
ব্যক্তিগত শোক আমাকে অনেক পথ হাঁটায়। এমন অনেক পথ – আগে হাঁটিনি। কিছু কথা, কিছু আলাপ, কিছু অভিজ্ঞতা মনে হল আরও অনেকের জানা জরুরি। পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করব কিছুটা অনিয়মিত।
ডঃ জয়ন্ত দাসের সঙ্গে আমার কথা শুরু হয় এবছরের মার্চে। নিতান্ত ব্যক্তিগত শোকের প্রেক্ষিতে শুরু হয়েছিল কথা চালাচালি – অনুসন্ধিৎসাই ছিল তার মূলে – প্রথমে, ডঃ দাসের সঙ্গেই। ডঃ বিশ্বরূপ চ্যাটার্জী এলেন তার পরে। আলাপন, যা মূলতঃ হাসপাতাল থেকে আসা সংক্রমণ বিষয়ে প্রশ্নোত্তর- চলেছিল ই মেইলে; ভাষা কখনও বাংলা ছিল, কখনও ইংরিজি । আলাপনের ভঙ্গি ও কালানুবর্তিতা অটুট রেখে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাকে ব্যক্তিগতর গণ্ডী টপকে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
মার্চের গোড়ায় ইন্দ্রাণী লিখছে,
প্রিয় জয়ন্তবাবু,
আপনাকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।
১। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে-হাসপাতাল থেকে আসা সংক্রমণ ভয়াবহভাবে গতিতে বাড়ছে। আপনার কি মনে হয়? এটা কি সত্যি? পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে বলছি। কোনো পরিসংখ্যান আছে?
২। হাসপাতাল থেকে আসা সংক্রমণে মৃত্যু ঘটলে রোগীর আত্মীয়স্বজন ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে যেতে পারেন কিন্তু
ক) প্রমাণ করা যাবে না যে ঐ হাসপাতাল থেকেই সংক্রমণ হয়েছে-প্রমাণ করতে হলে রোগীর শরীরের জীবাণু আর হাসপাতালের swab culture এর জীবাণু-র gene match করে দেখতে হবে। সেটা সম্ভব নয়।
খ) বহুক্ষেত্রেই মনোবল, লোকবল, অর্থবলের অভাবে মৃতের আত্মীয়স্বজন ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে যেতে চান না।
তাহলে কী করণীয়?
৩) ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে এই সমস্ত হাসপাতালগুলোকে যদি অন্ততঃ তাদের সমস্ত পরিচ্ছন্নতাবিধি খতিয়ে দেখতে বাধ্য করানো যেত -তবে একটা বড় কাজ হ'ত। এবং যতদিন না হাসপাতালগুলো তাদের পরিষেবা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং সেই মর্মে সার্টিফিকেট পাচ্ছে (এখানে একটা প্রশ্নঃ কে দেবে সার্টিফিকেট?) ততদিন সেই সব হাসপাতালে রোগী ভর্তি বন্ধ থাকবে - ঠিক এই ভাবে বাধ্য করাতে গেলে কীভাবে চাপ দিতে হবে? জনস্বার্থে মামলা করা ছাড়া আর অন্য কোনো পথ আছে? একটু আলোকপাত করবেন সময়মত।
উত্তরে ডঃ দাস লিখলেন,
আমার কাছে পশ্চিমবঙ্গের হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশান নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। মনে হয়, কোনো মেডিকাল মাইক্রোবায়োলজিস্ট ভালো জানবেন।
আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের ক) অংশে সহমত। দ্বিতীয় প্রশ্নের খ অংশ ঠিক প্রশ্ন নয়, আপনার মত। ঠিকই বলেছেন। ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে গেলে দৃষ্টান্তমূলক রায় হয়তো পাওয়া যেতে পারে কখনও কখনও, কিন্তু ধনী এবং ক্ষমতাবান লোকদের পক্ষে রায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, গরিব মানুষ সেখানে বঞ্চিত হবেন।
জনস্বার্থে মামলা একটা উপায়। আপনি তিন নম্বর পয়েন্টে যার উল্লেখ করেছেন। তবে ভারতের আদালতে ক্লাস অ্যাকশন সুট গৃহীত হয় কি না, আমার ধারণা নেই। ভোপাল মামলা এ ব্যাপারে দেখা যেতে পারে। তবে আমেরিকায় ক্লাস অ্যাকশন সুট যেভাবে কাজে আসতে পারে ভারতে তা নয়। তাই মনে হচ্ছে, অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে।
