রাতের জঙ্গলে বন-ফায়ারের আয়োজন হয়েছে; কাবাব ঝলসে উঠছে সেই আগুনে, ফটাফট কাঠ ফাটছে। আগুন ঘিরে চেয়ারে গোল হয়ে বসে আছে মাঝবয়সী বন্ধুরা, হাতে হুইস্কির গ্লাস। এক বন্ধু বলছে, "একবার একজন লোক আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলো, 'জঙ্গলে যাচ্ছ, যদি পথে বাঘ এসে যায়, কী করবে?' লোকটা চালাক-চতুর ছিল, বললো, 'আমি আর কী করব! যা করার বাঘই করবে!'" বন্ধুদের দল হাসিতে ফেটে পড়ে; কেউ গলা ছেড়ে 'ও লড়কি আঁখ মারে' গায়, কেউ কেউ বুনো জীবজন্তুর ডাক ডাকে নেশার ঘোরে। হাসির ফোয়ারা চলতে থাকে।
এই চরম আনন্দ-হুল্লোড়ের দৃশ্যে সবচেয়ে দুঃখের, হতাশার বিষয় কোনটা জানেন? ওই জোক-টা, যেটা শুনে সবাই হাসলো।
অমিত মাসুরকর পরিচালিত 'শেরনি'র একটি দৃশ্য উপরের ওই বন্ধুদের বন-ফায়ারের গল্পটা। গত ১৮ই জুন, ২০২১ আমাজন প্রাইম প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে 'শেরনি', ১২৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের একটি হিন্দি ছায়াছবি। কী আছে ছবিতে? জঙ্গলের ব্যাকড্রপে ভালো পরিচালক, দুঁদে অভিনেতারা এবং বিশ্বাসযোগ্য স্ক্রিপ্ট -- এই ত্রহস্পর্শে আপনি যা যা ভাবতে পারেন, তাইই আছে। একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প ( যা জটিল বা রুদ্ধশ্বাস নয়), একজন সৎ সরকারি অফিসার, তাঁর চেয়ে উচ্চপদে আসীন এক মেরুদন্ডহীন 'সুপার', এবং কিছু সৎ কিন্তু প্রভাবহীন অধস্তন কর্মী বা শুভাকাঙ্খী। জঙ্গলের মনোগ্রাহী দৃশ্যায়ন, গ্রামের সরল, ক্ষিপ্ত জনতা ও তাদের ভাঙিয়ে খাওয়া নেতারা আছেন, বাঘের মানুষ-মারাকেও যারা ভোটের প্রচারে লাগিয়ে দেন। বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে বাঘ আছে, শখের শিকারী আছেন, ভালো থেকে খারাপে বদলে যাওয়া মানুষ ও আশাভঙ্গ -- সব আছে। 'দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন' স্টিরিওটাইপ ভেঙে বেরিয়ে হালফ্যাশনের 'দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন'ও আছে শেষ অব্দি। এতক্ষণ অব্দি এমন কিছু কি পেলেন যা আপনি আশা করেন নি, বা পেয়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেছেন? মনে হয় না। আধুনিক বুদ্ধিদীপ্ত হিন্দি সিনেমার সঙ্গে পরিচিত কেউই হয়তো পাবেন না; এবং 'শেরনি'র বাজিমাত এখানেই।
এত এত স্বাভাবিকতার মাঝে 'শেরনি' এরকমই আরেক স্বাভাবিকতাকে ধারণ করে, যা মোটা দাগের দৃশ্য বা সংলাপে না থেকেও আছে। সে এমনই স্বাভাবিক, যে থেকেও আসলে বিস্মৃত; আমরা তাকে দেখেও দেখি না এই ছবিতে, আমাদের জীবনে। এমন হেঁয়ালি করা দস্তুর বৈকি, কারণ এই বিষয়টি হলো, পরিবেশ সম্বন্ধে আমাদের অসচেতনতা, বিস্মরণ। নিজেদের অসচেতনতা নিয়ে আমাদের সচেতনতার অভাব এর চেয়ে কম হেঁয়ালিতে কী করে বলি, বলুন?
