“আমরা যাইনি মরে আজও - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়;
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে”
- জীবনানন্দ দাশ
“মহীনের ঘোড়াগুলি মহীনের ঘরে ফেরে নাই
উহারা জেব্রার পার্শ্বে চরিতেছে”
- শক্তি চট্টোপাধ্যায়
কেউ কেউ বলে থাকেন রামায়ণ নাকি লেখা হয়েছিল রাম জন্মানোর আগে। হয়তো কথাটার মধ্যে কোন রহস্য আছে।
সে যাই হোক মহীনের ঘোড়াগুলির যখন জন্ম হয় তখন তাদের সামনে কিছুই ছিল না, শুধু ছিল ধু ধু ফাঁকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল আর ছিল তাদের ফেলে আসা পথের অভিজ্ঞতা। এই ফেলে আসা পথের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা বিস্তীর্ণ চারণ ভূমিতে সবাই মিলে এলোমেলো ভাবেই ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল।
তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোটার আরও ছিল বিভিন্ন ঘরানার জনা তিরিশেক ছুটন্ত ঘোড়া যারা মূলত ছেলেবেলায় একসাথে বেড়ে উঠেছিল কোন অঞ্চলে। ঘোড়াদের আস্তাবল ছিল নাকতলায় এবং তার দেখাশুনো করতেন আমাদের মা ও পিসি, যথাক্রমে বিভা দেবী ও রতনপ্রভা – যাঁরা স্নেহ দিয়ে, ঘোড়াদের সবরকম বেপরোয়া দুরন্তপনাকে উৎসাহ দিয়ে, তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঘোড়াদের কোন কোন বান্ধবীরাও। তারাও সমান তালে ছুটতে শুরু করেছিল দলের বিভিন্ন রকম দায়িত্ব নিয়ে।
সেই সময় তাদের ছোটাছুটির ধরণ দেখে অন্য এক দলছুট ঘোড়া – দীপক মজুমদার সত্তরের দশকের শেষের দিকে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সাথে, একসাথে অন্যধরণের কাজ করার জন্য। ওর সহযোগিতায় মহীনের ঘোড়াগুলির সঙ্গে বাউলদের এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নাকতলার আস্তাবলে গৌরক্ষ্যাপা, পবনদাস বাউল ও তার ছোটভাই স্বপনদাস এবং অন্যান্য বাউলদের যাতায়াত ছিল অবাধ ও যখন-তখন। তাদের নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সঙ্গীত সৃষ্টি করার আনন্দে আমরা সবাই মেতে উঠেছিলাম। আরও কিছু পরে আশির দশকের গোড়ার দিকে শিল্পী হিরণ মিত্র এসে ঘোড়াদের এই ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে তার ছোটা শুরু করে দিয়েছিলেন।
মহীনের ঘোড়াগুলি এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছুটতে ছুটতেই বেশ কিছু কনসার্ট, কোলকাতা জ্যাজ ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ এবং সেখানে তাদের কম্পোজিশন – “বাউল-জ্যাজ” পারফর্ম করা , টিভি প্রোগ্রাম ও তাদের তিনটে ভিনাইল রেকর্ড প্রকাশ হয়েছিল।
আমরা ম্যাক্সমুলারে সাঙ্গীতিক ধ্বনি নিয়ে কোলকাতা শহরের শব্দ নিয়ে কিছু অন্যধরনের পরীক্ষামূলক কাজ করেছিলাম। তাছাড়া আরও কিছু পরীক্ষামূলক কাজ পশ্চিম জার্মানীর “EMBRYO” নামে একটি জ্যাজ গ্রুপের সঙ্গে একসাথে করা হয়েছিল। Embryo দলটিও সত্তরের দশকের শেষ কিংবা আশির দশকের প্রথমে ‘কোলকাতা জ্যাজ ফেস্টিভাল’ এ অংশগ্রহণ করেছিল।
সম্পূর্ণ দলটিকে কেন্দুলি মেলায় প্রায় গেরিলা কায়দায়, অথরিটির অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিয়ে গিয়েছিলাম বাউল মিউজিশিয়ানদের পারফর্ম্যান্স দেখানোর জন্য। পরে কোলকাতায় ফিরে খিদিরপুর ডক অঞ্চলের শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে জ্যাজ ফরম্যাটে Embryo’র সঙ্গে আমরা একটা যৌথ কাজ করেছিলাম। Embryo দেশে ফিরে গিয়ে “Jazz impressions” নামে একটি ডাবল অ্যালবাম LP রেকর্ড প্রকাশ করে এবং সেখানে আমাদের এই কাজটিও