অদ্ভুত লাগে, ভারতের সঙ্গে এই মিলটা খুবই অদ্ভুত লাগে। আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া উনসত্তর বছরের পুরোনো দুটো টুকরো; সামান্য প্ররোচনায় তাদের একটার দিক থেকে অন্যটার দিকে ঘৃণা আর ক্রুরতার ছোঁড়াছুঁড়ি দেখে আমি উত্তরোত্তর হতাশ হয়ে পড়ছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টুকরোগুলো পাথর হয়ে উঠেছে আর তাদের চাপে কেই বা গুঁড়িয়ে না যাবে !
তবে ভারতের সঙ্গে এই সাদৃশ্যটা খুবই অদ্ভুত। অমিতাভ বচ্চন যখন হসপিটালে, তখন আমরা তাঁর সেরে ওঠার জন্য প্রার্থনা করি; রণবীর কাপুরের ছবি হিট করলে নীতু আর ঋষি-র চেয়ে আমাদের বেশী গর্ব হয়; আমরা কোনদিন অস্বীকার করি না কিশোর আর রফির গলার মত আবেদন আর কেউ আনতে পারেন না; তাদের বিষয়ে সবাই একমত যে তাঁদের নিজেদের গানের জগতের ছায়া আমাদের ওপরে পরে না; যদি বাইরের কারুর সঙ্গে কথা বলতে হয়, তখন শুধু এই ‘পরদেশি’ দের আমরা ‘দেশি’ শ্রেণীতে রাখি; তাঁদের স্তম্ভে আমাদের ইতিহাস লেখা থাকে, আমাদের ভাষায় তাঁদের শিকড় রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে এই মিলটা আরও বেশি অদ্ভুত। পিঠোপিঠি ভাইবোনের মত আমরা পরস্পরের প্ররোচনায় উত্তেজিত হচ্ছি, মারামারি করছি। শেষ অবধি পরস্পরের প্রতি আচরণে আমরা একই মাত্রায় আবেগপ্রবণ আর অধৈর্য হয়ে পড়ছি, “দ্যাখ ! তোরা কাশ্মীরে কি করেছিস !’ ‘আর তোরা বালোচিস্তানে কি করছিস !’ ‘তোরা উরিতে আমাদের আগে আক্রমণ করেছিস !’ ‘আর তোরা বুঝি কার্গিলের কথা ভুলে গেছিস ?’ ‘তুই আগে শুরু করেছিস !’ ‘না, তুই আগে করেছিস !’
অনাথ আশ্রমে পালিত শিশুদের মত, আমরা অনুভব করি আমরা মুক্ত, আমাদের অধিকার আছে কিন্তু কি ভাবে সেটা ব্যাবহার করতে হয় আমরা জানি না। মুসলিমরা গোরুর মাংস খাওয়ার কারনে খুন হলে ওরা সেটাকে পাত্তা দেয় না; রমজান মাসে ইফতারের আগে খাবার খেয়ে নেওয়ার কারণে খ্রীষ্টান আর হিন্দুরা নির্যাতিত হলে আমরাও চোখ বুঁজে থাকি। আমরা বলি ওরা কাশ্মীর ধ্বংস করছে, কাশ্মীরীদের স্বাধীন হওয়ার (অথবা অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার !) অধিকার আছে, কিন্তু আমরা কিভাবে বাংলাদেশের গলা টিপে ধরেছিলাম- সংখ্যাগুরু যেখানে বাংলাভাষী তেমন একটা দেশ কেন উর্দুকে জাতীয় ভাষা বলে মেনে নেবে না !- সেকথা আমরা ভুলে যাই। আমরা কখনোই সে বিষয়ে কথা বলি না, বলি কি ! নাকি বড্ড তাড়াতাড়ি আশা করে ফেলছি বোধহয়।
আমি যখন গত দশ বছরে আমার সবচেয়ে হাসিখুশি দিনরাত্তিরগুলোর কথা ভাবি, তার অর্ধেকের বেশিই সীমান্তের ওপারের ভাইবোনেদের কাটানো; একসঙ্গে খাওয়া, গান শোনা, রাজনীতির কথা আলোচনা, হাসি, গল্প আরও কতকিছু; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল তার মধ্যেও যে সীমারেখা আমাদের বিভক্ত করে রেখেছে তার বিরুদ্ধে একটা তীব্র চাপা প্রতিবাদ আমরা টের পাচ্ছিলাম।
