গাঢ় কালচেবেগুনি গোল গোল ফল। গাছে দিব্যি ঝুলে আছে থোকায় থোকায়। এদিকে নিচে আমি জুলুজুলু চোখে চকচকে লোভ দিচ্ছি, হাভাতে, হাত পাচ্ছিনা, এমন ধুকপুকে সোহাগী জারুন অথচ এই বুঝি কোন এক অলিখিত গল্পে উপসংহার লেখা হবে চোরা মুসবিদায়, ওমনি টুপটাপ নিটোল কালোঝাঁক মগডাল থেকে ঠ্যাং নামিয়ে উড়ে আসবে খুশিবিস্তারে...'ফলসা' নামের অনুমোদনে। বড় প্রিয় সে নাম। তুরীয় আকর্ষণ। ইদানিং তাকে খুঁজি, মা'কে লুকিয়ে চুরি করা আমূলস্প্রে'র মত স্মৃতিস্বাদে লেগে থাকা সে ঘোরতর প্রাংশুকে। অথচ সে অনামী। প্রচারমাধ্যমে ডানা মেলার আগেই ঝুপ করে জবজবে অন্ধকার নেমে গেছে সে পালকে। তাই ব্রাত্য।
আমিও এমন ফলসা হলাম, একদিন, অজান্তে। তখন ক্লাস সিক্স। প্রথম দিন। নতুন স্কুলে প্রথম পরীক্ষা আর রেজাল্ট এর দীর্ঘ গোপন আঁতাত বইদর্শনের ঘষাকাঁচ সুলভ প্ৰিঅ্যাম্বেলে নখ রেখেছি সবে। হঠাৎ চারিদিকে বেশ একটা ফিসফাস ব্যাপার। আমিও উৎসুক। কিন্তু যেই কানযুগল, সারি সারি কুচি শব্দের নৈবেদ্য গ্রহণে রাজি, ওমনি সব চুপচাপ। মেঝেতে পিঁপড়ে শুঁড় দোলালেও বুঝি তার শব্দ শোনা যায়। বেশ মাথা চুলকে, পেন্সিল চিবিয়ে ফিসফাস কত্তাদের দিকে করুণ তাকাচ্ছি তো আবার যে কে সেই। অগত্যা এ বালা-মুসিবতের শাপ-শাপান্ত করে মন দিয়ে শেষ পৃষ্ঠায় কাটাকুটিতে রাবীন্দ্রিক ছবি আঁকায় মন দিই।
দিন দুয়েক এমন চলার পর এক বন্ধুর আচমকা ঘোষণা - "টিচার্স রুমে তোকে নিয়ে কথা বলছে। আমরা আসার সময় শুনেছি। এই তোদের হঠাৎ করে এমন পাত্তা দিচ্ছে স্কুলটা। ভালো সাজার জন্য।" আমি থ'। কথার ভূমিকা, সূচনা, প্রসঙ্গ সবই মাথার উপরে রাইট অ্যাঙ্গেলে বেবাক হাঁ, যাকে বলে 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়ম'।
বন্ধুটি আবার বোঝানোর দায়িত্ব নিয়ে বলে, "তোদেরকে প্রচার দেওয়ার জন্যই তো তোকে এবার ফার্স্ট করেছে। নইলে এতদিনে এ স্কুলে তো কেউ হয়নি। আমার মা বলেছে। বাকিরাও বলছে। জিজ্ঞেস করে দ্যাখ।"
এবার আমার মোটামাথায় হাফ ঢোকা 'তোদের' এর সংজ্ঞা জানতে চাওয়ার আগেই সে বন্ধুটি বেশ জোর গলায় বলে, "তোরা যারা সবেতেই পেয়াঁজ-রসুন খাস!"
