" শুদ্ধসীমা থেকে যাত্রা কবিতার সর্বাঙ্গে , যেমন
মধুর বিহ্বল পায়ে পিঁপড়ে পড়ে ছড়িয়ে সুধায়
বিষে ও নির্বিষে, আমি যাই….”
একটি ছোট্ট মেয়ে | সে জানত ,তার বাবা পদ্য লেখেন | মা ঘরের কাজ , ঘরের বাইরে চাকরি , রান্নাবান্না, অতিথি সত্কার , এই যখন তখন তাদের দুই ভাইবোনের খুনসুটি আর লেখাপড়া , কাজ থেকে ফিরে এসে তাদের ভাই-বোনকে নিয়ে সাঁতারের ক্লাস , আঁকার ক্লাস , বাবার খামখেয়াল….দিব্যি হাসিমুখে সয়ে যান | বাড়ি চলে বাবার বেনিয়মে আর মায়ের নিয়মে | মেয়েটি ইশকুল যায় | খুব ক্রিয়েটিভ লেখালেখির চল সে ইশকুলে | সে ঝাঁপালো চুল দুলিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার বাবার ঘাড়ে , " দেখো তো , কেমন লিখেছি | " বাবা দেখেন , কখনো কখনো বলেন , " বা: , বাবুইপাখি , তুই তো বেশ লিখিস !" মেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, "যা: , তোমার খালি খালি ঠাট্টা, না ?"
মেয়েটি ভাবে ঠাট্টা ! কেন ভাবে ? কারণ তার বাবা যে 'লেখেন" ! পদ্য-গদ্যের চন্দনগন্ধ ছাপিয়ে যায় রান্নাঘরের মুসুরির ডালে কালোজিরে শুকনো লঙ্কা ফোড়নের ঝাঁঝকে | বাবার বন্ধুরা আসেন গল্প করতে , বাড়িতে সব সময় সদর দরজাটা প্রায় খোলাই থাকে | মেয়েটি ছোট থেকে বড় হয় বাবাকে লিখতে দেখে | বাবার গলায় উঁচু স্কেলের গান শুনে | বাবার সঙ্গে সেও গলা মেলায় | কিন্তু পাল্লা দিতে পারে না | সে শোনে , শোনে | শুনতে শুনতে তার শ্রুতি তৈরী হয়ে যায় | সে পড়ে আর পড়ে | আগে যত না, এখন বড় হচ্ছে তো…খুব পড়ে…বাবার লেখা….গোগ্রাসে | আর আচ্ছন্ন হয়ে যায় | এতই এ জড়িয়ে থাকা যে সেভাবে আর অন্য কেউ তাকে আচ্ছন্নই করতে পারে না | পারেওনি | আজ পর্যন্ত |
এই মেয়েটি আমার সই | কথা হয়েছে অনেকবার | তার বাবাকে নিয়ে | আমার প্রিয় কবিকে নিয়ে | মেলাতে চেষ্টা করেছি মানুষ - পদ্যকার- গদ্যকার এই তিনটি সত্তাকে | এ নিয়ে প্রশ্ন করেছি | জবাব পেয়েছি | সেগুলোই আগে বলি | এখানে | কথোপকথনে |
-- ছোটবেলার ছবি আঁকো একটু | বাবা লিখছেন….
