“মনসার সঙ্গে বাদ চান্দ বেণ্যা কৈল।
ছয় পুত্র লয়ে চান্দ বাণিজ্যে চলিল।।“
কেমন সে বাণিজ্য?
“সিংঘলের মুখে সাধু চলে শীঘ্রগতি।
বাহ বাহ বলে নৌকা কিবা দিবারাতি।।
ছয় পুত্র লয়ে চান্দ শ্রীঘ্রগতি চলে।
উপনীত হৈল গিয়ে পাটন সিংঘলে।।
নৌকা লাগাইল সাধু সমুদ্রকিনারে।
মনের কৌতুকে সাধু নাম্বিলা সত্ত্বরে।।
রাজভেট লয়ে সাধু বিদায় হইল।
উত্তম স্থানেতে যাজনে বাসা যে করিল।।
বাণিজ্যের আরম্ভ করিল সদাগর।
বিকিকিনি করে সাধু নাহি অবসর।।“
( বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদিত ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল, আনুমানিক সপ্তদশ শতকের লেখা)
মনসামঙ্গল পড়তে গেলেই খুব জানতে ইচ্ছে হত, সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে চাঁদ সওদাগরেরা যখন বাণিজ্যে যেতেন, সনকারা কি করতেন তখন? স্বামী-পুত্রের দেশে ফেলে রেখে যাওয়া বাণিজ্যপাট দেখাশোনা করতেন? নাকি তাঁর জন্য বরাদ্দ শুধুই সংসারকর্ম? প্রশ্নই সার, সনকারা আসলে কাব্যে উপেক্ষিতা। তাঁদের ডাক পড়ে শুধু যখন চাঁদ সওদাগরেরা ঘরে ফেরেন-
“দেশে আইল সদাগর বার্ত্তা গেল ঘরে।
সনকা বেণ্যানী আস্যে নৌকা নিবার তরে।।
দুর্ব্বা ধান্য নিল আর সুগন্ধি চন্দন।
ধুপ দীপ নিল আর যে লাগে যখন।।”
মঙ্গলময়ী নারীর মঙ্গলাচরণ বা ধর্মাচরণের পথে যতটা স্বচ্ছন্দ বিচরণ, বাণিজ্যের অর্থকরী জগতে সে প্রায় ব্রাত্য। অথচ সনকার এই প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থানের বিপক্ষে আমরা দেখি দরিদ্র ফুল্লরার সাংসারিক স্বাচ্ছ্যন্দবিধানের জন্য মাংস বেচতে যাওয়া।
নিদয়া বসিয়া খাটে, মাংস লয়ে গোলা হাটে
অনুদিন বেচয়ে ফুল্লরা।
শাশুড়ী যেমত ভণে, সেইমত বেচে কিনে,
শিরে কাঁখে মাংসের পসরা।।
মাংস বেচি লয় কড়ি, চাল লয় দাল বড়ি,
তৈল লোণ কিনয়ে বেসাতি।
শাক বেগুণ কচু মূলা, এঁটে থোড় কাঁচকলা,
নানা সজ্জা ভ’রে আনে পাঁতি।।
ফুল্লরা অবশ্য ব্যাধপত্নী, কালকেতুর বৌ। সমাজের প্রান্তিক স্তরে তাদের বসবাস। সুকুমার সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যেমনটি বলেছেন যে বঙ্গজাতির উৎপত্তি আর্য আর অনার্য দুই ভাবধারার মিশ্রণে। আর্যেরা ছিল মনোধর্মী অর্থাৎ চিন্তাশীল, আদর্শবাদী, তত্ত্বানুসন্ধিৎসু, সংযমনিষ্ঠ ও অধ্যাত্মপরায়ণ। আর অনার্যের ছিল প্রাণধর্মী অর্থাৎ ক্রিয়াশীল, বাস্তববাদী, অজিজ্ঞাসু, ভোগলিপ্সু ও দৈবনিষ্ঠ। তিনি এও বলেছেন যে সংস্কৃতিবিশুদ্ধ আর্যেরা ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মপ্রবণ। কাজেই ধরেই নিতে পারি যে মনুস্মৃতির “ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি” র বাণীটি সনকাদের মজ্জায় মজ্জায় বহমান। অন্যদিকে পেশায় ব্যাধ, কালকেতু-ফুল্লরার সামাজিক অবস্থান বোধহয় ওই আর্যেতর মানুষদেরই কাছাকাছি। ফলে একদিকে মেয়েদের নিয়ে তাদের যেমন সংস্কৃতিগত দায় কম, তেমনই কঠোর দারিদ্র্য তাদের মেয়েদের ঘরবন্দী হতে দেয় নি।
