এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মগ্নমৈনাক

    Anirban Dutta Choudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০১ এপ্রিল ২০১৯ | ৩১১৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মফঃস্বলের প্রেমের গল্প - এখনকার সময়ে খুবই কাঁচা এবং অদরকারি, স্মার্ট নয়।

    মগ্নমৈনাক
    অনির্বাণ দত্ত চৌধুরী
    --

    (১)

    মৈনাক আজ অনেক দিন পরে স্কুলের পাড়ায় এসেছেন। প্রায় বছর কুড়ি হয়ে গেল।
    তখন মৈনাকরা ভাড়া থাকতেন। একটা দোতলা হলুদ রঙচটা বাড়ির একতলায়। এই তো সেদিনকার কথা। টেস্ট দিয়ে হই হই করতে করতে বাড়ি গেলেন। টেস্টের পরে টানা তিনমাস ছুটি। বাড়ি বসে পড়তে হবে। তারপর মাধ্যমিক।

    তি--ন--মা--স।

    ভাবা যায়? গরমের সময় একমাস ছুটি ছাড়া স্কুল জীবনে এতোটা টানা ছুটি তো বলতে গেলে পাওয়াই যেত না।
    টানা এক মাস ছুটি - সেটাকে কম মনে হত।

    সত্যি? …… এরকম জীবন ছিল না কি কখনো?

    অবিশ্বাসে ভরা চোখে স্কুল বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মৈনাক। ভ্রু কুঁচকে গেছে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো? ক্লাসরুমের সবুজ দরজা গুলোকে কি বিশাল মনে হত তখন। পাল্লাগুলো যেন ঘিরে ধরছে, দরজার ফ্রেমের ওপরের দিকটা তো ক্লাস সেভেন অব্দি লাফিয়ে ধরতে হত। তারপর গোড়ালিতে ভর দিয়ে। আচ্ছা, এখন ছুঁতে গেলে কেমন হত?

    আজ তো ছুঁয়ে দেখা হবে না - শনিবার স্কুল বন্ধ, পরে একদিন উইকডে তে আসতে হবে। আসতেই হবে।

    বাকেট লিস্ট।

    টেস্ট দিয়ে অবশ্য মৈনাক সরাসরি বাড়ি যান নি। স্কুলের পরে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট-গল্প-আড্ডা সেরে স্কুল থেকে বেরিয়েছিলেন। হারকিউলিস সাইকেল, ঘন সবুজ রঙের। চেন কভার দেওয়া আছে। সিটের হাইট বাইশ ইঞ্চি থেকে বাড়িয়ে চব্বিশ ইঞ্চি করা হয়েছে। বাবার টোটকা। এতে নাকি ছেলে আরও চটপট লম্বা হবে।

    মিথ। একদম ফালতু মিথ।
    হাজার সাইকেলে চড়েও মৈনাক পাঁচ সাতের বেশি উঠতে পারেন নি।

    বন্ধুদের শেষবারের মত টাটা করে মৈনাক হারকিউলিসের প্যাডেলে চাপ দিয়েছিলেন। দেরী হয়ে যাচ্ছিল। সাইকেলে চেপে, হ্যাঁ ওই বাঁদিকের রাস্তা দিয়েই প্রতিদিনের মত, এগোচ্ছিলেন। প্যাডেলে একটু জোরে চাপ।

    স্কুলের পরে লাইব্রেরী, তারও দুটো গলি পরে বাবুনদের বাড়ি ছাড়িয়ে কথোপকথনের সামনে ছন্দা দাঁড়িয়ে থাকবে। মালতীবালা স্মৃতি বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের ছাত্রী ছন্দা।

    আর কথোপকথন একটা এস টি ডি বুথ।

    মারাত্মক পপুলার এস টি ডি বুথ। কাজের ফোন, অদরকারে ফোন, স্কুলের ফোন, কাজের মাসীর ফোন, আর সর্বোপরি প্রেমালাপের ফোন। সদা ব্যস্ত।
    টেস্টের পরে দুজনের স্কুলেই ছুটি পড়ে যাচ্ছে, এর পর নিয়মিত দেখা করা যাবে না। তাই সেদিন স্পেশাল অ্যাপো। একটু বেশী সময় কাটানো।