-- ছোটবেলা আর বড়বেলায় একটাই ছবি জানো | বাবা লিখছে | খাটে বসে , একমনে | বাঁ হাতটা খাটে ভর দিয়ে রাখা | মা এসেছে …সংসারের কথা নিয়ে | আমরা হুটোপুটি করছি | বাইরে নানান আওয়াজ, ফেরিওয়ালা….বাবা লিখছে … লিখছে…. কী পরিষ্কার করে ! কোনো কাটাকুটি নেই | কোনো ডুডলিং নেই | মা বলেছে , 'এই এত আওয়াজ ! তুমি কী করে যে লেখো '! বাবা বলেছে , ' এটা জানো আমার মাথার ভেতরে একটা হার্মনির কাজ করে | আর একবার ওই হার্মনি এসে গেলে আর কোনো বাইরের শব্দই আমার কানে আসে না |'
-- পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটি নেই ! বা: , জানো , প্রেমেন্দ্র মিত্রর ছিল অমন | উনি বলেছেন বড় সুন্দর একটি কথা | ' কেউ পাতায় কাটে, কেউ মনে | আমি মনে কাটি | '
-- একদম ঠিক | বাবাও ওইভাবেই লিখত | তোমায় দেখাবো পাণ্ডুলিপি | সেইজন্যই …ওই যে লিখলাম, মনের মতো হল না, ছিঁড়ে ফেলে দিলাম….ও সব পাটই ছিল না |
-- বাবা গান করতেন | আর আবৃত্তি ?
-- না ! কই আর ! শুনিনি তো কখনো সেভাবে বাড়িতে | এমনকি এই যে আমাকে আর ভাইকে নিয়ে ছড়া লিখেছে কত , কিন্তু মনেই পড়ে না , বাবার কাছে বসে ছড়া শুনছি ঘরে বসে | আর এমনিতে যদি কবিতা পাঠের কথা বল ,সে তো অজস্র | কবিতার আসর , সাহিত্যবাসর লেগেই থাকত | অনেক কবিতা পড়ত সেখানে | শুনে শুনে আমার যে কত কবিতাই মুখস্থ !
-- ছড়া ? বা: ! আচ্ছা, কবিতায় ছন্দ নিয়ে কিছু বিশেষ মতামত ছিল ?
--অবশ্যই ! বাবা প্রায়ই লিখেছে , ‘ ছন্দে লেখো আগে | পরে ছন্দ ভাঙার খেলা’ | এই যে সবাই কবিতা লেখে ; ছন্দের ছাঁকনি খুব দরকার | ওই ছাঁকনি ব্যবহার করলেই অ-কবি রয়ে যাবে ছাঁকনিতে আর কবিরা স্বতন্ত্র হয়ে বিরাজ করবেন | তখন সেই সব কবিদের মধ্যে আবার মূল্য নির্ণয়ন করা যাবে…কে কত উজ্জ্বল | এই তো, শান্তিনিকেতনে হয়েছিল ..কবিতা লেখার ক্লাস | সে কী উত্তেজনা | ছেলেপুলেরা লিখছে , বাবাকে দেখাচ্ছে, পড়ে শোনাচ্ছে | বাবা মাত্রা মেপে ঠিকঠাক করে শিখিয়ে দিচ্ছে | বাবা বলত , ' ছন্দ গড়তে শেখার পর…. বুঝতে পারবে | ওই যে সেই খুব চেনা কথা ক'টি ….বাবাই লিখেছিল , 'ভাঙা ….গড়ার চেয়েও মূল্যবান কখনো সখনো ' .. |
[ এবার কিছু স্বয়ং কবির জবানীতে :" আমি যে ভাষায় কথা বলি গদ্যে , আমি বা আমরা , তাকেই মোটামুটিভাবে অক্ষরপ্রধান ছন্দে বসাতে পারা যায় বলে মনে করি | একটু কাটছাঁট দরকার | সে কাটছাঁটের কাজ দর্জি তথা কানের | মাত্রাবৃত্তে নানারকম ভাবে লিখেছি | সবচেয়ে লিখে মজা পেয়েছি ওই মাত্রাবৃত্তকে স্বরবৃত্তের মতো ব্যবহার করে | ওটা একটা দড়ির খেলা | কান নির্ভর | এবং কান -নির্ভর | ছন্দজ্ঞান থাকলে তবেই ছন্দ ভাঙা যায় | বিহ্বলভাবে ছন্দ ভাঙার আমি ঘোর বিরোধী | আগে ছন্দোবদ্ধ লেখা , তারপর স্বেচ্ছাগদ্য" | ]
-- খুব নিয়ম বেঁধে লেখাপড়া, পদ্য লেখা ছিল কি ?
