১,১০০ জনে্র মৃত্যুর মিছিল, ধসে পড়া ভবনের ধ্বংস স্তুপের মধ্যে চাপা পড়া হাজার হাজার মানুষের বাঁচার হাহাকার, এরই মধ্যে নতুন দুটি প্রাণের জন্ম-মৃত্যু, হাজার নিখোঁজ আপন জনদের খোঁজে স্বজনদের আহাজারি, টানা সাত-আট দিন ধরে জীবন মৃত্যুর মধ্যখানে পতিত এইসব মানুষের প্রাণ বাঁচাতে শত শত মানুষের প্রাণান্তকর লড়াই এবং শেষ পর্যন্ত আড়াই হাজার মানুষকে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার মানবিক জয় বাংলাদশে এক দুঃসহ-মর্মান্তিক স্মৃতি হিসেবে জিয়ে থাকবে বহুদিন।
রানা প্লাজার ভবন ধ্বসে হতাহত হাজার মানুষদের একটা সাধারণ পরিচয় আছে। তারা মূলত পোশাকশিল্প শ্রমিক এবং এদের অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত নিয়ে সরকার, অর্থনীতিবিদ, নীতি-নির্ধারকসহ সকলের মধ্যে অনেক উচ্চাশা আছে। দেশের বৈদিশিক মূদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় প্রধান খাত হচ্ছে তৈরী পোশাক শিল্প।
বাংলাদেশের বৈদিশক মূদ্রা আয়ের ৭৮ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। ফলে এই মূহুর্তে পোশাক শিল্পের অস্তিত্ব ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। সামনের দিনে এই শিল্পের বিকাশ নিয়ে আরও আশার সঞ্চার হচ্ছে। ইইউ ২৭, এবং তুরস্ককে ছাপিয়ে চীনের পর বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতের চাকা সচল রাখছে যে লাখ লাখ শ্রমিক, তাদের জীবন উচ্চকিত নয়, বরং ভয়াবহ মানবেতর অবস্থায় পতিত। ন্যূনতম মানবিক জীবনতো দূরের কথা ন্যূনতম শ্রমিকের মর্যাদা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত।
গত ৩০ বছর ধরে এদেশের শ্রমিকরা শ্রমিকহিসেবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ন্যূনতম অধিকারের জন্য লড়ছে। তৈরী পোশাক শিল্পে যেসব দেশ অগ্রগণ্য তাদের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা সব চাইতে কম মজুরিতে কাজ করেন। ঘন্টাপ্রতি শ্রমের মূল্য কোরিয়ায় ৫ ডলার, তুরস্কে ৩.৫ ডলার, চীনে 0.৩৫ ডলার, অন্যদিকে বাংলাদেশে মাত্র 0.২৫ ডলার।
ঘন্টায় মাত্র 0.২৫ ডলারে ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিকের সহজলভ্যতা এদেশে গার্মেন্ট শিল্প দ্রুত বিকাশের প্রধান কারণ। আরও বিশেষ লক্ষ্ণনীয় যে, এই সস্তা শ্রমিকদের বড় অংশই হচ্ছেন নারী। আন্তর্জাতিক পুঁজির লাভজনক বিনিয়োগের স্থান হিসেবে তৃ্তীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠিকাদারীভিত্তিক রপ্তানিমুখী যে তৈরি পোশাক খাতের বিকাশ ঘটছে, তার প্রধান শ্রমশক্তি হচ্ছে নারী। তৃতীয় বিশ্বের এইসব দেশের মেয়েরা, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র এবং অশিক্ষিত মেয়েরা এক বিশাল রিজার্ভ শ্রমশক্তি। গ্রামাঞ্চলে তাদের বেশিরভাগেরই উপার্জনক্ষম কোন শ্রমের সুযোগ নেই। ফলে নিদারুণ দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে টিঁকে থাকা এইসব নারীদের শ্রম নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়া খুব সহজ হয়।
সস্তা শ্রমের পাশাপাশি নারীদের অধিক মাত্রায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করার আরও কিছু সুপ্ত কারণ আছে। নারীবাদী তাত্বিকরা দেখাচ্ছেন, অনুন্নত বিশ্বের দরিদ্র নারীরা অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ, তারা সহজে বশ্য, ভীষণ কর্মতৎপর, কর্তব্যনিষ্ঠ এবং মালিকের প্রতি একান্ত অনুগত। লিঙ্গীয় সামাজিকীকরণের যে ধরনের মধ্যে তারা বেড়ে ওঠে, তাতে তারা অত্যন্ত যত্নের সাথে, ক্ষিপ্র গতিতে, সুচারু এবং সুনিপুণভাবে কাজ করে। বিশেষত কাজের সুনিপুণতার জন্য প্রাচ্যের নারী শ্রমিকের বিশেষ সুনাম আছে। তার হাত ছো্ট এবং সে খুব যত্ন নিয়ে দ্রুত কাজ করতে সক্ষম। তার এইসব জৈবিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট তৈরী পোশাক শিল্পের বেঞ্চ এসেম্বলি প্রডাকশন লাইনের সুদক্ষতার জন্য খুবই উপযোগী।
