কোনো অজ্ঞাত কারণে আমার ধারণা ছিল, যে, বিগত দশ-পনেরো বছরে র্যাগিং ব্যাপারটা কমে আসছে। যা পড়ছি, তাতে মনে হচ্ছে, কমে তো নিই, বরং বেড়েছেও কিঞ্চিৎ, তাও হতে পারে। ছাত্র সংগঠনদের চুলোচুলি, মিডিয়ায় হইচই, হঠাৎ একটা ঘটনার খবর হয়ে ওঠা, সবই অব্যাহত। এই পদ্ধতিটা এতই চেনা, যে, দু-লাইন না লিখে পারছিনা।
১। র্যাগিং একটা সিস্টেমিক এবং সিস্টেমেটিক ব্যাপার। বিচ্ছিন্নভাবে র্যাগিং হয়না। এবং কলেজের প্রতিটি ছাত্র সংগঠন ব্যাপারটা জানে। হ্যাঁ, প্রতিটা ঘটনা জানেনা, অংশগ্রহণ বা এনডোর্স করেনা, সবই সম্ভব, কিন্তু জানেনা, এটা হয়না। যদি কেউ বলে, জানতামনা, তাহলে হয় সেই সংগঠনটা নেই (সেটা হতেই পারে, সব কলেজে সব সংগঠন থাকেনা), অথবা গুল দিচ্ছে। বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আর যদি কোনো সংগঠন বলে, জানেনা, কারণ এটা "বিচ্ছিন্ন ঘটনা", তাহলে সেটাও গুল। "বিচ্ছিন্ন র্যাগিং" হয়না। বিচ্ছিন্ন খুন-জখম-রাহাজানি-গুন্ডামি-শ্লীলতাহানি সবই হতে পারে, কিন্তু র্যাগিং না। কারণ, আপনি কল্পনা করে দেখুন, অন্য একটা ছেলেকে আপনি বলছেন, "এই, প্যান্ট খুলে রাত বারোটায় ইন্ট্রো দিয়ে যাবি" - এটা চুপি-চুপি হয়না, এবং এটা আপনার মাথাতেই আসবেনা, যদি না একটা কালচার চালু থাকে, এবং সেটার একরকম মান্যতা থাকে।
২। র্যাগিং কতদূর যায়, সেটায় অনেকেই বিস্মিত হচ্ছেন। হবার কোনো কারণ নেই। শারীরিক পীড়ন, যৌন লাঞ্ছনা, যৌন হেনস্থা - এগুলো খুব সাধারণ অস্ত্র, এগুলো র্যাগিং এর খুব চেনা বিষয়। এবং নিশ্চিন্ত থাকুন, প্রতিটা ছাত্রসংগঠন সেটা জানে। হ্যাঁ, যারা প্রবল উদ্যোগে জেন্ডার সেনসিটাইজেশন করে এসেছে, তারাও জানে, যে ওগুলো টুকটাক হয়, এবং সহ্য করে নিতে হয়। নচেৎ ছাত্রদেরও সমস্যা। কারণ, চার বছর কলেজে থাকতে হবে, সিনিয়ারদের সাহায্য নিতে হবে। আর এই সমস্ত খুচরো জিনিস সামনে চলে এলে সংগঠনেরও সমস্যা, "বৃহত্তর" বিষয়গুলোয় মনঃসংযোগ করা যাবেনা, যেগুলো তাঁরা অন্য কোথাও শিখে এসেছেন। এই কারণেই খুব বিরাট কিছু ঘটনা না ঘটে গেলে কলেজে র্যাগিং কখনই কোনো ইস্যু হয়না। নইলে, সব কটা সংগঠন চাইলে, একসঙ্গে চাইলে, র্যাগিং ঘটেনা।
৩। অভিযোগ আসেনা কেন। কারণ, কেউ পাশে থাকবেনা। যে ভর্তি হচ্ছে, তাকে কলেজে টিকে থাকতে হবে, আমরা যারা সোশাল মিডিয়ায় বাণী দিচ্ছি, তারা তো সঙ্গে থাকবনা। তাকেই একঘরে হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। আর র্যাগিং এর যে বড় অংশটা, যৌন হেনস্থা, সেটা নিয়ে বলতে গেলে লোকলজ্জা এবং পাবলিক হিউমিলিয়েশনের ভয় আছে। "তোর ** মেপেছে? হ্যা হ্যা হ্যা।" ইত্যাদি। আইন-কানুন তো নেইই। ছেলেদের যৌন লাঞ্ছনা, এবং ধর্ষণ, ভারতবর্ষে হয়না, কারণ আইনে নেই। ফলে এই সিস্টেমিক এবং সিস্টেমেটিক যৌনহেনস্থা মূলত আইনস্বীকৃত, বা বলা যায়, ওগুলো হয়না। আদতে সব্বাই জানেন, কী বিপুল এর প্রসার, সমকামীরা তো জানেনই, কিন্তু আইনগুলোকে ইউনিসেক্স করার কোনো দাবী শুনেছেন? নাঃ। দাবী তো নেইই, বরং বললে আপনি প্রগতিবিরোধী হয়ে যাবেন। যারা সেই স্ট্যাম্প মারবে, তারা প্রগতিশীলতার হোলসেলার, এবং ওই সংগঠনগুলোতেও আছে, যারা নাকি "কিছুই জানেনা"।