মানুষখেকো বাঘের মানুষমারাকে আমরা বরাবরই, অস্বীকার করে লাভ নেই, প্রায় রাজনৈতিক হত্যার চোখে দেখে থাকি। বাঘ হয়ে ওঠে জাতশত্রু, স্লোগান হয়ে ওঠে 'খুনের বদলা খুন'। এমতবস্থায় যে সব পরিবেশ-সচেতন, স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বাঘ না মেরে, ট্র্যাংকুইলাইজ করে তাকে বাগে এনে গ্রামবাসীদের পীড়ামুক্ত এবং প্রাণীটিকেও সুরক্ষিত করতে চান, তাঁদের প্রায় বাঘেরই মিত্রশক্তি হিসেবে দেখে সাধারণ মানুষ।
সমস্যা বহুবিধ আসলে। এতটুকু শুনে যদি 'নির্বোধ' সাধারণের দিকে আঙুল তুলে দেন, তবে সে আঙুল আবার ঘুরে যাবে অন্যদিকেই, যদি সাধারণের ন্যারেটিভ শোনেন। গবাদি পশুপালনে যাদের জীবন দাঁড়িয়ে আছে, তারা বাঘের ভয় কদ্দিন মাঠে-ঘাটে না গিয়ে বাড়িতে খিল তুলে বসে থাকবে? কৃষকরা কতদিন বন-সংলগ্ন ক্ষেতে ফসল না ফলিয়ে বাঘ-ধরার অপেক্ষায় থাকবে? বন থেকে দূরে যে মাঠে আগে গরু-ছাগল চরতো, সে মাঠ থেকে ঘাস সরিয়ে বড় গাছ বসিয়ে দিলে বনের ধারের মাঠ ছেড়ে তারা আর যাবে কোথায়? এই অবস্থায় বাঘ বেরোলে তারা কোনটা আগে দেখবে -- বাঘের জীবন? না নিজেদের জীবন? তার জন্য যদি শখের শিকারী হাতে বন্দুক তুলে নেয় বাঘ মারবে বলে, যদি স্থানীয় নেতা বাঘে-মারা মানুষের জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে ভোটব্যাঙ্ক জমায়, কার কী এমন ক্ষতি?
আপাতভাবে এর উত্তর পাবেন না কোনোদিনই, যদি না আপনি পক্ষ নেন, যদি না আপনার কাছে এই সবের ঊর্ধ্বে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, এবং সে কাজে আপনার ভূমিকা -- তা সে যতই সামান্য হোক। মেরুদন্ডহীন উচ্চপদস্থ অফিসারের ভূমিকায় ব্রজেন্দ্র কালা যখন বনদপ্তরের পরিবেশরক্ষার ডিজাইনে বিশ্বাস না রেখে স্থানীয় বিধায়কের প্রিয় শখের শিকারীর সঙ্গে হাত মেলান, বা বাঘ তাড়াতে অফিসে পুজোর আয়োজন করেন, রাগে সারা শরীর জ্বলতে থাকে। কিন্তু অন্যদিকে, বাঘ দুজন মানুষকে মেরে ফেলার পর যখন ডিএফও বিদ্যা ভিনসেন্ট (বিদ্যা বালান) ও অধ্যাপক নুরানি (বিজয় রাজ) গ্রামের ছোটদের শেখাতে শুরু করেন যে প্রথম কাজ হলো পরিবেশকে বন্ধু মনে করা, তাকেও খুব গ্রহণযোগ্য সদুপায় বলে মনে হয় না।
শেষ অব্দি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় -- পরিবেশ বিষয়ে আমাদের সংকল্প কী? বাঘে ধরলে যদি আমাদের পরিবেশকে মনে পড়ে, তখন আশু সমাধানের লক্ষ্যে পরিবেশ-সচেতনতার বাণীও যথেষ্ট বেমক্কা ঠেকতে পারে। কিন্তু পক্ষ বলতে এই একটিই -- বাঘ আসুক বা না আসুক, অপেক্ষায় না থেকে নিরন্তর সচেতন থাকা পরিবেশ নিয়ে, সচেতন করা এবং মনে রাখা, এত কিছুর পরেও অসচেতনতা আমাদের বেশিরভাগেরই রক্তে। কিন্তু তাই বলে সংখ্যাগরিষ্ঠের পথ সুপথ হয়ে উঠতে পারে না। 'বাঘ কেন মানুষ খাচ্ছে' বলে ঝাঁঝিয়ে উঠে হাতে বন্দুক তুলে নিলে ঘোড়ায় চাপ দেওয়ার আগে এটাও ভেবে নেওয়া দরকার, বাঘকে (বৃহদর্থে পরিবেশকে) তার স্বাভাবিক বসতি আমরা দিচ্ছি তো? এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে যাওয়ার মাঝে লোকালয়, হাইওয়ে, তামা নিষ্কাষণের খনি খুঁড়ে আমরাই কি তাকে বাধ্য করছি না, খিদের জ্বালায় সহজলভ্য মানুষের দিকে তাকাতে?
