২০০৪ সালের ১৫ কি ১৬ই অগাস্ট হবে। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আনন্দবাজারে প্রথম পাতা জুড়ে দুটো পায়ের পাতার ছবি বেরিয়েছিল মনে আছে। ধনঞ্জয়ের অন্তিম যাত্রার ছবি। সিকিওরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, স্কুলছাত্রী হেতাল পারেখের ধর্ষক ও হত্যাকারী। এভাবেই চিনতাম ওকে। “ভাল্লাগলে এনজয়, ধরা পড়লেই ধনঞ্জয়" জাতীয় চুটকী তখন বন্ধুবৃত্তে প্রায়ই শুনতাম। খ্যাঁক না হোক ফিক করে হেসেওছি সেসব শুনে। “রেপ কালচার" শব্দটা তখনো ভোকাবুলারিতে ঢোকেনি। মোটের ওপর, ধনঞ্জয়ের ঘটনার প্রাথমিক স্মৃতি আমার এরকমই, মানে মূল ঘটনার ১৫ বছর পরের স্মৃতি। সেটা আশ্চর্যের না, কারণ ৯০ সালে আমার বয়স ৬, ক্যাপ বন্দুকেও ভয় পাই, ধর্ষণ টর্ষণ বোঝার প্রশ্নই ওঠেনা।
যেদিন ফাঁসীটা হয়, টিভির ক্যামেরায় হেতালের স্কুলের কিছু ছাত্রী তর্জনী মধ্যমায় Victory চিহ্ন দেখিয়েছিল। তখন ব্যাপারটা নিয়ে অত ভাবিনি। উল্লাসটা বিসদৃশ লেগেছিল হয়ত, কিন্তু কোথাও একটা জাস্টিফিকেশনও খুঁজে নিয়েছিলাম। সেসময় এবিষয়ে সমবেত সামাজিক হিস্টিরিয়া, টিভিতে কলা সহযোগে ফাঁসীর দড়ির মেকানিক্স বিশ্লেষণ, আরও পরে ফাঁসুড়ে নাটার আত্মজীবনী প্রকাশ, পুজো উদ্বোধন ইত্যাদি কোনও কিছুতেই সেরকম অবাক হইনি। বাঙালীর হুজুগপ্রীতি জাতিস্বত্তার অঙ্গ।
শেষমেশ, ইতিউতি কিছু মানবাধিকার কর্মীর বক্তব্য বাদ দিলে, জনপ্রতিক্রিয়া হিসেবে যা পড়ে ছিল, তা হল,
“বেশ হয়েছে"।
বেশ যে নাও হয়ে থাকতে পারে, সেটা বুঝতে বুঝতে ২০১৬ হয়ে যায়। তখন পুজোর সময়।
আমার বন্ধু অভিষেকের কাছে একটা বইয়ের কথা শুনি। বইটার নাম "আদালত-মিডিয়া-সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসী”। আই এস আই-এর ৩ জন অধ্যাপক নাকি বিস্তর তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে দেখিয়েছেন, যে ধনঞ্জয়ের মামলায় তদন্তে প্রচুর ফাঁক ছিল, আর ধনঞ্জয় নাকি খুন নাও করে থাকতে পারে। আমি স্বভাবত অবশপাঠক, নন-ফিকশনের দিকে পারতপক্ষে যাই না, বইটা আবার গবেষণাগ্রন্থ বলে শুনলাম। ২৬ বছর আগের ঘটনা, তার ওপর অত তথ্যপ্রমাণের কচকচি আমি বুঝব কিনা কে জানে। তাই কতটা রিলেট করতে পারব সে নিয়ে সন্দেহ ছিল।
ভুল ভাঙল বইটা পড়তে গিয়ে। বইটা কখনোই তার গতি হারায় না। এর একটা কারণ অবশ্যই লেখার গুণ। কিন্তু সেটা গৌণ। মূলত ধাপে ধাপে যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেটাই মনোযোগ সরতে দেয়না। একটা clinical precision সবসময় কাজ করে। মনে হয়, কোনও অভিজ্ঞ সার্জন দক্ষ হাতে একটা ঘটনার ব্যবচ্ছেদ করছেন। আর আমরা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। বইটা রূদ্ধশ্বাসে পড়তে হয়, কোনও ভাল রহস্য উপন্যাসের থেকে এতে Thrill Element কোনও অংশে কম নেই।
