অনুবাদ ঃ শেখর সেনগুপ্ত
হেলথ ফর অল' এর উদ্যোগে আয়োজিত ২০১৬ র কনভেনশনে রাখা বক্তব্যের অংশবিশেষ। 'সবার জন্য স্বাস্থ্য- একটি স্বপ্ন যা সত্যি করা যায়', সম্পাদনা-পুণ্যব্রত গুণ, ৭ই এপ্রিল ২০১৭, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে প্রকাশিতব্য এই বইটি থেকে।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমার কাছে কোনো পাওয়র পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন নেই। তবে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই আমার পূর্ববর্তী বক্তারা আপনাদের জানিয়ে দিয়েছেন। সর্বজনীন স্বা্স্হ্য পরিষেবা বিষয়ে আমার ঠিক পূর্ববর্তী বক্তা ডা অরুণ সিং তাঁর সাবলীল উপস্হাপনা যেখান থেকে শুরু করেছিলেন তারই সূত্র ধরে আমি এই বিষয়ের উপর কিছু আলোকপাত করব।
চিরায়ত অর্থনীতির ধারণা অনুযায়ী কোনো দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হলেই সেই দেশের নাগরিকদের স্বাস্হ্যের মান বৃদ্ধি পাবে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ, যাঁরা দেশের নীতি নির্ধারক, তাঁরা এখনো ঐ ধরনের ভাবনা-চিন্তায় বিশ্বাস করেন। চিরায়ত অর্থনীতির সূত্র প্রেস্টন কার্ভ (যা নাকি মাথাপিছু জিডিপি-র সাথে গড় আয়ু বৃদ্ধির সম্পর্ক নির্দেশ করে)অনুযায়ী কোনো দেশের মাথাপিছু জিডিপি-র মান কম হলে সেই দেশের মানুষদের গড় আয়ুও কম হবে এবং মাথাপিছু জিডিপি-র মান বেশি হলে সেই দেশের মানুষদের গড় আয়ুও একটা নির্দিষ্ট মান পর্যন্ত বাড়তে থাকবে। মাথাপিছু জিডিপি-র মান বৃদ্ধি পেয়ে যখন ৪০০০/৫০০০ এ পৌঁছবে, তখন কিন্তু গড় আয়ুর প্রান্তিক বৃদ্ধি ঘটবে এবং গ্রাফে গড় আয়ুর তীক্ষ্ণ বৃদ্ধি বন্ধ হবে। এর থেকে বোঝা যায় যে জিডিপি-র বৃদ্ধি একটা নির্দিষ্ট মান পর্যন্ত গড় আয়ুকে বাড়তে সাহায্য করে। কিন্তু আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোলো উইলকিনসন, পিকেট এবং অন্যান্য অর্থনীতিবিদদের তত্ত্ব। ওঁরা দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন দেশের মাথাপিছু জিডিপি এক হওয়া সত্ত্বেও যেসব দেশের অর্থনৈতিক সাম্য বেশি, সেসব দেশের নাগরিকদের স্বাস্হ্য সূচক এবং অন্যান্য সামাজিক সূচকের মান, অর্থনৈতিক বৈষম্য যেসব দেশে বেশি, তাদের চেয়ে ভাল। আয় বৈষম্য মাপার সূচক গিনি কোইফিশিয়েন্টের কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। আয়ের সাম্য যে ভাবেই মাপা হোক না কেন, যদি সমাজে বৈষম্যের মাত্রা বেশি হয়, তবে প্রত্যেককেই তার মাশুল গুনতে হয়। যে সমাজে বৈষম্য বেশি সেখানে অবশ্যই দরিদ্রদের বেশি মাশুল দিতে হয়। কিন্তু সেখানকার ধনীদেরও আয়ের সাম্য বেশি যে সমাজে, সেখানকার ধনীদের তুলনায় বেশি মাশুল দিতে হয়। এই ছবিটা মাথা পিছু জিডিপি-র মান যাই হোক না কোনো সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা যদি জাপান ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তুলনা করি সেক্ষেত্রে কিংবা আরো অনেক তুলনামূলক বিচারের ক্ষেত্রেও আমরা একই ছবি পাব। এর থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, কোনো সমাজে স্বাস্হ্য খাতে বিনিয়োগের সুফল তখনই প্রত্যাশিত মাত্রায় পাওয়া যাবে যদি সেই সমাজে সাম্যের মাত্রা ভাল পরিমাণে বিরাজ করে। এই সত্যটা খুব সহজেই নানাভাবে বোঝা যায়। যেমন ধরুন, মুম্বই শহরে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়িটিতে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি বাস করতে পারেন, কিন্তু তাঁর বাড়ির পাশের বস্তিগুলি থেকে যদি সংক্রামক রোগের জীবাণু ছড়াতে থাকে তবে তিনি বা অন্য কেউ সেই রোগের সংক্রমণ থেকে নিজেদের পুরোপুরি মুক্ত রাখতে সমর্থ হতে নাও পারেন। সুতরাং সমাজে যদি বৈষম্য বিরাজ করে, তবে ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া বা মশাবাহিত অন্য কোনো রোগ অথবা অন্য যে কোনো, শুধুমাত্র সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রেই নয়, এমনকি দীর্ঘস্হায়ী রোগের (chronic diseases) ক্ষেত্রেও সব শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং আমরা যদি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, সাম্যের সমাজ বৈষম্যের সমাজের চেয়ে ভাল, তবেই আমরা সামাজিক সংহতির নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। অর্থাৎ, আমরা এমন এক সমাজে বাস করব যেখানে দেশের সবাই কিংবা বিশ্বের সবাই সামাজিক সংহতিতে বিশ্বাস করবে। এই সামাজিক সংহতির ভাবনাই হোলো সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবার ভিত্তি, কেননা সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার গোড়ার কথা হচ্ছে স্বাস্হ্য-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার সমগ্র অংশকে একটা অখন্ডরূপে দেখা। এখন এই সমষ্টির প্রত্যকেই হয়ত একসাথে অসুস্হ হয়ে পড়বে না। কিছু লোক হয়ত একসাথে অসুস্হ হয়ে পড়তে পারে, কিন্তু বেশির ভাগ লোকই সুস্হ থাকবে। কিন্তু সবাই যদি স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্প রূপায়ণের জন্য কিছু কর দেয় বা স্বাস্হ্য বিমা করায় (কর ও স্বাস্হ্য বিমার মধ্যে পার্থক্য পরে আলোচনা করব), তাহলে কোনো এক সময়ে যারা অসুস্হ হয়ে পড়বে, তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান আসবে সেসময় যারা সুস্হ থাকবে তাদের দেয়া কর বা স্বাস্হ্য বিমার প্রিমিয়ামের টাকা থেকে। অবশ্য কোনো ব্যক্তি তিন বছর ধরে সুস্হ থাকার পর চতুর্থ বছরে অসুস্হ হয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু সাধারণত যে কোনো সমাজে সুস্হ লোকেরাই অসুস্হদের চিকিৎসাব্যয়ে ভর্তুকি যোগায়। যদি কোনো দেশে প্রগতিশীল কর-কাঠামো থাকে, সেখানে ধনীরা বেশি হারে কর দেবে এবং এই কর বাবদ প্রাপ্ত অর্থ যদি স্বাস্হ্যখাতে ঠিকমত বিনিয়োগ করা হয়, তবে সেক্ষেত্রে ধনীদের কাছ থেকে আদায় করা কর গরীবদের চিকিৎসায় ভর্তুকি দিতে ব্যবহার করা যাবে। এটাই হোলো সংহতির ভিত্তি, যা কিনা সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পকে নিশ্চিত করবে।
সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পের ভাবনার উদ্ভবের পিছনে ছিল উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানিতে সামাজিক বৈষম্য, বৈষম্যের কারণে উদ্ভূত স্বাস্হ্য-সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা এবং আরো নানা অন্যায়ের বিরূদ্ধে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সক্রিয় প্রতিবাদ আন্দোলন। তৎকালীন জার্মানির চ্যান্সেলার বিসমার্ক বুঝেছিলেন যে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে সন্ত্তুষ্ট করা প্রয়োজন, না হলে সমাজে বিস্ফোরণ ঘটবে। সেইজন্য তিনি স্বাস্হ্যবিমা প্রকল্প শুরু করেছিলেন এবং যা শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে সবার জন্য স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পের ভাবনার সূচনা করল। পরবর্তী কালে বেভারিজ (Beveridge) রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের (UK) শ্রমিকদলের স্বাস্হ্যমন্ত্রী অ্যনুউরিন বেভান (Aneurin Bevan) সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবার ভাবনাকে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে জাতীয় স্বাস্হ্য পরিষেবার (National Health Service) সূচনা করেন। কিন্তু আবার বলছি যে সামাজিক সংহতি ও বিপ্রতীপ ভর্তুকি দানের (cross subsidization) নীতিই সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পের ভিত্তিমূল। বিসমার্কের অবশ্য অন্যান্য বিবেচনাও ছিল। প্রথমত, তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো যেন আরো প্রতিবাদী না হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, তিনি মনে করেছিলেন যে শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক অবস্হায় জার্মানির অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সুস্হ সবল তরুণদের যোগান নিশ্চিত করা দরকার। তৃতীয়ত, তিনি বুঝেছিলেন যে সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্খাকে বাস্তবায়িত করতে গেলে সেনাবাহিনীতে স্বাস্হ্যবান তরুণদের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু মূল কারণটা ছিল সামাজিক অস্হিরতা এবং তারই ফলশ্রুতিতে জার্মানিতে সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল। এখন লোকেরা বুঝতে পারছে যে দেশবাসীর মঙ্গলের জন্যই তাদেরকে স্বাস্হ্য পরিষেবা দিতে হবে। সেইজন্যই অনেক দেশেই সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার। অনেক দেশ স্বাস্হ্যের অধিকারকে তাদের সংবিধানে নাগরিকদের স্বীকৃত অধিকারের মর্য্যাদা দিয়েছে। কিছু দেশ সবার জন্য স্বা্স্হ্যকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিলেও, রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে এমন কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করেছে যা কিনা সর্বজনীন স্বা্স্হ্য পরিষেবার আদলেই তৈরি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা কী? বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার সংজ্ঞা অনুযায়ী সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা হচ্ছে এমন এক প্রকল্প যা নিশ্চিত করবে যে স্বাস্হ্য সংক্রান্ত পরিষেবা পাওয়ার জন্য দেশের নাগরিকরা যেন কোনো আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে, কিংবা চিকিৎসাজনিত খরচ সাধ্যাতীত হওয়ার কারণে যেন কোনো সমস্যায় না পড়ে। বিশ্ব স্বা্স্হ্য সংস্হা মূলত তিনটি বিষয়কে গুরুত্ত্ব দিয়েছে- (১) আপামর জনসাধারণকে স্বা্স্হ্য পরিষেবার কার্যক্রমের অধীনে আনা, (২) জনসাধারণকে কোন কোন স্বা্স্হ্য পরিষেবা দেওয়া হবে তা চিহ্নিত করা এবং (৩) স্বাস্হ্য পরিষেবা পাওয়ার জন্য জনগণের যা খরচ হবে তার পর্যাপ্ত অংশের দায় রাষ্ট্রকে বহন করবে এটা নিশ্চিত করা, যাতে চিকিৎসার জন্য ব্যয়ের আর্থিক ঝুঁকি জনসাধারণকে বহন করতে না হয় অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য জনসাধারণের পকেটে চাপ না পড়ে। সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবার এই সংজ্ঞাকে আজকাল WHO cube (হু ঘনক)বলাহয় । এর ঘনকের একটা মাত্রা চিহ্নিত করে জনসংখ্যার কত অংশ স্বাস্হ্য পরিষেবার অধীনে আছে, অপর মাত্রা চিহ্নিত করে স্বাস্হ্য পরিষেবার ধরনকে এবং তৃতীয় মাত্রা চিহ্নিত করে এই পরিষেবার খরচকে।
এখন বিষয়টাকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখবে। রাজনীতিবিদদের আগ্রহ থাকবে জনসংখ্যার কত অংশকে স্বাস্হ্য পরিষেবার অধীনে আনা যাচ্ছে সেই ব্যাপারটায়। কেননা যত বেশি মানুষকে এই পরিষেবার অধীনে আনা যাবে তার কৃতিত্ব রাজনীতিবিদরা দাবী করতে পারবেন, ভোট বাক্সে তাদের বেশি সুবিধা হবে এবং সুবিধাভোগী মানুষজন রাজনীতিবিদদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন। সে কারণেই অন্ধ্রপ্রদেশে “আরোগ্যশ্রী” প্রকল্প প্রবর্তিত হয়েছিল। এটা ছিল দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা মানুষদের কাছে সরকারি স্বাস্হ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার একটা প্রকল্প, তার আওতায় কিন্তু অন্ধ্রের ৮০% মানুষকেই আনা হয়েছিল। এর ফলে ডা রাজশেখর রেড্ডি নির্বাচনে জয় লাভ করেছিলেন এবং পুননির্বাচিত হওয়ার জন্য “আরোগ্যশ্রী” প্রকল্পের গুণকীর্তনও করেছিলেন।