    প্ল্যান তাই ছিল। ইন ফ্যাক্ট, মৈনাক বেশ সুন্দর দেখতে কাঁথা স্টিচের মলাটের ডায়েরীর ভেতরে গোলাপ লুকিয়ে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

    কিন্তু গড ডিজপোজ করলেন।

    বৃষ্টি নেমে এলো। অঝোর ধারে। মৈনাক হাঁ করে বৃষ্টিতে ভিজছেন। কাঁথা স্টিচের ডায়েরীও ভিজছে।

    অসময়ের বৃষ্টি।

    কথোপকথন বন্ধ, সবুজ রঙের পিসিও, হলুদ রঙের এসটিডি আর লাল রঙের আইএসডি। এসটিডি লেখাটা বাঁদিকে কিছুটা উঠে গেছে। মৈনাকের জামা ভিজে সপ্‌সপ্‌। দুপুর বেলায় কে আর ফোন করতে আসে? সেই সন্ধ্যে হলে, যদি ঝড় থামে, তবেই কথোপকথন খুলবে।

    দশ বারোটা বাড়ি পরে সুমনের বাড়ি - গেলেই হত। কিন্তু মৈনাক যান নি। কাকীমা যদি জিজ্ঞেস করে বসেন - এখানে কোথায় এসেছো মৈনাক?

    মৈনাকদের বাড়ি তো রেললাইন পেরিয়ে সেই রবীন্দ্রপল্লীতে। পুরোটা উল্টোদিকে। কাকিমাকে কি জবাব দিতেন মৈনাক?

    স্কুল গেটের সামনে দাঁড় করানো হণ্ডা সিটির ভেতরে আজকের মৈনাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শেষ কবে নিজের স্কুল বা কলেজের সামনে বৃষ্টিতে ভিজেছেন সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না। আজকেও সে আশা পূর্ণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। দুর ছাই, বাকেট লিস্টে আর একটা আইটেম যোগ হল।

    বায়োলজির স্যার জীবনবাবু পড়াতেন, যে প্রাণী জীবনধারণের জন্য অন্য জীবের ওপর ভরসা করে তাকে পরজীবী বলে। পরজীবি দুপ্রকার হয়, মিথোজীবী – আর ... আর একটা মনে পড়ছে না। স্কুলের জীবনটা বোধহয় মিথোজীবিতা ছিল, তাঁদেরও স্কুলকে প্রয়োজন, স্কুলেরও প্রয়োজন ছাত্রের।

    সেদিন মৈনাক মিনিট দশেক সাইকেলে বসে থেকে, ভ্যাবলার মত ভিজে বাড়ি চলে এসেছিলেন। জানতে পারেন নি আরো কিছুক্ষণের মধ্যে, ছন্দা, বৃষ্টিতে রিকশা না পেয়ে জল ঠেলে ঠেলে কথোপকথনের সামনে হাজির হয়েছিল। চারদিন বাদে যখন জানতে পারলেন, তখন বড্ডো দেরি হয়ে গেছে। ছন্দা জ্বর-টর বাঁধিয়ে বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার। মৈনাক ভয়ে ছন্দাদের বাড়িমুখো হন নি।

    একজন বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়ায় নি।

    তারপর কালের নিয়মে মাধ্যমিক এল। চলেও গেল। অ্যাডিশনাল পরীক্ষার শেষে মালতীবালার সামনে থেকে ছন্দাকে পাকড়াও করলেন মৈনাক। ছন্দা এড়িয়ে যাচ্ছিল, মৈনাক’ই জোর করেছিলেন।