-- না না | যখন খুশি , তখন | আসলে খুব মনে মনে একাচোরা ছিল | একটা মজার ঘটনা বলি | মায়ের কাছে শোনা | ১৯৮৫ | বাবা কবিতা উত্সবের উদ্যোক্তা | সেবার অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান হয়েছিল | ন্যাশনাল লাইব্রেরি , শিশির মঞ্চ … বাবা গেছে শম্ভু মিত্রর বাড়ি | বলেছে , ' শম্ভুদা , কবিতা উত্সব | আপনি
আসবেন তো ?' শম্ভু মিত্র বলেছিলেন, ' যেতে পারি ; কিন্তু একটা শর্ত আছে|' বাবা জানতে চেয়েছিল , 'কী শর্ত ?' শম্ভু মিত্র বলেছিলেন , ' তোমার একটি কবিতা আমি পড়ব | তোমাকে সেই কবিতার অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে | ' বাবা নাকি বলেছিল , ' তাহলে বোধহয় আপনার আর আসা হল না ! '
নিজের ভেতরে কী ঘটছে, কাউকে বলত না বাবা | নিজের লেখাপত্তর নিয়েও তেমন আলাপ আলোচনা করত না | হয়ত একটা কোনো ঘটনা ঘটল, সে অভিঘাত বাবাকে বিপর্যস্ত করল, বাবা তা মনের মধ্যে লালন করল মাস , বছর ধরে | তারপর হয়ত কোন পদ্য বা গদ্য| মানে…..ওইটা রয়েই গিয়েছিল….বাবার মধ্যে ; কিন্তু ঘুমোয়নি | জেগেই ছিল |
-- কখনো এমন হয়নি , যে পদ্য লেখা আসছে না ….খুব ছটফটানি …
-- ওষুধ ছিল | তখন বাবা অনুবাদের কাজ করত | সেইভাবেই মায়াকভস্কি , হাইনে, রিলকে, গালিব , খৈয়াম….
-- আর যে ভাষাগুলো জানা নেই ?
-- হয়ত খুব প্রামাণ্য ইংরিজি অনুবাদ | তবে মূল ভাষার বিশেষজ্ঞ তো থাকতেনই কেউ কেউ | যেমন মায়াকভস্কির সময় মুকুল গুহ , হাইনের জন্য বিক্রমণ নায়ার , গালিব বা খৈয়ামে আয়ান রশিদ খান | জানো , বাবা শুরু করেছিল গীতার অনুবাদ | সে তো অসম্পূর্ণই রয়ে গেল | মা যখন তাগাদা দিত কাজটা শেষ তাড়াতাড়ি করার জন্য , বাবা বলত …খুব শক্ত কাজ | খুব মন:সংযোগ দরকার | বাবাকে গীতা খুব আকর্ষণ করত |
-- সামগ্রিকভাবে সাহিত্যচর্চা….এই যে যাদের রুজি-রুটি…….
-- বাবা বলত সাহিত্য করতে কেউ জন্মায় না | করতে হয়, করে নিতে হয় | যার ভাল্লাগে , সে করে | যার ভাল্লাগে না , সে করে না !
-- আচ্ছা, এই ধর রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ….
-- বাবা বলত , রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের কাছে জল হাওয়া আকাশের মতোই অনিবার্য | আমাদের নি:শ্বাসে আমাদের রক্তে এক হয়ে মিশে আছেন | তবে বাবা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতার অত ভক্ত ছিল না | কিন্তু গান ? গান শুনতে আমরা বাধ্য | সুখে দু:খে আমাদের পরম আশ্রয় | আর জীবনানন্দর প্রভাব যে পদ্যে এসেছে, তা তো বাবা স্বীকার করেই গেছে | কারণ জীবনানন্দের পদ্যের যে মারাত্মক মায়া ! আবার বেরিয়েও এসেছে সেই প্রভাব থেকে |
-- আর রবীন্দ্রনাথ ?
