নবারুণ ভট্টাচার্য এবং তার আটটি আখ্যানের সন্মিলিত ঘোষণা - "অমানবিকতা ও তৎসংশ্লিষ্ট আবশ্যিক যে বুজরুকির সার্কাসের মধ্যে আমরা রয়েছি তার সঙ্গে কোনোরকম আপোষ অসম্ভব।"
আমি এই আপোষহীন লেখকের আটটি আপোষহীন আখ্যান থেকে দুটি বেছে নিয়েছি কিছু কথা বলার জন্য।
মানুষ নবারুণের থেকেই লেখক নবারুণের আত্মপ্রকাশ। তাঁর এই লেখক সত্তাটিকে চিনলে, তা আংশিক হলেও, এই আপোষহীন মানুষটিকে চেনা যাবে। এমন মানুষ আর এমন লেখক এমন একাকার হয়েছেন - পাঠকদের অভিজ্ঞতায় এমনটি আর আছে কিনা বলা কঠিন।
এক।। খেলনা নগর।।
‘খেলনা নগর’ আখ্যানটি ২০০৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও আগেই ১৯৯৮ সালে শারদীয় প্রতিদিনে ছাপা হয়েছিল।
খেলনানগরের প্রায় সবটাই ধ্বংস আর পরাজিতের পরাজিত হওয়ার আখ্যান।
নামকরণ থেকেই বোঝা যায় এটি একটি কারখানা বা শিল্পশহর। স্টাফ্ড পুতুল তৈরি হত এখানে। একসময়, তখন কারখানার রমরমা অবস্থা, আগুন লেগে কারখানা পুড়ে যায়। সাদামুখো, পোড়া ঘায়ের মুখময় দাগ নিয়ে বেঁচে যায়। বামন আর দুজন শ্রমিক ‘৮’ আর ‘৯’ ও বেঁচে যায় আর কারখানা খোলার আন্দোলন চালিয়ে যায়। বাকিরা কাফিড্রিলের নেশায় ডুবে থাকে আর টিনজাত খাবার (যা একদা আকাশপথে এসেছিল) খেয়ে বাঁচে অথবা মৃত্যুর দিকে হামাগুড়ি দেয়।
এসব বলে বেঁচে থাকা বামন। শোনে এক নতুন লোক - উইন্ডচিটার, যে তাদের পানীয় জলের শুদ্ধধারা দেখিয়ে দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে প্রথমে। এমনকি খেলনানগরে লুকোনো সোনার কথাও সত্যি, বলে সে। ‘৮’ এবং ‘৯’ ভাবে ওই সোনাবেচা টাকা দিয়ে আবার কারখানা খুলবে। তারা কারখানা-প্রাঙ্গন খুঁড়ে পাথরের স্ল্যাব বের করে, কিন্তু উইন্ডচিটারের দেওয়া ঘুমপাড়ানি ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে হাতকাটার দল ওদের দেখতে পায় [কে ওদের খবর দিল?] এবং গর্তের মধ্যে সোনার মুদ্রা থাকায়, যেটা উইন্ডচিটারই রেখে দিয়েছিল, ওরা চোর সন্দেহে ‘৮’ ও ‘৯’ কে উলঙ্গ করে পিটিয়ে মেরে ছাদের ওপর উল্টো করে ঝুলিয়ে দ্যায় একটি অস্বাভাবিক বড় মৃত শকুনের পাশে। সেটি প্রকৃতপক্ষে ওই ধ্বংসকারী ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণির খবর পাচারকারীর কাজ করত।
খেলনানগর এবং তার বেঁচে থাকা শেষ ৪৮৫ জন মানুষ একই দিনে, একই ক্ষণে, একসঙ্গে নিহত হয় এক পরীক্ষামুলক নিউট্রন বোমার বিস্ফোরণে। এটি নিঃসন্দেহে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তার আগে খেলনানগরের পশ্চিমে ট্রাকে করে অন্য উন্নত দেশের রাসায়নিক বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ এনে জড়ো করা হয়েছিল। কুমার একটি খালাসি কিংবা ক্লিনার হয়ে এসেছিল, মূক জিশার প্রেমে পড়ে খেলনা নগরেই থেকে যায় ও ওই দিনে জিশার সঙ্গেই অকেজো এস.টি.ডি. বুথে মারা যায়। উইন্ডচিটার ওদের ওই শহরের বাইরে নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েছিল। সে কথা রেখেও ছিল - মেল ও ফিমেল বডিতে চড়া নিউট্রন ও গামা রেডিয়েশন কী প্রতিক্রিয়া ঘটায় তা জানার জন্য প্লাস্টিকের বস্তায় ওদের ভরে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল।