    আবার সেই কথোপকথন। আবার সেই ফিসফিস।

    - তুমি দেরী করে এসেছো, তাই আমায় দেখতে পাও নি। প্লিজ এটা নিয়ে আর রাগ কোরো না। লক্ষীটি, প্লিজ।
    - ওই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসছি, দেরি তো হবেই ...... এসেছিলাম এই ঢের। তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে না কেন?
    - ছিলাম তো, পাক্কা দশ মিনিট। আর কতক্ষণ থাকবো?
    - তোমার তো সাইকেল, টুক করে এসেছো, আবার টুক করে চলে গেছো। আমি কি জানতে গেছি নাকি কখন এসেছো? আদৌ এসেছো কিনা?
    - কি? ... আমি আসি নি? তুমি এটা বলতে পারলে? আমি মিথ্যে কথা বলছি?
    - বলতেই পারো, তোমায় তো আর কম দিন দেখছি না।

    ফিসফিস কখন হিসহিসে পরিণত হয়েছে, মৈনাক-ছন্দা টেরও পান নি। টের পাওয়ার কথাও নয়। হিসেব মেলানোর সময় কে আর অত ভাবে।

    - ছন্দা আমি এসেছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তোমার জন্য একটা কাঁথা স্টিচের ডায়েরি ......
    - কি জানি বাবা, কিছুই বিশ্বাস নেই। তোমরা ছেলেরা কথায় কথায় ঢপ দিতে পারো।
    - তাই যদি হয়, তাহলে দেখা না করলেই হয়। এতোই যদি অবিশ্বাস, তাহলে ......
    - কে চেয়েছে দেখা করতে? আমি? না তুমি? টেনে টেনে আমাকে এখানে নিয়ে এলো কে? মৈনাক, আমার আর তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না ......
    - প্লিজ ছন্দা, একটু ভাবো, মাধ্যমিক ছিল সামনে।
    - আরে ... ভারী আমার মাধ্যমিক রে। নম্বর কি পাবে সেতো জানা আছে। আবার বড়ো বড়ো কথা।

    খোকন’দা কথোপকথন থেকে মুখ বাড়ালো।
    তোদের হয়ে গেলে জানাস। রঙের মিস্ত্রীকে খবর দিতে হবে।
    কেন খোকনদা?

    দোকানের নাম মুছে আবার লিখতে হবে, কথোপকথন চলবে না। ভাবছি নতুন নাম দেব।

    কলহ।

    তখনকার মত হেসে ফেললেও, মৈনাক টের পেয়েছিলেন একটা ধাক্কা। একটা জোর ধাক্কা। মনের মধ্যে একটা জেদ। সত্যিই তো লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র তিনি। পড়াশোনায় বরাবরই মোটামুটি। ছন্দা কিছু ভুল বলে নি। কিন্তু এত জনের সামনে বলল। কথাটা কি তাচ্ছিল্যের সাথেই না বলল। বিদ্রূপের হাসি মাখানো ছিল। খোকনদাও হাসছিল।
    ছন্দাকে দেখিয়ে দিতে হবে। রেজাল্ট কাকে বলে সেটা ছন্দাকে দেখিয়ে দিতে হবে।

    তা দেখিয়েছেন বটে মৈনাক।

    হায়ার সেকেন্ডারি থেকে শুরু করে জীবনের পরের পরীক্ষাগুলোয় ক্রমাগত সাফল্যের ধাপ উৎরেছেন। ছন্দা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, নতুন সম্পর্ক। ভাঙ্গা-গড়া। মাল্টি-ন্যাশনাল অফিসে ঢুকে তরতর করে উন্নতি। অফিসের সহকর্মীর সাথে প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে।

    ছন্দার সাথে আর কোনোদিন কথা বলা হয়ে ওঠে নি মৈনাকের। সত্যিটা হল মৈনাক কথা বলেন নি ইচ্ছে করে। ছন্দা অবশ্য ক্লাস ইলেভেনে, বারদুয়েক কমন বন্ধু মারফত যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন।

    আহত মৈনাক কোনো উৎসাহ দেখান নি। শুধু একটা ভেজা কাঁথা স্টিচের ডায়েরি বন্ধু মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যস্‌।

    ছন্দা কোনোদিন সেভাবে আর মৈনাকের জীবনে ফিরে আসেন নি। হায়ার সেকেন্ডারিতে জেলায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে কলকাতায় চলে এলেন।
    ক্লাস নাইন-টেনের ‘দুরন্ত’ প্রেম মৈনাকের জীবনে ব্যারাকপুর লোকাল হয়েই রয়ে গিয়েছে।