-- বাবা 'ধর্মে আছ জিরাফেও আছ ' তে রবীন্দ্রনাথের মতো ভাষায় লেখবার চেষ্টা করেছিল | এর একটি কারণ ছিল | তখন অনেকেই বলত , আধুনিক কবিতা সকলের জন্য নয় | শুধুই এক বিশেষ গোষ্ঠীর পাঠকের জন্য | তাই বিষয়ের দিক থেকে নয়, রবীন্দ্রনাথের ধরনের ছন্দ বা ভাষার একটু সরলীকরণের কথা চিন্তা করেই লিখেছিল | আর জীবনানন্দ ? এবার বরং বাবাই বলবে | বাবার ভাষায় :
[ " টোটাল, টোটাল কবি বলে মনে হয় আমার ওঁকে | একটু এলোমেলো, হয়ত ক্রিয়াপদের জন্যই লাগে, অনেকসময় | অনেকসময় প্রকাশভঙ্গির জন্যই উনি এলোমেলো, এটাই ওঁর স্বভাব লেখার | সেটা হয়ত অনেক জায়গায় আমারও এলোমেলো ভাব এসেছে | সরাসরি ওঁর অনুকৃতি বলতে পার | তবে আমার নিজস্ব কিছু জিনিসপত্রও আছে !"]
-- আর গান ছাড়া রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অন্য কিছু ?
-- বলেছে তো ! রবীন্দ্রনাথ এত বড় এক মানুষ, যে শুধু পুজো ক’রে তার ভিতরের মানুষটিকে চিনে নেওয়া যায় না | অগস্ত্য মুনির কাছে যেমন বিন্ধ্য পর্বতকে নত হতে হয়েছিল , রবীন্দ্রনাথের কাছেও তেমন ভারত নামের পর্বতটিকে নত হতে হয়েছে | তবে বাবার কিছু অভিযোগও ছিল | বলত , রবীন্দ্রনাথ মহর্ষিকে নিয়ে বিস্তর লিখেছেন, কিন্তু মায়ের কথা তেমন নেই তো ! রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও দেখো, মাতৃচরিত্র আছে , কিন্তু তা রক্তমাংসের চরিত্রের মতো জীবন্ত নয় | বা , এই যেমন বলত রবীন্দ্রনাথের লেখায় কলকাতা বা চিত্পুরের মতো জায়গা….কেমন অনুপস্থিত | অথচ ওঁর তো দেখার চোখ ছিল !
-- আর তোমার বাবার গদ্য লেখা ?
- ও : , সে এক কাণ্ড ! বাবা মোটেই ভালবাসত না গদ্য লিখতে | দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যা| আশির দশক | বরাত এল উপন্যাস লেখার | বাবা লেখার জন্য ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিল কোথায় একটা | পরে সমীর সেনগুপ্ত বলেছিলেন , সে কী ভীষণ যুদ্ধ বাবার …সরস্বতীর সঙ্গে | গুচ্ছের বীয়ারের বোতল, কিন্তু লেখাও হচ্ছে না , খোলাও হচ্ছে না ! গদ্য লেখা বাবার ধাতে ছিল না | আর জানো , লিখেছে তো | কিন্তু আত্মজৈবনিক উপন্যাসগুলোতে যে সব মানুষের আসা যাওয়া , যে সব মুখের ; তারাই ঘুরেফিরে এসেছে পদ্যে, গদ্যে …বারেবারে | ঘুরেফিরে এসেছে কৈশোর , প্রথম ভালবাসা, নস্ট্যালজিয়া | ফলে আমরা বলতাম , কেমন মনে হয় কোথায় যেন পুনরাবৃত্তি ! বরং বাবার ভাষাতেই বলি,
[ " কবিতা একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস, গদ্য খুব কম্পার্টমেন্টাল ব্যাপার | এটা সুখের প্রশ্ন | গদ্য লেখায় ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই সুখ পাই না | গদ্য ও পদ্য-র মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত | গদ্যকার হল মজুর , কবি হল শিল্পী| তবে মজুরও কখনো শিল্পী হয়ে ওঠে | যেমন রাজমিস্ত্রী আর্কিটেক্ট হয় | তবে গদ্যশিল্পী হয়ে ওঠাটা একটা বড় পরিশ্রমসাপেক্ষ | কায়িক শ্রমটাই আসল | পদ্য লিখতে কি শ্রম নেই ? আধুনিক কবিকে যথেষ্ট শ্রম করতে হয় -- মানসিক শ্রম | একটি সার্থক পদ্য লিখতে গিয়ে তাকে তছনছ হয়ে যেতে হয় | এটা সবচেয়ে বড় কথা, তার সেই মানসিক ওলটপালট অবস্থাকে মাত্র কিছু কিছু শব্দের মধ্যে দিয়ে পদ্যে গড়ে তুলতে হয়”|]
-- আর তোমার মা ? মা আসেননি বাবার লেখায় , কবিতায় ?
-- মা তো ছিলই সবটা জুড়ে | বাবা একবার বলেছিল , মাকে দেখার আগে বাবা অন্য মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে হয়ত ; কিন্তু সেই স্নেহ, প্রীতি, মমতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেনি| সেখানে মা-ই প্রথম, মা-ই শেষ | একবার, মায়ের মুখেই শুনেছি….মা ছিল , আর সমীর কাকু , সমীর সেনগুপ্ত | মা বলেছিল, ' তুমি আমাকে নিয়ে তো কিছু লেখ না !' বাবা সমীর কাকুকে বলেছিল , 'কী যে বলে ! ' অর্থাৎ পুরোটা জুড়েই কিন্তু মা |
-- আর তুমি ?
-- আমি ? বাবা যে বলেছিল……
[ " বাবুইকে যে ভালোবাসি, সে কি আমার মেয়ে বলে ? কী জানি , ও মেয়ে না ছেলে তা মনেও পড়ে না আমার | ও যেন আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য একটা কিছু ,একেবারে আলাদা | কিন্তু ও তো আমার ; ও তো আমারই মেয়ে | আসলে ও আমারই একটা অংশ | একেবারে আমার | আবার মাঝে মাঝে মনে হয় যদি জড়িয়ে ফেলে আমাকে ? তখন একটা প্রতিরোধ আসে , আমি প্রবল যন্ত্রণা পাই | কিন্তু আমি আবার ফিরে আসি ওর কাছে, আমার নিজেরই কাছে |'']
-- আর এই যে কবিতায় বাস , নিরলস কবিতাতেই ….কবির, কবিতাপ্রেমীর……
-- আমি …এই প্রশ্নটি মনে আসে আর বাবার গলা কানে ভেসে আসে….