হু ঘনকের এর দ্বিতীয় মাত্রা হোলো কি ধরনের পরিষেবা প্রদান করা হবে। এই বিষয়ে স্বাস্হ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একটা ভূমিকা আছে। একজন চিকিৎসক হিসাবে আমি চেষ্টা করব যত বেশি সংখক রোগীকে যত ভাল চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেখানে চিকিৎসার খরচটা আমার বিবেচ্য নয়, কেননা আমি মনে করি যে পরিষেবা দেওয়াটাই আমার মূল কর্তব্য।
আর অর্থননীতির প্রশাসকদের কাজ হোলো হু ঘনকের এর তৃতীয় মাত্রা, অর্থাৎ চিকিৎসার খরচের দিকটা নিয়ে ভাবা। তাঁরা বলবেন যে হ্যাঁ, নাগরিকদের চিকিৎসাজনিত ব্যয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ রাষ্ট্র বহন করবে যাতে চিকিৎসাজনিত ব্যয়ের কারণে লোকরা আরো গরীব হয়ে না পড়ে। কিন্তু সাথে সাথে তাঁদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে এই খাতে ব্যয় যেন রাষ্ট্রের আর্থিক বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।
সবার জন্য স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পের এই তিনটি প্রেক্ষিতই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই প্রেক্ষিতগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়েন আছে, প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণের জন্য যে কোনো সমাজে তার সুষ্ঠু মীমাংসা করতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ যাই হোক না কেন, এটা নজরে রাখতে হবে যে, প্রকল্প রূপায়ণের ফলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণীর মানুষরা যেন উপকৃত হন।
যদিও বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হা এই পরিষেবা প্রকল্পকে পিকাসোর বিমূর্ত কিউবিজিমের ধারণার মত একটা ঘনকের (cube) সাথে তুলনা করেছে, কিন্তু আমার মনে হয় এটা অনেকটা সেই রুবিক কিউবের মত যার অনেকগুলো মুখ বা তল আছে, যে তলগুলোকে আমাদের একসাথে মেলাতে হয়। যখন কেউ রুবিক কিউবের তলগুলোকে মেলাতে যায়, তখন তাকে সবচেয়ে দুর্বল অংশের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর রাখতে হয়। সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। হু ঘনকের সমালোচনায় বলা হয় যে, সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পে পরিষেবার মান নিয়ে ভাবা হয় না। এটা অবশ্যই বলা যায় যে পরিষেবা বলতে কত লোক পরিষেবা পাচ্ছে কিংবা কি ধরনের পরিষেবা পাচ্ছে শুধুমাত্র সেটাকেই বোঝায় না, পরিষেবার গুণগত মানকেও বোঝায়। স্বাস্হ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে যেসব সামাজিক উপাদান পরিষেবার গুণগত মানকে নির্ধারণ করে সেগুলোও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সমাজে সবাই বিশুদ্ধ পানীয় জল পাচ্ছে কিনা, সবার বাড়িতেই স্বাস্হ্য সম্মত শৌচালয় আছে কিনা, নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে কিনা, সবার মাথা গোঁজার জন্য বাড়ি-ঘর আছে কিনা, সমাজে মানুষজনের আয়ের পরিমাণ, সমাজে বিভিন্ন লিঙ্গের অনুপাত, নাগরিকদের পুষ্টির মান, প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য প্রত্যেকে পাচ্ছে কিনা, ইত্যাদি। এইসব সামাজিক উপাদানগুলো, স্বাস্হ্যের গুণগত মানের উপর যাদের প্রভাব স্বাস্হ্য ক্ষেত্রে সরাসরি পদক্ষেপের তুলনায় বেশি, আমাদের দেশে তাদের অবস্হা কি রকম? এসব কিছুকে আমরা কি করে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসবো?
কেউ কেউ সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পকে কেবলমাত্র স্বাস্হ্য বিমা বলে মনে করেন। কেউ কেউ আবার মনে করেন যে, সরকার এই প্রকল্পে শুধু আর্থিক সহায়তা দেবে হয়, বিমার ব্যবস্হার মধ্য দিয়ে কিংবা কর বাবদ প্রাপ্ত রাজস্ব থেকে। কেউ কেউ মনে করেন যে এই প্রকল্পের ব্যাপ্তি অনেক বড়। এখানে স্বাস্হ্য ব্যবস্হার আরো অনেক উপাদান যেমন স্বাস্হ্য কর্মী, পরিকাঠামো, প্রয়োজনীয় ওষুধের যোগান, পরিচালন ব্যবস্হা, তথ্য ব্যবস্হা গড়ে তোলা, বিভিন্ন গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন প্রভৃতি দিকগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে আলোচনার সময় এই পরিভাষাটা (অর্থাৎ সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্প) খুবই বিভ্রান্তিকর ও জটিল হয়ে যায়। এর কারণ হোলো আমরা সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্প মানে স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্প-এরকম একটা বহুল প্রচলিত ধারণাকে এড়িয়ে চলতে চাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্পের ধারণার ব্যপ্তি বিশাল। ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্হ্য প্রকল্পও একধরণের সামাজিক বিমা প্রকল্প। কিন্তু অনেকে ভাবেন যে এটা একটা বেসরকারি বিমা প্রকল্প যা নাকি ব্যক্তি মানুষ কিনে থাকেন। এব্যাপারে আমরা বিভ্রান্তি দূর করতে চাই বলে আলোচনার মুখবন্ধেই উল্লেখ করেছিলাম যে সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্প হচ্ছে স্বাস্হ্য পরিষেবা নিশ্চিত করার প্রকল্প, শুধু মাত্র স্বাস্হ্য বিমা নয়। আমাদের দেশের সরকার এই পরিভাষাটা (অর্থাৎ সবার জন্য স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্প) গ্রহণ করেছেন, কিন্তু কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়াই। সুতরাং আমরা কি ভাবে একে ব্যাখ্যা করব?