আমি ডঃ বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায়কে লিখছি, ভারতের হাসপাতালে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য উনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উনি এখন সৌদিতে। ওঁর উত্তর পেলেই আপনাকে জানাবো।
ডঃ চ্যাটার্জির মেইল আমরা পেয়ে যাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। উনি ডঃ দাসকে লিখলেনঃ
ইন্দ্রাণী দত্তর সঙ্গে আমি একমত যে একটি বিশেষ হাসপাতাল থেকেই একটি বিশেষ সংক্রমণ (হেল্থকেয়ার অ্যাসোসিয়েটেড ইনফেকশন বা এইচ এ আই)এসেছে, তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা কঠিন। কিন্তু হাসপাতালে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিধি মানা হচ্ছে কিনা, হাত পরিস্কার থাকছে কিনা, ইউরেনারি ক্যাথেটার, ভেন্টিলেটর, সেন্ট্রাল লাইন ব্যবহার করার সময়্নির্দিষ্ট বিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, (পরিভাষায় যাকে বলি প্রসেস প্যারামিটার) সেগুলো অনায়াসে নজরে রাখা যায় ব্যায়সাপেক্ষ নিশ্চয়ই কিন্তু মেরোপেনেমের কোর্স কেনার চেয়ে খরচ কম।আমার মতে, যতদিন না বীমা সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসার খাতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেজ ধরে প্যাকেজ চালু না করবে, ততদিন হাসপাতালগুলো নড়ে চড়ে বসবে না। যেমন কোনও রোগী ইলেকটিভ কোলেসিস্টেকটমির জন্য ভর্তি হলেন। এই ক্ষেত্রে দু ডোজ আই ভি সেফাজোলিন সার্জিকাল প্রোফাইল্যাক্সিসের জন্য আর একটা টাইজিসাইক্লিন বা মেরোপেনেমের কোর্স লাগে সার্জিকাল সাইট ইনফেকশনের জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত সংক্রমণের জন্য মেরোপেনেম বা টাইজিসাইক্লিন লাগে, হাসপাতালকেই তার খরচ দিতে হবে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করা রোগীর আইনি অধিকার। কিন্তু ভারতে ডাক্তার আর রোগীর অবস্থার যা ফারাক, তাতে গরীব রোগীরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় কতটা এগোবেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
এরপরে, ডঃ দাস লিখছেন ইন্দ্রাণীকেঃ
হাসপাতালে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কী করা উচিত আর কী নয়, তা সবিস্তার পাঠিয়েছেন বিশ্বরূপ।
ইন্দ্রাণী ডঃ দাসকে বলেছিল লেখাটি সে শেয়ার করতে চায় ফেসবুকে এবং অন্যত্র। ডঃ চ্যাটার্জির অনুমতি চাই সেজন্য।
ডঃ চ্যাটার্জি অনুমতি দেন।
ডঃ চ্যাটার্জির ডকুমেন্টটি ইংরিজিতে, অনুবাদের দায়িত্ব এই মুহূর্তে স্বয়ং ডঃ চ্যাটার্জিই নিয়েছেন। তাই ডকুমেন্টটি ইংরিজিতেই রাখা হল এ লেখায়, আপাততঃ।
এবারে ইন্দ্রাণী লিখছে ডঃ দাসকেঃ
জয়ন্তবাবু,গত রাতে ডকুমেন্টটি এক ঝলক দেখেছি। সুলিখিত । মূলতঃ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, সেবাকর্মী এক কথায় যাঁরা রোগীর সংস্পর্শে আসবেন বা সেবা/ চিকিৎসা করবেন - লেখাটি তাঁদের জন্যই। তবে, হাসপাতালে রোগীকে দেখতে আসা নিকটজন, এবং রোগী হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে সেবা শুশ্রূষাকারীর এলেখার কিছু অংশ জানাটা জরুরি মনে হয়।
এই মুহূর্তে আমার দুটি প্রশ্ন।
১। হাসপাতালগুলো কী কী করতে হবে আর কী হবে না, সেই বিধি মেনে চলে? অবশ্যই না। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বা মৌলিক পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা হচ্ছে কি না- ছ মাস অন্তর বা বছরে একবার কি তার কোনো অডিট হয়?