শুধু চাঁদ সদাগরের গল্প নয়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় খ্রীষ্টপুর্ব প্রথম শতকেই বাঙ্গালীর তৈরি কাপড় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, কদরও পাচ্ছে। রাজ্যের বণিক শ্রেণীর হাতে প্রচুর অর্থ, সেই অর্থের জোরে তাঁরা সহজেই রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হয়ে উঠছেন। কৃষিজ জিনিষ, শিল্পজাত দ্রব্যের দেশের মধ্যে স্থলপথে কেনাবেচার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছিল নৌ বাণিজ্য – নদীপথে দেশের মধ্যে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে বনিকেরা জাহাজ নিয়ে পাড়ি জমাতেন বহির্দেশে। আরব ব্যবসায়ীদের দাপটে বহির্বাণিজ্যের সমৃদ্ধির জগতে ভাঁটার টান ধরল অষ্টম শতকে। বাণিজ্য-প্রধান বাঙ্গালিই ধীরে ধীরে হয়ে গেল কৃষি-নির্ভর। আর এই পর্বেই পৌরাণিক, নারায়ণের অর্ধাঙ্গিনী লক্ষ্মীর জায়গায় এসে বসলেন শস্য-প্রাচুর্যের আর সমৃদ্ধির দেবী মা লক্ষ্মী। নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালির ইতিহাস ( আদি পর্বে )’ জানিয়েছেন যে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না। হারানো সাম্রাজ্য কিছুটা হলেও ফিরে পাওয়া গেল আবার চতুর্দশ শতকে। তবে এই পুরো সময় জুড়েই ছোটখাট অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের কাজে মেয়েদের দেখা মেলে। শুধু সপ্তদশ শতকের ফুল্লরাই নয়, চর্যাপদের যুগেও মেয়েদের খেয়ানৌকার পাটনী হিসেবে পাচ্ছি।
গঙ্গা জউনা মাঝেরে বহই নাই।
তাহঁ বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলা পার করেই।।
কিন্তু ওই ছোট স্তরে মেয়েদের দেখা মিললেও, একটু বড় মাপের সংগঠিত বাণিজ্যের জগতে মেয়েদের দেখা মেলা ভার। অবশ্য একটা কথা মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের প্রাচীন আমলের যে সব ঐতিহাসিক উপাদান অর্থাৎ বিভিন্ন সাহিত্যকীর্তি, ভ্রমণকাহিনী, তাম্রলিপি, প্রস্তরলিপি ইত্যাদি মেলে তার কোনটাই সরাসরি বাণিজ্যসংবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা নয়। কাজেই বাণিজ্যের সম্বন্ধে যা খবর মেলে সবই পরোক্ষ। সেই সব পরোক্ষ সূত্র থেকে শ্রেষ্ঠী ( আজকের ভাষায় ব্যাঙ্কার ) এবং সার্থবাহদের ( স্থলবাণিজ্যের ক্যারাভান-লিডার) প্রতিপত্তির কথা উদ্ধার করা যায়। এও বোঝা যায় যে স্থানীয় স্তরে হাট-বাজার তো ছিল-ই, স্থলপথে আর নদীপথে দেশের মধ্যে দূরে দূরে বাণিজ্যও ছিল – আর ছিল বহির্বাণিজ্য। বিভিন্ন সূত্রে বিজয়সিংহের লঙ্কাজয় কাহিনী ( মহাবংশ, বিজয়সিংহ খ্রীস্টপুর্ব ষষ্ঠ শতকের মানুষ ) থেকে মহীপালের রাজত্বে বণিক বুদ্ধমিত্র, লোকদত্ত থেকে ধনপতি দত্ত ( ষোড়শ শতকের মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল) অবধি যা কিছু জানা যায় তাতে অবশ্য শুধু পুরুষদেরই জয় জয়কার। এমনিতেই মেয়েদের ইতিহাস নীরবতার ইতিহাস। তবু বিদ্যাচর্চা বা সাহিত্যচর্চা বা আধ্যাত্মিকতার জগতে কয়েকজন মনস্বিনীর নাম মেলে। কলহনের রাজতরঙ্গিনীতে কমলা নামের এক অষ্টম শতাব্দীর নর্তকীর সন্ধান মেলে – তিনি নিজগুণে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তবু জীবন ও জীবিকার অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের ছায়া চেনা ইতিহাসের সীমানায় দেখা যায় না। কাজেই প্রাচীন তথা মধ্যযুগের বাংলায় যদি বা কোন নারী শ্রেষ্ঠী বা বণিক থেকেও থাকেন, ইতিহাস হয় তাদের খবর রাখে নি, বা তাঁরা সত্যিই অনুপস্থিত ছিলেন।
অবশ্য আর্য আর অনার্যেরা মিলে মিশে যে বাঙালি জাতি তৈরি করেছিল, তা ছিল এক শ্রেণী আর জাতিতে-বিভক্ত সমাজ। অনার্যেরা ছিল নিচু জাতি। উচ্চতর যে সমাজ তা আদতে ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা প্রবল প্রভাবিত, মনুস্মৃতি তার উত্তরাধিকার। সে সমাজে মেয়েদের জায়গা ছেলেদের নীচে। শুধু হিন্দুধর্ম না, এই উপমহাদেশের বেশির ভাগ ধর্মমতই সেই পথের অনুসারী। পাতিব্রাত্য আর মাতৃত্ব ছিল মেয়েদের সমাজ-নির্ধারিত আদর্শ। সমাজের একদম উচ্চস্তরে মেয়েদের মধ্যে কিছুটা প্রাথমিক পড়াশোনার চল ছিল, কিন্তু ওই অবধিই। মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার বলতে মুলতঃ ছিল স্ত্রীধন। এমনকি তাতেও মেয়েদের কতটা সত্যিকারের অধিকার ছিল তা নিয়ে বিবিধ মতামত আছে। সুকুমারি ভট্টাচার্যের মতে আর্যরা যখন ক্রমশঃ আরও আরও জায়গা দখল করল, তখন সেই সঙ্গে তারা অনেক সস্তা দাস-দাসীরও মালিক হল, ফলে আগে যে সব বাইরের অর্থনৈতিক কাজকর্মে বাড়ীর মেয়েদের সাহায্য প্রয়োজন ছিল, সেই প্রয়োজন আর থাকল না। আর ততদিনে অতিরিক্ত উৎপাদন আর বাণিজ্য দুই-ই শুধু সমাজের বিশেষ বিশেষ দলের কুক্ষিগত হয়ে গেছে। তার ফলস্বরূপ সম্পদের মালিকানাও চলে গেছে তাদেরই হাতে। সেই সম্পদ সঠিক উত্তরাধিকারীর হাতে পড়াটা সুনিশ্চিত করতে মেয়েদের, বিশেষতঃ উচ্চশ্রেণীর মেয়েদের উপর এসেছিল হরেকরকম বিধিনিষেধ। অর্থনৈতিক সম্পদের অভাব, সমাজ-নির্ধারিত শ্রেণী-বিভাগের নিষ্পেষণ, নিজের স্বোপার্জিত অর্থে নিজের অধিকার না থাকা, ভাগ্যমুখিনতা ইত্যাদি বিবিধ কারণ নিচুশ্রেণীর মেয়েদের হাট-বাজারের গন্ডির বাইরে বেরোতে দেয় নি বলে অনুমান করা যেতে পারে। আর উঁচুশ্রেণীর মেয়েদের কমোডিফিকেশন, শ্রমের লিঙ্গ-বিভাজন, বহির্জগতে বিচরণের সামাজিক বাধা ইত্যাদি বিবিধ কারণে তাঁরা শুধু শ্রেষ্ঠী কন্যা বা বণিকজায়া বা সার্থবাহ-মাতা হয়েই কাটিয়ে গেছেন।