উন্নত দেশ কীভাবে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলির ওপর আধিপত্য কায়েম রাখে এই আখ্যান তার নমুনা। প্রেম তাদের বাঁচাতে পারেনা। প্রতিবাদীদের মাথা তোলবার আগেই নিশ্চিহ্ন করা হয়। তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বহিরাগত বিশ্বাসঘাতকদের। আর পারমাণবিক অস্ত্র তো আছেই নিরস্ত্র, নিরন্ন প্রায় অবমানবদের মারবার জন্য।
একটি না বলা কথা আমার মনে হয়েছে এই আখ্যানের মধ্যে ধরা আছে। এই শক্তিশালী দেশগুলো এই নগরের মানুষগুলিকে ভয় পায়। তাই এদের মধ্যে বপন করে বিভেদ ও অবিশ্বাসের বীজ। হিরোশিমা নাগাসাকির চাইতেও বেশি শক্তিশালী বোমা বানিয়ে পরীক্ষা করে যাদের তারা খরচের খাতায় লিখে রেখেছে তাদের ওপর, তাদেরই ওপরে এই অস্ত্র নিক্ষেপ করার জন্য। কারণ হিরোসিমা নাগাসাকির মানুষ আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন।
দুই।। অটো।।
খেলনানগরের কুহকী বাস্তব থেকে ‘অটো’র আখ্যানে ঢুকে পড়তে পড়তে মনে হল হড়কে পড়লাম ধুলো, ধোঁয়া, মেঘ, তারা, আকাশ, বন্ধ দগ্ধ কারখানা, রাস্তা, বাস আর অটো স্ট্যান্ড আর এর মধ্যে জীবন বয়ে নিয়ে চলা মানুষজনের মধ্যে।
প্রায় সবার মতো চন্দনের জীবনও বদলাচ্ছিল। রিক্সাওয়ালা, গ্যারাজে অস্থায়ী কাজ, ভোটের সময় বিস্তর খাটাখাটনি এসবই বাবা গলার ক্যান্সারে মরার পরে। তার নিজের গলায় রক্ত ওঠার কারণে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরে আরও পরে আয়ার কাজ করে সংসার চালানো মাও একেবারে হাত পা ফুলে মরে যাবার পরে সে অটোচালকের কাজে থিতু হয়। অবে এবারে অভাবিত এক আকস্মিকতায় সে একটি হ্যাংলা মেয়েকে বিয়ে করে ফ্যালে। তাও চলতো কিন্তু আরেক আকস্মিকতায় সে একাধারে সাহসী ও ভীতু হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই সে তার অটো দিয়ে একটি ট্যাক্সির পথরোধ করে। ভেতরে ছিল তিনটি ডাকাত বা তিনজন মানুষ। গণপ্রহারে তিনজনই নিহত হয়। নৃশংসভাবে। চন্দনের নার্ভ এই হত্যাদৃশ্য সইতে পারেনি। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। প্যান্ট ভিজিয়ে ফ্যালে। তাকে অটো চালিয়ে বাড়ি দিয়ে আসে - হেডব্যান্ড জিন্স্ আর শস্তা স্নিকার পরা ভিকি নামে এক হাফ মস্তান যুবক। এ ঘটনায় চন্দনের এমন নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় যে সে পুরুষত্ব হারিয়ে ফ্যালে। বারেবারে সেই অস্তিত্ব কাঁপানো মৃত্যু বা হত্যাদৃশ্য, সেই গাড়ির তলায় শুয়ে কাজ করা তেলকালি মাখা ছেলেটির নির্বিকার মুখে নির্ভুল লক্ষ্যে একজন দুষ্কৃতির ‘চোঙা তবিল’ ফাটিয়ে দেবার পর আরেকজনের, যার ইতিমধ্যে একটি চোখ খোবলানো, ‘চোঙা তবিল’ ফাটিয়ে দেওয়ার সইতে না পারা দৃশ্য ওকে শারীরিক ও মানসিকভাবে এমন দুর্বল করে দ্যায় যে ওকে কয়েকদিন জ্বর নিয়ে শুয়ে থাকতে হয়। এরই মধ্যে চন্দনকে দেখার অছিলায় ভিকি নিয়মিত আসে ও চন্দনের বৌ মালার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে আর মালা মিথ্যে বলে চন্দনের গাড়িতে তার ভালো ভালো শাড়ি ও গয়না নিয়ে ভিকির ডেরায় গিয়ে ওঠে।