কী আশ্চর্য! তাহলে কি হাইওয়ে না বানিয়ে, মাইনিং না করে সবাই মিলে তপোবনে ফিরে যাবো, বাঘকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে?
ঠিক এইটাই! এই কাজটাই করে 'শেরনি' আমাদের মাথার ভিতরে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে আনে; যেখানকার জল যতটা গড়িয়ে আজকের দিনে এসেছিল, আবার সেই জলের দাগ ধরে ইতিহাসে আমরা ফিরে যেতে থাকি; দেখা যায়, জলের রেখা আর রক্তের দাগ একটা সময়ে আলাদা করা যাচ্ছে না। প্রথম আঘাত কে হেনেছিল? দুঃখের বিষয়, মানুষ এত সভ্য হয়েও, এ বিষয়ে আজও নিরুত্তর।
অভিনয়ে বিদ্যা বালান, বিজয় রাজ, নীরজ কবি, শরৎ সাক্সেনার মতো অভিনেতারা যে কেমন করবেন, সে আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আস্থা টিকুর কাহিনি ও চিত্রনাট্য, রাকেশ হরিদাসের সিনেমাটোগ্রাফি, দীপিকা কালরার সম্পাদনা এই ছবির স্তম্ভ এক একটি। উৎকর্ষ উমঙ্গ ধোতেকরের আবহ মিনিমালিস্ট, ও সে কারণেই যথাযথ।
ইংরেজিতে যাকে 'irony' বলি আমরা, এক অপূর্ব ব্যঞ্জনায় তাকে সিনেমার শেষে ব্যবহার করেছেন নির্দেশক মাসুরকর। ডিএফও বিদ্যা ভিনসেন্ট চেয়েছিলেন অকারণে বন্যপ্রাণী না মেরে পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখে এই বাঘ-সংকটকে রুখতে। ফলত, সুবিধাবাদী সরকারি শক্তির চক্ষুশূল হয়ে উঠতে সময় লাগেনি তাঁর। তাই সিনেমার শেষে বদলি হয়ে যান একটি মিউজিয়ামের কিউরেটর হয়ে -- বিদ্যা সেখানে বন্যপ্রাণীদের দেখভাল করছেন আজ, যত্নে তাদের সংরক্ষণ করছেন। সেই প্রথম জোকটির মতো, দুঃখ বা হতাশার এটুকুই -- বন্যপ্রাণীগুলি মৃত। ঠিক যে ধরণের প্রাণীহত্যার বিরুদ্ধে বিদ্যা সরব হয়েছিলেন, আজ সেই হত্যা-পরবর্তী ট্রফিগুলিই তাকে পাহারা দিতে হচ্ছে। কাঁচের বাক্সে প্রাণীগুলি ঠিক সেভাবেই বসে আছে, যেভাবে তাদের বসে থাকার কথা ছিল, বনে।
ভীষণ সুন্দর লাগল।❤
ধন্যবাদ, বিপ্র। :)
সিনেমাটায় কিছু না থেকেও সবটা আছে। কয়েকটা ক্লোস শট, বেশী সময় জুড়ে জঙ্গলের নীরবতা (জঙ্গল আছে কিন্তু পশু পাখির শব্দ নেই) আর সব শেষে বুঝিয়ে দেওয়া আর কয়েকটা দিন পর থেকেই পশু পাখিরা কেবল সংরক্ষণশালায় থাকবে, তারপর ধীরে একদিন সব আলো নিভে যাবে, তারা আর কোথাও থাকবে না।
Absolutely! শেষ দৃশ্যের মতো poignant দৃশ্য আধুনিক হিন্দি সিনেমায় কমই আছে, মনে হয়। পরিস্থিতি, প্রেক্ষিত, সবই একেবারে খাপে খাপে বসে যায় ওই দৃশ্যে।
জঙ্গলের যে silence, সেটাকে অবশ্য দুটো purpose এ ব্যবহার করা হয়েছে। একটা, যেটার উল্লেখ করলি। আর অন্যটা একটা situational use কিন্তু; কারণ tiger attack এর আগে জঙ্গলের যে এলাকায় বাঘ ওঁৎ পেতে আছে, বা আসছে, সেটা unusually শান্ত হয়ে যায়, নীরব হয়ে যায়। তখন একমাত্র দুটো ডাক শুনতে পাওয়া যায় সাধারণত -- গাছের ডাল থেকে বাঁদরের, এবং মাটিতে বার্কিং ডিয়ারের। বাঘ approach করলে এদের ডাককেই জঙ্গলের alarm call বলে ধরা হয়। কাজেই, সেই নীরবতাটাও ভালো ব্যবহার করা হয়েছে এখানে।
শুভংকর,
খুব ভালো রিভিউ করেছেন। সিনেমাটা আজকে রাত্তিরে দেখব এবং পরিচিতদের রেকো করব।
অনেক ধন্যবাদ, রঞ্জন বাবু। অবশ্যই দেখুন। বাতুলতাহীন, গুরুত্বপূর্ণ এরকম সিনেমা আরও পাবো আমরা, আশা করি।
দেখলাম, অনেক ধন্যবাদ।
খানিকক্ষণ ঝিম ধরে বসেছিলাম। ছত্তিশগড়ে কর্মস্থলে বারনওয়াপারা টাইগার স্যাংচুয়ারি এবং আরও দুটো অভয়ারণ্য, কিছু বনগ্রাম ভাল করে ঘোরা। ফরেস্ট গার্ডের ঠেকেও রাত কাটিয়েছি। দু'একবার বাঘের সঙ্গে সামান্য দেখা হয়েছে। জঙ্গল, ফরেস্ট স্টাফ এবং আদিবাসীদের জীবনের টুকরোগুলো ভীষণ অথেন্টিক। একেবারেই রোম্যান্টিসাইজ করা নয় । অন্যরকম ফিল্ম, মেলোড্রামা নেই।
রঞ্জন বাবু, রোম্যান্টিসাইজ করে নি বলেই আরও অবাক হয়েছি। করার সুযোগ খুবই ছিল। কিন্তু এমন পরিমিতিবোধ! খুব ভালো লেগেছে সে কারণে।
আমার কন্যা গতকাল সিনেমাটার কথা বলছিল। আজ আপনার রিভিউ পড়ে আমি অধীর আগ্রহে আছি দেখার জন্য !
সবুজ বাবু, অবশ্যই দেখুন সিনেমাটি। এত mature সিনেমা হিন্দি, বা ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সচরাচর আসে না। নির্মেদ, to the point!
কোনো কারিগরী গোলযোগে তিনবার জমা পড়ে গেল। ত্রুটি মার্জনীয়।
আপনার রিভিউটি মনোগ্রাহী । বিজ্ঞানীর রিভিউটিও পাঠালাম। আশা করি ভাল লাগবে।
ভালো লাগলো রিভিউ । ছবিটা অত্যন্ত ভালো প্রত্যেকের দেখা উচিত ।
অনিন্দিতা দি
ইংরাজি লেখাটি পড়লাম। দিব্যি লাগলো। ধন্যবাদ, share করার জন্য।
Tim
ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো লাগল মতামত পেয়ে...