২। হাসপাতাল যাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মূল বিধিগুলো মেনে চলতে বাধ্য হয়, সেজন্য আমরা মানে সাধারণ মানুষ কী করতে পারি?
আরও প্রশ্ন করছি পরে।
ডঃ দাস লিখলেন,
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। প্রথম প্রশ্নের ক্ষেত্রে এখন কী হয় বলতে পারব না, তবে দশ বছর আগে আমি একটি কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালে স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করেছি, পুরো সময়। কিছু নিয়ম ছিল, যদি বিশ্বরূপ যেগুলো বলছে, সেগুলিই কি না, মনে পড়ছে না। তবে বেশিরভাগ বিধি নীতিগতভাবে মেনে চলা হত। তবে কোনও সময় কেউ কেউ ভুলও করেছেন।
তবে আমার এক সিনিয়র কঠোরভাবে এ সব নিয়মবিধি পালন করানোর চেষ্টা করেছেন। অ্যানেস্থেশিওলজিস্টও খুব কড়া ছিলেন এ সব ব্যাপারে।
এখন একটা দাতব্য এবং একটা কর্পোরেট হাসপাতালে আছি, তাতে অবশ্য ওপিডি (ত্বকের রোগের)র বাইরে কী হচ্ছে, তা খুব একটা জানি না।
তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গাফিলতিতে কোনও রোগীর ক্ষতি হলে জনস্বার্থে মামলা করা যেতে পারে।
এরপরে, আরও প্রশ্ন থাকে ইন্দ্রাণীর । উত্তর জানাটা জরুরি মনে হয়।
ইন্দ্রাণী লিখছে,
জয়ন্তবাবু,
আবার পড়লাম ডকুমেন্টটি। আগেও লিখেছি, আমার মনে হয় এই ডকুমেন্টটি শেয়ার করা জরুরি। রোগীর আত্মীস্বজন আর সেবা শুশ্রূষাকারীদের এই 'ডু'স আর 'ডু নটস' জানা এবং তা মেনে চলা দরকার। ইংরিজি ডকুমেন্ট-ই এখন শেয়ার করা যাক, বাংলা অনুবাদ হাতে এলে, তখন সেটিরও প্রচার করব। ডকুমেন্টটির কিছু জায়্গা সাধারণ মানুষের জন্য হাইলাইট করা বিশেষ জরুরি। যেমন অনেকেরই জানা নেই অথচ অবশ্যই জানা উচিত যে জল মেশানো ডেটল কখনও মারাত্মক জীবাণু Pseudomonas aeruginosaর বাসস্থান হতে পারে।আমার আরও কিছু প্রশ্ন আছে। উত্তর জানতে আগ্রহীঃ
১। ডঃ চ্যাটার্জী ঐ ডকুমেন্টে লিখেছেন যে মানুষের শরীরে বসবাসকারী সাধারণ জীবাণু যা সাধারণ অবস্থায় আদপেই মারাত্মক নয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যন্ত ক্ষতিকারক জীবাণুতে রূপান্তরিত হতে পারে। এখন জানা দরকার যে সেই বিশেষ পরিস্থিতিগুলি কী। কোনো কেমিক্যাল ( হয়তো কোনো ওষুধ) বা শরীরের কোনো বিশেষ পরিস্থিতি ( অস্ত্রোপচার/ আঘাত ইত্যাদি) কি 'সাধারণ জীবাণুকে মিউটেট করে ক্ষতিকারক জীবাণুতে পরিণত করছে? তাই যদি হয়, তবে এই মিউটেশনের জন্য জীবাণুদের কটি প্রজন্ম লাগে আর অঙ্কের হিসেবে তা কি কয়েক ঘন্টা/ দিন/ মাস? তাহলে কি যে কোনো রোগীরই -যার কোনো অস্ত্রোপচার হবে-এই ঝুঁকি মানে তার শরীরের সাধারণ জীবাণুর মিউটেশন হয়ে ক্ষতিকারক জীবাণু হয়ে ওঠার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়? এইটা জানা খুব জরুরি।