন মানুষ সর্বদেশে, সর্বসময়েই কম। আরও কম সেই মানুষদের সংখ্যা যাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই অপর-চলনে টিকে থাকেন। লিয়াকত আলি সেই ব্যতিক্রমীদের একজন।
সিউড়ি কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই নকশালপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সত্তরের দশকের সেই আগুনে আর রক্তাক্ত সময়ে, মৃত্যুর পাশে পাশে হেঁটে, বীরভূমের গ্রামে জমিদারবাড়ির বন্দুক লুঠ বা শ্রেণীশত্রু খতমের ছক কষেছে লিয়াকতদের পার্টি ইউনিটও। তেমনই এক ‘অ্যাকশন’-এ গিয়ে প্রথম মানসিক ধাক্কা। ‘ইউনিট কমরেড’দের নৃশংসতা, নির্মমতা টলিয়ে দিয়েছিল বিশ্বাসের ভিত। লিয়াকতদার কথায়, যে রাষ্ট্রটাকে ভাঙতে চাইছি, সেই রাষ্ট্রের অমানবিকতা-নিষ্ঠুরতা-পুলিশ-জেলখানাই যদি আমরা বহন করে নিয়ে যাই তবে লাভটা কী! ধরা পড়ে জেলে যাওয়ার আগেই পার্টির ভাবনা এবং কাজকর্মের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত বছর দেড়েক জেলে ছিলেন। বেরিয়ে আর, ফেলে আসা পথে ফেরার কথা ভাবেননি।
এর পর কলেজ শেষ করে লেবার ওয়েলফেয়ার কোর্স করতে কলকাতা। তার পর বিড়লার কোম্পানিতে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার। হাসতে হাসতে লিয়াদা একবার বলেছিলেন— “মুর্খের মতো ভেবেছিলাম, এ ভাবে শ্রমিকদের জন্য কাজ করব।” মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। শ্রমিক কল্যাণ অফিসারটির সঙ্গে কারখানার শ্রমিকদের মাখামাখি, দোস্তি, আড্ডা পছন্দ হচ্ছিল না কর্তৃপক্ষের। ফলে খিটিমিটি শুরু। বছর আড়াই পেরোতে না পেরোতে চকরিতে ইস্তফা দিয়ে আবার পথে নেমে পড়লেন। শুরু হল এক ভবঘুরে, বাউণ্ডুলে জীবন। নতুন করে জীবনের খোঁজ। পথে পথে। কফি হাউসে। কবিদের আড্ডায়। লেখায়-তর্কে-চর্চায়। এবং সব কিছু টপকে বাংলার মাটি ছুঁয়ে বয়ে চলা এক সাধনার ধারাপথে নিজেকে বইয়ে দিলেন লিয়াকত আলি।
চলতে চলতে পরিচয় ক্যাথরিনের সঙ্গে। সম্ভবত কোনও এক গ্রামীণ মেলায়। ক্যাথরিন সুইডেনের মেয়ে। পরিচয় গড়াল ঘনিষ্ঠতায়। দু’জনে ঘুরছেন। দেখে বেড়াচ্ছেন। এই আখরা থেকে ওই মাজার। এই মেলা থেকে ওই আসর। দিল্লি, আগরা, আজমের শরিফ, হরিদ্বার, বৃন্দাবনও ঘোরা হল। কিন্তু ক্যাথরিনকে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে হবে। নিয়ে যেতে চান লিয়াকতকে। লিয়াকত রাজি হননি শেষ পর্যন্ত। লিয়াকতদার কথায়— খুব কষ্ট হয়েছিল দু’জনেরই। কিন্তু সুইডেনে গিয়ে করবটা কী? অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ক্যাথরিন।
লিয়াকতদার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার অনেক আগেই ওঁর সম্পর্কে পড়েছিলাম সুধীর চক্রবর্তীর বইতে। সুধীর চক্রবর্তী বা শক্তিনাথ ঝা-র মতো অধ্যাপকেরা তাঁদের গবেষণা কর্মের প্রায় পুরোটাতেই বাংলার তথাকথিত অন্ত্যজ সমাজের ধর্ম, গান, কর্ম, দর্শনকে ঘিরে কাজ করেছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মাঝেমধ্যে ‘ওপাড়ার প্রাঙ্গেনের ধারে’ গিয়ে নয়, এঁরা ওঁদের প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেছেন, থেকেছেন, খেয়েছেন, মিশেছেন, অন্তরঙ্গ হয়েছেন বছরের পর বছর ধরে। ওঁদের কথা লিখেছেন, লিখে চলেছেন। শক্তিনাথবাবু তো বাউল-ফকিরদের নিয়ে সংগঠিত কাজও করে যাচ্ছেন। কিন্তু এঁরা কেউ লিয়াকত আলি হয়ে ওঠেননি। লিয়াকত ওই বাউল-ফকিরদের মধ্যেকার একজন হয়ে গিয়েছিলেন। সুধীরবাবুর কথায় বলতে গেলে ‘লিয়াকত মর্মে মর্মে পাকা ফকির। তারও কোনও চাহিদা নেই জীবনের কাছে।’
এ এক অদ্ভুত কথা। চাহিদা নেই জীবনের কাছে। এও কি হয়? হয় যে, তা নিজের চোখে তো একটু একটু হলেও দেখেছি। এই বীরভূমেরই বারিদ খ্যাপা গত বছর দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। বারিদবরণ দাস বাউলকে অনেকে বারিক বলেও চেনেন। বা মুর্শিদাবাদের নিমাই। দারিদ্রময় জীবন। কিন্তু মুখে লেগে থাকা সারাক্ষণের অনাবিল হাসি তাঁদের মনের যে আনন্দময় অনুভূতির সন্ধান দেয় সদাসর্বদা, তা আমাদের মতো মানুষদের কাছে বিস্ময়কর লাগে। কোথা থেকে আসে এই মহানন্দ? এঁরা সুখসন্ধানী নন। শরীরের সুখ বা আরামকে এত অনায়াসে তুচ্ছজ্ঞান করা যায়, এঁদের না দেখলে বিশ্বাস হবে না। গান শোনানোর জন্য কেউ কুড়ি টাকা দিল না দু’হাজার, তাতে এঁদের মুখের হাসিটা এদিক ওদিক হয় না। টাকাপয়সা না পেলেও আপনাকে গানের পর গান শুনিয়ে যাবে। এই প্রেমানন্দের পথে পথেই ঘুরে বেড়িয়েছেন লিয়াকত আলি।
এ প্রেম মানব প্রেম। শরীরের প্রতি, দেহের প্রতি প্রেম। চোখে না দেখা ঈশ্বর, আল্লার ঠাঁই নেই এই প্রেমে।
“...মুখে কেবল আল্লা বলা হয়বাউল-ফকিরদের কাছে মন্দির-মসজিদ অসার বস্তু। দেহই তাঁর মন্দির। দেহই তাঁর মসজিদ। এ দেহকেই তাঁরা পুজো করেন। এ দেহের উদ্ভব যে বীজে, সেই বীজের যত্ন নেওয়াই তাঁদের সাধনা।
আল্লা কেবা আমি কেবা হল না তার পরিচয়—
আপন কাছে না দেখিয়া দেখে বেড়াও জগতময়...” (মহম্মদ শাহ)
“...ইসমাইলের জন্মস্থানে উঠাও খোদার কাবা ঘরবা
তোমার জন্ম কোনখানেতে রাখছনি রে তার খবর...” (রাধাবল্লভ)
“...তারে যদি দেখতে পাইঅনুমান নয়, বর্তমানের সাধক ওঁরা। লিয়াকত আলির কবিতাও তো সেই কথাই শোনায়— ‘মন্দির মসজিদের নামে ইটপাথরের খাঁচা নয়। সহজ বংশীধ্বনীর মতো’ হোক সাধনার পথ।
চিত্তের অন্ধকার সন্ধ মেটাই।
শুনেছি যা শুনব না তা
বর্তমানে দেখানো চাই।...” (রাধেশ্যাম দাস)
“...পড়ে মুরশিদের পদতলেযেখানেই মানুষ পেয়েছেন— মনের মতো পছন্দের মতো মানুষ, কথা বলার মতো মানুষ— কয়েক কিলোমিটার উজিয়ে নিজেই চলে যেতেন বন্ধুর সঙ্গ পেতে। সঙ্গ দিতে। আর এ সঙ্গ যাঁরা হারালেন, শুধু তাঁরাই জানেন, কোন শূন্যতা তৈরি করে গেলেন লিয়াকত আলি।
লিয়া কাঁদে বেহাল হালে
মানুষে না মানুষ পেলে
মানবজীবন যায় বিফল...”
“...জন্ম নিয়ে এই মানুষেকিন্তু প্রকট সাম্প্রদায়িক রূপটা তো সহজেই দেখা যায়। লিয়াকত দেখেছিলেন অনেক গভীরে। অনেক সূক্ষ্মতায়। আমাদের অসাম্প্রদায়িক, উদার মনের অন্দরেও যে হিন্দু-মুসলিম, ব্রাহ্মণ-বাউড়ি, উঁচু-নিচু, আমরা-ওরার অন্তঃসলিলা প্রবাহ চলে, তাকেও খুঁড়ে বের করে আনতেন লিয়াকত। আমাদের অনেকের কাছেই তা বিড়ম্বনার, অস্বস্তিকর। শুনেছি, কোনও কোনও বাউল-ফকিরও লিয়াকতদার সামনে বেশি তত্ত্বজ্ঞানের মুখ খুলতেন না। সত্যি না কি? জিজ্ঞেস করেছিলাম এক দিন। সহাস্য লিয়াকতের জবাব, ‘উনি আমার থেকে কম তত্ত্ব জানেন এমন নয় কিন্তু। আসল কারণটা অন্য। বাউল-ফকিরদের আখরায় তাদের অন্দরমহলেও তো আমার স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। বাউলানি, ফকিরানিরাও আমাকে আপন করেছেন। আর এই অন্দরমহলেই একজন পুরুষের ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে পড়ে। খুলে পড়ে বাইরের ভেক। আসলে ওই লোকটা জানে, ও যে শুধুই ভেকধারী তা আমি জানি।’ এমনই সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করতেন লিয়াকত।
গেলি জাতবাজারে স্বভাব দোষে
মানুষ ভজার ছেড়ে দিশে
ভুললি লাও-এর একতারাটা...।”