[ " কা কবিতা ? তা, আমিও জানি না | কিংবা কোনো সময় থেকে জানতে জানতে আমি পদ্য লেখা শুরু করিনি | এবং বোধ করি কেউই তা করে না | অর্থাৎ এ নিয়ে কোনরূপ নিদান হানার পক্ষপাতী আমি নই | পদ্যভাব পড়ে আছে মাঠেঘাটে , ফলফুলুরিতে , আছে গাইবাছুরে , পুঁইমাচায় ...এমনকি বাঁশবাগানের মাথায় ঘুড়ির মতো লটকে থাকা চাঁদের টুকরোয় | ভাঙা দেয়ালের পাশে , চাঁদের রুজুরুজু উন্মাদ দৌড়ঝাঁপ এবং হৃদয় , হৃদয়ের চতুর্দিকে ঘিরে ফেলার নেশা আমাদের পেয়ে বসে এবং আমরা শব্দে শব্দে ঘা মেরে বাজিয়ে , বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেইসব আলেখ্যর কাছে এনে সবাইকে দাঁড় করাতে চাই | সকলে দাঁড়ায় না | সবার দাঁড়ানোর কথাও না | কেউ কেউ দাঁড়ায় | তারা ঠুকরে ঠুকরে কবিতার ছবির রং রস হৃদস্পন্দন খায় | গোগ্রাসে যারা গেলে তারা কবিতার শত্রু | যারা ঠুকরে খায় , তারা এদিকওদিক ঠিকরে পড়ে | তাদের জ্বালার আর অন্ত নেই | কবিতা আমার প্রাণের আরাম , আমার আত্মার শান্তি , আমার হৃদয়ের দু:খ-সুখের সমুদ্র | কবিতা আমার দুপুর রোদের ছায়া - যা বাইরে পড়ে না, পড়ে ভিতরে , আমার সঙ্গে পৃথক সে কখনোই নয় | এইসব আহ্লাদে কথাবার্তা | তাছাড়া , বেশি কিছু নয় , বড় কিছু নয় | হয়ত |"]
-- বাবা কি খুব ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন ? মন্ত্রপাঠ, পুজো আচ্চা …
-- বাবার কাছে ঈশ্বর মানে বড় | যে বাবার কথা শোনে , বাবাকেও কিছু শোনায়| সেই ঈশ্বর ….বাবা যখন মধ্যরাতে অন্ধকার চৌরঙ্গী পার হত বা ট্রামলাইন ধরে সেই উন্মত্ত দৌড়…..সঙ্গে থাকতেন | বাবার সঙ্গেই | আমৃত্যু |
-- এই যে সারা জীবন ধরে এত অজস্র কবিতা লিখেছেন…….
-- কই না তো ! বাবা বিশ্বাস করত সারা জীবন ধরে কোনো কবি একটিই কবিতা লিখে যান | শুধুই টুকরো টুকরো করা থাকে | খণ্ড কবিতা | জুড়ে দিলে একটিই | নাম দিতে হয় শুধু ওই খণ্ডগুলিকে চিনে নেবার জন্য | না দিলেও চলে | সংখ্যাই যথেষ্ট | অত বিশাল পদ্য কে ছাপবে ? তাই টুকরো করে বিলিয়ে দেওয়া | নিজেকে| একটি একটি খণ্ড পদ্য কবির আলাদা আলাদা মুড | পাঠক কবিকে স্পর্শ করে সেই মুডের মাধ্যমে | আবার হয়ত একই পদ্যের মুড আলাদা আলাদা পাঠকের কাছে আলাদা আলাদা | কারণ প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের মধ্য দিয়ে যে বোধ রয়ে যায় , সে অনুযায়ী তার কাছে সেই পদ্যটির আবেদন ধরা পড়ে | পদ্য ছবির মতোই একটি আর্টফর্ম , তাই পদ্য এক একজনকে এক এক মুডে নাড়া দেয় |
-- আচ্ছা , কখনো নিজের লেখা আবার ঘষামাজা করতেন ?