চাঁদ সদাগরের “সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি, বসিয়ে হাজার দাঁড়ি” সাগর পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য যাত্রার সুবর্ণদিন শেষ হয়ে গেছে প্রায় অষ্টম শতকেই। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে আমরা শুধু তার স্মৃতিটুকুর ছায়া পাই। তবে মোটামুটি ভাবে চতুর্দশ শতকের গোড়া থেকে আবার বাণিজ্যের অবস্থা কিছুটা হলেও ফেরে। শুধু অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য না, বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের কথাও এই সময়ের বিভিন্ন পর্যটকের লেখায় পাওয়া যায়। বাণিজ্যনগরী হিসেবে সোনারগাঁ, সপ্তগ্রাম, চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতকের পর থেকে তো সরাসরি ইউরোপীয় জাতিদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায় বাংলার বন্দরে- শহরে। বাংলার বিখ্যাত বস্ত্রশিল্প তো বটেই, চিনি, নুন, অস্ত্র-শস্ত্র, গহনা সবই বেচাকেনার দ্রব্য। তবে গবেষকরা যদিও জানিয়েছেন যে আমির খসরুর লেখায় এক সুগার-প্ল্যান্টেশনের ( অর্থাৎ আখের খেত কি?) মালিক ছিলেন শকরা খাতুন নামের এক মহিলা, তবু মোটের উপর এই পর্বেও ব্যবসায়ে নারীর দেখা মেলা ভার। এই সময়ে কিন্তু বিদ্যাচর্চার বা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আমরা পঞ্চদশ শতকের ইন্দ্রভূতি, ষোড়শ শতকের প্রিয়ম্বদা দেবী ( শ্যামারহস্যের রচয়িতা ), বংশীদাশ কন্যা চন্দ্রাবতী, সপ্তদশ শতকের আনন্দলতিকা খ্যাত জয়ন্তী দেবী প্রমুখের দেখা পাই। ভুরশুটের বীরকন্যা ভবশঙ্করী নিজের কৃতিত্বে আকবরের থেকে রায়বাঘিনী উপাধি পান। আবার রাজ্যশাসনের কাজে তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও রানী ভবানী, মণি বেগমদের দেখা মেলে। এ কথা অনস্বীকার্য যে এঁরা সকলেই সেই সময়ের পক্ষে নেহাতই ব্যতিক্রমী চরিত্রে। বরং অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, পর্দা বা অবরোধপ্রথা মেয়েদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খুব সহজ ছিল না। তবু এই সময়ের বাংলাতেই যেখানে জগৎশেঠদের প্রবল আর্থিক রমরমা, সেখানে সেই জগতে মেয়েদের সামগ্রিক অনুপস্থিতি সমাজের পিতৃতন্ত্রের উপস্থিতি এবং তাঁদের সবরকমের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মুঠোর বাইরে না যেতে চাওয়ার প্রবণতাকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। তবু এতকিছুর পরেও প্রশ্ন জাগে মেয়েদের নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নিয়ে – যে মেয়েরা মৃত স্বামীর প্রাণ ফেরান’র জন্য একাকী অজানা পথে পাড়ি দেন, পুরুষবেশে টোলে অধ্যাপনার ও আর্তজনের চিকিৎসার কৃতিত্ব যে নারীদের ঝুলিতে, স্বামী-নাবালক পুত্রের নামে রাজ্যশাসনে যাঁরা কুন্ঠিত নন, শুধু সংগঠিত অর্থনীতির ক্ষেত্রেই তাঁদের এই বিরাগ কেন?
