দৃপ্তা ষড়ঙ্গী এই মুহূর্তে দিল্লি এইমসে ভর্তি। এবিভিপির গুণ্ডারা তাকে ঘিরে ধরে লাঠিপেটা করেছে, তার পা ভেঙে দিয়েছে। দৃপ্তাকে নিয়ে দূর থেকে লিখলেন তাঁর কাছের বন্ধুরা।
প্রীতলতাদের উত্তরাধিকারীরা - উপমা নির্ঝরিণী
আমি জানি যে, দৃপ্তাকে নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো আবেগপ্রবণ লেখা লিখলে ও ভীষণ রেগে যাবে এবং পরের বার দেখা হলেই ও হয়ত ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেবে। কিন্তু, এখন আমি সেই চড় খেতে প্রস্তুত। ওর সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ হয়েছিল, তখন সদ্য একজন মহামান্য বিচারক ময়ূরের চোখের জলের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সময় থেকেই এই মহান ব্যক্তিদের কীর্তি দেখে-শুনে আমরা একসঙ্গে হাসি, কাঁদি এবং রাগে ফেটে পড়ি। দৃপ্তা কলকাতার একটি এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করত যেখানকার ছাত্ররা 'রাজনীতি' থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করেন। আমাদের দেশের তথা পৃথিবীর বহু মানুষ এতটাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা প্রাপ্ত যে তারা 'রাজনীতি' না করলে বা না বুঝলেও তাদের কোনই অসুবিধা হয় না। দৃপ্তার কাছে অরাজনীতির বিলাসিতার সুযোগ ছিল। কিন্তু, ও শপিং মল, নেটফ্লিক্সের জীবনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরাসরি ময়দানে নেমেছে। যখন ওর কাছে রাস্তায় নামার সুযোগ ছিল না, তখন ও ক্রমাগত উচ্চমানের রাজনৈতিক মীম বানিয়েছে। আর আজ এই সঙ্কটকালে ও কম্পিউটারের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়েনি। জামিয়ায় আক্রমণের খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেছে সেখানে।
আজ সকালে এবিভিপির গুণ্ডাবাহিনি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে হামলা করেছে। এর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তারা আক্রমণ করেছিল, তখন চোখের সামনে দেখেছি সাংবাদিকের মাথা থেকে টুপ টুপ করে পড়া রক্তবিন্দু ভাঙা কাচের গুঁড়োয় মিশে যাচ্ছে, চারদিকে আগুন জ্বলছে এবং এ টি এমের ভিতরে একলা মেয়েকে ঘিরে ধরে সঙ্ঘীগণ অত্যাচার চালাচ্ছে। তারপর ঘটে গেছে জামিয়া, আলিগড়ের ঘটনা। রাষ্ট্রের নৃশংসতার মাত্রা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তর প্রদেশ ভয়াবহ অত্যাচার চলছে। আর কাশ্মীরের কথা তো আমরা জানতেই পারছি না। দেশজুড়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের ক্রমাগত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দৃপ্তা নিজেও হুমকি শুনেছে। এই হুমকিগুলো আমাদের ভয় কাটিয়ে দিতে সাহায্য করে। আজ বিকেল বেলা দৃপ্তা যখন বলল ওকে ঘিরে ধরে লাঠিপেটা করা হয়েছে, তখন আমার হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, বুঝতে পেরেছিলাম যে, ও আরো সাহসী হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের গুন্ডাবাহিনী ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র যত আমাদের উপর অত্যাচার নামিয়ে আনবে, আমরা তত সাহসী হব। ততদিন পর্যন্ত আমাদের সাহস সঞ্চয় করে যেতে হবে, যতদিন না এই রাষ্ট্র মানুষের সম্মিলিত সাহসের কাছে নত হতে বাধ্য হয়। আজ যে প্রজন্ম নতুন বসন্তের রাস্তা দেখাচ্ছে, তারা একটা সুন্দর পৃথিবী পেতে চায়। যেখানে 'বুড়ো বুড়ো চোর ডাকাত'-রা আমাদের অক্সিজেন, শুদ্ধ জল, দূষণমুক্ত পরিবেশ ও অন্যান্য অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না। প্রীতিলতা, সাবিত্রীবাঈ প্রমুখের বিদ্রোহী মননের এবং সাহসের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী রাবণ, আয়েশা, দৃপ্তারা। তারাই আমাদের লড়াইয়ের সঠিক পথ দেখাবে।