চন্দনের পুরুষত্ব হারাবার কথা প্রচার করে কাল্পনিক ভয়ে ভীত নন্দ যদিও সে ডাকাত পেটানোয় অংশ নেয় এবং ডাকাতির মাল আছে ভেবে একটা ব্যাগ হাতায়। পরে সেটায় চারটে গুলি ও একটা দেশি পিস্তল দেখে চন্দনের অন্যমনস্কতা ও অসুস্থতার সুযোগে চন্দনের মায়ের পুরনো কাপড়ের বাক্সে জড়িয়ে রেখে দ্যায়।
এদিকে চন্দনের ‘ধ্বজো’ নামটা গেঁড়ে বসেছিলো আগেই। এবার তার সঙ্গে বউ পালানোর পরে নানা রসের ও রঙের গল্প চাউর হলো মহল্লা জুড়ে। চন্দন নেশায় বুঁদ, বন্ধু বলতে ট্রাম অ্যাক্সিডেন্টে অ্যাঁকাব্যাঁকা শরীরের মিউচুয়াল ম্যান, যে অপরের কেসে জেল খাটে। কথা প্রায় বলেই না। সবাই আড়ালে দু-কথা বললেও সামনে চুপ থাকে।
চন্দনকে একমাত্র উৎসাহ দেয় বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া আশমানতারা ছোট হোটেলের মালিক এরফান। সে একটা ভ্যানগাড়িতে আশমানতারা হোটেল চালায়। ভ্রাম্যমান হোটেল। তার এই বজ্জাতি ব্যবসা বুদ্ধিকে পুলিশকর্তাও তারিফ করেন।
এরমধ্যে চন্দন খবর পায় মালা পূর্ণ গর্ভবতী। সে অটোর ধুলোমাখা গায়ে দাগ কেটে হিশেব করে বোঝে বাচ্চাটা নিঃসন্দেহে তার। সে বাক্স হাতড়ে মায়ের পুরোনো কাপড় খোঁজে অটোকে চান করিয়ে মুছবে বলে আর হঠাৎই সেই কান্ট্রিমেড ওয়ান শটার আর চারটে গুলি পেয়ে যায়। ভরদুপুরে সে ব্যাটারির দোকান থেকে ইশারায় ডেকে নেয় ভিকিকে। বলে মালার পেটের বাচ্চাটা তার। ভিকি ধ্বজোর বাচ্চা হয়না বলে ঠাট্টা করলে সে সোজা ভিকির বুকে গুলি করে। তারপর অটো নিয়ে থানায়। পিস্তলটা আর বুলেট তিনটে টেবিলে রেখে সে খুনের কথা কবুল করে। এর পরের ঘটনা লেখক বলেছেন দুটি বাক্যে। দ্বিতীয়টি একটিমাত্র শব্দে - অটো। সেটি থানার পেছনে, দেওয়াল ঘেঁষে, অনেকদিন চুপ করে দাঁড়িয়েছিল।
এর আগে মনে হয় ‘কয়লার মত রাত থেকে,
দিনের সূর্যের আলোয়,
বেরিয়ে আসে অটো - - - ’
সত্যিই চন্দন এবার প্রকাশ্যে দিনের আলোয় তার বউ এর পালানোর যোগ্য জবাব দিল তার ‘ধ্বজো’ নাম খণ্ডন করে।
নরারুণের লেখনী কথা বলে ঠিকঠাক ভাষায় ঠিকঠাক লোকের মুখে। পাঠকের মনে হয় একখাবলা সত্যি কলকাতা যা আমরা দেখেও দেখতে না পাওয়ার ভান করি আমাদের বোধবুদ্ধির মধ্যে গেঁথে দিচ্ছেন লেখক। সমাজবিরোধীদের ধোলাই দিয়ে মেরে ফ্যালার নারকীয় উল্লাস যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। এমন করে আমাদের দুর্বলতা জেগে ওঠে তাঁর কলমে যেন আমরা চন্দনের মতো সইতে পারিনা। ভিকির মত বাধা না দেওয়ার দলে।
মিউচুয়াল ম্যান যেন আউটসাইডার। তবুও পেটের তাগিদে জড়িয়ে থাকে সমাজের মিথ্যে পরিচয়ে। নন্দ তো সাধারণ হয়েও অদ্ভুত চরিত্রের। তবু তার জন্যই শেষ পর্যন্ত চন্দন ফুঁসে উঠতে পেরেছিল।
আর অটো যেন চন্দনের জীবনের নীরব দর্শক। যা শেষাবধি এক প্রতীক হয়ে ওঠে।