শুভ মহাষষ্ঠীর শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই সকলকে। সঙ্গে রইল এই উপহার -
"একপর্ণিকা" পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা একটি রহস্য-উপন্যাস।
শনিবার সন্ধে, ৬টা ১০।
নন্দদুলালবাবুর কণ্ঠস্বর যাকে বলে জলদগম্ভীর, মানে মেঘের গর্জনের মতো। তার ওপর কথা বলেন একেবারে উচ্চগ্রামে। এ-বাড়ির কাছাকাছি কোনও গ্রাম নেই ঠিকই, থাকলে গ্রামের লোকেরাও ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠত। সকালে সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা যখন এসে পৌঁছেছি, নন্দদুলালবাবু বাড়িতে ছিলেন না, কোথাও বেরিয়েছিলেন। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর বিকেলবেলা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমরা তিনজন—মা, বাবা আর আমি বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে দেখলাম বিশাল মার্বেল টপ টেবিলের ও-পারে ভদ্রলোক বসে আছেন সাবেক কালের বিশাল এক চেয়ারে। কাঠের চেয়ারের রঙ কালো কুচকুচে। পরে বাবার মুখে শুনেছি, ওই কাঠের নাম মেহগনি। আজকাল আর তেমন পাওয়া যায় না—পেলেও তার যা দাম, সোনার থেকে খুব কিছু কম নয়। আমাদের দেখেই ভদ্রলোক বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন, “খুব দুঃখিত, হঠাৎ একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়াতে আমাকে শহরে যেতে হয়েছিল। অসুবিধে কিছু হয়নি তো? ন্যাপাকে সব বলাই ছিল, আশা করি আতিথ্যের কোনও ত্রুটি হয়নি।”
বাবা খুবই বিনয়ী স্বরে বললেন, “না না, আমাদের কোনও অসুবিধেই হয়নি। নৃপেনবাবু কোনও ত্রুটি রাখেননি।”
“আরে ধুর, ন্যাপা আবার নৃপেন হল কবে থেকে? হতভাগার সব ভালো, মাথার ভেতরটা শুধু ন্যাপা-পোঁছা, ফোঁপরা। ওইটাই যা মুশকিল। বলি, গজভুক্ত কপিত্থ শুনেছ?”
প্রশ্নটা নন্দদুলালবাবু আমার দিকেই তাকিয়ে করলেন। আচমকা প্রশ্নে আমি একটু থতমত খেলেও সামলে নিয়ে বললাম, “আজ্ঞে, হাতিতে খাওয়া বেল। হাতি নাকি বেলের খোসা না ছাড়িয়েও ভেতরের শাঁস চেটেপুটে খেয়ে ফেলতে পারে।”
পরে বাবা আমাকে বলেছেন, হাতিরা ওইভাবে বেল খায় সেরকম কোনও প্রমাণ নাকি পাওয়া যায় না। সাপের দুধ-কলা খাওয়া, কিংবা হাঁসের জল ছেঁকে দুধ খাওয়ার মতোই ব্যাপারটা পুরো কাল্পনিক প্রবচন।
আমার উত্তর শুনে নন্দদুলালবাবু বললেন, “ভেরি গুড। ন্যাপার মুণ্ডুটাও ওইরকম।”
নন্দদুলালবাবুর হো হো হাসির দমকে পুরোনো বাড়ির সিলিং থেকে ঝুরঝুর করে কিছুটা বালি ঝরে পড়ল। এই সময় নৃপেনবাবুর সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকল বাদলকাকু। তার হাতে চায়ের ট্রেতে চার কাপ চা আর অন্য প্লেটে চানাচুর, বিস্কুট। বাবা-মাকে চা দেওয়ার পর বাদলকাকু আমাকে চা দিতে এলে আমি বললাম, “আমি তো চা খাই না।”
সে-কথা শুনে নন্দদুলালবাবু বললেন, “ভেরি গুড। তার মানে তুমি এঁচোড়ে পাকা নও। এ-বয়সে চা খাওয়া দু-চক্ষে দেখতে পারি না। কিন্তু কী খাবে? কোল্ড ড্রিঙ্ক? আইসক্রিম?”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “আমার কিছু লাগবে না।”
“তা বললে হয়? আমরা চা খাব, আর তুমি বসে বসে দেখবে? বাদল, খোকাবাবুর জন্যে আইসক্রিম নিয়ে আয়।”
আমি আপত্তি করলাম না। আইসক্রিমে আমার না নেই। সকলেই চায়ের কাপ হাত তুলে নিয়ে চা খেতে লাগলেন। কিন্তু অবাক হলাম নন্দদুলালবাবু যখন সশব্দে চায়ে চুমুক দিলেন, তার আওয়াজ শুনে। চায়ে চুমুক দিয়ে নন্দদুলালবাবু বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, “নবাকে হঠাৎ সিঙ্গাপুর যেতে হল কেন?”