ওরা রেখেছিল। সেই অ্যালবাম তারা কলকাতায় পাঠিয়েছিল এবং তার ইনসাইড কভারে একটি সিল্যুএট ছবি ছিল। বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারী মিউজিশিয়ানদের নিয়ে। সেখানে লেখা ছিল ‘Violinist of Baul Jazz group of Calcutta, Abraham Mazumder’। Embryo গ্রুপটি একটা বড় বাসে করে তখনকার পশ্চিম জার্মানি থেকে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল এবং বিভিন্ন দেশে পারফর্ম করতে করতে ইউরোপ, টার্কি ও সম্ভবতঃ ইরাক, ইরান, আফঘানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতবর্ষে এসেছিল। এই সমস্ত দেশের মিউজিশিয়ানদের নিয়েই তাদের ‘Jazz Impressions’ অ্যালবামটি প্রকাশ পেয়েছিল। Embryo তাদের সঙ্গে রাখত বিশাল এক স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ক্যানভাস, সেখানে তাদের অঙ্কনশিল্পী – Stephan, তাদের পারফর্ম্যান্স চলাকালীন স্টেজে পেইন্টিং করত এবং এইভাবে তাদের পরিভ্রমণের শেষে এই বিশাল ক্যানভাসটি সম্পূর্ণ করেছিল। আমরা সেই কাজটি খুবই উপভোগ করেছি, প্রভূত উৎসাহ পেয়েছিলাম এবং পরবর্তী কালে গানের সঙ্গে আঁকা ছবি মহীনের ঘোড়াগুলির স্টেজ পারফর্ম্যান্সের একটি অঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল। হিরণদা’র এই স্বতঃস্ফূর্ত পারফর্মেন্স মহীনের ঘোড়াগুলির লাইভ প্রোগ্রামে একটা অন্য মাত্রা এনে দিত।
Embryoকে নিয়ে আরো একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
Embryoর Jazz festএ পারফর্ম করার পরে আর একটি প্রোগ্রাম, সম্ভবত রবীন্দ্র সদনে, অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে তারা মহীনের ঘোড়াগুলিকে ইনভাইট করেছিল। তাদের প্রোগ্রাম চলাকালীন এক সুন্দর সাঙ্গীতিক মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল, সেই সময় লোভ সামলাতে না পেরে দর্শকদের আসন থেকে স্টেজে উঠে গিয়ে আমি ওদের থেকে একটি মাইক্রোফোন চেয়ে নিই এবং ওদের সঙ্গে ভোক্যাল ইম্প্রোভাইজেশনে যোগ দিই। যখন আমার পার্টটা শেষ করব, সেই সময় আমার প্রি-ক্লোজিং সিগনেচার হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম শীর্ষাসনকে। স্টেজের উপর মিনিট পাঁচেক শীর্ষাসন করেছিলাম। আর সমস্ত মিউজিশিয়ানরা একদম সাইলেণ্ট হয়ে গিয়েছিলেন, সমস্ত হলে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, যতক্ষণ না সেই শীর্ষাসন থেকে আবার নর্ম্যাল পোজিশনে ফিরে এলাম। মিউজিকও যেমন চলছিল তেমন ভাবেই চলতে লাগল এবং সঙ্গে দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি। যেন এই নিস্তব্ধতা টোটাল কম্পোজিশনের একটা পার্ট! এই প্রসঙ্গে তখন বেশি কিছু না ভাবলেও পরে আমি John Cageর বিখ্যাত কম্পোজিশন – 4' 33"এর মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই অ্যালবামে চার মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড, অর্থাৎ পুরোটা সময় জুড়েই ছিল শুধু নৈঃশব্দ।
তার দু’একদিন পরেই আমাদেরও ম্যাক্স মুলারে জ্যাজ পারফর্ম্যান্স ছিল। আমরাও Embryoকে ইনভাইট করেছিলাম আমাদের অনুষ্ঠানে আসার জন্য। নির্দিষ্ট দিনে আমাদের প্রোগ্রামের সময় Embryoর কাউকেই দেখতে পেলাম না দর্শকের মাঝে। যখন আমাদের পারফর্ম্যান্স শুরু হয়ে একটা সুন্দর মুহূর্ত তৈরি হয়েছে ইম্প্রোভাইজেশনের, তখন দেখলাম দর্শকাসন ফুঁড়ে উঠে এলেন ট্রাম্পেট হাতে নিয়ে – Embryo’র পেইণ্টার-মিউজিশিয়ান স্টিফান। আমাদের সঙ্গে পারফর্ম্যান্সে যোগ দিয়ে সে এক অন্য রং লাগিয়ে দিয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে।