২। আবারও সেই একই প্রশ্ন উঠে আসে- হাসপাতালগুলি এই 'ডু'স আর 'ডু নট' গুলি যাতে মেনে চলে, তার ব্যবস্থা কী করে করা যেতে পারে? একটি পুরোনো মেইলে ডঃ চ্যাটার্জী লিখেছিলেন, "যতদিন না বীমা সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসার খাতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেজ ধরে প্যাকেজ চালু না করবে, ততদিন হাসপাতালগুলো নড়ে চড়ে বসবে না"
এখন বাস্তবে তা সম্ভব কী করে? করণীয় কী? আপনার কোনো সাজেশন?
জয়ন্তবাবু উত্তরে লিখছেন,
বিশ্বরূপকে আপনার প্রশ্ন পাঠাচ্ছি।জানি না, বিনা প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হলে তার খরচ হাসপাতালকে দিতে বাধ্য করা কীভাবে সম্ভব।হাসপাতাল তো জানেই যে খরচ হয় রোগী নয় বীমা সংস্থা দেবে। আমার মনে হয় না বিশ্বরূপ বা অন্য কেউই উত্তর দিতে পারবে।
বীমানীতির আমূল পরিবর্তন চাই। অর্থাৎ ঠিকঠাক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার তফাত করতে হবে এবং প্রথমটিকেই গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র প্রয়োজনমাফিক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অন্যতম শর্ত। এখন কিছু প্রক্রিয়াগত বিধি মেনে চললেই বীমা সংস্থাগুলো টাকা দেয়, চিকিৎসাবিজ্ঞান মেনে চিকিৎসা হয়েছে কি না দেখে না। তবে ডাক্তার চিকিৎসাবিধি মেনে চিকিৎসা করেছেন কি না, বীমা সংস্থাকে তা যাচাইয়ের অধিকার দেওয়ার মধ্যেও সমস্যা হবে।
ইন্দ্রাণী | unkwn.***.*** | ১২ জুন ২০১৩ ০১:৩৪77010
রূপঙ্কর সরকার | unkwn.***.*** | ১২ জুন ২০১৩ ০২:৩৭77015
aka | unkwn.***.*** | ১২ জুন ২০১৩ ০২:৪০77016
aka | unkwn.***.*** | ১২ জুন ২০১৩ ০২:৪৪77011
bb | unkwn.***.*** | ১২ জুন ২০১৩ ০৩:২৬77012
ন্যাড়া | unkwn.***.*** | ১২ জুন ২০১৩ ০৩:৪০77013
Abhyu | unkwn.***.*** | ১২ জুন ২০১৩ ০৪:৪৩77014
ব | unkwn.***.*** | ১৩ জুন ২০১৩ ০১:৫৭77018
pi | unkwn.***.*** | ১৩ জুন ২০১৩ ০২:১৩77019
ranjan roy | unkwn.***.*** | ১৩ জুন ২০১৩ ০৪:০৪77020
ইন্দ্রাণী | unkwn.***.*** | ১৩ জুন ২০১৩ ১২:১০77017
nina | unkwn.***.*** | ১৪ জুন ২০১৩ ০৯:২১77021