এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সমাজ

  • আজকের ব্রাহ্মণ্যধর্মের চৌপদী - পর্ব দুই

    রঞ্জন রায়
    আলোচনা | সমাজ | ১৩ নভেম্বর ২০২৫ | ২৮৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মনুস্মৃতি, মায়াবাদ, ভগবদ্গীতায় যুদ্ধের নৈতিকতা ও হিন্দুত্বের তত্ত্ব

    ছবি: রমিত




    ৩.০ মনুসংহিতা কী বলেন?

    নিও-নর্মাল কে সি পাল
    নতুন শতাব্দীর দুটো দশক পেরিয়ে গেল। বিশ্বায়নের যুগে ঘরে বসে দুনিয়ার খবর, অডিও এবং ভিস্যুয়াল মাধ্যমে আমরা পেয়ে যাচ্ছি। কথা চলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে গেছে। নতুন কোন জায়গায় গেলে আমরা অচেনা লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করি না। বরং মোবাইলে জিপিএস দেখে ঠিকমত পৌঁছে যাই আমড়াতলার মোড়ে।

    কিন্তু আচমকা চারদিকে শুনতে পাই যে এসবই নাকি ‘ব্যাদে আছে’! সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট করছিলেন। গণেশের নাকে হাতির শুঁড় প্লাস্টিক সার্জারি করে লাগানো হয়েছিল। রামায়ণের পুষ্পক বিমান আসলে প্রাচীন যুগের এয়ার ইন্ডিয়া।

    অথচ কেউ খেয়াল করেন না যে পৌরাণিক যুগে রাজপ্রাসাদেও ইলেকট্রিসিটি ছিল না। সর্বত্র দীপদান এবং মশালের আলো। এমনকি বৌদ্ধযুগেও বাসবদত্তা ভিক্ষু উপগুপ্তকে দেখছে প্রদীপের আলোয় –“ প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাহার নবীন গৌরকান্তি”।

    আর পৌরাণিক যুগে তো সবাই যাতায়াত করেন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে, মানে পশুতে টানা শকটে বা রথে। তাই দেবতারাও সব বলদবাহন, ময়ুরবাহন, অশ্ববাহন, হস্তীবাহন এবং মকর বা সিংহবাহিনী।

    বাস্তববুদ্ধি ঘুলিয়ে দেয়ার এজাতীয় চেষ্টা যে কয়েক দশক আগেও হয়নি এমন নয়। যেমন সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য নয় পৃথিবী। এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। তখন এসব শুনে বা হাওড়া ব্রীজের গায়ে লেখাগুলো পড়ে আমরা সবাই হাসতাম, কে সি পালকে কিছুটা প্রশ্রয়ের সুরে বলতাম পাগল। কিন্তু আজকাল অবস্থা বদলে গেছে। ওই কথাগুলো বলা হচ্ছে জোরগলায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে।

    যেমন শেষ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসে পেপার পড়া হয়েছে যে প্রাচীন যুগে ভারতে বিমান ব্যবস্থা ছিল। সেই বিমান অনেক উন্নত টেকনোলজিতে চলত। তাতে মোটরগাড়ির মত ‘ব্যাকগিয়ার’ ছিল। হাইকোর্টের বিচারপতি বলছেন ময়ূর হল খাঁটি ব্রহ্মচারী। তার চোখের জলে ময়ূরীর গর্ভ হয়। বোকাবাক্সতে দেখছি এমন দাবি যে জ্যোতিষে ক্যানসার সেরে যায়। বা পতঞ্জলি আশ্রমের ৭৫০ টাকার প্যাকেজে করোনা রোগী ১০০% সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্যে পরে কা কথা, দেশের প্রধানসেবক নিজেই গণেশের শুঁড়কে প্রাচীন প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ বলে দাবি করছেন।

    এখন কেউ হাসতে সাহস করেনা। এ নিয়ে প্রশ্ন করেনা। করলেই আপনি হয় দেশদ্রোহী, নয় ভারতের সংস্কৃতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্টে ঘা দিচ্ছেন।

    মনুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা?
    খবরের কাগজ বলছে রাজস্থানে নাকি মনু মহারাজ বা মনুস্মৃতির প্রণেতা মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপন করা হবে। তাঁকে দেখতে কেমন কেউ জানেনা। কোথাও ছবিটবি দেখিনি। ইদানীং একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠার হুজুক শুরু হয়েছে। সাভারকর , শ্যামাপ্রসাদ , নাথুরাম গডসে হয়ে গেছে। এবার আমাদের প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থের রচয়িতা মনুর পালা। যদিও দলিত সমুদায়ের বক্তব্য আমাদের সমাজে জাতপাতের ভাগাভাগি, ছোঁয়াছুঁয়ি এসব নাকি মনুস্মৃতিতে লিপিবদ্ধ, সেখান থেকে শুরু। তাই ওঁরা দেশের অদলাবদলি করে শাসন ক্ষমতায় থাকা বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে মনুবাদী পার্টি বলেন।

    ইদানীং দলিতদের উপর অত্যাচার বেশ বেড়েছে।

    অর্থাৎ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নামে যা খুশি বলাটা নিও-নর্মাল হয়ে গেছে।

    এর সামাজিক প্রতিফলন দেখছি বিশেষ করে তিনটে ব্যাপারে।

    এক হল খাদ্যাখাদ্য। ডাক্তার নয়, সরকার ঠিক করে দেবে আপনি কী খাবেন বা কী খাবেন না। শুধু তাই নয়, ফ্রীজে গোমাংস রাখা আছে এই সন্দেহে আদালতে না গিয়েই লোককে পিটিয়ে মারা হচ্ছে।

    দুই, নারীর কীসে ভাল তা অবলা কোমল ভারতীয় নারী বোঝেনা। ওর কেমন পোশাক পরা উচিত, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা চলাফেরা করা উচিৎ, কাকে বিয়ে করা উচিত নয় সব ঠিক করে দেবে পুরুষের বা যুবকের দল, থুড়ি রাষ্ট্র। অর্থাৎ ভারতীয় নারী কোনদিনই প্রাপ্তবয়স্ক হয় না। তার বিয়ে তো ঠিক করে দেবে তার বাবা-মা। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য । কাজেই প্রাপ্তবয়স্ক চাকুরে মেয়ে যদি অন্যধর্মের ছেলেকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করে তাহলে তার কথায় কান না দিয়ে তার বাবা-মা বা সমাজের কোন অতি উৎসুক যুবকের ‘জোর করে ধর্মান্তরণ করা হচ্ছে ‘ অভিযোগ পেয়ে নতুন স্বামীকে জেলে পোরা যাবে। এটাই কয়েকটি রাজ্যে নতুন তৈরি ‘লাভ জিহাদ’ আইন।

    তিন, দলিতদের ভারতীয় সমাজে ঠিক জায়গা কোথায়? আম্বেদকর কি হিন্দু ধর্মের দলিতদের প্রতি ক্রুরতার প্রতিক্রিয়ায় কয়েক হাজার অনুগামীর সঙ্গে নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে বৌদ্ধ হয়ে যাননি?

    কয়েক বছর আগে উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত মেয়েটিকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে হত্যা করার বীভৎস ঘটনাটিকে মেয়েটির মৃত্যুপূর্ব জবানবন্দী সত্ত্বেও যেভাবে সরকারি পুলিশ, ডাক্তার ও কিছু মিডিয়া মিলে মিথ্যে, এবং নিহতের পরিবারের ‘অনার কিলিং’ বলে দাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল তা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

    তাহলে ভারতীয় বা হিন্দুসমাজের এই তিনটে বিষয়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য কী? দেখুন, এখন আর একটি নতুন সত্য বা পোস্ট-ট্রুথ হল যাহা হিন্দু তাহাই ভারতীয়। অথচ, বিশুদ্ধ বেদান্তদর্শন চর্চার সূত্রগ্রন্থে দেখছি বিভিন্ন মনু, গৌতম, পরাশর এবং যাজ্ঞবল্ক্য আদি বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রকে উল্লেখ করে বলা হচ্ছে—শূদ্রের নেই বেদ পাঠ বা শ্রবণের অধিকার। আর মনুসংহিতায় নাকি আমাদের প্রাচীন আচার-বিচার, উচিত-অনুচিত মায় সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড সবই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এমনকি কলোনিয়াল যুগে বৃটিশরা এ নিয়ে বেশি খোঁচাখুচি করেনি। তাই হিন্দু কোড বিল রচিত হয়েছিল স্মৃতিশাস্ত্র বা সংহিতা বিশেষ করে মনুস্মৃতি মেনে।

    কেন ? কারণ পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য ইত্যাদি অনেকগুলো সংহিতা থাকলেও মতভেদ হলে মনুর বিধানই বেদ-অনুসারী এবং মান্য বলে ধরা হয়।