এখন এই কথা ভাবলে মনে হয় ভারতের সঙ্গে এই মিলটা আদৌ অদ্ভুত নয়। আমাদের চিরপ্রণম্য যে পিতা বা প্রভু, সেই মহাশক্তি যা আমাদের শাসন করে, সেই ‘পশ্চিম’ হল আমাদের অদৃশ্য অভিভাবক, আমরা প্রতিনিয়ত যাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে চলেছি কিন্তু যিনি কোনওদিনই প্রকৃত অর্থে আমাদের ভালোবাসেন নি। আমাদের পরস্পরের জন্য যদি সত্যি বলতে যে শুধু আমরাই আছি, সেইটা স্বীকার করতে আমাদের অদ্ভুত এক অনিচ্ছা।
আশ্চর্য এটাই যে সুদুর অতীতে নেওয়া এক সিদ্ধান্তের বোঝা আমরা বয়ে চলি; যে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আলাদা একটা সামাজিক-রাজনৈতীক পরপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয়েছিল, যেখানে একজন তৃতীয় ক্রুর শত্রুপক্ষ এটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল যাতে আমরা পরস্পরকে শত্রু / আক্রমণকারী হিসেবেই দেখি আর হ্যাঁ, আমরাও সেটাই করে চলেছি এখন পর্যন্ত। যেটা অবাক করে সেটা হল আমাদের সামনে পড়ে থাকা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার দিকে আমরা চোখ বুঁজে থাকি আর আমাদের যাবতীয় রাগ-হতাশা-বিষাদ আমাদের কাছে শত্রু হয়ে দেখা দেয়।
সত্যি বলতে কি, আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অদ্ভুত ব্যাপার হল আমাদের ঘন ঘন চেহারা (ভূমিকা) বদলানোর প্রবণতা। বিশ্বের কাছে বেশির ভাগ সময়ে, আমরা সহোদর ভাই-বোনের মত; সারাক্ষণ বাবার নেকনজরে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে বাবা বেড়াতে নিয়ে যায় কি একটা খেলনা কিনে দেয় কি আরো ভালো হয় যদি হাতখরচের পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে দেয়। আর বাকি সময়ে আমরা বিবাহবচ্ছিন্ন দম্পতির মত, একসঙ্গে থাকছি, সারাক্ষণ পরস্পরের পেছনে লাগছি, পরস্পরকে দোষারোপ করছি যে কার জন্য একসঙ্গে থাকা যাচ্ছে না, কিন্তু কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছি না যে আমরা আর একসঙ্গে নেই আর সেইমত সমঝোতাতেও আসতে পারছি না। মনে হয় যেন আমাদের ভাগাভাগির ক্ষত এখনও এত জীবন্ত, এত যন্ত্রণাদায়ক যে আমরা যে ছেড়ে এসেছি তা ওরা মেনে নিতে পারে না, আর ওরাই যে আমাদের ছেড়ে আসতে বাধ্য করেছে আমরাও এটা মেনে নিতে পারি না । এইরকম একটা ক্ষেত্রে আমরা শুধু এই ভেবেই শান্তি পেতে পারি যে অন্যজনও আমার মতই আহত হয়েছে; সর্বপ্রকারে সেই চেষ্টা করাই এখন আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।
আজ আমি পড়লাম যে ভারত দাবী করেছে যে তারা পিওকে-তে একটা সার্জিক্যাল অ্যাটাক করেছে। কথাটা হাস্যকর। তক্ষুণি আমি কতগুলো একইরকম হাস্যকর পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াও দেখলাম। অনেকেই অনৈতিক কাজ করছে, কেউ এও যে বলছে সীমান্তের ওপারের গণহত্যার নায়কদের কাছ থেকে আর এর চেয়ে বেশি কি আশা করা যায়! হঠাৎ করে যেন সবাই নিজেদের রাজনীতিকদের গৌরবময় চরিত্রের প্রতি খুবই ক্ষমাপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। এটা সত্যিই খুব অদ্ভুত যে অন্যের দিকে আঙুল তোলার সময় কত তাড়াতাড়ি আমরা ভুলে যাই যে দুদিকেই সরকার কত ঝামেলার মধ্যে আছে।
আমি নিশ্চিত যে এই খবরটা একমাসের মধ্যে আমার মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু আমার মাথা থেকে যেটা বেরয় নি সেটা হল যুদ্ধপরিস্থিতি এড়াতে একটা ক্রিকেট ম্যাচ উপলক্ষ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি (Head of State) দিল্লীতে এসেছেন; কিম্বা দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা কমাতে একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ তাঁর পাকিস্তানি সহরাজনীতিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন; কিম্বা সেই সময়ের কথা যখন সৌরভ গাঙ্গুলী স্বীকার করছেন আক্রামের থেকে বড় বোলার আর হয় না; বা যখন সোয়েব মালিক সানিয়া মির্জাকে বিয়ে করছেন; বা সেই সবচেয়ে সুন্দর রাজনৈতিক মিলনের ছবি যেখানে ওয়াগা সীমান্তে দু দেশের রক্ষীরা হোলি উপলক্ষে আলিঙ্গনে বেঁধেছেন পরস্পরকে। আমার মনে হয় এটা সম্ভব এই কারণেই যে আমাদের মধ্যে অনেকেই শান্তি চায়, আমরা তার আশাতেই থাকি কিন্তু অন্যেরা যুদ্ধ চায়।
আমার মনে হয়, আমি বলতে চাইছি যে, ২০ বছর পরে উরি পাঠ্য বইয়ের একটা ঘটনামাত্র হয়ে থাকবে। আমাদের সংকলিত ইতিহাসের পাতায় এটা আর একটা সেইরকম সময় হিসেবে চিহ্নিত হবে যখন ভারতের সঙ্গে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ প্রায় ‘গরম’ হয়ে উঠেছিল। আমার কাছে এটা হবে আমার ভারতীয় বন্ধুদের চিনে নেওয়ার আর একটা সুযোগ (এবং উল্টোটাও)। আমার বুড়ো কাকার কছে এটা শুধু মাত্র আর একটা সেইরকম ঘটনা, পাকিস্তানের ব্যর্থতার সময় একটু মন ভালো করার জন্য যে বিষয়ে আলোচনা করে সান্ত্বনা পাওয়া যায় এই ভেবে যে দেশভাগটা হয়েই সবচেয়ে ভালো হয়েছে আর ভারতকে ছেড়ে আমরা ভালোই আছি।
কিন্তু যেটা কখনই ‘আর একটা ঘটনামাত্র’ হবে না, সেই কথাটা আমরা কেউ খেয়াল করি না। ঘটনাটা হল যে আমরা এখন বিচ্ছিন্ন আর সেই বিভাগটা আমাদের দুজনের কাছেই যন্ত্রণাদায়ক। ঘটনা হল একসময় যেখানে দুপক্ষের মধ্যে ঐক্য ছিল, পারস্পরিক গর্বিত হওয়ার মত কিছু বিষয় ছিল, এখন সেখানে শুধুই ঘৃণা। ঘটনা হল আমরাই একটা বাইরের শক্তি কে এই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়েছি এবং নিজেরাই তাদের শিকার হয়ে পড়েছি। আর ঘটনা হল এটাই যে আমরা নিজেদের যতটা ভাল করে জানি ততটা আর কেউই জানে না কারণ একসময় আমরা একটি অস্তিত্বই ছিলাম।
একটা কথা ভেবে ভাল লাগছে যে আমি যখন সীমান্তে ওপারে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমাদের সরকারের এই নিজেদের সর্বশক্তিমান দেখাবার প্রবণতা নিয়ে আমার উদ্বেগের কথা লিখলাম, সে লিখল, ‘ওরা যাই করুক না কেন আমি সবসময়ই তোমাকে ভালোবাসব’। এটা একধরণের স্বস্তি যে কুড়ি বছর পরে তুমি যদি পাঠ্যবইয়ের বাইরে এসে তোমার ধর্মগ্রন্থের দিকে তাকাও, তোমার এটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগবে না যে তারা একটাই বাণী প্রচার করতে চাইছে, একটামাত্র বার্তা আমাদের মন দিয়ে অনুসরণ করতে হবে আর সেই বার্তাটা হল ভালোবাসা।
আলিজাই জাফর ইসলামাবাদের বাসিন্দা, একজন অ্যাক্টিভিস্ট। অনুমতিক্রমে ব্লগটি অনুবাদ করেছেন অনিকেত পথিক।