এই প্রকল্পকে আমি তিনটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তের সাথে তুলনা করব। একদম ভিতরের বৃত্তটা নির্দেশ করছে স্বাস্হ্য পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্হান কি ভাবে করা হবে। আদর্শগত ভাবে স্বাস্হ্য পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্হান হওয়া উচিত দেশের কর ব্যবস্হার মাধ্যমে সংগৃহীত রাজস্ব থেকে। কর্মচারীদের জন্য মালিকদের দেওয়া স্বাস্হ্যবিমা এবং ব্যক্তিগত স্বাস্হ্যবিমাকেও (যারা এটা চাইবে) অর্থ সংস্হানের পরিপূরক হিসাবে ধরা যেতে পারে।
সমকেন্দ্রিক বৃত্তের দ্বিতীয় বৃত্তটি হোলো স্বাস্হ্য কর্মী, পরিকাঠামো, প্রয়োজনীয় ওষুধের যোগান, পরিচালন ব্যবস্হা, তথ্য ব্যবস্হা গড়ে তোলা, বিভিন্ন গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন প্রভৃতি। স্বাস্হ্য সংক্রান্ত অন্যান্য উপাদানগুলোকে (দ্বিতীয় বৃত্ত) আর্থিক উপাদানের (প্রথম বৃত্ত) সাথে যুক্ত করে আমরা স্বাস্হ্য পরিষেবার একটা কাঠামো গড়ে তুলতে পারি। আর এই কাঠামোটাকে তৃতীয় বৃত্ত অর্থাৎ স্বাস্হ্য পরিষেবার সামাজিক পরিকাঠামো (বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্বাস্হ্য সম্মত শৌচালয়, মাথা গোঁজার জন্য বাড়ি-ঘর, দূষণ মুক্ত পরিবেশ, পুষ্টির হার, খাদ্যের যোগান ইত্যাদি) দিয়ে ঘিরে দিলেই আমরা সবার জন্য স্বাস্হ্যকে নিশ্চিত করতে পারব। কেননা, এই সামাজিক পরিকাঠামোগুলো ছাড়া সবার জন্য স্বাস্হ্যকে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্বাস্হ্য খাতে অর্থ বরাদ্দের অবস্হা (যা নিঃসন্দেহে মূল চালিকা শক্তি) কি রকম এবং আমাদের দেশের স্বাস্হ্যের হাল খারাপ কেন? ইতিমধ্যেই ডা অরুণ সিং বলেছেন যে ভারতে স্বাস্হ্য খাতে বরাদ্দ খুবই কম। কতিপয় অর্থনীতিবিদ তর্ক করে বলেন যে দেশের নাগরিকদের স্বাস্হ্যের উন্নতি যখন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বাইরের কিছু নিয়ামকের উপর নির্ভর করে এবং স্বাস্হ্য খাতে বরাদ্দ করা অর্থ যখন ঠিকমত খরচ হয় না, তখন আমরা কেন এই খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়াবো? এই ধরনের যুক্তি সম্পর্কে পরে আলোচনা করব। এখন আমরা কিছু দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করব। বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার ২০১২ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে স্বাস্হ্য খাতে ভারতবর্ষ তার জিডিপি-র ৩.৮% ব্যয় করেছিল, চিন করেছিল ৫.৪%, মেক্সিকো ৬.১%, জার্মানি ১১.৩%, যুক্তরাজ্য ৯.৩% এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র্র ১৭%। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র্র বর্তমানে তাদের জিডিপি-র ১৮.২০% স্বাস্হ্য খাতে ব্যয় করা সত্ত্বেও তার সুফল পাচ্ছে না। সুতরাং এই ব্যাপারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র্র কোনো ভাল উদাহরণ নয়। আবার ভারতবর্ষ যে তার জিডিপি-র ৩.৮% স্বাস্হ্যের জন্য ব্যয় করেছিল সেটাও স্বাস্হ্যের ব্যাপারে আদর্শ উদাহরণ নয়, স্বাস্হ্য সূচকের দিক থেকে খুবই নীচের দিকে ভারতের অবস্হান। বিগত বছরগুলোত মানব সম্পদ উন্নয়নের সূচকে ভারতের স্হান ১৩০ থেকে ১৩৬ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এর প্রধান কারণ হোলো শিক্ষা ও স্বাস্হ্যের ব্যাপারে আমাদের অবহেলা। মেক্সিকো যারা জিডিপি-র ৬.১% স্বাস্হ্য খাতে ব্যয় করে তাদের দিকে আমাদের তাকানো উচিত। অবশ্য যুক্তরাজ্যের জিডিপি-র ৯.৩% স্বাস্হ্য খাতে ব্যয় করার পিছনে রয়েছে তাদের জাতীয় স্বাস্হ্য প্রকল্পের (NHS) অস্তিত্ব।
কিন্তু স্বাস্হ্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণের থেকেও গুরুত্বপর্ণ হোলো কী ভাবে এই অর্থ খরচ করা হচ্ছে এবং কোথা থেকে এই অর্থের যোগান আসছে? আপনারা যদি স্বাস্হ্য খাতে সরকারি ব্যয়ের তথ্য বিচার করেন তবে দেখবেন যে ২০১২ সালে ভারত সরকার ব্যয় করেছিল মোট খরচের ৩০.৫%, চিন ৫৬%, মেক্সিকো ৫১.৮%, জার্মানি ৭৬.৭%, যুক্তরাজ্যের সরকার ব্যয় করেছিল ৮৪% (NHS সহ)। কিন্তু সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হোলো, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যেখানে নাকি বেসরকারি স্বাস্হ্য ক্ষেত্রের রমরমা সেখানেও স্বাস্হ্য খাতে সরকারি ব্যয় ছিল ৪৭%, অথচ ভারতবর্ষের সরকার খরচ করেছিল ৩০%। স্বাস্হ্য খাতে সরকারি ব্যয়ের অপ্রতুলতার কারণেই আমাদের স্বাস্হ্য ব্যবস্হার এই দুর্দশা। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেশের সরকারি স্বাস্হ্য ব্যবস্হাকে ক্রমশ সংকুচিত করে তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি, আর তার ফলে বিনিয়ন্ত্রিত ও অসংবেদনশীল বেসরকারি স্বাস্হ্য ব্যবস্হার দিনে দিনে বৃদ্ধি ঘটছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্হার (regulatory system) অভাবে আমরা এই মিশ্র স্বাস্হ্য ব্যবস্হাকে ঠিকমত পরিচালনা করতে পারছি না এবং সেই কারণেই টাকা খরচ করা সত্ত্বেও আমরা আকাঙ্খিত ফল পাচ্ছি না। এছাড়া আমরা দেখছি যে স্বাস্হ্য খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ অনেক সময় খরচ হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পুরোপুরি খরচ না হওয়ার পিছনে কেন্দ্র থেকে রাজ্যগুলোতে বরাদ্দকৃত অর্থ দেরীতে পাঠানো কিংবা রাজ্যের সদর দপ্তর থেকে ট্রেজারিতে এবং স্বাস্হ্য দপ্তরে দেরী করে পাঠানোর ব্যাপারগুলো তো আছেই। কিন্তু যদি স্বাস্হ্য ব্যবস্হায় দক্ষতার ঘাটতি থাকে, প্রয়োজনীয় স্বাস্হ্য কর্মীর অভাব থাকে, পরিকাঠামোয় যদি যথেষ্ট বিনিয়োগ না হয়, সরকারি হাসপাতালগুলোতে অত্যাবশ্যক ওষুধ, টিকা ইত্যাদি কেনা না হয়, তবে গোটা স্বাস্হ্য ব্যবস্হাটাই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থের যথাযথ ব্যবহার করার ক্ষমতা থাকে না। বরাদ্দ অর্থ খরচ করতে না পারার কারণে কেন্দ্র রাজ্যগুলোকে আর টাকা দিতে চায় না, কিন্তু স্বাস্হ্য পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করে রাজ্যগুলোর খরচ করার ক্ষমতা বৃদ্ধিরও কোনো চেষ্টা করে না। কেন্দ্রীয় সরকারের এই ভূমিকা প্রসঙ্গে সেই প্রবাদের কথা মনে পড়ে-“যেহেতু শিশুটা অসুস্হ, তাকে আর খাবার দিও না।”