    “মন্বর্থবিপরীতা যা সা স্মৃতির্ন প্রশসস্যতে”। যার ব্যাখ্যা মনুর সাথে মেলেনা তা স্মৃতিশাস্ত্রের মর্যাদা পাবে না।

    আবার ‘যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎক্বচিৎ’। অর্থাৎ যা এই বইয়ে আছে তা অন্য স্মৃতিগ্রন্থেও আছে, আর যা এতে নেই, বুঝতে হবে তা কোথাও নেই।

    কাজেই রাজস্থানে মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপিত হলে আশ্চর্যের কিছু নেই।

    মনুসংহিতাতে বাস্তবে কী বলা হয়েছে তা নিয়ে খতিয়ে না দেখেই বাজারে অনেক কথা বলা হয়। আমি চেষ্টা করব এই স্বল্প পরিসরে মনুসংহিতার স্বরূপের বর্ণনা করে তিনটি ভাগে খাদ্যাখাদ্য, জাতিপ্রথা এবং নারীর অবস্থান নিয়ে উনি কি বলেছেন তা তুলে ধরতে। মনে হয় জাতিপ্রথা নিয়ে আগে কথা বলা উচিত। কারণ, ওটাই আমাদের সমাজের প্রাচীন কাঠামো। খাদ্যাখাদ্য বা নারীর অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে ওই কাঠামোকে মেনে।

    দেখা যাক, সংহিতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুস্মৃতিতে বাস্তবে কী বিধান দেয়া আছে।

    বারোটি অধ্যায়ঃ
    এতে রয়েছে দ্বাদশ অধ্যায়।

    প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব। আরও বলা হয়েছে যে ব্রহ্মা এই শাস্ত্র মনুকে শিখিয়েছিলেন (শ্লোক ১/৫৮)। মনু দশজন প্রজাপতি মহর্ষি (মরীচি, অত্রি, বশিষ্ঠ, নারদ, ভৃগু আদি) কে শিখিয়েছিলেন। এখন ভৃগু উপস্থিত জিজ্ঞাসু মহর্ষিদের শোনাচ্ছেন।(১/৫৯)।

    এতে কী কী আছে?

    প্রায় চল্লিশটির বেশি বিষয়ে এতে আলোচনা আছে। কিছু উল্লেখ করছিঃ পৃথিবীর উৎপত্তি, সংস্কারের নিয়ম, স্ত্রীসংভোগ, বিবাহের প্রকার, মহাযজ্ঞবিধি, শ্রাদ্ধবিধি, জীবিকা, খাদ্যাখাদ্য, সাক্ষীকে প্রশ্ন করার নিয়ম, স্ত্রীপুরুষের পারস্পরিক ধর্ম, মহপাতক, উপপাতক, প্রায়শ্চিত্ত, দন্ডবিধি, সম্পত্তির নিয়ম, বর্ণসংকর, বিভিন্ন বর্ণের আপদ্ধর্ম, দেশধর্ম, জাতিধর্ম ইত্যাদি (১/১১৮)।

    এই তালিকাটি দেখুনঃ
    অধ্যায় ক্রমাংক। বিষয়
    ১। সৃষ্টি থেকে প্রলয়
    ২। ভূগোল – আর্যাবর্ত, ইত্যাদি; ব্রহ্মচারীর গুরুকুলে পালনীয় বিধি
    ৩। গার্হস্থ্য আশ্রম, আট প্রকার বিবাহ, কন্যার লক্ষণ, শ্রাদ্ধের নিয়ম
    ৪। গৃহস্থের আচারসংহিতা
    ৫। খাদ্যাখাদ্য বিচার, বেদবিহিত হিংসাকে অহিংসাকে মানা
    ৬। বানপ্রস্থের আচার আচরণ
    ৭। রাজার আচরণ; করব্যবস্থা, সাম-দান-ভেদ ও দন্ডের প্রয়োগ
    ৮। দন্ড বিধি ( পেনাল এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড)
    ৯। স্ত্রীপুরুষ সম্পর্ক, উত্তরাধিকার, (সিভিল ও সিভিল প্রসিডিওর কোড)
    ১০। বর্ণাশ্রম ধর্ম, তাদের আচার-আচরণ বিধি
    ১১। নিয়মের উল্লংঘন করলে প্রায়শ্চিত্ত ও শাস্তি
    ১২। শরীর উৎপত্তি, স্বর্গ ও নরক গমন, ব্রহ্মবেত্তার লক্ষণ

    এবার তিনটে কিস্তিতে মনুসংহিতা অনুযায়ী সমাজে শূদ্রের স্থান , নারীর স্থান ও খাদ্যাখাদ্য বিচার নিয়ে কথা বলব।



    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৩ নভেম্বর ২০২৫ | ২৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বপন সেনগুপ্ত ( ঝানকু ) | 103.218.***.*** | ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৮:০২735745
  • অত্যন্ত জরুরি প্রবন্ধ ....
    অসাধারণ!
     