অন্যদিকে, এসব নারীদের নম্র, ভদ্র এবং অনুগত চরিত্র তথাকথিত ‘সাউন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন’ বজায় রাখতে উপযোগী। শ্রমিকের অধিকার এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিয়ে তারা পুরুষ শ্রমিকদের মতো উচ্চবাচ্চা করে না এবং উত্তেজিত হয়ে মাঠে নামে না। শত শোষণ-নিপীড়নেও তারা প্রতিবাদ মুখর হয়ে মালিক আর শিল্পের জন্য ক্ষতিকর-বিপজ্জনক হয়ে উঠে না। ফলে এদের শ্রম শোষণ করে পুঁজির উত্তরোত্তর বৃদ্ধি অধিক নিরাপদে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। তাই আমরা দেখি শুধুমাত্র সস্তা শ্রমের মাধ্যমেই এসব শ্রমিকদের শোষণ করে মুনাফা করা সীমিত থাকে না। শ্রমিক ছাটাই করে, একই বেতনে প্রতি শ্রমিকের ওপর কাজের চাপ বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা নিশ্চত করা হয়।
অন্যদিকে ঘন্টাভিত্তিক মজুরি পরিশোধে না গিয়ে ‘পিস রেট’ ভিত্তিক মজুরিতে কাজ দেয়া হয়। অনুন্নত বিশ্বে বিকশিত তৈরী পোশাক খাতের ক্ষেত্রে শ্রম ভাড়ায় এটি এখন বহুল চর্চিত পদ্ধতি। এর ফলে একদিকে উৎপাদন বাড়িয়ে নেয়া যায় এবং অন্যদিকে কাজের একটা ইনফরমাল ও টেম্পোরাল চরিত্র বজায় রাখা যায়। কাজের এই ইনফরমাল এবং টেম্পরাল চরিত্রের ফলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সংগঠিত হতে পারেন না। এর চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে, পিস রেট ভিত্তিক মজুরির ফলে অনুন্নত বিশ্বের নারী শ্রমিকরা অধিক উপার্জনের তাগিদে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কাজের চাপ নেয় এবং ভয়ংকর শারীরিক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে যেসব দরিদ্র নারীরা লাবণ্যের সামান্য ছিটেফোঁটা নিয়ে হলেও শহরে আসেন গার্মেন্টে কাজের খোঁজে, শ্রমিক হওয়ার পর তারা প্রায় কঙ্কালসারে পরিণত হন।
পুরুষ কর্তা-নারী অসহায় অধীন, সমাজে বিদ্যমান প্রথাগত এই ক্ষমতা সম্পর্ক নারী শ্রমিককে তুলনামূলক বেশী শোষণ-নিপীড়নের সুযোগকে এক ধরনের ন্যায্যতা দেয়। আমাদের দেশের গার্মেন্ট মালিকদের অনুভব এমন যে, গ্রামের অশিক্ষিত এবং দরিদ্র নারীদের তাদের কারখানায় শ্রমিক করে তারা রীতিমত দয়া করছেন। প্রথাগত লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজনে গ্রামাঞ্চলের এইসব দরিদ্র নারীদের রোজগারের কোনো সুযোগ ছিল না। তাদের কল্যাণে তারা মাসে রীতিমত দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করছেন। তারা এইসব নারীদের পরিবারের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করছেন।
আবার পরিবারে-সমাজে অবহেলিত, ক্ষমতা বঞ্চিত, গ্রাম থেকে উঠে আসা নারী শ্রমিকরাও মালিকের এই মনস্তত্বে আক্রান্ত হন এবং একভাবে আত্মস্ত্ব করেন। ফলে পুঁজিবাদী দর কষাকষির মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক এখানে কার্যত গড়ে উঠে না। বরং, এক ধরনের মালিক-দাস সম্পর্কের মতো অবস্থায় পৌঁছায়, যেখানে শ্রমিকের জীবনের ওপর মালিকের সর্বময় কর্তৃত্ব কায়েম করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারখানার তুলনামূলক বেশী মজুরীর কাজগুলো মেয়েদের ভাগ্যে জোটে না। তাদের কাজের কোনো নিয়োগ পত্র থাকে না। একটি আইডি কার্ড দেওয়া হয় মাত্র; তাও আবার তাদের উপর মালিকের তদারকির সুবিধার্থে। ফলে কাজের ক্ষেত্রে লিখিত কোনো টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস থাকে না।