    কলেজ-ইউনিভার্সিটির বাকি সম্পর্কগুলো মৈনাকের সেভাবে মনেও পড়ে না। কিন্তু মালতীবালা স্মৃতি বিদ্যালয়ের ছন্দা, ক্লাস টেনের বিনুনি বাঁধা ছন্দা, মানুষ মৈনাক’কে চিরকালের জন্য পালটে দিয়ে গেছে।

    ইঁদুরদৌড়ের লাস্ট ল্যাপে, পাকা ম্যারাথন রানারের মত স্পিড বাড়িয়ে, প্রথম ঝাঁকটায় ঢুকে পড়েছেন মৈনাক। কুড়ি বছর আগের, ছন্দার সেই অপমানের বদলা নেওয়ার দৌড় এখনও চলছে। দৌড় থামার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখছেন না মৈনাক।

    মৈনাক খুব মন দিয়ে ভেবে দেখলেন, সেই তুলনায় ছন্দার জীবনে তাঁর সেরকম কোনো ভূমিকাই নেই। থাকতে পারে না।

    শুধু এক সেই বাল্যপ্রেম।

    আর বাল্যপ্রেমে ...... সে তো সবাই জানে ......

    (২)

    হাঁটতে হাঁটতে কখন কথোপকথনের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন খেয়ালই ছিল না মৈনাকের। কিন্তু দোতলা বাড়িটার নীচতলায় কথোপকথন কই? এ তো মোবাইলের দোকান।

    মৈনাক একটু উঁকি-ঝুঁকি মারলেন। ওই তো কে একটা বসে আছে। খোকনদা কি? হ্যাঁ, সেরকমই মনে হচ্ছে। খোকনদাই বসে আছে। মাথা ফাঁকা প্রায়। চেহারায় একটা হাল্কা সফল ব্যাবসায়ী জেল্লা চলে এসেছে, আর চোখে চশমা। দোকান ভালোই চলে মনে হয়, এসি চলছে। খুব দামী মোবাইল সেট নেই। কিন্তু দোকানে কাটতি আছে, সেটা লেটেস্ট মোবাইলের পসরা দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে।

    দোকানের নামটা অবশ্য খোকনদা পালটায় নি। নিয়নের লাইট জ্বলছে - কথোপকথন।

    বাকেট লিস্টে আরেকটা আইটেম যোগ হতে দেওয়া যায় না। মৈনাক ঢুকে পড়লেন। হেডফোনটা অনেক দিন ধরেই বেগড়বাঁই করছে, এমনিতেই কিনতে হত।

    খোকনদা চিনতে পারল না। সেটাই স্বাভাবিক। মাধ্যমিকের পরে আর দু-বছর ছিলেন মৈনাক এই স্কুলে। কুড়িটা বছর চলে গেছে। আঠেরো আর আটত্রিশে যে বড্ডো বেশী তফাত।

    একটা চলনসই হেডসেট কিনে মৈনাক নিজের পরিচয় দিলেন। খোকনদা প্রথমে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর হো হো করে হেসে ফেলল।

    - সে কি রে, আপনি ... মানে ... তুই? কতদিন বাদে দেখলাম রে? তা প্রায় বছর কুড়ি হবে ... হবে না?
    - হ্যাঁ, এক্স্যাক্টলি কুড়ি’ই। তোমার দোকানে তখন একটা এস টি ডি বুথ ছিল, সবাই খুব ফোন করতে আসত।
    - ঠিক ঠিক, তারপরে একটা ইন্টারনেট কাফে করেছিলাম, জানিস। তদ্দিনে তোরা পাস করে চলে গেছিস। কিন্তু তাও শেষ দিকে আর চলছিল না, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট ঢুকে পড়ল। এই বছর পাঁচেক হল, ওটা পালটে মোবাইলের দোকান দিলাম। তবে কি জানিস, দোকানের নামটা কিন্তু পাল্টাই নি একবার’ও। তো অ্যাদ্দিন বাদে হঠাৎ ...... স্কুল দেখতে এসেছিস তুই?
    - হ্যাঁ, ওই ... আর কি।
    - তা কেমন দেখলি?
    - অনেক কিছুই পালটে গেছে খোকনদা। অবশ্য ... সেটাই স্বাভাবিক। আমিও তো অনেকটাই ...... তুমি কিন্তু অনেকটা এরকম আছো খোকনদা। আচ্ছা, আমাদের ব্যাচের আর কাউকে দেখো নাকি?
    - না ... সেরকম কেউ তো এখানে আর থাকে টাকে না। মাঝে মধ্যে তোর মত কেউ আসে। তবে ...
    - তবে কি?
    - না মানেই, কাছেই একটা নতুন ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইমারি স্কুল খুলেছে।
    - আরে দূর, আমাদের সময় আবার ইংলিশ স্কুল কোথায়? তুমি আমাদের স্কুলের কথা বলো ......
    - আরে শোনই না ...... ওই স্কুলটায় ছন্দার ছেলে পড়ে। ছন্দাকে দেখি, মাঝে মাঝে নিতে আসে। পাশের পাড়াতেই ছন্দার বিয়ে হয়েছে। ছেলেকে এই স্কুলটায় ভর্তি করেছে। আমাকে বিয়েতে বলেছিল। আমার কাছ থেকেই ফোন রিচার্জ করায়।

    মৈনাক চুপ।

    - কি রে, তোর মনে নেই? তোদের সাথেই তো পড়তো, নাকি আমি ভুল করছি? অ্যাতো বছরে তো আর কম স্টুডেন্ট পাস করল না।
    - হ্যাঁ, মানে ... আমাদের সঙ্গেই ...
    - দাঁড়া দেখি তুই একটু। ইংরিজী স্কুল। শনিবারও পুরো খোলা। একটু পরেই যাবে এদিক দিয়ে। দ্যাখ, চিনতে পারিস কিনা।

    (৩)

    খোকনদাই ডাকল – এই যে ছন্দা, ছন্দা – শোনো একবার এদিকে।
    একটি ক্লাস থ্রি-ফোরের সাদা-নীল স্কুল-ড্রেস বাচ্চাকে নিয়ে ছন্দা হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটু অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন।

    - কি হয়েছে, খোকনদা?
    - এই দ্যাখো দেখি, একে চিনতে পারো নাকি?
    মৈনাক চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মন দিয়ে ছন্দাকে দেখছিলেন। বুকের ভিতর কেমন একটা শিরশিরানি। এরকম হচ্ছে কেন? কোথায় যেন শুনেছিলেন – সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লে কোনোদিন সেই ভালোলাগার অনুভূতি উবে যায় না। হাজার চেষ্টা করলেও না।

    ফল্গু নদীর মত লুকিয়ে থাকে।

    ছন্দা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল – কেমন আছো? এদিকে কোনো কাজে এসেছো?
    - না, আসলে হঠাৎ করেই অনেকটা ...
    - ভালোই তো, কোথায় আছো এখন?
    - টেক্সাস ... মানে অফিসের কাজে।
    - বাঃ, কাকু-কাকিমা কেমন? ভালো তো?
    - হ্যাঁ বাবা-মা ভালোই আছেন, তোমার?
    - হুম্‌ম্‌... বাবা-মা আছে, বেশ আছে। এ বয়েসে যেমন থাকার সেরকম’ই আছে।
    - ছন্দা ... তোমার ছেলে?
    - হ্যাঁ, লাল্টু ... যা দুরন্ত হয়েছে না।

    মৈনাক লক্ষ্য করলেন, ছন্দা তাঁকে একবারও নাম ধরে ডাকলেন না। কাটা কাটা কথা। এতোটা অবহেলা, এতোদিন পরেও। মৈনাকের একটু কষ্ট হল।