সময় সামনের দিকে এগোলেও মেয়েদের অবস্থার বদল হয় নি বিশেষ। ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গলের কালের প্রায় দুশো বছর পরের ১৮৬২ সালের কলকাতার বর্ণনায়ও মেছুনীর কথা এসেছে - ‘শোভাবাজারের রাজাদের ভাঙ্গা বাজারে মেছুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা মাচ ও লোনা ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের- “ও গামচাকাঁধে, ভাল মাচ নিবি?” “ও খেংরা-গুঁপো মিন্সে, চার আনা দিবি” বলে আদর কচ্ছে- মধ্যে মধ্যে দুই একজন রসিকতা জানবার জন্য মেছুনী ঘেঁটিয়ে বাপান্ত খাচ্ছেন।‘ তাঁতিনীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে হাল ফ্যাসনের শাড়ীর অন্তঃপুরে জোগান দেওয়ার গল্প তো এই কিছু বছর আগেও শহর কলকাতার চেনা ছবি ছিল। তবু যে সময় দ্বারকানাথ ঠাকুর নব্য ভারতের দিকপাল ব্যবসায়ী বলে দেশে-বিদেশে খ্যাত হচ্ছেন, শুধু দাদনী ব্যবসা করে বা ইউরোপীয়দের এজেন্সী নিয়ে নিমাই চরণ মল্লিক, মতিলাল সীল, রামদুলাল দে প্রমুখ বানিয়ারা বিশাল বড়লোক হয়ে উঠছেন, এদেশে সেই ইংরেজ আমলেও, মেয়েদের বরং আমরা বিপ্লবে-বিদ্রোহে সামিল হতে দেখছি। কিন্তু দ্বারকানাথ, রামদুলালের পাশে দাঁড়ানোর মত কোন মেয়ে পাচ্ছি না। অবশ্য ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে বাণিজ্য আর রাজনীতি হাতে হাত ধরে চলেছে, সে দুনিয়াটা সে আমলের মেয়েদের বোধ-বুদ্ধির সীমার বাইরেই ছিল বোধহয়।
এই সময়ে অবশ্য আর একটা ঘটনা ঘটল। “কোন সমাজের মূল্যায়ণ হয় তারা তাদের মেয়েদের প্রতি কেমন ব্যবহার করে” এই ধারণাটা ইউরোপীয় প্রভাবে আমাদের দেশেও এসে জাঁকিয়ে বসল – অতএব সবাই উঠে পড়ে লাগলেন মেয়েদের উন্নতি করতে। সতীদাহপ্রথা ও বাল্যবিবাহ রদ, বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং সবার উপরে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার একটা বড়রকমের বদল ঘটাল। দেখা গেল নতুন যুগের দাবী মেনে সমাজ একটু মুঠো আলগা করছে। ঘর আর বাইরের মাঝে যে অনতিক্রম্য প্রাচীর ছিল, বিশেষতঃ সমাজের উচ্চস্তরের মেয়েদের যে পাঁচিলের বাইরে পা দেওয়া একরকম মানা-ই ছিল, সেখানে সরলা দেবী চৌধুরানী, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের মত প্রগতিশীলা মেয়েদের চেষ্টায় একটি দুটি জানালা খুলতে শুরু করল। ঘরের বাইরে বেরিয়ে উপার্জন যদি করতেই হয়, তাহলে মেয়েদের জন্য ধার্য করা হল শিক্ষিকা বা সেবিকার ভূমিকা। শিক্ষাবিস্তারে মেয়েরাও এগিয়ে এলেন। তাই উনবিংশ শতকের শেষে বা বিংশ শতকের প্রথমে বেগম রোকেয়ার মত অনেকেই এগিয়ে আসেন মেয়েস্কুল খুলতে। তবে যেহেতু উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাবিস্তার, তাই একে হয়তো বাণিজ্যিক উদ্যোগ ঠিক বলা যাবে না। বরং আজ একবিংশ শতকে দাঁডিয়ে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা দুই-ই যখন বাণিজ্যিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত তখন বরং ডঃ মৌসুমি ঘোষের মত মানুষদের (যিনি ফিউচার ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনীয়ারিং এন্ড ম্যানেজমেন্টের একজন প্রতিষ্ঠাতা ) উদ্যোগপতির তকমা দেওয়া যায়।