রহস্যোপন্যাসের সাথে ফারাক শুধু একটা জায়গাতেই। ঘটনাগুলো একটাও কাল্পনিক নয়। আর ঠিক সেকারণে বইটা Engaging সবসময়ই, কিন্তু কখনোই Entertaining নয়।
বইয়ের সম্পূর্ণ বক্তব্যকে লেখকরা চার পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথমটা Prologue, মানে প্রসিকিউশনের বয়ান। বস্তুত, এই ছোট অংশটাই হল ধনঞ্জয় সম্পর্কিত সেই কাহিনী যা আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনে এসেছি।
দ্বিতীয় পর্বে সেই কাহিনীর ফাঁকগুলো দেখানো হয়। এখানেই ধাপে ধাপে জানা গল্পটা ভেঙে পড়তে থাকে। মোটিভ, অ্যালিবাই, বাড়ির আর্কিটেকচারাল ডিটেল, প্রাথমিক এভিডেন্স, সাক্ষ্য, ফরেন্সিক রিপোর্ট, কিছুই বাদ যায়না। অসঙ্গতি অজস্র। এই অংশে এসে পাঠক প্রথমবার অনুধাবন করবেন, কোথাও একটা বড়সড় ভুল হয়ে গেছে। কে অপরাধী, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, কে যে অপরাধী নয়, তা প্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
তৃতীয় পর্ব হল বিকল্প ব্যাখ্যার সন্ধান। শার্লক হোমসের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে।
“When you have eliminated all which is impossible, then whatever remains, however improbable, must be the truth.”
অবশ্য improbable শব্দটা আপেক্ষিক, সেটা যে ভাবছে তার চিন্তার Framework এর ওপর নির্ভর করে।
লেখকরা সঠিক জানতেন, কোনও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প ব্যাখ্যা উঠে না এলে জনমানসে মৃত্যুর পরেও আসামী রেহাই পাবেনা, যতই যুক্তি থাক। অন্যদিকে, এই পর্বটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ কিছুটা অনুমান এখানে অনিবার্য হয়ে পড়ে। লেখকরা এই অংশে খুব সচেতনভাবে নিরাসক্ত থেকেছেন, একবারের জন্যও কল্পনাস্রোতে ভেসে যাননি। অনুমানের অংশগুলো আলাদা করে চিহ্নিত করে দিয়েছেন, যাতে পাঠক বিপথে চালিত না হন। তারপরেও দেখা যায়, বিকল্প সম্ভাবনার দিকে পাল্লা অনেক ভারী। দুই সম্ভাবনার একটা তুলনামূলক আলোচনা বইতে আছে, তাতে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
এই পর্যন্ত এসে পাঠকের মনে একটা প্রশ্ন থাকবে। মামলা চলাকালীন দীর্ঘ সময়ে কেন এসব কথা সেভাবে ওঠেনি? কি করে এত অসঙ্গতি স্বত্বেও এই মামলা একরৈখিক গতিতে এগোল? লেখকরা সেটা শেষ পর্বে ব্যাখ্যা করেন। এই অংশটা আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ তথ্যপ্রমাণ সম্ভব-অসম্ভব সবকিছু পেরিয়ে এখানে সিস্টেমের একটা অন্ধকার দিক ফুটে ওঠে। এখানে একটা জিনিস আমাকে বিশেষভাবে ধাক্কা দিয়েছিল, যেটা লেখকরা খুব নির্মোহ বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন। এই মামলায় যেভাবে বিভিন্ন ঘটনা আসামীর বিপক্ষে যায়, তাকে এক অদ্ভুত সামাজিক equilibrium বলা যায়। চুম্বকের কাছাকাছি যেরকম লোহার কুচি রাখলে তা এক বিশেষ প্যাটার্নে এসে থিতু হয়, সেই একই ধাঁচে এই