-- কক্ষনো নয় | আগের দিন রাতে লেখা যা, পরের দিন সকালেই আর পড়ে দেখত না | কারণ……
[ " আমি সবসময় চাই এগিয়ে যেতে | ওই জন্যই আমার পরবর্তী মুহূর্তটি চাই, অন্যরকম অভিজ্ঞতা চাই | এমনকি অনেকদিন বাদে যদি দেখি কোথাও কোনো ত্রুটি থেকে গেছে , সংশোধন করি না | কারণ যে সময়ে পদ্যটি লিখেছিলাম, সেই সময়ের অনুভূতিতে তা সত্য ছিল | পদ্য লেখার ক্ষেত্রে ওই মাঝেমধ্যে বাগান পরিষ্কারে আমার বিশ্বাস নেই |"]
-- " কখনো তোমার করে , তোমাকে ভাবিনি……"
-- আমার মা | এই লেখায় বাবা ছুঁয়ে থেকেছে মাকে | বলতে চেয়েছে , খুশিমতো এই যে জীবন….মা তেমন আলাদা করে জায়গা পায়নি হয়ত | এই ব্যস্ততা …. কিন্তু আমরা তো এই বৃত্তে আছি | একই সমাজে | ….
[ " যদিও উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্য থেকে অনেক পদ্য লেখা হয়েছে , তবুও দু'বার মৃত্যুর কাছাকাছি এসে মনে হয়েছিল , ' এবারে একটু ঘুরে দাঁড়ানো ভালো | জীবনের থেকে বড় তো আর কিছু নয় |”]
-- " এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে চিতাকাঠ ডাকে আয় আয় …"
-- বাগবাজারের গঙ্গা | বাবার মামারবাড়ি | দিদিমার মৃত্যু | শ্মশান |
বাবার দিদিমা যে ঘরে মারা যান , সে ঘরের দেয়ালে একটা নাকি পেরেক পোঁতা ছিল | বাবা প্রায়ই ওই পেরেকটায় গিয়ে হাত বোলাত | ওই পেরেকে যেন বাবার দিদিমার স্পর্শ !
-- " যেতে পারি , যে কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো ?"
-- জীবন তো অসুখী নয় | তাই মৃত্যুর মুখোমুখি এসে যে একবার বড় সাধ হয়….
''কিন্তু কেন যাবো ?''
" সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো"…. সন্তান যে বড় আপন , বড় মায়ার | তার মধ্যেই তো নিজের অনেক কিছু রয়ে যায় | ……
[ " তবু রক্তে চৈত্রের বাতাস , তাই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে রয়ে গেলাম …এমন নয়| শুধু একটি চুমো খেতে যতটুকু সময় ! এর মধ্যে একটা আলগা ভাব রয়েছে, উদাসীনতা কাজ করেছে | যতই সামাজিক হবার চেষ্টা করি , আসলে মূলে রয়ে গেছে একটা ছন্নছাড়া প্রভাব | আবারও যেন সামাজিক হয়ে উঠতে চাওয়া…..' তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো….'কারণ…যদি যেতেই হয়… ঠিক এর অনুরূপ একটি জীবন আমার অন্যত্রও চাই | তাই 'তোমাদের' কথাও ভাবতে হয় বৈকি !'
… এবং অবাধ্য শব্দ ক্রমাগত সাজিয়ে মহান আবার বানাতে হবে নিজহাতে নিজেরই সমাধি….
যাকে বলে ফেরা , বলে পিছুটান , পিতৃদু:খ বলে |”]
এখন অনেক রাত | আমরা কথা বলছি | অনেক অনেক | কথা গড়িয়ে যাচ্ছে কবিতায়, গদ্যে, নির্জন আলাপচারিতায়| আমি এক গভীর বিষণ্নতার নকশিকাঁথা শরীরে মনে জড়িয়ে ছুঁয়ে ছিলাম আমার প্রিয় কবিকে | আকাশ কোনো কথা বলছিল না , বাতাস ছিল চুপটি করে | ফুলের মতো সহজ হয়ে আসছিল কবিতার কাছে বলার মতো কিছু ভাষা
….যাতে দেয়াল নেই, দরজা নেই..কবিতা হাত রেখেছিল আমার দুই হাতে ….আমার
কানে কানে অস্ফুটে বলছিল , " তোমার কথা আমিও কিছু জানি……"
কবি : শক্তি চট্টোপাধ্যায়
কবিকন্যা : তিতি