    লাল্টু একটু রাস্তার ওপারে এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিল। ভারী মিষ্টি ছেলেটি। সাদা জামা নীল হাফপ্যান্ট। ছন্দা কব্জিতে বাঁধা কালো হাতঘড়িটায় একনজর বুলিয়ে, ডেকে উঠলেন - লাল্টু, এদিকে এসো। বাড়ি যেতে হবে, দিদুন ফোন করেছিল। মেঘ করেছে, এক্ষুণি বৃষ্টি নামবে।

    মৈনাক হেসে তড়বড় করে কিছু একটা বলতে গেলেন, কিন্তু কথা খুঁজে পেলেন না। মাথায় একটাই পাক খাচ্ছে – এতোটা উপেক্ষা। প্রাপ্য ছিল তাঁর?
    ছন্দা মৃদু বাধ্যবাধকতার হাসি হেসে মৈনাকের দিকে তাকালেন, আজ তাহলে এগোই। ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।

    মৈনাক কিছুই ঠিক করে বলে উঠতে পারলেন না। আধখানা ঘাড় নাড়লেন।

    ছন্দার সাথে দেখা না হলেই ভালো হত, নিজেকে খুব অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে। সেই মাধ্যমিকের পরে, কুড়ি বছর ধরে, মেয়েটি কোনোদিন তার কথা ভাবেও নি। আজ যে দেখা হল, তাতেও তার ওপরে কোনো প্রভাব পরে নি। আজই হয়ত বাড়ি ফিরে স্বামীর সাথে এই ঘটনা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে।

    ছন্দার হাত ধরে লাল্টু এগিয়ে যাচ্ছে। মৈনাক দেখছেন। কথোপকথনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। টুপটুপ করে ভারী ফোঁটার বৃষ্টি পড়ছে, একটা ফোঁটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে, গায়ে লাগছে না। পুরো ব্যাপারটা জলছবির মত লাগছে। মৈনাকদের ছোটোবেলায় পাওয়া যেত। খাতার ওপরে রেখে পেন্সিলের পেছন দিকটা দিয়ে ঘষলেই ম্যাজিকের মত ...... এখন কি আর পাওয়া যায়?

    মৈনাক পিছু হাঁটছেন। স্কুলের সামনে বৃষ্টিতে ভেজা’টা যে বাকেট লিস্টে ছিল, মৈনাকের সেটা আর এখন মনে পড়ছে না।

    (৪)

    মোড় ঘোরার মুখে, মৈনাকের পাশ দিয়ে সাদা-নীল একটা তীর ছুটে গেল। লাল্টুর বয়েসী একটি ছেলে। একই স্কুলের হবে।

    দৌড়োচ্ছে আর চিৎকার করছে - এই মৈনাক, মৈনাক, লাল স্কেচপেনটা, কালকে মনে করে নিয়ে আসিস কিন্তু।

    মার হাত ধরে ছোট্টো মৈনাক ঘুরে তাকালো – ওকে, ওকে … সিওর আনবো।

    মোড়ের ওপাশে নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে আরেক মৈনাকের হঠাৎ জীবনবাবুর মুখটা মনে পড়লো –

    আর এক ধরণের পরজীবী হয় - তাদেরকে বলে - মৃতজীবী।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০১ এপ্রিল ২০১৯ | ৩১১৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • নির্মাল্য | 121.24.***.*** | ৩০ জুলাই ২০২০ ০৩:৪৮95673
  • বেশ গল্প। শেষ টা এক্সপেক্ট করিনি। 

  • dc | 103.195.***.*** | ৩০ জুলাই ২০২০ ০৮:০২95675
  • "সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লে কোনোদিন সেই ভালোলাগার অনুভূতি উবে যায় না"

    হুম।
  • | ৩০ জুলাই ২০২০ ০৯:৪৬95678
  • আচ্ছা এই গল্পটা আমি আগে কোথায় যেন পড়েছি। ফেসবুকে কী? ওই কাঁথাস্টিচের ডায়রি আর ফোনবুথের ব্যপারটা একদম পরিস্কার মনে আছে।
  • r2h | 2405:201:8805:37c0:41a9:8a56:96a4:***:*** | ৩০ জুলাই ২০২০ ০৯:৪৯95679
  • গুরুতেই কি? ২০১৯এর লেখা তো।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন