দিলারা আর ওর মেয়ে ফাতিমা আমার প্রথম দুজন রোহিঙ্গা মহিলা হাইকার। দিলারা ৩৭ বছর। মেজ মেয়ে ফাতিমা ১৭।
ফোনালাপে ফাতিমা (পুরোটাই ইংরেজী)
- আমি আসব ১১:৩০ মিনিটে তোমাদের নিয়ে যেতে।
- পারব না আমরা যেতে আজ।
-কেন? আজ তো ফ্যামিলি পার্টি।
- মা’র শরীর ভাল না। আমাকে সব ঘরের কাজ করতে হবে।
- সে কী? তাহলে আমি একটু দেরী করে আসছি? আজ কোন হাইক নয়। তোমার মা না আসুক। তুমি তোমার ভাইবোনদেরও আনতে পারবে। আমার গাড়িতে তিনজনের জায়গা হবে। শুধু গল্প আর খাওয়া। নদীর পাড়ে। সুন্দর খেলার জায়গা। নৌকাও চালানো যাবে নদীতে।
- মা কে জিজ্ঞেস করি।
মা’র সাথে রোহিঙ্গা ভাষায় কথা বলছে। আমি ৬০ শতাংশ বুঝতে পারছি ফোনের এপার থেকে। মা রাজী না।
- মা তো না করছে।
কিন্তু ওর যে খুব আসার ইচ্ছে সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ফাতিমা ভীষণ মাপা। বয়সের তুলনায় পরিণত তো বটেই আর এই পরিবারের প্রধান হলেন ওদের মা দিলারা। আমি ওদের বাড়ীর তিনজনের সাথে কাজ করি - দিলারা, বড় ছেলে আহ্সান আর মেজ মেয়ে ফাতিমা। সবার কাছেই মা’র কথাই শেষ কথা।
আমি বুঝতে পারি। আজ মুশকিল। দিলারা কোন কারণে মেজাজ খারাপ করে আছে।
- এরপর REI তে যাব তো! নতুন জুতো হবে আমাদের!
আবার ওদের ভাষায় কথা। এবারের কথার ধারায় বুঝলাম যে বরফ গলছে।
দুপুর ১:১৫ - তিন ভাইবোন আর আমার মেয়ে। গাড়ি চলছে।
আমি নিজে থেকে কারো অতীত নিয়ে কোন প্রশ্ন/ কৌতুহল দেখাই না। আমি এইভাবে ভাবি যে, অতীত ওদের পুরনো জীবন। এদেশে আসার পর সব একদম নতুন করে শুরু। তাই বর্তমান সময়ে থেকে যা যা পরিস্থিতির সামনে পড়তে হচ্ছে সেগুলির ওপর কাজ করা।
কিন্তু অতীত উপেক্ষা করা কি সম্ভব?
আমি গাড়ি চালাচ্ছি। আমার মেয়ে পাশের আসনে। ওরা তিন ভাইবোন পেছনে। খুব গল্প হচ্ছে। ফাতিমা’র ছোট বোন লায়লা ফোনে হিন্দি গান চালিয়ে দিল!
আমার মেয়ের মেয়ের বয়স এগারো, তার মধ্যে দশ বছর এদেশে। ওদের অভ্যাসের মধ্যে আছে কথায় কথায় অনুমতি চাওয়া আর অন্যদের অসুবিধে হচ্ছে কিনা তা যাচাই করে নেওয়া। তাই বিনা অনুমতিতে লায়লা হিন্দি গান চালানোয় আমার আমার মেয়ে আমার দিকে এমন করুণার চোখে তাকালো যেটা দিয়ে ও বোঝাতে চাইছে যে ওকে ক্ষমা করে দাও। আমি ইশারায় বোঝালাম যে ঠিক আছে। আমার সাথে কম্যুনিটি ঘুরতে ঘুরতে ও-ও অনেক কিছু বুঝতে পারে। আমি কথা শুরু করলাম-
- লায়লা, তোমার কোন গ্রেড হল!
-6th
- ওমা! সোহাগও তো একই গ্রেডে যাবে! সোহাগ! তুমি ওর সাথে গল্প করতে পারো তো!
দুজন আস্তে আস্তে কথা শুরু করল। কোন মিল নেই কোনদিকেই। কিন্তু তবুও কি সুন্দর অনেক কিছু মিলে যায়। সোহাগ বই পড়তে, গান শুনতে আর ঘুরতে ভালবাসে। লায়লা বই পড়তে ভালবাসেনা, ঘোরাঘুরিও খুব একটা পছন্দ নয়। হিন্দি/ পাকিস্তানি সিনেমা/গান/ সিরিয়েলের ভক্ত!
সোহাগ গুটিকয়েক হিন্দি সিনেমার গান আর নায়ক নায়িকা চেনে যার অধিকাংশই পুরনো দিনের। হঠাৎ সোহাগ বলে উঠল
- রেখার “পহেলি জিন্দগানি” জানো?
লায়লাও উচ্ছসিত। সেও জানে। এরপর এক, দো, তিন - সেটাও জানে। এবার সোহাগ বলল “হাল ক্যয়সা হ্যায় জনাব কা” - লায়লা পারল না ধরতে। তিন ভাইবোন ইউটিউবে খুঁজতে শুরু করল। এরপর ওরাও কিছু হিন্দি গান শোনাল। আমি আর আমার মেয়ের অধিকাংশই অজানা। আমাদের ঝুলিতে সব পুরনো। ওরা একদম আপডেটেড।
চলে এলাম ইভেন্টে। নানারকম অনুষ্ঠান। নানা দেশের খাওয়া। নানা ভাষার মানুষ।
আমাদের আরো একটি প্রোগ্রাম হল “কম্যুনিটি হেল্থ প্রমোটার”। রেফিউজি হতে হবে। সিটিজেন হলেও রেফিউজি হিসেবে এ দেশে এসেছে এমন মহিলা ইংরেজী পড়তে লিখতে আর বলতে পারলে এই প্রোগ্রামে ঢোকা যায়। ১৮ বছর হতে হবে। ওদেরকে বেসিক ট্রেনিং দেওয়া হয় আর অনেক সাপোর্টিভ কাগজপত্র। মূল উদ্দেশ্য হল কম্যুনিটিকে স্বাস্থ্য সচেতনতার উপকারিতা নিয়ে বলা আর পরামর্শ দেওয়া। এই প্রোগ্রাম আমার হাত দিয়েই শুরু। কঠিন কাজ - কারণ, প্রথমত: ট্রেনিং এর জন্য উপযুক্ত স্পিকার খুঁজে বার করা, ওদের রেজ্যুমে জমা দিয়ে আ্যাপ্রুভ করা, এবং স্পিকাররা কোন সান্মানিক পাবে না। পুরোটাই স্বেচ্ছায় নিজের মূল্যবান সময় কম্যুনিটিকে উৎসর্গ করা। দ্বিতীয়ত: কারা কারা এই প্রোগ্রামের জন্য এলিজেবল। তৃতীয়ত: প্রত্যেক ভাষার একজনকে খুঁজে বের করে রাজী করানো- অনেক কাজ। যথারীতি কোন রোহিঙ্গা মহিলা পেলাম না।
আমার ধারণা আমি খুব ভাল করেই একেকটা সেশন অর্গানাইজ করছিলাম। কিন্তু আমার এক সহকর্মী - কোনভাবেই রোহিঙ্গা সংক্রান্ত কোন কাজকেই নম্বর দেয়না। আর সব নেগেটিভ রিপোর্ট জমা হয় ডিরেক্টরের কাছে। আমি যদি বলি অমুক স্পিকার খুব ভাল ট্রেনিং মেটেরিয়েল সহ পুরো সেশন টা দারুণ করেছে - ও ঠিক ওর নিন্দে করবে। এই সহকর্মী ২২ বছর আগে এসাইলি কোটায় কুর্দিস্তান থেকে এসেছে। সব কিছুতেই অনেক কিছু জানে। আমার মতে সাংঘাতিক ফাঁকিবাজ! নিজের এক বিশাল গোষ্ঠী আছে। সেই নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে অনেক খবর পায়। আর যে কোন প্রোগ্রামে শেয়ালের কুমির ছানার মত গুটিকয়েক নির্দিষ্ট মহিলাকে প্রোজেক্ট করে এবং আমার দৃষ্টিতে ওই মহিলারা কোনভাবেই সুযোগ নিতে পারে না। আর্থিক, সামাজিক - সবদিকেই সাংঘাতিক স্বচ্ছল। কিন্তু সবরকম প্রোগ্রামে একই সেট। রান্না,হাইকিং, হেল্থ প্রমোটার, ছবি তোলা, ইন্টারভিউ - সবেতে ওরাই। আমি আমার মতামত জানাই। ফলস্বরূপ পরের বছর হেল্থ প্রমোটার প্রজেক্ট আমার হাত থেকে চলে যায়। পরে সুযোগ হলে আরো ঘটনা বলব।
ফিরে আসি সেদিনের কথায়। হেল্থ প্রমোটার হিসেবে যে কজন রেফ্যুজি মেয়ে কাজ করে কম্যুনিটিতে তাদের সন্মানিত করা হল এই ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠানে। কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। অতীতের ঐ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এভাবেও যে নতুন দেশে নতুন ভাবে আলো দেখা যায় - সম্মানের সাথে রোজগার করা যায় - কেউ ভাবেনি!
অতীতকে তবু উপেক্ষা করা যায় না।
কত কথা! গল্পের বইয়ের মত। কিন্তু সত্যি - সত্যি থেকেই গল্প তৈরী হয়।
তিন ভাইবোনকে ভীড় থেকে একটু দূরে বসতে দেখলাম। জোর করলাম না। সামনেও গেলাম না। নিজেদের মত করে অনুভব করুক।
অনুষ্ঠান শেষ হবার পর বললাম -- যাও! পার্কে খেলতে পারো! সোহাগও খেলছে। নদীর ধারে বসবে! দোলনা আছে নদীর পাড়ে।
তেমন উৎসাহ নেই। ভাই কে দেখলাম কেমন একটু জড়সড়। নদীর দিকে যাবার কথা বলায় কেমন ঘাবড়ে গেল। আমি এই কিছুদিন কাজ করে যতটা বুঝেছি যে কক্ষনো কোন কিছু নিয়ে জোর করা যাবে না। আমি আর দ্বিতীয় বার কিছুই বললাম না।
এবার হাইকিং এর জন্য জামাকাপড়/ আনুষঙ্গিক জিনিস আর নতুন জুতোর জন্য REI এর দোকান। আবার গাড়ি। আবার একটু গল্প শুরু করলাম।
- তোমরা কি সবাই হিন্দি বোঝ?
ফাতিমা - মা বোঝেনা তেমন। আমরা ভাইবোনরা বুঝি। আমাদের বাবাও বোঝে।
লায়লা - আমরা তিন ভাইবোন ছ'টা ভাষা জানি!
আমি অবাক!
আমার মেয়েও বলে উঠল “আমিও পাঁচটি ভাষা জানি!” বলেই লজ্জা পেল “I mean - English পড়তে/ বলতে/ লিখতে জানি। বাংলা বলতে জানি। অল্প লিখতে আর পড়তে। হিন্দি বুঝি। ঠিক বলতে পারিনা। আর এখন ফ্রেন্চ আর ম্যান্ডারিন শেখা শুরু করেছি।“
লায়লা আর ফাতিমা মালায়, ইন্দোনেশিয়ান, বার্মিজ, রোহিঙ্গা, হিন্দি ভাষা বলতে ও বুঝতে পারে। ইংরেজী বলতে, লিখতে, পড়তে পারে। পাকিস্তানি সিরিয়েল দেখে অনেকটা উর্দু বোঝে।
আমি বললাম তাহলে তো সাতটি ভাষা!
কিন্তু উর্দু তে অতটা দক্ষ না বলে সাত নম্বরটা ছেড়ে দিল।
কী আশ্চর্য্য। লেখাপড়ার তো সুযোগই পেল না। বয়স কত? কী করে জানে এত ভাষা!
আমি জানতে চাইলাম মজা করেই যে হিন্দি আর উর্দু তো বুঝলাম কি করে শিখলে। বাকী ভাষা! ওগুলো শিখলে কি করে?
এরপর যে ঘটনা শুনতে হল - শুনতে শুনতে শুধু প্রার্থনা করছিলাম মনে মনে - থেমে যাক ওরা - আর নিতে পারছিলাম না। আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ ভর্তি জল। টপ্ টপ্ করে পড়ছে। এদিকে তিন ভাইবোন অনর্গল বলে যাচ্ছে। কে কোন লাইন বলছে সে বোঝার দরকার নেই।
ফাতিমা আর লায়লার কথা
আমরা চার ভাইবোন তখন। আমার দাদা আহসান ১২, আমি ফাতিমা ১০, লায়লা ৪, আমার এই ভাই ২। আমাদের কি সুন্দর বড় বাড়ী ছিল! আমরা রাতের খাবার খেয়ে বাড়ীর উঠোনে বসেছি - গল্প করছি, খেলছি- হঠাৎ দেখি সকাল হয়ে গেল। আর অনেক চিৎকার। আমার মা’র পেটে বাচ্চা। বাবা চীৎকার করে সবাইকে দৌড়াতে বলল। আমি তো অবাক! এত তাড়াতাড়ি সকাল হল কী করে আর সবাই দৌড়াচ্ছিই বা কেন? শুধু আমরা না, আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশীরা - সব্বাই। তিন/চার ঘন্টা দৌড়াচ্ছি - কানে আসছে নানা আওয়াজ। কথা, কান্না, ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠা, চীৎকার, হায় হায়, ভয়, আর্তনাদ - সব রকম। কিন্তু এর পাশে বাজির মত শব্দ। আমি তো তখন ১০! সব আওয়াজ বুঝি না। পরে নানাজনের কথা থেকে বুঝলাম যে ওগুলো গুলির শব্দ - বাড়িতে আগুন লাগার পর জিনিস ফাটার শব্দ। ও, তার মানে সকাল হয়নি - আগুনের আলো!
তিন/চার ঘন্টা দৌড়ানোর পর একটা জঙ্গল আর পাশে একটা নদী মত জল। যে যেখানে পারল লুকিয়ে বসে গেল। আমার মা খুব কষ্ট পাচ্ছিল। পেটে বাচ্চা তো! বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে জলে চলে গেল।
কী বলব তোমায়। ক্ষিদে পেয়েছে, ক্লান্ত - কিন্তু কেউ কথা বলিনি! আমি আর দাদা তবুও বড়। আমার এই ছোট ভাই বোন দুটি তো ছোট! জানো! ওরাও শব্দ করেনি! আরো অনেক বাচ্চা ছিল - সবাই ভয়কে বুঝতে পারছিল - কেউ কাঁদেনি। অন্ধকার কমে আসছে। গাড়ির আওয়াজ, গুলির আওয়াজ আর চীৎকার স্পষ্ট হচ্ছে। বাবা আস্তে আস্তে বলল “সবাই একসাথে হাত ধরে থাক। একসাথে মরে যাব”। জানো আমার এই বোন লায়লা তো ছোট আর বোকা ছিল! ও বাবাকে জিজ্ঞেস করছে “বাবা, মরে গিয়ে যেখানে যাব, দেখবে জলে যেন থাকতে না হয়। ঠাণ্ডা লাগছে এখানে”।
এরপরই তিন ভাইবোন কি হাসি - লায়লার ঐ বোকা কথা নিয়ে। আমার মেয়ের চোখ ভেসে যায়। শক্ত শরীরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে প্যাসেন্জার সিটে। পেছনে তিনজন কলকল করে যাচ্ছে - কখনো হেসে গড়াচ্ছ্ তো কখনো সত্যিই যে ভয় পেয়েছে যেসব ঘটনায় সেগুলো বলছে।
আর আমি? গাড়ি চালাতে যেন ভুল না হয়, কেউ যেন চোখে জল না দেখে - খুব মনযোগ দিয়ে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছি। কথাগুলো শুনতে চাইছি না। আবার থামাতেও পারছি না।
আমার একবার মনে হচ্ছে যে বলুক ওরা! হয়তো হাল্কা হবে। আবার আয়না দিয়ে পেছনে যখন দেখছি ওদের - বুঝতেও তো পারছি না যে কী ভারী আর কীই বা হাল্কা হচ্ছে।
- জানো, আমাদের আশেপাশের লোক আ উ শব্দ করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে , জলে পড়ে যাচ্ছে, গুলির শব্দ - আমরা ভাবছি এইবার আমাদের পালা। মা শুধু বারবার বলছে যে এই জলই আমাদের বাঁচাবে। আমাদের ঠিক আগে দাঁড়ানো লোক তিনজন টপ্ টপ্ করে জলে ডুবে গেল। আমাদের সামনে বন্দুক হাতে ৫/৬ জন বার্মার আর্মি। হঠাৎ মাইকে নির্দেশ এল যে আজকের মত গুলি বন্ধ। ওপর থেকে নির্দেশ। আমরা আর মারা গেলাম না। এরপর দু/তিনদিন ওখানেই বসা। জামাকাপড় পাল্টাইনি। খাওয়া নেই। এরমধ্যেই আমাদের গোষ্ঠীর কিছু লোক শুকনো কিছু খাবার নিয়ে এল। বড়দের সাথে শলাপরামর্শ করল কি সব। মা কে দেখলাম কানের দুল খুলে দিতে।
এরও দেড়দিন পর একটি ছোট নৌকায় ৬৫ জন উঠলাম। কি কষ্ট ! বসার ঠিকঠাক জায়গা তো নেই। সবার গায়ে কি বাজে গন্ধ! এরপর আমাদের সাথে খুব চিটিং হল। আমার মা’র থেকে কানের দুল নিয়ে তো নৌকায় জায়গা দিল - কিন্তু ৫/৬ ঘন্টার পর নৌকার মোটরের জ্বালানি শেষ। কোন বৈঠা নেই। বড়রা কাঁদতে লাগল। এখন ছোটরাও কাঁদল। জল যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে নৌকাকে, আমরাও সেদিকেই যাচ্ছি। ২৮ দিন - ২৮ দিন আমরা জলে।
আমি এমন হতভম্ব হয়ে গেলাম যে আমার মুখ দিয়ে প্রশ্ন বেরুল “ওমা! খেতে কী ঐ দিনগুলিতে? বাথরুম যাওয়া?”
আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় হাইকিং, ট্রেকিং, ৱ্যাফটিং মজার ব্যাপার। ক্রুজে করে জলে ঘোরা আর নানা বন্দরে নেমে উপভোগ করা। আমার কল্পনা কল্পনাও করতে পারে না ২৮ দিন ৬৫ জন মানুষ না খেয়ে বাথরুম ব্যবহার না করে কিভাবে থাকে।
প্রশ্নটা করেই বুঝলাম যে কত বাজে প্রশ্ন। আর এই প্রথম আয়না দিয়ে পেছনে দেখলাম যে তিনটি দু:খী মুখ। এখনো ভাবলে আমার লজ্জা লাগছে যে কী করে আমি এই প্রশ্ন করতে পারলাম !
ওরা তিনজনে এরপর একটা লাইনেই বলল যে জল খেত নদী থেকে তুলে। আর বাকীটা খুব দু:খের ছিল- ওরা আর বলতে চায় না।
REI-এর দোকানে পৌঁছালাম। এরপর মজাই হল। ফাতিমা নতুন হাইকিং বুট, মোজা, জামা, প্যান্ট, ব্যাগ, হাইকিং স্টিক, হাইকিং এর উপযুক্ত আরো কিছু জামাকাপড়/ জিনিস পেল।
লায়লা আর ভাই পেল না। ওদের মন খারাপ। আমারও মন খারাপ।
কিন্তু ওরা তো আমাদের প্রোগ্রামে নেই! আর এই গ্রুপ শুধু মেয়েদের। নাবালকেরও জায়গা নেই।
প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল। খারাপ লেগেছিল। একটু পরেই ধীরে ধীরে বুঝলাম - কমিউনিটিতেতে need কিভাবে তৈরী করতে হয়।
REI থেকে ফেরার পথে লায়লা বলল “Can I register for next year?”
আমি বললাম “of course!”
আর ক্ষুব্ধ নাবালক বলল “Do something for boys!”।
আমার ভেতরে তখন স্বর্গীয় স্বাদ।
REI থেকে ওদের বাড়ী ফেরার পথে আবার কথা শুরু হল।
- ঐযে জলে এতদিন থাকতে হল, এরপর থেকেই জলকে আমাদের বাজে লাগত। মা বোঝালো - এই জলই আমাদের বাঁচিয়েছে। তাই জলের ওপর রাগ করা যাবেনা। আমরাও আস্তে আস্তে মেনে নিলাম। শুধু ভাই এখনো স্বচ্ছন্দ নয়। তাই ভাই জলের কাছে খেলতে যায়নি।
২৮ দিন পর একটা জায়গা দিয়ে আমাদের নৌকা যাচ্ছে। দূরে ডাঙা থেকে কিছু লোক আমাদের দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। আমাদের নৌকায় অনেক লোকই আধমরা আর অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আমাদের গলা ওদের কাছে পৌঁছালো না। ভাষাও অন্য। এরপর কয়েকটা স্টিমার এসে আমাদের উদ্ধার করল। আমি অজ্ঞান হবার আগে শুনলাম একটি শব্দ “ইন্দোনেশিয়া”।
কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলেন - রোহিঙ্গারা বেসিকেলি বাঙালি কিনা। আমি জানিনা। পড়াশুনা করলে নানা তথ্য হয়তো পেতে পারি। আমার ইচ্ছে/ ধৈর্য্য কোনটাই নেই।
রোহিঙ্গারা নিজেদের বাংলাদেশী বলতে স্বচ্ছন্দ নয়, বাংলাদেশীরাও রোহিঙ্গাদের পছন্দ করে না - ভীষণ ব্যঙ্গ আর খারাপ খারাপ কথা।
আচ্ছা, এই পুরো লেখা কিন্তু সম্পূর্ন ভাবে আমার অনুভূতি। সব তথ্য, আবেগ - সব আমার মত করে পাওয়া। ভিন্ন মত হতেই পারে।
আমি এখানে বাংলাদেশী কয়েকটা দোকানে যাই বাজার করতে। যেহেতু বেশী কথা বলি, প্রচুর বন্ধু হয়। নানা কথা হয়। আর আমি তো আগরতলার কথ্য ভাষা বলি, তাই কম সময়ের মধ্যেই অনেক কথা শুরু হয়ে যায়।
২০২০ সাল ছিল আমেরিকার জনগননা আর ভোটের জন্য ভোটার্স রেজিস্ট্রেশন। আমার অর্গানাইজেশন ঐ দুটো প্রোগ্রামের গ্র্যান্ট পায় আর আমি ঐ দুটো প্রোগ্রামের কোর্ডিনেটর ছিলাম। আমাদের কাজ ছিল নানা কম্যুনিটিতে মানুষকে সচেতন করা যাতে মানুষ নিজেকে আর নিজের পরিবারকে জনগননায় অংশগ্রহণ করায়। আর, যারা ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন, ওরাও যাতে নিজেদের রেজিস্টর করে, আর্লি ভোট, মেইল ইল ব্যালট - এসবে নিজেদের নথিভুক্ত করে। আমি ভারতীয় বাঙালি, তেলেগু, বাংলাদেশী, আর রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর জন্য কাজ করেছি।
যেখানেই যাই, আমার নানা কাজের পরিসর নিয়ে কথা ওঠে। যে মুহূর্তে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর নাম শোনে বিশেষ করে ভারতীয় আর বাংলাদেশী বাঙ্গালীরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে- খুবই বিচ্ছিরি।
ভারত বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমান নিরপেক্ষভাবে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ উঠলেই দেখি পিণ্ডি চটকানো শুরু হয়। বাংলাদেশ থেকে আসা পরম বৈষ্ণব মধ্যবিত্ত বা ভারত থেকে আসা ধর্মপ্রাণ সমাজসেবী বড়লোক মুসলিম ব্যাবসায়ী - কেউই রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় না। বিরাট অভিযোগ - রোহিঙ্গাদের কেন একপাল বাচ্চা, এদিকে নিজেরা হয়তো সাত আট ভাইবোন আর তিন চারজন ছেলে মেয়ে।
এবার এইসবের পর আবার "ওরা" কেন আমাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে না তা নিয়েও বিশাল অভিযোগ।
আপনাকে আমাকে কেউ একটু উপযুক্ত সম্মান না দিয়ে কথা বললে আমরা অপমানিত হই। যোগাযোগ/কথা বলা বন্ধ করে দিই। এখানে এই ইগোর লড়াইয়ে বছর বছর দুর্গাপুজার ক্লাব ভেঙে গিয়ে নতুন তৈরী হয়ে যাচ্ছে। আর দিনের পর দিন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে যারা বংশানুক্রমে লাঞ্ছনা, অপমান, তাচ্ছিল্য বয়ে বেড়াচ্ছে তাদের থাকতে হবে মিলেমিশে! হ্যাঁ, অনেকে চালাকি করে, মিথ্যে বলে, ঠকাতে চায় - আর কী করবে? আপনি আমি তো কোন জায়গা দেব না আমাদের সাথে।
একটাই অপরাধ - পরিস্থিতির চাপে কোন এক পূর্বপুরুষকে বিতাড়িত, উচ্ছেদের শিকার হতে হয়েছিল। এর থেকে সমাজ আর বেরুতে দিচ্ছে না। অন্য পথটা খুব কঠিন।
ওয়ার্কশপ
কমিউনিটির রোহিঙ্গা মহিলারা প্রথম লাইব্রেরি ঢুকেছে। প্রথম কার্ড হয়েছে। প্রথম টাইপ করেছে কম্পিউটারে। সে যে কি আনন্দ আমার! কি যে কঠিন কাজ!
প্রথমত: পুরুষরা চান না মহিলারা বেরুক। মহিলারা নিজেরাও বেরুতে চান না। সারাদিন শুধু ঘরের কাজ, রান্না আর বাচ্চা সামলানো। প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকার সংগ্রামে কেটে গেলে সূক্ষ্মতর চাহিদা গুলি ঘষে যায়।
বেড়ানো বলতে লোকের বাড়ী দাওয়াত। সেই একই মানুষ- কোন চিন্তার আদানপ্রদান নেই। সবসময় ক্লান্ত।
দ্বিতীয়ত: বাচ্চা। বাড়ী ভর্তি নানা বয়েসের বাচ্চা। কিভাবে বেরুবে? গাড়িও চালাতে পারে না।
তৃতীয়ত: ভাষা। যাবে কোথায়? কী করে কথা বলবে?
ফাতিমার পরিবার বেঁচে গেল। ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ৭ বছর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বরে ওরা আমেরিকায় আসে।
কী কষ্টের বর্ণনা! ফাতিমা আর ওর ভাইয়ের বয়স ১০ এর বেশী ছিল বলে ওদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি ছিল না! ছোট ভাই বোন দুজন স্কুলে যেত।
ফাতিমা আর ওর দাদা শুধু ইংরেজী শিখতে পারত। কোন এক নন্ প্রফিট গ্রুপ চালাত।
দুজনের আগ্রহ পড়াশুনার। খুব দু:খ করে বলেছিল এই দুই ভাইবোন। যখন প্রথম দিন আমি ফাতিমার ফোন পেলাম- এত সুন্দর মিষ্টি গলা- ঠিক গ্রামার মেনে আমেরিকান উচ্চারণ।
সবরকম কষ্টের মধ্যে - সবচে বেশী মন খারাপ করতে দেখেছি এই স্কুলে না যেতে পারার জন্য। ছোট ভাইবোনের বই নিয়ে ওরা পড়া শিখেছে। এরপর এদেশে এসে সরাসরি মিডল স্কুল আর হাই স্কুলে ঢুকেছে। এখানে জন্মগত নাগরিক না হলে ইন্টারনেশন্যাল সেন্টার যেতে হয়। ইভ্যালিউয়েশন হয়। এরপর ঠিক হয় কিভাবে ক্লাসে এগুবে। আলাদা আলাদা কারিকুলাম।
অতি শিক্ষিত পরিবার - টি.ভি সিরিয়েল, সিনেমা সব জায়গায় কিছু পরিচিত ঘটনা থাকে। যেমন, বাপের বাড়ী নিয়ে খোঁটা, মা-বাবার শিক্ষা, পরিবেশ, ভাই বোনের চরিত্র, আত্মীয় গোষ্ঠী কত খারাপ, এমনকি দেশ/ রাজ্য /এলাকাভিত্তিক খোঁচা - আর বাঙাল - ঘটি’র যুদ্ধ বলে তো লাভই নেই। রান্না করার পদ্ধতি নিয়ে পর্যন্ত তুমুল পারিবারিক কলহ। এসব ঘটনা নিয়ে বাস্তবে কত ইগো’র লড়াই! সংসার ভেঙে যায়, সম্পর্ক নষ্ট হয়।
ভেবে দেখুন তো একবার - একটি পরিবারের দিকে সারাক্ষণ সমাজের আঙুল - “এমা! এখানেও!” “ওগুলো রেফিউজি” “ইস্! এখানেও ভরে যাচ্ছে” - এসব নেগেটিভ ঘৃণা ভরা কথা যদি সারাক্ষণ শুনতে হয় - কী হবে আমার আপনার মনের অবস্থা! বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ী গিয়ে নতুন মেয়ের সাথে মানিয়ে নেওয়ার শাশুড়ী বৌমা’র গল্প দিয়ে তো হলি, বলি, টলি, ঢালি - সব এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাষ্ট্রি পয়সা রোজগার করছে।
সে জায়গায় বাস্তবে একটি ষোল বছরের মেয়ে, স্কুলে পড়তে পারেনি, - ওকে ফোন করে পরিচয় দিতে হয় “ Hello Ma’am! I am Fatima, a new refugee from Indonesia seeking your help!”
আমার বুক ফেটে যায়। গলা বন্ধ হয়ে যায়।
আমরা যারা কাজ করি কম্যুনিটিতে - ৮৫% ই রেফিউজি ব্যাকগ্রাউন্ড। আমরা গুটিকয়েক বাইরের। আমার এক আমেরিকান সহকর্মী সবসময় মরমে মরে থাকে। অনেক সাদা আমেরিকান ভলান্টিয়ারের কথা শুনলে মনে হয় পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষের চোরা স্রোত আমরা জানি, তবু আমেরিকান বাড়ী থেকে যখন ডোনেশন আসে- মুগ্ধ হয়ে যাই। ড্রাই ক্লিন করে ডেট লাগানো রিসিপ্ট থাকে, অন্যদিকে পয়সাওলা ভারতীয় বাড়ি থেকে ডোনেশন আসে দোমড়ানো ফেলে দেওয়া ব্যবহারের অযোগ্য পুরনো জামা কাপড়!
যেরকম কুন্ঠা, অস্বস্তি আর তলানো আত্মবিশ্বাস নিয়ে সামনে এসে নিজেকে রেফিউজি পরিচয় দেয় - আমার কান ব্যথা করত প্রথম প্রথম। এখন অনেক সহজ হয়ে গেছি। সামনাসামনি এসে যদি নতুন কেউ কথা বলতে চায় - নিজেই এমন একটা সহজ স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরী করার চেষ্টা করি যাতে সামনের মানুষটির নত না হতে হয়।
আমিও তো হিংসা/দ্বেষ/ লোভে ভরা সাধারণ মানুষ। একেকজনের বাড়ীর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলে বমি চলে আসে। বাথরুম ব্যবহার করার কথা ভাবতেও পারিনা। আমি ছাড়া রোহিঙ্গা পরিবারে কেউ যায় না। একটা গল্প বলি।
আমার এক সহকর্মী স্টেসি - অন্য অফিসের - আমার কাছে কয়েকটা ঘটনা শুনে কৌতুহলী হয়ে আমার সাথে গেছিল খুরশিদা’র বাড়ী। আমরা ওর পেছনের বাগানে বসেছিলাম। জমিতে লঙ্কা, ধনেপাতা, টমেটো, লাউ, কুমড়া, পুঁই ইত্যাদি চাষ। কিন্তু কেমন বোঁটকা গন্ধ। দেখলাম বড় বড় মাছ শুঁটকির জন্য মাটিতে গর্ত করে রাখা। আরেক জায়গায় বড় ধামায় কতগুলো কালো কালো জিনিস। পাশে পাখীর খাঁচায় ১১ টা প্যারাকিট। ওদের পালক ভর্তি ওই ধামায়। আমি আমলকি ভেবে ধরতে গেলাম। খুরশিদার পুরো পরিবার এমন চিৎকার করল - আমি ভয় পেয়ে বললাম “ কী হল” - লাজুক হাসি দিয়ে খুরশিদা বলল ওগুলো গরুর মাংস শুকনো করা হচ্ছে।
কাঁঠালের আমসত্ত প্রবাদ শুনেছি। এবার দেখলাম গরুর মাংসের আমসত্ত। আমার ধর্ম রক্ষা নিয়ে আমার কম্যুনিটি সাংঘাতিক সচেতন। এদিকে আমার ঘরের বাকী দুজন সর্ব প্রকার মাংসের সদ্ব্যবহার তো করেই, সাথে ব্যাঙ , অক্টোপাস পর্যন্ত ছাড় পায়নি, বিফ জার্কি নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই। যাক্-
তো খুরশিদা না খাইয়ে ছাড়বে না। এদিকে সেই স্টেসি স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সচেতনতা তথা বাতিক তথা ওসিডির জন্যে কোন গ্রুপ থাকলে তার আ্যডমিন হবার উপযুক্ত। দাঁড়িয়েই আছে। আমি বললাম “তুমি তো নিশ্চয় খাবে না!”
আমাকে অবাক করে বলল “খাবো!” গাড়ি থেকে নিজের বাটি চামচের ব্যাগ আনল, ওয়াইপ্স আর স্প্রে দিয়ে ওর চারদিক জীবাণুমুক্ত করল। অনেক ক্ষমা চাইল ওর আচরণের জন্য। আমায় অনুবাদ করতে বলল। আমি শুধু বললাম “ও যা করছে করুক। পাত্তা দিও না। তোমরা তাড়াতাড়ি যা খেতে দেবে দাও।” আমাদের সাথে কথা বলতে বলতেই মাটিতে বসে খুরশিদা শিল নোড়ায় লঙ্কা বাটছিল। আমার কী আনন্দ হল শিল নোড়া দেখে। জেনে নিলাম কোথায় পাওয়া যায়।
স্টেসি হাঁ করে দেখছে। একই বাটি থেকে বারবার গ্লাভ না পরা হাতে শিলে জল ছিটোচ্ছে আর মিহি করছে লঙ্কা। পাশে একটু পরপর থুতু ফেলছে ওর বর। খুরশিদাও লঙ্কা বাটতে বাটতে পানের পিক ছুঁড়ে দিচ্ছে শিলের একটু দূরে।
আমি আবারও বললাম “Are you sure!”
ও আমাকে অনুরোধ করল “please don’t demotivate me”
আমি হাসলাম।
খাবার এল ৩০ মিনিটের মত অপেক্ষার পর। এ ফাঁকে আমরা ওদের পুরো পরিবারের সাথে কিছু কাজ করলাম। খুরশিদার বাড়ীতে ১৪ জন থাকে। বেসমেন্ট সহ ৭ টি শোবার ঘর ৪ টি বাথরুম। বাইরেই বসলাম। আমার জন্য মুরগীর ঝোল আর নানা সবজি দিয়ে চিংড়ির ঝোল। স্টেসির একটা আইটেম বেশী, গোরুর ঝোল। এমন নয় যে আমাদের জন্য স্পেশাল। প্রায় প্রতিদিন মোটামুটি একই মেনু। দেরিতে ঘুম থেকে উঠে এটাই ব্রান্চ।
আমি শেষ বারের মত ওকে সাবধান করতে চাইলাম। বললাম খুব ঝাল হবে। শুনল না। শুধু যখন খুরশিদা’র মেয়ে ওর থালায় ভাত দিতে গেল আমি বলে দিলাম যে এক হাতার বেশী দেবে না।
এক চামচ ভাত ঝোল মেখে মুখে দেওয়া মাত্র স্টেসি লাল হয়ে গেল। আমি আবারও বললাম। আমার মনে হল ওকে জ্বিনে ধরেছে। ও খাবেই। আমার দু/তিন চামচ খেতে খেতেই বাকী ৫ জন যারা আমাদের সাথে খেতে বসেছিল ওদের প্রথম থালা ভাত শেষ। খুরশিদাও খাচ্ছিল। অন্যরা যখন আবার ভাত চাইল খুরশিদা ওর ডান হাতটা ভাল করে চেটে পরিষ্কার করে হাঁড়িতে ঢোকালো। আমি স্টেসির দিকে তাকালাম। ওর চোখ লাল ও জল। ঘেন্না না ঝাল - ও আর ওর স্বাস্থ্য সচেতনতা/ ওসিডি জানে!
আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছে। কিন্তু সেই স্বাদও ছাড়তে পারছি না।
নাটকের শেষ পার্ট - স্টেসি ঐ একহাতা ভাত শেষ করল। আমার আলাদা করে পাতে নুন নেওয়ার বদ্ অভ্যেস আছে। আমার প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বার ঐ হাঁড়ির ভাত আর নুন খেতে পারলাম না। ঐ বাটির নুন বাকী সবাই সময়ে সময়ে আঙ্গুল দিয়ে নিয়ে জিভের ঠেকাচ্ছিল।
স্টেসি কান্না গলায় বলল “Can I use the restroom to wash my face?”
আমি বললাম “You can but you won't!”
স্টেসি নিজের বাড়ী ছাড়া বাইরের বাথরুম ব্যবহার করে না। ওসিডির জন্য লং ড্রাইভে যেতে পারে না। সেই স্টেসি গেল ওদের বাথরুমের দিকে।
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্টেসি বাথরুমের দিকে গেল। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে আমার ফোনে স্টেসির নাম। ধরলাম ফোন।
ওপার থেকে “I am leaving. I am gonna kill you! I will rather pee on my pant than using that bathroom”।
আমি বললাম “If you can’t make it then go to the Clarkston Library. আমিও আসছি।”।
ফেরার পথে আমি নিজের জন্য শিল নোড়া কিনলাম।
এর দেড় মাস পরে স্টেসির সাথে একটি কনফারেন্সে দেখা। মাইক হাতে ও বর্ণনা দিয়েছে আমি কত করুণাময়ী। আমি স্টেসিকে বোঝাতে পারব না যে আমি তো খুরশিদার রান্নায় আমার কোনাবনের দিদাকে খুঁজে পাই।
ইন্দোনেশিয়ায় ফাতিমা আর তিন ভাইবোন নিজেদের উদ্যোগে স্থানীয় ভাষা শিখতে শুরু করল। ৬ বাই ৬ এর ঘরে ৮ জন। ওদের বাবার কাজ করার অনুমতি নেই ইন্দোনেশিয়ার রেফ্যুজি ক্যাম্পে। কিন্তু ওদের মা নাকি কাজ করতে যেত ক্যাম্পের বাইরে। কোন একজন শিক্ষিত প্রভাবশালীর বাড়ী। ফাতিমা বা ওর দাদা পালা করে যেত মায়ের সাথে। ঐ বাড়ির পরিবেশ ওদের মানসিক গঠনে সাহায্য করেছে। সেদিক থেকে ওরা ভাগ্যবান।