সেদিন প্রথম বুঝি, পুজো আর ঈদের বাইরে ধর্মের এমন কুলীন-নাকউঁচু-লঘু-গুরুর ষষ্ঠ বিভাজন আছে। সেই প্রথম মনে হয়েছিল ফলসা আর আম এর মত 'আমরা-ওরা'ও কেমন যেন ঘরপালানো ছেলের মনে লুকিয়ে বিকেলের আকাশ দেখে কোন কোন দিন, মাদুর পেতে তাকায় শূন্যে: একটা চিলের গা ছুঁয়ে থাকা গোলাকার পথে বোনা মুক্তিনিশান; তারপর এক পা দু' পা করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে চুপচাপ, লক্ষ্মীর ঘট নেড়ে খোঁজে সিকিপয়সা আর হঠাৎ হঠাৎ পালায় মুক্তিখোঁজে।
এরপর স্কুল ছেড়ে কলেজ থেকে চাকরি - মাঝেমধ্যে কেউ কেউ হারিয়ে পাওয়া জিনিসের মত মনে করিয়েছে ফলসাকিসিম হয়তোবা, সতর্কে-অসতর্কে।
"তোমাকে দেখে বাঙালি তো মনে হয়না" (মুখে মাছ-ছাপ যে কেন নেই!) "তুমি মুসলিম তো বাঙালি কী করে?!" ( বোঝো, ভাষা-ধর্ম ঘেঁটে এক্কেরে বিজেপির আইটি সেল) "তুমি বিরিয়ানি খাওয়াবে কবে?!"( স্টেপল ফুড বিরিয়ানি নাকি! আগে অমলেটটাই বানাতে পারি কিনা দ্যাখ! ওভার-কনফিডেন্সে দেখছি ৫৬ ইঞ্চি) "এথনিক ডে'তে বোরখা পরবি নাকি?"( আজ্ঞে, জানেনই তো বোরখা ফলসাদের 'জাতীয় পোশাক') এগুলো অবিশ্যি ঝোপ-ঝাড় থেকে আঁশ-ফলের বাজারে খুঁজে দশ টাকা শ' দশার মহার্ঘ্য উত্তরণ। শুনে বুঝে আত্তীকরণ। তবে এসব হাতে গোনা 'বন্ধু' আমায় ফলসা ঠাউরালেও বাকিদের সাথে দিব্যি মিক্সডফ্রুট আড্ডা হয় দেদার।
ছেলেবেলার সে ফলসা গাছের মত এখনও মায়া আঁকড়ে জেগে থাকে কিছু বনেদীবাড়ি। মাথা উচুঁ করা নাজনীন, মোহময়ী ইতিহাসের পরতে পরতে তার মুহব্বত। যবনিকা পড়ে গিয়েও কোন এক ফাঁকে ধরা দেওয়া ক্ষীণ আয়ু। গাছ নেই, ফুল-পাতা শূন্য তবু শেকড়ের কোনো এক ভাঙা মূলটপের মত লেজুড় সে 'বড়বাড়ি'র ইতিহাস। যে জমিদার জমানায় কেউ বিলেত ফেরত কেউবা ডাক্তার-প্রফেসর, সে জমানা ক্রমে বেগানা হতে হতে ধুলো বালি, বালি ধুলো। জমিটুকু সম্বল করে বংশপরম্পরায় বনেদিয়ানা দেখাতে দেখাতে বিস্মৃত হয়েছে শিক্ষা-সাবেকিয়ানা। মেয়েরা হাঁড়ির তলানিটুকু খেতে খেতে বড় হয়েছে অভ্যেসে, গড়পাঠ শেষে তারপর ঢুকে গেছে বিয়ে প্রতিষ্ঠানে। সাবেক ইতিহাসের গায়ে মরচে আরেকটু ঘন হয়ে গেলে তারা ধীরে ধীরে খোঁজ নিয়েছে 'পেশা'র। এ যেন অশীতিপর বৃদ্ধা, রাস্তাটুকু পার হতে উন্মুখ, অথচ অকৃত্রিম দীর্ঘ সময় ধরে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে ফাঁকা পলিথিন, শ্লথ ভঙ্গুর পলে।
যে ফলসা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতাম ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলোকে খুশি মাখিয়ে, কেউ বুঝি খুব শক্তিমান, গাছটা ধরে বেশ ঝাঁকাল, কেউ যদি ডালে উঠল...আরও কত কী, সে গাছের আশেপাশে অনেকেই জড়ো হতো ছেলেমেয়ে, নানা সাইজের। তাদের কয়েকজনের মুখ চিনি, কয়েকজনের চিনিনা; শুধু জানি, ওরা সবাই আমার মত ফলসাবাঁধনে সমবেত। যে মাসি মায়ের সাথে কাজে হাত লাগায়, রোজ সকালে তিন বাড়ি বাসনমাজা, ঘর মোছার পর একগা ব্যাথা নিয়ে ঘুম ভাঙে যার, সে আর তার চার ছেলেমেয়েও তো ফলসা খেতে উঁকি মারে বনে-বাদাড়ে, যাতায়াতের পথে। হ্যাঁ, এ ঘোর কলিকালেও চার ছেলেমেয়ে। বোধ হয় ভেতর ভেতর একটা ভয় বেঁচে-বর্তে খাটে হেলান দিয়ে শোয় আর বেশ হুকুম করে জানান দেয়, মেয়ে হলে যদি গাছ ঝাঁকাতে না পারে, যদি গাছে উঠতে না পারে আর যদিওবা উঠল গায়ের জোরে, ওমন 'অলক্ষুণে' মেয়ের একমাত্র জীবনের উদ্দেশ্য বিয়ের তোড়জোড়ে জল ঢোকার পাইপের মুখ যে কেটে দেওয়া হবে ন্যুব্জমনে, অতএব যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, গাছ ধরে টান থুড়ি ছেলে আনান। আমি সে মাসিকে বলে'কয়ে মেজ আর ছোট মেয়ে দুটো'কে নিয়ে এলাম নিজের পড়ার টেবিলে। বেশ কিছুদিন লজেন্স-চকোলেট খাইয়ে যদিওবা বসল,পরীক্ষা যেদিন নেব বললাম তারপর থেকে তাদের সাক্ষাৎ, ঈশ্বরদর্শন সমান। মাসিকে খুঁচিয়ে জানতে পারলাম যে মক্তবে (পাড়া গাঁয়ের ইসলামিক টোল, যেখানে কোরআন এর আগে প্রাথমিক শিক্ষাস্বরূপ আরবী অক্ষর, আমপারা পড়ানো হয়) গেলে মাঝেমাঝে কোনো বাড়িতে খতম (কোরআন পড়ে শেষ করা) পড়াতে ডাকে, তখন লাড্ডু মিষ্টি পাওয়া যায়, কপাল ভালো হলে বিরিয়ানিও জোটে আর এমনি খালা ডাকলে পড়িয়ে উল্টে পরীক্ষা নেয় তো যাব কেন! স্কুুুলে গেলে মাস্টারও বকে। অতএব ঠেলেঠুলে যা হলো বিদ্যে, তাকে তেলাকচু জঙ্গলের সারগাদায় ফেলে উপসংহারে বিয়ের পিঁড়ি ধরে টানাটানি। আম এর লোভ দেখালাম তবু সাহস করে ফলসা ছেড়ে কিছুতেই এগোলো না মেয়েদু'টো।
তবে বাড়ির উল্টোদিকেই যে কাকুকে ভ্যান চালাতে দেখেছি গত কুড়ি বছর, সে তার মেয়েকে দিব্যি ফলসা, আম সবই ঘুরে দেখিয়েছে। সদ্য অঙ্কে মাস্টার্স শেষ করে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিঁড়ি ভাঙা ধাপে।
ফলসা কুড়োনো শেষ হলে কোঁচড়ে পুরে নিতাম জন্মান্তরখুশি। সে সামলে ক্ষুদি ক্ষুদি পায়ে ফিরতাম বাড়ির পথে, খিজির নির্দেশক। বারান্দায় গোল হয়ে পা'দুটোকে সামনে ছড়িয়ে কোঁচড় থেকে বের হতো, একে একে, বহু মেহনতী রতন। দীর্ঘ বাক্যের মত রচিত, অক্লান্ত, অথচ দাঁড়ি-কমাহীন সে পরিশ্রমের প্রতি পরতে পরতে তারা আমার ইন্দ্রিয়-আবেগের মর্ম স্বরূপিণী। রোদের সুতো তাদের গায়ে লুকোচুরি খেলত, অনিয়মে, বেঁকেচুরে আর চকচকে রেখায় কখনো কখনো ঠিকরে পড়ত রূপের খোলস। তখন অপলক চেয়ে দেখা সে সৌন্দর্যরেখা, মেদবর্জিত রুবারু। তাকে ভয়ে, বুকে শিরশিরানি চেপে চকের শব্দে বন্ধ করতে হয়না চোখ, আচমকা আড়ালে, লুকোতে হয়না মুখ, পর্দার ঠোঙায়। সে দিব্যি রাজি পাড়ি দিতে, নামী-অনামী বিদ্রোহে মাথা কুটে অপারগ। আমার সেসব ফলসাকিসিম তখন স্বপ্নিল....সংহিতা....মাশরুরা।