বিংশ শতাব্দীতে প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাঙ্গালিদের ডাক দিলেন চাকরীর মোহ ছেড়ে ব্যবসা করতে। তৈরি হল বেঙ্গল কেমিক্যালস, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফস লিমিটেড ইত্যাদি। রাজেন মুখার্জী, বীরেন মুখার্জীর বাণিজ্য-সামাজ্যের শুরু ১৮৯০ সালে, স্বাধীনতার সময়েও তা দপদপিয়ে চলছে। কিন্তু সে বাণিজ্যসাধনার ডাকও গিয়ে পৌঁছায় নি বাঙ্গালী মেয়েদের কানে। কিংবা হয়ত পরিস্থিতি তখনো অনুকূল নয়। পঞ্চাশের দশকে দেশভাগের পরে, বিশেষত উদ্বাস্তু মেয়েদের কাছে অর্থসাধনা জরুরী হল। হুড়মুড়িয়ে মেয়েরা ঢুকে পড়লেন সব রকমের চাকরীতেই। মেয়েরা দোকান-পাট চালাচ্ছেন এ দৃশ্যও খুব সুলভ না হলেও ধীরে ধীরে চোখ-সওয়া হয়ে গেল। কিন্তু লক্ষ্মণের গন্ডী ওইখানেই টেনে দেওয়া।
আজ স্বাধীনতার বছর সত্তর পরে, বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বেশ টলটলায়মান। যেটুকুও বা টিকে আছে, তার বেশিটাই আর বাঙ্গালীর হাতে নেই। তবু বাঙ্গালী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাসংস্থা বলতে প্রথম যেসব পৃথিবী-বিখ্যাত বা ভারত-বিখ্যাত নামগুলি মনে আসে, সেগুলি সবই ছেলেদের তৈরী। মেয়েরা সেখানে অদৃশ্য। ভারত সরকারের দেওয়া ২০১৭-১৮ সালের তথ্যানুযায়ী আমাদের দেশের মাইক্রোব্যবসার ২০.৪৪% মালিকানা ( পূর্ণ বা আংশিক) মেয়েদের হাতে থাকলেও ছোট ও মাঝারি ব্যবসার মালিকানার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা যথাক্রমে ৫.২৬% ও ২.৬৭% । পশ্চিমবঙ্গের জন্য আলাদা তথ্য না মিললেও ধরে নেওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের ছবিটাও মোটামুটি এরই কাছাকাছি। তবে বছর বছর ট্রেন্ডটা উর্ধমুখী এটাই যা আশার কথা।
তবে বঙ্গভূমির অধিবাসী অর্থে যদি বৃহত্তর অর্থে বাঙ্গালী শব্দটি ধরা হয়, তাহলে প্রভা খৈতানের মত একগুচ্ছ মহিলা এগিয়ে আসবেন। প্রভা কলকাতা চেম্বার অফ কমার্সের ১৯৯৩-৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট এবং সেখানকার এতাবতকালের একমাত্র মহিলা প্রেসিডেন্ট। না, সমৃদ্ধির বিচারে এঁদের তৈরি সংস্থাগুলিও দেশের প্রথম হাজারটা সংস্থার মধ্যে আসে না। তবে একটাই কারণে এঁদের কথা বলা – মেয়ে বলে প্রতিবন্ধকতা এঁদেরও কম নয়, রক্ষণশীলতা হয়তো বাঙ্গালীবাড়ির তুলনায় বেশি বই কম নয় – তবু এঁরা পারলে বাঙ্গালী মেয়েরা পারে না কেন? তবে কি ওই সব রাজনৈতিক-সামাজিক কারণ আসলে কিছু নয়, ঝুঁকি নেওয়ার প্রতি অনীহা আর বিগত কয়েক শতকের কলোনিয়ান কেরানী তৈরির শিক্ষার প্রভাবে ব্যবসার প্রতি নাক সিঁটকান মনোভাব-ই আসল কালপ্রিট? কিংবা এর আসল কারণ লুকিয়ে আছে বাঙ্গালীর পুজো-আর্চার মধ্যেই ? আমরা সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করি ঘরে ঘরে। প্রতি বৃহস্পতিবার বাঙ্গালীর কন্যারা মা- ঠাকুমা- দিদিমাদের অনুসরণ করে ধুপ ধুনো দিয়ে, সাধ্যমত মিষ্টি-ফল থালায় সাজিয়ে, শঙ্খ বাজিয়ে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করেন আর পাঁচালী পাঠ করেন –
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এঁয়োগন ।
ব্রতের সকল কিছু করিবে আয়োজন ।।
আসন পাতি তাহে লক্ষ্মী মূর্তি বসাইবে ।
আম্র পল্লব, গোটা ফলে ঘট সাজিবে ।।
বিবিধ পুস্প, বিল্বপত্র নৈবদ্য সকল ।
দিবে কলা, শর্করা আতপ তণ্ডুল ।।
একটি করে মুদ্রা রাখিবে লক্ষ্মী ঘটে ।
একমুষ্টি তণ্ডুল জমাইবে লক্ষ্মী ভাঁড়ে ।।
আম্র পল্লবে করিবে সিঁদুর তৈলে গোলা।
চাল বাটি লক্ষ্মী সম্মুখে দিবে আলিপনা ।।
ধূপ দীপ জালি সম্মুখে রাখিবে ।
আসন পাতি লক্ষ্মী পূজায় বসিবে ।।
একমনে পূজা দিবে লক্ষ্মী নারায়ন ।
পূজাশেষে ব্রত কথা করিবে পাঠন ।।
“একটি করে মুদ্রা” আর “একমুষ্টি তণ্ডুল” এর গন্ডীর মধ্যে কি আর বড় স্বপ্ন আঁটে, না কি লক্ষ্মীর পাঁচালির বেঁধে দেওয়া কোড অফ কন্ডাক্টের মধ্যে প্রোডাকসন কস্ট, সার্ভিস কোয়ালিটি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ইত্যাদির কচকচি মানায়?
তথ্য সহায়তাঃ
রায়, নীহাররঞ্জন “বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব”
ক্ষেমানন্দ, মনসামঙ্গল বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদিত
চক্রবর্তী, মুকুন্দরাম সচিত্র কবিকঙ্কণ চন্ডী
সংসদ বাংলা চরিতাভিধান
Islam, Kamrunnesa “Economic History of Bengal (c. 400 – 1200 AD)”
Sarkar , Suvobrata “Bengali entrepreneurs and western technology in the nineteenth century: a social perspective”
Bhattacharji, Sukumari. "Economic Rights of Ancient Indian Women."
Economic and Political Weekly 26, no. 9/10 (1991): 507-12
Chatterjee, Ratnabali. "Sectional President's Address: Veiled And Unveiled: Women In Medieval Bengal."
Proceedings of the Indian History Congress 62 (2001): 160-79.
Alam, Md. Khurshid “Urbanization under the Sultans of Bengal during 1203_1538 A D”
https://newsroom.mastercard.com/wp-content/uploads/2018/03/MIWE_2018_Final_Report.pdfhttp://allpachali.blogspot.com/2016/10/blog-post.html ( শারদীয়া ১৪২৬ সপ্তধা পত্রিকায় প্রকাশিত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।