নবা মানে নবদুলালকাকু বাবার স্কুলের সহপাঠী। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই নন্দদুলালবাবু নবদুলালকাকুর দাদু। নবদুলালকাকুর দেশের এই বাড়িতে আমাদের একসঙ্গেই ছুটি কাটাতে আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নবদুলালকাকুকে অফিসের কাজে যেতে হল সিঙ্গাপুর আর কাকিমাকে যেতে হল বেঙ্গালুরু, অফিসের জরুরি সেমিনারে। আমাদের এখানে আসাটা প্রায় ভেস্তেই যাচ্ছিল, কাকু আর কাকিমা জোর করাতে আমরা চলেই এলাম। কাকু বলেছিলেন, দাদুর বয়স হয়েছে, শরীর ভেঙে যাচ্ছে দিনকে দিন, এই সময় না এলে কবে আর আসা হবে কে জানে। তাছাড়া এই বাড়িতে নাকি একটা রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটার সমাধানের জন্যেও দাদু নাকি বার বার চাপ দিচ্ছেন নবদুলালকাকুকে। নবদুলালকাকু খুব অনুরোধ করেই বলেছিলেন, “অফিসের কাজের যা চাপ, দেখছিস তো একসঙ্গে যাব ঠিক করেও যেতে পারলাম না। তুই আর শোভা এবার যদি না যাস সমু, আর তার মধ্যে দাদুর কিছু একটা যদি হয়ে যায়, দাদু শান্তি পাবেন না রে।”
সমু মানে সমরেশ সান্যাল আমার বাবা আর শোভা আমার মায়ের নাম।
নবদুলালকাকু আরও বলেছিলেন, “আমরা না গেলে তোদের অসুবিধে হবে বুঝছি, কিন্তু তাও আমার অনুরোধ, তোরা যা। নৃপেনদা আছে, বাদলকাকু আছে, দাদু নিজে আছেন—তোদের খুব একটা অসুবিধে হবে না, দেখে নিস।”
অগত্যা আমরা চলেই এলাম। কথা আছে, সিঙ্গাপুরের এবং বেঙ্গালুরুর কাজ মিটলেই কাকু-কাকিমা সোজা এখানে চলে আসবেন। হয়তো তিন-চারদিনের মধ্যেই।
নন্দদুলালবাবুর প্রশ্নে বাবা চায়ে হালকা চুমুক দিয়ে বললেন, “সফটওয়্যারের কোনও মেজর সমস্যার জন্যে সিঙ্গাপুরের এক ক্লায়েন্ট নবকে ডেকেছে। নবকে ওরা খুব ভরসা করে। ওদের বিশ্বাস, নব ছাড়া এ-সমস্যার সমাধান হবে না। নব বলছিল, ও না গেলে ক্লায়েন্ট হয়তো নবদের অফিসের সঙ্গে ব্যাবসাই বন্ধ করে দেবে এবং অনেক টাকা ক্ষতিপূরণ চাইবে।”
“অমন চাকরি করার দরকারটা কী শুনি? এ-তল্লাটে রায়চৌধুরীদের খাওয়ার চিন্তা? আমার আর সে বয়েস নেই, কিন্তু নবা যদি এখনও এসে শক্ত হাতে সবদিক সামলায়, আমাদের পরের সাতপুরুষও পায়ের ওপর পা চাপিয়ে আরামে কাল কাটাতে পারে।”
মা চা খাওয়া শেষ করে খালি কাপ সামনের টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, “নবদা চলে আসবেন বলেছেন। আর বীথিকাও বলল তিন-চারদিনের মধ্যেই চলে আসবে।”
মায়ের কথায় নন্দদুলালবাবু এতটুকুও নরম হলেন না। বললেন, “ছাড়ুন তো ম্যাডাম। এসব ওদের বাহানা। শহরে থেকে থেকে এমন অভ্যেস করেছে, গ্রামের বাড়িতে আসতে, দাদুর খোঁজখবর নিতে ওদের গায়ে যেন জ্বর আসে! ছেলেপুলেরা আজকাল সবাই স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। শহরের সুখ আর আরাম পেলে আর কিচ্ছু চাই না।”
রাগ রাগ স্বরে কথাগুলো বলে নন্দদুলালবাবু গুম হয়ে বসে রইলেন। আমরাও কেউ কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর মা আবার বললেন, “নবদা বলছিলেন, আপনাদের বাড়িতে নাকি কোথাও কিছু একটা খুব দামি জিনিস রাখা আছে, কোথায় আছে কেউ জানে না? কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে? আপনাদের বংশপরম্পরায় নাকি কোন একটা গোপন সংকেত...”