একদিকে নিম্নতম মজুরি, অন্যদিকে সেই মজুরি আবার নির্ধারিত সময়ের ১০-১৫ দিন পরে পরিশোধ করা হয়। কাজের ঘন্টার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। গড়পরতা দিনে ১২-১৪ ঘন্টা তো খাটতেই হয়। শিপমেন্টের সময় সেটি টানা ৩৩ ঘন্টায় পৌঁছায়। আর এত হাড় ভাঙা খাটুনির পর পান থেকে চুন খসলেই চলে অশ্লীল গালাগালি, এমনকি কখনো কখনো শারীরিক নির্যাতন পর্যন্তও চলে। মালিক-দাস সম্পর্কের করুণ-মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত দেখি, যখন নিশ্চিত মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে নারী শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা যায়।
তাজরিন গার্মেন্টে আগুন লাগার বিপদ এলার্ম বেজে ওঠার পরও শ্রমিকদের বের হওয়ার গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আগুনের কুন্ডের মধ্যে ঝলসে ছাই হয়েছিল শত শত শ্রমিক। আর সাভারে লাঠি পেটা করে শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কাজ করতে। কবরের আজাবের মতো যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে।
এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বরাবরই সাক্ষী গোপাল। নিউ লিবারেল অর্থনীতির পথে হাঁটা রাষ্ট্রের এই স্বাক্ষী গোপাল ভূমিকার পথ ধরেই তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে পুঁজি আসে নির্বিঘ্নে মুনাফা লুটতে। এসব দেশে শ্রমিকের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার এবং শ্রম আইন বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেই। নেই কারখানার সেফটি কমপ্লায়েন্স নিয়ে কোনো কড়াকড়ি, কার্যকর তদারকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারখানার মালিকানা আর সরকারের মালিকানা একই গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত। ফলে শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে মুনাফার চূড়ান্ত করে অনায়াসেই পার পাওয়া যায়। এমনকি শ্রমিককে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েও বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি সবচেয় ভয়াবহ। তাজরিন এবং রানা প্লাজার মত এত নির্মম কাঠামোগত হত্যার ঘটনা এই সময়ে তৈরী পোশাক খাতে অগ্রগণ্য কোনো দেশেই ঘটতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ এক মিরাকল ইকনমির দেশ। এখানে রাষ্ট্রের তরফ থেকে অধিকাংশ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান-শিল্প বিকাশ-শিক্ষা-চিকিৎসার কোনো আয়োজন নেই। তবুও দেশ এগিয়ে চলছে মানুষের নিজস্ব উদ্যোগে-মানুষের শ্রমে।
‘নিউ লিবারেল ইকোনমি’র এই রাষ্ট্রের মর্মকথা হচ্ছে– প্রত্যেকের রুটি- রুজি, চিকিৎসা, শিক্ষা এমনকি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। সকলকে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। যে টিকে থাকবে সেই ফিট। বাকিরা হারিয়ে যাবে সাভারের ধসে পড়া ভবনের মতো মৃত্যুকূপে। কিন্তু নিউ লিবারেল ইকনমির বর্তমান রাষ্ট্র টের পায়নি যে তার অগোচরে মৃত্যকুপে পতিত হাজার হাজার শ্রমিকের প্রেতাত্মা বিশাল শক্তি নিয়ে ভর করছে লাখ লাখ শ্রমিক নারী-পুরুষের মধ্যে। অচিরেই তারা প্রমাণ করবে যে তারাই ফিট।
----
লেখাটা এক বছর আগের। কিন্তু অবস্থা তার পরে কিছু বদলায়নি প্রায়।