ঘটনায় সমাজের বিভিন্ন অংশের লোকজন নিজেদের এক আপাত-সহজপাচ্য থিওরির চারদিকে align করেন। এই থিওরি কিন্তু তথ্য বা প্রমাণের ভিত্তিতে তৈরি না। এক সামাজিক পিরামিডের মধ্যে এই থিওরির জন্ম হয়, তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের আগেই। সেই অমোঘ পিরামিড আগেই নির্ধারণ করে দেয়, কার কোন কথা কতটা গুরুত্ব পাবে, বা আদৌ পাবে কিনা। তার জন্য আলাদা করে প্রভাব খাটানোর দরকার পর্যন্ত পড়েনা।
শেষপর্যন্ত তাই সব যুক্তি-প্রমাণ তুচ্ছ করে ওই থিওরিটাই টিকে থাকে। আর থাকে মাস হিস্টিরিয়া। সবকিছু থিতিয়ে গেলে, পড়ে থাকে দুটো লাশ। হেতালের আর ধনঞ্জয়ের। ওই পিরামিডের তলায়।
উপসংহারে লেখকরা লিখছেন, “ফাঁসীর আগে ধনঞ্জয় বলেছিল সে নিরপরাধ। গরিব বলে তার ফাঁসী হচ্ছে।" অতি সাধারণ কথা। যেকোনো ফাঁসীর আসামীই একথা বলতে পারে। পুরো বইটা পড়বার পরে এই বাক্যের অভিঘাত কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। একটা সিস্টেমের কাছে মানুষ কি পরিমাণ অসহায়, সেটা বারবার মনে হচ্ছিল এই লাইনটা পড়ে। বইটা যেদিন শেষ করি, সেটা কালীপূজোর রাত। যেরকম হয়, রাতের স্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে পটকা কি তুবড়ির আওয়াজ আসছে। আমার কাছে তখন কিরকম অবাস্তব লাগছিল সবকিছু। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমার ধারণা, বইটা পড়লে যে কারোর মধ্যেই এই ঘোরটা তৈরি হবে। মানুষ যে framework এ বাস করে, তার ভিত ধরে টান দিলে এরকম হয়।
মাসখানেক আগে পদ্মপুকুরে এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ওদের বাড়িটা চক্রবেড়িয়া স্কুলের উল্টোদিকে। কি প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, "ওখানে ধনঞ্জয় থাকত, জানিস?”
ও বলেছিল, “মানে রেপিস্ট ধনঞ্জয়”?
আমি খুব রেগে উঠেছিলাম। যেন আমার পরিচিত কারো সম্পর্কে কথাটা বলা হচ্ছে।
বন্ধু কিছুটা অবাক। “এত রিঅ্যাক্ট করবার কি আছে? আমি কোত্থেকে জানব?”
সত্যিই ত। আমরা জানব কোত্থেকে? কিন্তু জানা উচিত ত। আমাদের সবার। সবাই মানে যারা ওর নাম জানি। যারা ওই নাইলনের দড়িটা ছুঁয়েছি। তাতে সযত্নে গিঁট দিয়েছি। টেনে দেখেছি শক্ত হয়েছে কিনা। আর সব শেষ হয়ে গেলে, ওই পায়ের পাতাদুটো কেঁপে স্থির হয়ে যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করেছি শান্তভাবে।
পুনশ্চ:
এবিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক বাংলা ছবিটা আমি দেখেছি। সেপ্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। লেখার শুরুতে “Engaging" বনাম “Entertaining" প্রসঙ্গটা তুলেছিলাম। সিনেমাটা যদিও তথ্যনিষ্ঠ, তবু তা দ্বিতীয় দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থাৎ, Entertain করতে গিয়ে engage করবার credibility হারিয়ে ফেলে। বইটা তা করেনি।
প্রাসঙ্গিক সূত্রগুলো -