মায়ের কথা শেষ করতে দিলেন না নন্দদুলালবাবু। থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“সিন্ধুকে মথিয়া হরি রাখিলা সিন্দুকে।
বিন্দুকে সিন্ধু কহে বৈরি নিন্দুকে॥
মুক্ত রিপু চিত্ত লভে সদানন্দ মুক্ত।
উক্ত হরি চিন্তনে রহ সদা যুক্ত॥
নব নব যুগে আসে অবতার নব।
তব মহিমা হরি আমরণ কব॥
এই সংকেতের কথা বলেছে নবা? যত্তসব বুজরুকি আর মিথ্যে গুজব। গ্রামের বাড়ি আসতে পারে না, দাদুর খবর রাখতে পারে না, কিন্তু খুব লোভ, সংকেত খুঁজে ধনরত্ন যদি কিছু পাওয়া যায়! আজকালকার ছেলেছোকরাদের মতিগতি বুঝতে আমার আর বাকি নেই। এমন ভাব করে, বাপ-পিতেমোর সম্পত্তিতে যেন কোনও লোভ নেই। এদিকে মনে মনে ষোলো আনা ইচ্ছে, যদি কিছু পাওয়া যায়! জমি-জিরেত-ক্ষেতখামার সামলাতে অনেক হ্যাপা। সেসব দায় ঘাড়ে নেব না, কিন্তু যদি কিছু হিরে-টিরে মুক্তা-পান্না পাওয়া যায়, সেসব ছাড়ব না। ধান্দাবাজ, স্বার্থপর!”
নবকাকুর সঙ্গে আমাদের খুবই ভালো সম্পর্ক, দীর্ঘদিনের পরিচিতি। নন্দদুলালবাবু দাদু হয়েও ওঁর সম্পর্কে যা বলছেন, নবকাকুর সঙ্গে সেসব কথা একদমই মিলছে না। বাবার ছোটবেলার বন্ধু, তিনি প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মা ইশারায় মানা করলেন।
আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর মা চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, “আমরা একটু ঘুরে আসি দাদু। বেড়াতেই তো আসা! সন্ধেবেলা ঘরে বসে থাকার মানে হয় না।”
নন্দদুলালবাবু ভুরু তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোথায় যাবেন? অন্ধকারে বেশি দূরে কোথাও না যাওয়াই ভালো। চারপাশেই জঙ্গল কিনা।”
“না না, বাইরে নয়, আমরা ছাদ থেকে ঘুরে আসছি।”
“সে বরং ভালো। আপনাদের সঙ্গে কাল সকালের আগে আর দেখা হবে না। আমি আবার রাত্রে তেমন কিছু আহার করি না, বয়েস হয়েছে। তবে কোনও কিছু দরকার হলে ন্যাপাকে ডাকবেন, অসুবিধে হবে না।”
আমরা কেউ কিছু বললাম না। আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাকি অংশ পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করলেই পড়া যাবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।