ঝড়ের চোখ
নির্নিমেষ ভট্টাচার্য
"কেন আমার ক্ষমতা নেই বিশাল ধ্বংস হয়ে জন্মিয়ে ওঠার"- উৎপল কুমার বসু
"পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?"- প্রমীলা (মেঘনাদবধ কাব্য/তৃতীয় সর্গ)
কথার সময় পেরিয়ে গিয়েছে এখন। এখন সময় নেই নির্জনে বসার, চুপচাপ। আমাদের শহরে শুধু গুঞ্জন শোনা যায়। যত চিৎকার, গর্জন ও মরে মরে যাওয়া সব আরো পশ্চিমে, আরো উত্তরে, উত্তর-পশ্চিমে।
যেদিন দিল্লির ডাক এলো সেদিন পাশাপাশি হেঁটে গেছিলাম ক্যামাক স্ট্রীট ধরে। অকপটে বলি, ঈর্ষা সহজ অনুভূতি। যাদবপুরে বিষয় একই, আমি থার্ড, তুই ফোর্থ। তবু আমি রইলাম কোলকাতায়, তুই চল্লি দিল্লি। দুবছর দুয়ো দিয়ে এসেছিলাম 'আর্মচেয়ার রেজোলিউশনারি' বলে। আর বিরক্ত হয়েছি জ্ঞানের আস্ফালন দেখে। পৃথিবী আর না-পৃথিবীর বিরোধ ছিলো। আমার ছিলো রাস্তা দেখার বড়াই। তাই হাঙরের মতো সিনেমা দেখা, গাদা গাদা বই পড়া, এবং তাদের নাম ইঁট পাথরের মতো ছুঁড়ে মারাকে ব্যঙ্গ করেছি (বেশ করেছি)। মিম বানানোকে চূড়ান্ত আনপ্রোডাক্টিভ মনে করি, এখনো। এই সব অনঙ্গ কুয়াশার ভেতর সংবেদনশীলতা হারানোকে ভয়ও পাই। কিন্তু মানুষ পাল্টায়, তার চেয়েও বেশী পাল্টায় তার অবস্থান।
আমাদের ক্ষেত্রে অবস্থান পাল্টাপাল্টি হয়ে গেলো। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম বইয়ের ভেতর, সুরের ভেতর, বাইরের জগতকে বেমালুম অস্বীকার করে বসলাম। ভেবেছিলাম সক্রিয় রাজনীতি করবো, করলাম না। তুই করলি। তোর পার্টিসান হওয়া নিয়ে বিরক্ত ছিলাম। পার্টিসান হয়ে এমন কোনো মহান কাজ করিসনি। কিন্তু কাজ করেছিস, যা আমি করিনি, করার সাহস নেই, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক স্বচ্ছতাও নেই।
এই লেখা ব্যক্তিগত, আর আমি পাকা লিখিয়ে নই। হাবিব জালিবের গানটা সেই রাতগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেয় যখন দিল্লি থেকে ফোন আসত। জেএনইউ হোস্টেলের ছাদ থেকে ফোন আসত। আমি আমার মতন বকে যেতাম, তুই তোর মতন। কথোপকথনের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য থাকত না। তারপর ধীরে ধীরে সব কমে আসা। আমায় এই লেখাটা লিখতে বলা হয়েছে, যিনি বলেছেন তাঁর কথা ফেলতে পারবোনা। কিন্তু আমি এসব লিখতেই চাইনি। কোলকাতা ফিরলে মুখোমুখি বলতে চেয়েছিলাম। আদি-সূত্র অগ্রাহ্য করে বন্ধু বলে পরিচয় দেওয়া গর্বের না হোক, ভালোলাগার। রাগ, ঈর্ষা এবং বিদ্রূপ মেশানো হলেও, ভালোলাগার। ধরা যাক এটা খোলা চিঠি। তবু, চিঠি তো। অসৎ চিঠি লেখা অসম্ভব (মার্জিত চিঠি লেখা একেই দুষ্কর)।
ভাঙা পা জোড়া লাগলে সরকারমশায়ের এই প্রকাণ্ড অবশগুন মূর্তিটা চুরমার করে দে।
শহর দ্বিমত হবে তাই গলিতে কবর ছড়ানো
আমাকে এভাবে হারাবে?আমি তো এভাবে হারানো।
বাগান নিভিয়ে হাওয়া ঝুলে,টাল টাল হাওয়াতে সমন—
কারা বাগানে কীলক ঠুকে গেছে?কারা প্রথম বাগান হারানো?
ক্রমে লেপ্টে,জড়িয়ে গেছে চিৎ ঋতু শাল,সচিত্র গুঁড়ো করা মুখে
তোমার সফলতা নিবিড়ে,অরণ্যজলে?আমি উৎসমুখে হারানো।
মধ্যে,দূর থেকে দূরে লিখিত সমর,সফরে গোপনতা বলে
শোনো,মধ্যবর্তী কোনো বিরহে আরোহণ,নিপুণ কামোদে হারানো।
ডাকবাক্স প্রদাহে পুড়েছে অধীর দাগ আর অবারিত ভোরের খিলান
জ্বলে,আল্লাহকৃষ্ণহ্রদে,জলে,কত কত হামিদ সূতিঘর দস্তরখান হারানো।
আছি,হু।যতির ঘোষণা ভুলে আছি তবু রুহের সংবাদে
যন্ত্রনাস্পদ,আরো রাত অবধি মনে রেখো আমার তোমাকে হারানো।
শহর দ্বিমত হবে তাই গলিতে কবর ছড়ানো
আমাকে এভাবে হারাবে?আমি কবীর,বীজকে হারানো।