ফলে এইগুলো আপাতত চলবে। হইচই হচ্ছে, কদিন একটু বন্ধ থাকবে। দুটো-তিনটে ছেলেকে তুলেছে, তারা বলির-পাঁঠা, না সত্যিই অপরাধী জানার উপায় নেই। যাই হোক, এখন হস্টেলে একটু ভয়ের আবহাওয়া চলবে। তারপর থিতিয়ে গেলে হস্টেল-সেন্টিমেন্ট আবারও ফিরে আসবে। তারপর আবার হেনস্থা হবে, কারণ ওগুলো হয়না, বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সমস্যা থাকলে সমাধান হয়। কিন্তু সমস্যাই না থাকলে আর সমাধান কীসের।
লিখলাম কেন? কারণ পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই হস্টেলের ছাত্র বা ছাত্রী নন। তাঁদের জানা দরকার, বিষয়টা কী এবং কেমন।
সংযোজনঃ
লেখাটা ফেবুতে দিয়েছিলাম। প্রগতিশীলতার হোলসেলারদের সম্পর্কে আমার মত শুনে কেউ কেউ শুনে আঁতকে উঠেছেন। তাই এই সংযোজন। এটা পরে ফেবুতেও দিয়ে দেব। ব্যাপার হল, আঁতকে ওঠার মতোই জিনিস হলেও কথাটা কিন্তু আদপেও অজানা নয়। যৌন লাঞ্ছনা নিয়ে নতুন আইন হয় নির্ভয়া কান্ডের পর। সেটা আমরা সবাই জানি, অনেকেই রাস্তায় হেঁটেওছি। এবং বেশিরভাগই ব্রিটিশ আমলের আইনের বদলে নতুন আধুনিক আইনের পক্ষে সওয়াল করেছি। আইন বদলানোর জন্য সে সময় তৈরি হয়েছিল ভার্মা কমিশন। তারা এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়। সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিও অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তাবিত বিলের খসড়া তৈরি করে ফেলে। সেই খসড়ায়, প্রত্যাশা অনুযায়ীই যৌন লাঞ্ছনা সংক্রান্ত আইনের খোলনলচে বদলানোর কথা ছিল। এবং জেন্ডার-নিউট্রালিটির কথা ছিল। অর্থাৎ কিনা, যৌন লাঞ্ছনা পুরুষ বা মহিলা, যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে, এবং আইন সব ক্ষেত্রেই এক (" ...replacing the word 'rape' wherever it occurs by the words 'sexual assault', to make the offence of sexual assault gender neutral and also widening the scope of the offence of sexual assault;") ।
এইটাই আইন হয়ে যেত। সরকার এই মর্মে অর্ডিন্যান্সও করে ফেলেছিল। কিন্তু সমস্যা আসে দুই দিক থেকে। চরম দক্ষিণপন্থীদের একটা অংশ আপত্তি করে। "ছেলেদের আবার ধর্ষণ কী" বা "ভারতীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে যাবে", এইসব দিক থেকে। তারা তখন বিরোধীপক্ষ। ফলে এই আপত্তিতে বিল পাশে গোলযোগ কিছু হতনা। কিন্তু সমস্যা আসে "প্রগতিশীল"দের দিক থেকেও। "গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মহিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং আন্দোলনকারীরা" লিঙ্গনিরপেক্ষতার প্রবল বিরোধিতা করেন। সরকারের কাছে এবং প্রকাশ্যে লিখিত বিবৃতি দেন। পড়তে নাটকীয় লাগে, তার প্রথম দাবীটিই, বোল্ডে, "The Accused Must Be Male."। অর্থাৎ অভিযুক্তদের পুরুষ হতেই হবে। আক্রান্ত কী পুরুষ হতে পারে? না, তাও পারেনা। কারণ, "There is no basis to the argument that gender neutral laws allow young boys to be protected from abuse, because all young boys and girls are fully protected by gender neutral laws in the Protection of Children from Sexual Offences Act 2012." অর্থাৎ কিনা, বাচ্চা ছেলেদের জন্যও আইনটা লিঙ্গনিরপেক্ষ করার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ তাদের জন্য পকসো আছে। অস্যার্থ, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের যৌনলাঞ্ছনা হয়না।
আজকে যাঁরা যৌনলাঞ্ছনার প্রতিকার চাইছেন, তাঁদের বলার কিছু নেই, যে, কথাটা ভুল। কিন্তু ওই সময়ে ওটাই প্রগতিশীলতার মুখপাত্রদের বয়ান ছিল। তাতে সই করেছিলেন জনাকুড়ি সংগঠনের প্রতিনিধি। সই করেন কবিতা কৃষ্ণন, তিনি তখন এআইপিডাব্লুএর সম্পাদিকা, নিবেদিতা মেনন, বৃন্দা গ্রোভার ইত্যাদিরা। সবই দিল্লি এবং কিছু বোম্বে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যা হয়। বোম্বের বাইসেক্সুয়াল এবং লেসবিয়ানদের একটা সংগঠন ছিল, দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু পুং সমকামীদের কোনো সই নেই। সিপিএম বাদে বামপন্থী লিবারাল তৃতীয় ধারার অংশটা সবটাই এই ছাতায় চলে আসে। সিপিএমের কারো সই না থাকলেও, তাদের অবস্থানও এইটাই ছিলঃ "...rejects the Verma Committee recommendations on issues like making rape a gender specific crime in the law"।
এর পিছনে যুক্তি ছিল মোটের উপর একটাই। পুরুষ ও নারীর অবস্থানের অসাম্য আছে সমাজে। কথাটা ঠিকই। কিন্তু তার জন্য অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন না এনে, ফৌজদারি বিধিতে বৈষম্য আসবে কেন, পরিষ্কার না। এবং পুং দের পুংদের হাতেও আক্রান্ত হতে কী অসুবিধে সেটাও বোঝা যায়না। যাহোক, অন্যের মুখে ঝাল খাবার দরকার নেই, বিশদে পড়তে চাইলে বিবৃতিটা পুরোটা যে কেউ পড়ে নিতে পারেন। কিন্তু মোদ্দা কথা যা দাঁড়াল, ক্ষমতার সমীকরণ যাই থাক, এই "প্রগতিশীল" মতামতটাই শেষ পর্যন্ত থাকে। সরকার সমালোচনা অনুযায়ী আইনটাকে "কেবলমাত্র পুরুষ অপরাধী ও আক্রান্ত নারীদের জন্য" করে ফেলে। এটা ২০১৩ সালের কথা। মূলধারার প্রগতিশীলদের অবস্থান তার পর থেকে আর বদলায়নি।
ফলে ব্যাপারটা এই যে, যৌন লাঞ্ছনার প্রতিকার যতই চান, লাঞ্ছনা যতই সুসংবদ্ধ হোক, আইনে ওটা স্বীকৃত না। কালকেই কাগজে বেরিয়েছে, স্বপ্নদীপের ক্ষেত্রে পকসো আইন প্রয়োগ করতে হচ্ছে, কারণ, কপালগুণে ছেলেটির বয়স ১৮র কম ছিল। যাদের ১৮ টপকেছে, এবং যারা মারা যায়নি, তাদের ক্ষেত্রে যৌন লাঞ্ছনার সুরাহা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। এবং প্রগতিশীলরা, দেখবেন, তবু জেন্ডার-সেনসিটাইজেশন নিয়ে কথা বলছেন ঢোঁক গিলে, কিন্তু আইন বদলানোর দাবী তাঁরা তুলবেননা। এবং সেটা একেবারেই আপতিক না, ওটাই লাইন। এই লাইন কেন, কোন পশ্চাদপদতার হিসেবে হরিয়ানভি দক্ষিণপন্থা এবং দিল্লির প্রগতিশীলতা এক বিন্দুতে এসে পৌঁছয়, সে অন্য বিষয়। কিন্তু এইটা তো জেনে রাখা দরকার, প্রথম বর্ষের ছেলেরা হস্টেলে খুন হলে সুবিচার-টুবিচার পেতেও পারে, কিন্তু স্রেফ যৌনলাঞ্ছনার কোনো প্রতিকার হবেনা। ব্যান্ডেজ লাগিয়েই চলবে। "ধুর, ওটা তেমন কিছু না, একটু তো ন্যাংটো করে ঘুরিয়েছে খালি" টাইপ। কারণ লাইন এটাই, যে, ওটা যৌন লাঞ্ছনা নয়।
এই হল গপ্পো। এই লেখার ফলে গপ্পোটা কিছুই বদলাবেনা। কিন্তু তাও লিখলাম কেন? কারণ, আশা আছে, "প্রগতিশীল"রা এখনও প্রশ্ন করতে ভুলে যাননি। প্রশ্ন তোলার জন্যই লেখা। কোনো ন্যারেটিভ দিব্যজ্ঞানে মেনে নেবেননা। সব্বাইকে সন্দেহ করুন, প্রশ্ন করুন, "প্রগতিশীলতা"কে সমেত, আমাকে শুদ্ধু, নইলে আর বেঁচে থেকে লাভ কী?
সূত্রঃ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।