এভাবে ওরা নিজের দায়িত্বে স্বনির্ভর হয়। সুন্দর ব্যবহার আর নানা ভাষায় পারদর্শী। কিন্তু দু:খের ব্যাপার হল - ওর দাদা আহসান অ্যামাজন ওয়ারহাউসে কাজে ঢুকে গেছে। আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে ও কলেজ যাবে কিনা। এদেশে আসার পরপর ও আমাকে যে সব স্বপ্নের কথা বলেছিল - সরে যাচ্ছে। এখানেই সমস্যা। এখানেই মনে হয় ফাতিমার ছোট ভাইয়ের কথা “Do something for the boys”।
এক এক করে সবকটা পর্ব পড়ছি। খুব সুন্দর হচ্ছে লেখাটা।রিফিউজি আমেরিকার ভেতরের আমেরিকা, মানুষের পেটের ভেতরের মানুষ গুলো বেরিয়ে আসছে। অনবদ্য
এই লেখাটা পড়তে আমি ভয় পাই। আবার এই লেখাটা না পড়ে থাকতেও পারি না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি পরের পর্বের জন্য।
একটা কথা শেয়ার করতে চাই। হীনযানী বৌদ্ধ দর্শন পড়ব বলে কোলকাতায় খুঁজে খুঁজে গেলাম বেলেঘাটা রেলকলোনী ছাড়িয়ে এক বিহারে, একজন নামকরা বৌদ্ধ শ্রমণের কাছে। উনি কোলকাতা থেকে পালিভাষায় ডক্টরেট করেছেন। ওঁরা চট্টগ্রাম থেকে আগত 'বড়ুয়া'। কিছু অনুবাদ করেছেন, ইউনিতে কন্ট্যাক্ট ক্লাস নেন। আমি ইম্প্রেসড। উনি বই দিলেন। হোয়া গ্রুপে রোজ সকালে একটি বুদ্ধের ছবি ও পিটক গ্রন্থের থেকে দুটো শ্লোক ও ব্যাখ্যা পাঠাতে লাগলেন। আমি আপ্লূত ।ওমা! যেই রোহিঙা শরণার্থীরা বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করল উনি রোজ সকালে গ্রুপে রোহিঙ্গা বিদ্বেষ, ওরা বার্মায় কত বৌদ্ধ মেরেছে এবং কেন ওদের শরণ দেওয়া উচিত নয় বা ওদের সঙ্গে যাও হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে --এইসব মেসেজ পাঠাতে লাগলেন।
আমি লিখলাম- রোহিঙ্গারা কি নৃশংস দস্যু অঙ্গুলিমালের থেকেও খারাপ? তথাগত কি আমাদের এই ঘৃণার শিক্ষা দিয়েছেন?
সম্পর্ক শেষ হোল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
"বাংলাদেশীরাও রোহিঙ্গাদের পছন্দ করে না - ভীষণ ব্যঙ্গ আর খারাপ খারাপ কথা।"
একদম সত্যি কথা।
সেদিনই টিভি অফিসে এক জুনিয়র সহকর্মীকে আরেক জন উদ্বাস্তু অর্থে "রোহিঙ্গা" বলে ব্যঙ্গ করছিল। এই নিয়ে খুব হাসাহাসি।
শেষে দাদাগিরি ফলাতে হলো। খুব কঠিন গলায় ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞ্তা থেকে জানলাম, এপারে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষ, দুষ্টুমি করেও এই জনগোষ্ঠীকে হেয় করা যাবে না, ইত্যাদি। সবাই আমার কথা মেনে নিল।
#
এই বিচিত্র বেদনাময় রিপোর্টাজ ভাষ্য বই হিসেবে প্রকাশের দাবি রাখে, জীবন্ত দলিল। আগাম বুকিং দিলাম
খুব ভালো লাগে সবার কমেন্ট পড়তে | চেষ্টা করছি আরো মানুষের সাথে কথা বলে যেতে | এতদিনের অভিজ্ঞতায় যে ব্যাপার আমি অনুভব করতে পারি যে মানুষের সাথে মানুষের মতো ব্যবহার | আপনার আমার কাঙ্খিত ব্যবহার আমাদের মাধ্যমেই আমরা পেতে পারি | অনেকসময় হয়তো হিসেবে মেলেও না | কি আর করা তখন |
আপনাদের কোম্পানি কি নিউ আমেরিকান পাথওয়েস ?
আগে ক্লার্কসটন, জর্জিয়া র ওপর একটা ভিডিও দেখে ছিলাম তাতে এদের কথা শুনেছিলাম। এছাড়া রিফিউজি কফি বলেও এটা সংস্থার উল্লেখ করেছিল তাতে, ফুড ট্রাক চালায়। আর তখন যে মেয়র ছিল, ভীষন অল্প বয়সী, দেখে মনে হয় টেক কম্পানির লোক।
নিউ আমেরিকান পাথওয়েস হল রিসেটেলমেন্ট এজেন্সি। আমরা রিসেটেলমেন্ট এর পরের ধাপ। রিফিউজি কফি - ওপরের ছবিটা ওখানকারই। ☺️ পেছনে ঐ ট্রাক।
আচ্ছা আচ্ছা , বুঝতে পেরেছি ধন্যবাদ
প্রথম দেখায় খেয়াল করিনি ভালো মতো
পড়তে পড়তে গা শিরশির করছিল। আমি হলে নিশ্চয়ই পারতাম না ঐভাবে ভাত তোলার দৃশ্য দেখেও খাওয়া চালিয়ে যেতে। না দেখলে তেমন সমস্যা হয়ত হবে না, কিন্তু দেখার পর! তুমি সত্যিই খুব আলাদা সুকন্যা।
এমন লেখা আগে কখনো পড়িনি।