আমাদের পরিকল্পনাবিদরা এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে স্হির করলেন, যে অর্থ সরকারি ক্ষেত্রে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকছে তা দিয়ে স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। সরকার স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্প চালু করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিমা সংস্হাগুলোকে টাকা দেবে। নাগরিকরা ঠিক করবেন তাঁরা কোন সংস্হায় (সরকারি না বেসরকারি)বিমা করবেন এবং এইভাবেই তারা রাষ্ট্রীয় স্বাস্হ্য বিমা যোজনা (RSBY) বা আরোগ্যশ্রী বা অন্য কোনো স্বাস্হ্য বিমায় নথিভুক্ত হবেন। এইভাবেই সরকার তার দায়িত্ব পালন করবে। এখন কথা হচ্ছে এই ধরনের ভাবনা চিন্তায় কি কোনো সমস্যা আছে? রাষ্ট্রীয় স্বাস্হ্য বিমা যোজনা বা আরোগ্যশ্রী বা রাজ্য সরকারগুলোর যে কোনো স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্প (রাজ্য সরকারের এই বিমা প্রকল্পগুলোর নাম আবার মুখ্যমন্ত্রী পাল্টানোর সাথে সাথে পাল্টে যায়) খতিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন যে এইসব বিমা প্রকল্পগুলোতে কেবলমাত্র হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার খরচ বিমা সংস্হাগুলো মিটিয়ে দেয়, তাও পুরো খরচ নয়। রাষ্ট্রীয় স্বাস্হ্য বিমা যোজনায় বিমাকারিরা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করালে চিকিৎসার খরচ বাবদ বছরে সর্বাধিক ৩০০০০ টাকা পান, চিকিৎসার পুরো খরচ নয়। হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন সর্বাধিক ৩০০০০ টাকার অতিরিক্ত অন্য যে কোনো খরচ, হাসপাতলের বহির্বিভাগে চিকিৎসার খরচ, পরবর্তীকালে চিকিৎসকের ফি, প্রয়োজনীয় ওষুধ কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, এগুলোর কোনোটাই পাওয়া যায় না। অথচ দেখা গেছে ভারতবর্ষে চিকিৎসাজনিত ব্যয়ের ৭২% হচ্ছে বহির্বিভাগে চিকিৎসার খরচ, বিশেষত ওষুধের পিছনে খরচ। চিকিৎসার এইসব খরচের বোঝা যদি আমরা লাঘব করতে না পারি তবে আদপে আমরা কোনোরকম আর্থিক সহায়তাই প্রদান করছি না। এই ধরনের বিমা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে কিছু অংশের মানুষ হয়ত কিছু স্বাস্হ্য পরিষেবার সুযোগ পায়, কিন্তু চিকিৎসার সর্বনাশা ব্যয় ভার কমানো সম্ভব হয় না, সমাজের গরিব মানুষদের কোনোরকম আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া যায় না। আমাদর দেশে প্রতি বছর ৫০ মিলিয়ন মানুষ চিকিৎসা খাতে সাধ্যের বাইরে খরচের কারণে দরিদ্র হয়ে পড়ে। আমি আগেই বলেছি, আমাদের দেশে চিকিৎসাজনিত ব্যয়ের ৭০% আসে বেসরকারি খরচ থেকে, প্রকৃতপক্ষে ব্যয়ের ৬১% আসে ব্যক্তিগত খরচ থেকে, আর ৯% আসে স্বাস্হ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প থেকে। এই চিত্রটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে খারাপ। চিকিৎসাজনিত ব্যয়ের ক্ষেত্রে শুধুমা্ত্র সরকারি অর্থের যোগানের নিরিখে পৃথিবীতে আমাদের স্হান একদম নিচের দিকে কেবল তা নয়, ব্যক্তিগত খরচের নিরিখেও পৃথিবীতে আমাদের স্হান সবার উপরে। তা সত্ত্বেও আমরা এখনো আশা করি যে স্বাস্হ্য সংক্রান্ত সূচকের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ভাল স্হানে থাকবে। বস্তুত স্বাস্হ্য সংক্রান্ত সূচকের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের স্হান কেবলমাত্র শ্রীলঙ্কার চেয়ে খারাপ তা নয়, আমরা বাংলাদেশ, নেপাল ও আরো অনেক দেশের থেকে পিছিয়ে আছি এবং এতে কিন্তু অবাক হওয়ারও কিছু নেই।
আমরা প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবাকে অবজ্ঞা করে এসেছি। সবরকম স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্পেরই প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবার ব্যাপারে আগ্রহ নেই, কেননা সেক্ষেত্রে অনেক রোগের চিকিৎসাই বিমার অন্তর্ভূক্ত হবে, ফলে বিমাকারীদের দাবির পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং বিমা সংস্হাগুলোর মুনাফা খুবই কম হবে। অপরপক্ষে রোগের সংখ্যাকে সীমাবদ্ধ করে রাখলে বিমা কোম্পানিগুলোর মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ আরো বেড়ে যাবে। সেইজন্যই বিমা কোম্পানিগুলো প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবাকে বিমার অন্তর্ভূক্ত করতে চায় না। সরকার যদি প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবাকে শক্তিশালী না করে তবে স্বাস্হ্য পরিষেবার পরবর্তী দুই স্তরের (যথাক্রমে secondary এবং tertiary care) মান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি দেশে সুসংহত প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবা থাকে এবং তার সাথে ধারাবাহিক চিকিৎসারও বন্দোবস্ত থাকে, তাহলে প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবার সাথে দ্বিতীয় (secondary care) ও তৃতীয় স্তরের (tertiary care) স্বাস্হ্য পরিষেবার কার্যকরী যোগসূত্র স্হাপিত হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবার কেন্দ্রগুলো দক্ষ দ্বাররক্ষীর ভূমিকা পালন করবে। এই কেন্দ্রগুলোতে যত বেশি সম্ভব রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করা হবে এবং যতটা সম্ভব প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হবে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজন হলে প্রাথমিক স্বাস্হ্য কেন্দ্র থেকে রুগীকে জেলা হাসপাতাল বা অন্য কোন হাসপাতালে পাঠানো হবে। এখন যদি সরকারের এই ধরনের পারস্পরিক সংযোগ ব্যবস্হা না থাকে তবে রুগীরা বলির পাঁঠা হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্হ হতে বাধ্য হবে এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো দ্বিতীয় (secondary care) কিংবা তৃতীয় স্তরের (tertiary care) চিকিৎসার জন্য যে কোনো অংকের টাকা ধার্য করে বসবে। সেকারণে স্বাস্হ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে আমরা এমন একটা ব্যবস্হা চাই যেখানে প্রাথমিক স্বাস্হ্য কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, অর্থাৎ তিন স্তরের স্বাস্হ্য কেন্দ্রগুলো অত্যন্ত কার্যকরী ভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকবে। এই ব্যবস্হা নিশ্চিত করবে যে যারা গ্রাম বা শহরের প্রাথমিক স্বাস্হ্য কেন্দ্র থেকে সঠিক প্রাথমিক চিকিৎসা পাবে, তাদের অধিকাংশই ভবিষ্যতে সুস্হ থাকবে। চিকিৎসার জন্য যখন তাদের জেলা হাসপাতাল বা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন হবে, তখন তারা সেখানে যাবে এবং চিকিৎসা শেষে আবার প্রাথমিক স্বাস্হ্য কেন্দ্রে ফিরে আসবে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা ঘটে নি। যুক্তরাজ্যে জাতীয় স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পে (NHS) এই নীতি কিছুটা অনুসরণ করা হয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কাইজার পার্মানেন্টি নামে স্বাস্হ্য পরিষেবার একটা সংস্হা আছে, যা কিনা কিছু কিছু রাজ্যে স্বাস্হ্য বিমার সাথে সাথে স্বাস্হ্য পরিষেবাও প্রদান করে, তারাও এই নীতি অনুসরণ করে। কাইজার পার্মানেন্টির যে শাখা স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রদান করে তারা রোগ প্রতিরোধের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়, যাতে কিনা রোগী দ্রুত গুরুতর অসুস্হ হয়ে না পড়ে এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে রোগী তাদেরকে ছেড়ে চলে না যায়।
স্বাস্হ্যের ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে আর্থিক সাহায্যের উদ্দেশ্য হোলো নাগরিকদের স্বাস্হ্যকে ভাল রাখা, ভাদের অসুস্হ করে তোলা নয়। ভারতবর্ষে যদি প্রাথমিক স্বাস্হ্য কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল (অর্থাৎ secondary care centre) ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলোর (অর্থাৎ tertiary care centre) মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন শহয়ে যায়, তবে secondary ও tertiary care centre গুলো প্রত্যেক রোগীকে, রোগীদের স্বাস্হ্য বিমাকে ব্যাংকের ATM-এর মত ব্যবহার করবে এবং তাদের থেকে খুশীমত টাকা আদায় করবে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্হার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাই ঘটে চলেছে। আমাদের দেশে স্বাস্হ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার খরচ ও মানের ব্যাপার কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় আমাদের ভুগতে হচ্ছে। এছাড়াও বেসরকারি মেডিকাল কলেজের সংখ্যার বৃদ্ধিও আমাদের দুর্ভোগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বর্তমানে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আমাদের দেশের ক্রিকেট খেলার সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্হা BCCI-কে দুর্নীতিমুক্ত করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। আমি আরো খুশী হতাম যদি তারা মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়াকে (MCI) দূর্নীতিমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নিতেন, কেননা BCCI-এর চেয়ে MCI-তে দুর্নীতির কারণে ভারতের বেশি সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সেই কারণেই আমি মনে করি আমাদের দেশে স্বাস্হ্য ব্যবস্হায় আরো মৌলিক সংস্কারের দিকে আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন এবং সেই ব্যাপারে সবার এগিয়ে আসা দরকার।
সে কারণেই অধুনা বিলুপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের সবার জন্য স্বাস্হ্য সংক্রান্ত বিষয়ের যে উচ্চ স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল ছিল, তার কমিটি মিটিং-এ আমরা বলেছিলাম যে ২০১২ - ২০১৭ সাল-এর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কালে স্বাস্হ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ জিডিপি-র ১.৪% থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম ২.৫% করা উচিত। আমরা এ কথাও বলেছিলাম যে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্পগুলো যেমন-CGHS (Central Government Health Scheme), ESI (Employees’ State Insurance), RSBY (Rashtriya Swasthya Bima Yojna), বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিমা প্রকল্পগুলোকে জুড়ে দিয়ে বড় আকারের একটা স্বাস্হ্য সুরক্ষা প্রকল্প করতে হবে এবং সরকারও যেন তার রাজস্ব খাতে আয়ের থেকে আরো বেশি পরিমাণে অর্থ এই সুরক্ষা প্রকল্পে প্রদান করে। তাহলেই স্বাস্হ্য সুরক্ষার জন্য বড় আকারের অর্থ ভান্ডার সৃষ্টি হবে এবং সব ধরনের স্বাস্হ্য পরিষেবার জন্য, বিশেষত জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য আরো উন্নত মানের সুযোগ সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে। অনেকেই বলবেন, tertiary স্বাস্হ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন কি? সেটা কি খুব ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যাবে না? হ্যাঁ, সত্যিই তা ব্যয়সাপেক্ষ হবে। কিন্তু ধরুন, উড়িষ্যার কোনো এক যুবককে সাপে কেটেছে এবং তাকে বাঁচানোর জন্য হয় ভেন্টিলেটর অথবা ডায়ালিসিসের প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে কি আমরা বলব যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিষেবা (tertiary care) বলে এগুলো সে পাবে না? ধরুন একজন মহিলার সন্তান প্রসবের সময় কোনোরকম ত্রুটির কারণে জরায়ুতে ফুটো হয়েছে অথবা পরবর্তীকালে জননেন্দ্রিয়তে ভগন্দর (vesicovaginal fistula) হয়েছে, সেক্ষেত্রে কি আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিষেবা (tertiary care) বলে তাঁকে ফিরিয়ে দেবো? সুতরাং কিছু কিছু সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিষেবা (tertiary care) আছে যেক্ষেত্রে আমাদের নমনীয় হতে হবে, যেমন শিশুদের লিউকোমিয়া। অবশ্যই আমাদের সামর্থ্য সীমাবদ্ধ, শুরুতেই আমরা সব ধরনের রোগের চিকিৎসা এই স্বাস্হ্য সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনতে পারব না। সবার জন্য উন্নত মানের স্বাস্হ্য পরিষেবা (Universal Health Coverage, সংক্ষেপে UHC) পৌঁছে দিতে হয়ত আমাদের আরো এক কিংবা দুই দশক অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু UHC-এর বিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে বিশেষত সমাজের সবচেয়ে দুর্বলদের কাছে যেমন-গরিব, নারী ও শিশুদের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হোলো প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবা। যদি আমরা সেটা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে স্বাস্হ্য ক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরে ন্যায্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা ঠিকমত পরিকল্পনা করতে পারব এবং আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
একইসঙ্গে দক্ষ স্বাস্হ্য কর্মী বাহিনী তৈরীর জন্যেও আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে। সবার জন্য স্বাস্হ্যের সুযোগ কাগজ কলমেই থেকে যাবে যদি না আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের প্রয়োজনীয় দক্ষ স্বাস্হ্য কর্মী বাহিনী তৈরী করতে পারি। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য আমাদের ডাক্তার নির্ভর হওয়ার দরকার নেই। বস্তুত সামনের সারির বিশাল সংখ্যক স্বাস্হ্য কর্মী যাঁরা প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন, তাঁরা নার্স বা সামাজিক স্বাস্হ্যকর্মী (community health workers) যাই হোক না কেন, তাঁরা গ্রামে এমনকি শহরেও প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবার অধিকাংশ কাজগুলো করতে পারবেন। যদি মাঝেমধ্যে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তারও ব্যবস্হা করা যায়। মজার কথা হোলো, দেশের অর্থনীতিতে মন্দা চলছে বলে আমরা হা হুতাশ করি, অর্থনীতির হাল ফেরানোর জন্য আরো চাকরি সৃষ্টি হওয়া দরকার বলে মনে করি। অথচ আমাদের দেশে প্রচুর সংখ্যায় স্বাস্হ্য কর্মী কম। আমাদের দেশে দক্ষ স্বাস্হ্য কর্মী বাহিনী তৈরীর জন্য কেন বিনিয়োগ হচ্ছে না? কেন আরো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, সাধারণ ডাক্তার, নার্স, পেশাদার স্বাস্হ্যকর্মী, সামাজিক স্বাস্হ্যকর্মী তৈরীর জন্য বিনিয়োগ হচ্ছে না? এই উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ হলে কম বয়সীদের জন্য, বিশেষত মহিলাদের জন্য অনেক কর্মসংস্হান হবে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে প্রবীণদের তুলনায় নবীনেরা সংখ্যায় বেশি। ফলত, কাজের সন্ধানে শ্রমের বাজারে প্রতি বছর বিশাল সংখ্যায় কর্মক্ষম নবীন হাজির হয়। সেক্ষেত্রে যদি এই কর্মক্ষম নবীনদের ঠিকমত প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্হ্যকর্মী হিসাবে নিয়োগ করা হয়, তবে স্বাস্হ্য ক্ষেত্রে দক্ষ স্বাস্হ্যকর্মীর চাহিদা পূরণ করা যাবে এবং এই কর্মসংস্হান দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে সাহায্য করবে। কিন্তু এর জন্য রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত উপদেশ দেবেন যে সামজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রকৃত সম্পদ সৃষ্টি হয় না, কেবলমাত্র উৎপাদন শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমেই তা সৃষ্টি হয়। কিন্তু স্বাস্হ্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে দক্ষ স্বাস্হ্যকর্মী সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র কর্মসংস্হান ও ভোগব্যয়ের বৃদ্ধিই ঘটে না, মানবজীবনের মান ও উন্নত হয়; ফলত তাদের উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং এই ভাবনাগুলো আমাদের দেশের অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে প্রোথিত করতে হবে। তা করতে হলে দেশের সব অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে হবে।
আমরা বলেছি দক্ষ স্বাস্হ্যকর্মীর যোগান বাড়াতে হবে। এরপর বলেছি যে, অত্যাবশ্যক ওষুধপত্র ও রোগ নির্ণায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষার খরচ যদি সরকার বহন করে, যা কিনা দেশের জিডিপি-র ০.৫%, তাহলে চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয়ের অঙ্কটা যথেষ্ট পরিমাণে কমানো যাবে। এই পদক্ষেপগুলো নিলে সরকারি স্বাস্হ্য ব্যবস্হার প্রতি লোকেদের আস্হা বাড়বে। তামিলনাড়ুর মডেল অনুসরণ করে রাজস্হান সরকার যখন বিনামূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধপত্র সরবরাহ শুরু করল, সরকারি প্রাথমিক স্বাস্হ্য কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ নেওয়া লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তার মানে সরকারি স্বাস্হ্য ব্যবস্হার প্রতি লোকেদের আস্হা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এরপর আমরা বললাম যে বেসরকারি স্বাস্হ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর যথাযথ নজরদারি ব্যবস্হা চালু করা হোক, নানাধরণের স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্পগুলোর বদলে সারা দেশে একটাই স্বাস্হ্য বিমা প্রকল্প চালু করা হোক, এমন একটা চুক্তি করা হোক যাতে বেসরকারি স্বাস্হ্য পরিষেবা সংস্হাগুলো দায়িত্বপূর্ণ ভাবে ও দায়বদ্ধতার সাথে সরকারি স্বাস্হ্য পরিষেবা সংস্হাগুলোর পরিপূরক হিসাবে কাজ করে।
আমরা বলেছি, প্রথমে সরকারি স্বাস্হ্য পরিষেবা ব্যবস্হাকে শক্তিশালী করতে হবে। শুধুমাত্র প্রাথমিক স্বাস্হ্য কেন্দ্রগুলো নয়, জেলা হাসপাতালগুলোকেও শক্তিশালী করতে হবে। জেলাগুলোতে আরো নতুন নতুন মেডিকাল কলেজ, নার্সিং কলেজ স্হাপন করতে হবে। এদেরকে প্রশিক্ষণের মূল কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে এরা secondary পরিষেবা এবং কিছু পরিমাণে tertiary পরিষেবা দিতে পারে।
আমরা সরকারি ও বেসরকারী ক্ষেত্রের অংশিদারিত্বের (Public Private Partnership, সংক্ষেপে PPP) কথা বলেছি। কিন্তু PPP মানে বেসরকারি ক্ষেত্রের মুনাফা নয়। PPP-র মানে হওয়া উচিত সাধারণের মঙ্গলের জন্য সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রের অংশিদারিত্ব। PPP-র ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হোলো-প্রথমে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা কর, তারপর ব্যাখ্যা কর এই ব্যবস্হার মাধ্যমে জনগণকে কি কি পরিষেবা দেওয়া হবে এবং কি ভাবে এই ব্যবস্হার দায়বদ্ধতা ঠিক করা হবে। PPP-র ব্যাপারে আমাদের সুপারিশে সবদিকগুলোই বিবেচনা করেছি। আমরা বলেছি যে স্বাস্হ্য পরিষেবা ক্ষেত্রের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় স্তরেই, শক্তিশালী নজরদারী ব্যবস্হা থাকা দরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে, বাস্তবে এই সুপারিশগুলোর কোনটাই মানা হয় নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি কেন্দ্রীয় সরকার বলছে যে, এখন থেকে স্বাস্হ্যের বেশিরভাগ বিষয়ের দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলোকে নিতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার শুধু পরিকাঠামো আর শক্তির দায়িত্ব নেবে। সামজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের বেশিরভাগ অংশের দায়িত্ব কেন্দ্র রাজ্য সরকারগুলোর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি অর্থ কমিশন সুপারিশ করেছে যে, এযাব্ৎ কেন্দ্র তার কর বাবদ সমগ্র আয়ের যে ৩২% রাজ্যদের মধ্যে বন্টন করত তা ১০% বাড়বে। অর্থাৎ, কেন্দ্রের কর বাবদ সমগ্র আয়ের ৩২% পরিবর্তে ৪২% রাজ্যদের মধ্যে বন্টন করবে। কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ কমিশনের ঐ সুপারিশ গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রাজ্যগুলোর আয় বৃদ্ধির ব্যাপারটা খুবই কাল্পনিক ও গোলমেলে। কেননা, পরিকল্পনা খাতে রাজ্যগুলো কেন্দ্র থেকে যে আর্থিক সহায়তা পেত তা অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রকৃত বৃদ্ধি ১০% নয়, প্রায় ৩% হয়েছে। কিন্তু এই প্রান্তিক বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও কোথাও কি এমন নিশ্চয়তা আছে যে রাজ্যগুলো এই অতিরিক্ত অর্থ স্বাস্হ্য পরিষেবার জন্য ব্যয় করবে এবং যদি তা করেও তবে কি সেই অর্থ রাজ্যগুলোর প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবাকে শক্তিশালী করবার জন্য ব্যবহৃত হবে? আমাদের কাছে তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। স্বাস্হ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে একটা কাঠামো আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন। প্রতিটি রাজ্যের নিজেদের জন্য আলাদা করে কোনো কাঠামোর প্রয়োজন নেই। যুক্তরাষ্ট্র্র্রীয় কাঠামোতে রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থাকা ভাল, কিন্তু এর ফলে উন্নত রাজ্যগুলো কেন্দ্র থেকে পাওয়া অনুদানের সদ্ব্যবহার করে স্বাস্হ্যের ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যাবে আর গরিব রাজ্যগুলো ক্রমশ পিছু হটতে থাকবে। ফলে স্বাস্হ্য ক্ষেত্রে রাজ্যে রাজ্যে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। এছাড়া স্বাস্হ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীয় কাঠামোর বদলে রাজ্যে রাজ্যে পৃথক কাঠামো থাকলে এক রাজ্যের লোক অন্য রাজ্যে গেলে পরিষেবা ভোগের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেবে। একজন ভারতীয় হিসাবে দেশের যে কোনো জায়গাতেই সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবার সুযোগ (যা আমাকে দেওয়া হবে) তা সমান ভাবে পাওয়া উচিত। আমি যদি চেন্নাইতে জন্মাই, হায়দ্রাবাদে লেখপড়া করি, দিল্লীতে চাকরি করি এবং কোনো কাজে মুম্বাই যাই, তখন কিন্তু এটা নিশ্চিত থাকা দরকার যে সব জায়গাতেই আমি এবং আমার পরিবার একই ভাবে সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবার সুযোগ পাব। এটা কখনোই হওয়া উচিত না যে তেলেঙ্গানা রাজ্যের অধিবাসী হয়ে আমি রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করা মাত্র সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাব। এসব কারণেই আমাদের প্রয়োজন একট সুচিন্তিত সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্প, যা কিনা জাতীয় প্রকল্পের কাঠামোর মধ্যে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত থাকবে, অথচ তার মধ্যে রাজ্যভিত্তিক বৈশিষ্ট্যগুলো গ্র্র্র্র্হণের সুযোগ থাকবে। রাজ্যভিত্তিক বৈশিষ্ট্য বলতে আমি বোঝাতে চাইছি যে বিহার কালাজ্বরের ব্যাপারে বিশেষ কোনো পরিষেবা চাইতে পারে, কেরালা হৃদরোগের ব্যাপারে বিশেষ কোনো পরিষেবা চাইতে পারে, সেটা মেনে নিতে কোনো অসুবিধে নেই। অর্থাৎ, সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পে রাজ্যভিত্তিক বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণ সম্ভব, কিন্তু কাঠামোতে যতদূর সম্ভব সাযুজ্য বজায় রাখতে হবে। এই প্রকল্পের কাঠামো তৈরীর ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারি অর্থের যোগানের বিষয়টার দিকে নজর রাখতে হবে, কারণ অর্থ যোগানের নিশ্চয়তার ওপরই সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রকল্পের মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রকল্প তৈরীর সময় প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিষেবাকে গুরুত্ব দিতে হবে, কেননা এই পরিষেবাই সমগ্র স্বাস্হ্য পরিষেবার ভরকেন্দ্র। সামাজিক সাম্য ও সংহতির আদর্শকে প্রকল্পের মূল নীতি হিসাবে গণ্য করতে হবে, কেননা এই আদর্শ ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্হ্য পরিষেবা কার্যকরী হওয়া অসম্ভব। না হলে, প্রত্যেকে যদি শুধু তার নিজ নিজ স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে, তাতে দেশের বিশাল অংশের মানুষের কাছে এই প্রকল্প কোনোরকম ন্যায্যতা পাবে না। মনে রাখতে হবে স্বাস্হ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে শুধুমাত্র গরিবরাই নয়, গরিবী সীমার ওপরে থাকা মানুষদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। মধ্যবিত্তশ্রেণীর অধিকাংশ লোকই চিকিৎসা-ব্যয়, বিশেষত বিপর্যয়কারী ব্যয় বহন করতে পারেন না।