সাঙ্গীতিক স্বতঃস্ফূর্ততার আবেদন সততই মধুর।
জ্যাজ ফেস্ট নিয়ে লিখতে গিয়ে আরও একটি দল Rena Rama Quartet নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। এরা কলকাতার ডালহৌসি ক্লাবে প্রথম পারফর্ম করেছিল সম্ভবত ১৯৭৮এ। এরা যখন তাদের একটা কম্পোজিশন – “Batiali” বাজিয়েছিল। আমি দর্শকদের আসন থেকে ছুটে গিয়ে তাদের পিয়ানিস্ট – Bobo Stensonকে “জয়ন্ত” বলে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তোমরাও বাংলারই ছেলে। এবং “জয়ন্ত” বলে এই বাঙালী নাম দিয়ে ওকে ডাকার এক্সপ্রেশনের ভেতরের অর্থ বোঝানোর পর Bobo নিজের কাজকে সার্থক মনে করেছিল।
Bobo Stenson মহীনের ঘোড়াগুলির আস্তাবলে এসে আমাদের সঙ্গে গান বাজনা করে গিয়েছিল সিকিওরিটির চোখে ধুলো দিয়ে। ওর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বহুদিন ছিল। নিয়মিত ভাবে ওদের নতুন অ্যালবাম আমাদের পাঠাত। মনে রাখতে হবে তখন পোস্ট করা অ্যালবাম পেতে যথেষ্ট দেরি ও অসুবিধা হত। বছর পাঁচ ছয় আগে Rena Rama Quartet আবার এসেছিল Kolkata Jazz festএ। দেখা হল অনেক বছর বাদে। আমাদের সবারই চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যেমন পাল্টে গেছে আমাদের নিজেদের মিউজিকও। এইসব নিয়ে কথা হয়েছিল Boboর সঙ্গে ।
মহীনের ঘোড়াগুলি এই আপাত বাধাশূন্য প্রান্তরে ছুটতে গিয়ে বুঝল আসলে এই প্রান্তর চোরাগোপ্তা আক্রমণে পরিপূর্ণ। তারা বুঝল, এ কাজ বা এ চলা চলতে হলে আরও অনেক ঘোড়ার দরকার যারা কিনা স্বেচ্ছায় এই পথে ছুটে চলবে। শুরু হল ভেতরে ভেতরে “ডাকাতির দল” গড়ার কাজও।
সত্তরের দশকে মহীনের ঘোড়াগুলির যে কাজ শুরু হয়েছিল সেই কাজ আশির দশকে গৌতম চট্টোপাধ্যায় “লক্ষ্মীছাড়া” নামে একটা ফিল্মের ভিতর দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল এবং সে কাজ অনেকদূর এগিয়েও কাজটি সিনেমার আকারে প্রকাশ পায় নি কোনোদিন। তার কারণ অবশ্যই হঠাৎ আবিষ্কার করা তার পকেটের শূন্যতা।
কিন্তু এ ছোটা তো বন্ধ হয় না।
নব্বইয়ের দশকে তাই আমরা দেখলাম গৌতমকে একঝাঁক নতুন ঘোড়া/ঘুড়িদের নিয়ে “মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত” – চারটি অ্যালবাম প্রকাশ করতে। সঙ্গে সাথী ছিলো এক প্রাচীন ও নির্জন ঘোড়া – অরুণেন্দু দাস। তাছাড়া প্রাচীন আরও দুই যন্ত্রশিল্পী – প্রবীর দাস ও শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের সাহচর্য এই আন্দোলনকে একটা নতুন উচ্চতা দিয়েছিল। ক্রমশঃ মহীনের ঘোড়াগুলির এই ছোটাছুটির ধরণ বাংলা সঙ্গীত জগতে একটা নতুন যাত্রার সূত্রপাত করল। ফল স্বরূপ আমাদের বাংলায় অসংখ্য বাংলা গানের দল বা বাংলা ব্যান্ডের জন্ম নিল। এই আন্দোলনকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে চার দশক প্রজন্মের দুরন্ত সব ঘোড়ারা। তাদের নাম আলাদা ক’রে এই লেখায় আর উল্লেখ করলাম না। তারা বাউল ফকিরদের সঙ্গীতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছে এবং তারা মেলাতে চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের সঙ্গে আমাদের শহুরে এবং দেশজ লোকসঙ্গীতের ব্যঞ্জনাকে। তারা অন্য ধরনের সাঙ্গীতিক বিন্যাস তৈরি ক’রে নতুন ধারার সঙ্গীত সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এবং এটাই বড় আশার কথা।
আমাদের ভরসা রাখতে হবে তাদের ওপর। আমার বিশ্বাস আগামী প্রজন্মের ঘোড়ারা যদি মিথ্যে সম্মান আর সমস্ত রকমের প্ররোচনাকে অগ্রাহ্য করে তাদের লক্ষ্য ঠিক রেখে