  • হীরেন সিংহরায় | ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৯:৫৮735748
  • মনুর ব‍্যাংকিং সুদের  বিধানটি  অতি  চমকপ্রদ । ব্রাহ্মন দেবে মাসে ২%  ক্ষত্রিয় ৩% বৈশ‍্য ৪% শূদ্র  ৫% । বার্ষিক রেট হলো ২৪% ৩৬% ৪৮% ও ৬০% যথাক্রমে । স্টেট ব‍্যাংকে দেখা ডিফারেনশিয়াল রেট অফ ইন্টারেস্টের  পয়লা নজির।  এবার তোমার আমার ই এম আই হিসেব করো! 
     
  • অরিন | 119.224.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০২৫ ০১:৩০735758
  • মনুস্মৃতি কে লিখেছিলেন একটু আলোচনা করুন না। মনু আসলে কে ছিলেন? কবে, কোথায় থাকতেন? এ বই (?) লেখার প্রেক্ষাপট কী? এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হলে পড়তে সুবিধা হয়। 
  • Ranjan Roy | ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ০০:১৯735908
  • অরিন
    সরি, আপনার পোস্টটি আজ দেখলাম। 
     
    ১ বিশেষজ্ঞদের মতেঃ মনুসংহিতা রচনায় কালে কালে অনেকের হাত পড়েছে। তাই অনেক পরস্পরবিরোধী নির্দেশ। নারীকে চারটে শ্লোকে দেবী জ্ঞানে স্তুতি, আবার ৩৬টি শ্লোকে গুষ্ঠির ষষ্ঠীপুজো! 
    খাদ্যাখাদ্য নিয়েও নানান বিরোধাভাস। কিন্তু দুটো ব্যাপারে কোন বিরোধ নেইঃ
     
    এক, ব্রাহ্মণকে অনেক বড় অপরাধেও প্রাণদণ্ড দেয়া চলবে না। বড়জোর দেশান্তরী করা যেতে পারে।
    কিন্তু শূদ্র বেদপাঠ করলে বা ব্রাহ্মণকে অপমান করলে কঠিন শারীরিক শাস্তি, এমনকি প্রাণদণ্ড। 
     
    দুই, নারীর স্বাধীনতা নেই। তিনি দ্বিজ নন, পৈতে হয় না। তাই শাস্ত্রপাঠ করতে পারেন না।
    বোঝাই যায়, স্মৃতিশাস্ত্র বেদ উপনিষদের অনেক পরে রচিত। তখন অপালা, বিশ্ববারা, গার্গী, মৈত্রেয়ীদের দিন গেছে।
    গবেষকেরা একমত এর রচনাকাল ১ম এবং ২য় কমন এরা (সি ই) নাগাদ। 
     
    এর চারটে ভার্সন পাওয়া যায়। উইলিয়াম জোন্স এন্ড কোং বঙ্গীয় ভার্সন পেয়েছিলেন--কুল্লুক ভট্ট নামক বাঙালি পণ্ডিতের লেখা। তবে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে প্রাপ্ত ভার্সনকে বেশি প্রামাণ্য ধরা হয়। 
    মনুসং হিতায় মেধাতিথির ভাষ্যকে সবচেয়ে উত্তম ধরা হয়।
     এখন ভরত চন্দ্র শিরোমণির টীকাও পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার প্রশ্নে  বাংলার জীমূতবাহনের "দায়ভাগ" টীকা প্রসিদ্ধ। তবে বাকি ভারতে "মিতাক্ষরা" পদ্ধতি মান্য।
    কোম্পানির আদালতে হিন্দুদের বিচারের জন্য স্মৃতিশাস্ত্র, মূলতঃ মনুস্মৃতিকে, ভিত্তি করে  নির্বাচিত ১১জন  পণ্ডিত মিলে হিন্দু কোড বিলের রূপরেখা তৈরি করেন। এর দায়রা ছিল সিভিল-- বিবাহ, উত্তরাধিকার এবং দত্তক নেয়া।
     
    ক্রিমিনাল ল বৃটিশের তৈরি আইন হিসেবে চলত। 
     
    মনুসং হিতা কে রচনা করেন এবং কেন?  এ বিষয়ে টেক্সচুয়াল এভিডেন্স কী বলে?
     প্রথম অধ্যায় থেকে দেখা যাচ্ছে কিছু ঋষি এসে মহর্ষি স্বায়ম্ভুব* মনুকে অনুরোধ করছেন--
    "বিনম্র অনুরোধ, আপনি আমাদের চার বর্ণ এবং ওদের সৃষ্ট 'বর্ণসংকর' (অর্থাৎ বাস্টার্ড বা উচ্চজাতির পুরুষের সঙ্গে নিম্নজাতির স্ত্রীর মিলনের ফলে জাত সন্তান) জাতির লোকদের আচরণীয় ধর্মের প্রকাশ করার কৃপা করুন। ১/২
     
    * স্বায়ম্ভুব মানে যিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন--নন বায়োলজিক্যাল আর কি! 
     
    আপনি চার বেদ ও যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের জ্ঞাতা (১/৩) , চার প্রকার প্রাণীর জন্ম ( জরায়ুজ--যারা জরায়ু থেকে জন্মায়, অন্ডজ-- ডিম থেকে জন্মায়, স্বেদজ--ঘাম থেকে জন্মায় মশা মাছি পোকা, উদ্ভিজ --মাটি ফুঁড়ে বেরোয়) বৃত্তান্ত বলুন। 
    মনু বললেন--অব্যক্ত নিরাকার পরব্রহ্মএর ব্যক্ত সাকার রূপ হলেন ব্রহ্মা।  প্রলয়ের পর প্রত্যেক কল্পকালে পরব্রহ্ম বেদোচ্চারণ করে নিজেই নিজেকে উৎপন্ন করেন। অর্থাৎ উনি একইসঙ্গে সৃষ্টির আদি বা উপাদান কারণ এবং নিমিত্ত কারণ। (১/১০)
     
    এভাবেই উনি সবার পিতামহ ব্রহ্মাকে সৃজন করেন।  তাই পরমেশ্বরের নির্বিকার রূপ হোল ব্রহ্ম আর সাকার বা সবিকার রূপ হলেন ব্রহ্মা।  এরপর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নিজেই স্থাবর জঙ্গম, নর নারী সব সৃষ্টি করেন।  তাই উনি প্রজাপতি । মানে মানবের পিতামহ। নিয়ন্তা।  (১/২৭)
    অনাদি পরব্রহ্ম লোককল্যাণ হেতু মুখ , বাহু, হাঁটু এবং পা থেকে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র উৎপন্ন করলেন। মনু বললেন--আমিই ব্রহ্মা। (১/৩৬, ৩৭)। 
     
    আমি অনাদি ব্রহ্মের ইচ্ছে পূর্ণ করতে দশ জন মহর্ষিকে সৃষ্টি করলাম। ওনারা বাকি সৃষ্টির কাজ করলেন। (১/৪০)
     
    *সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে মনুস্মৃতির বর্ণনার সঙ্গে পুরাণের বর্ণনার অনেকখানি অমিল। 
     
    এভাবে মনু মহর্ষিদের বলে চললেন। বলা হয় প্রথম ৫২ শ্লোক ওঁর রচনা আর বাকি সব মহর্ষি ভৃগুর রচনা। 
     
    স্মৃতিশাস্ত্র রচনার কেন দরকার পড়ল? আমার যা মনে হয়
     
    স্পষ্টত তখন বর্ণাশ্রম ধর্ম বেশ rigid  আগের  flexibility হারিয়েছে। তাই দরকার পড়ল বিভিন্ন জাতির কোড অফ কন্ডাক্ট, সম্পত্তি, বিবাহবিধি, রাজার কর্তবা, স্বামী স্ত্রীর কর্তব্য, পাপ ও প্রায়শিচত্ত এর নিয়ম বেঁধে দেয়া। মনুস্মৃতি সেই কাজটাই করেছে। আজকে তার প্রাসংগিকতা হারালেও সেই সময়ে রাজ্যগঠনের দিনে এই কাজটা নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক ছিল--গোঁড়া ব্রাহ্মণবাদী  পিতৃতান্ত্রিক ঝোঁক সত্ত্বেও। 
  • অরিন | 119.224.***.*** | ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ০১:৩০735910
  • অসংখ‍্য ধন‍্যবাদ রঞ্জনবাবু। ভারি সুন্দর করে লিখলেন। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন