খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিলেন যে কবি, তিনি তাঁর কবিতায় লিখেছেন—“কবি তুমি যেয়ো না, যেয়ো না।” সম্প্রতি করোনার ভালোবাসার নিশ্চিন্ত ‘আশ্রয়’ হয়ে অগণিত ভক্ত, পাঠক-প্রেমিকদের কাঁদিয়ে তিনি বসুন্ধরা ছেড়ে চলে গেলেন! হাহাকার শোনা গেল—“কবি তুমি যেয়ো না, যেয়ো না”, যেন তাঁরই কথা ধ্বনিত হল চারিদিকে দেশময়! কবির নাম শঙ্খ ঘোষ।
আমি একজন সামান্য মানুষ। মানুষের মাঝে কাঙাল প্রাণ নিয়ে খুঁজে বেড়াই খাঁটি মানুষ সত্তাকে। ভক্ত প্রাণের মালিক হতে পারিনি। ভক্ত পাঠক তো নই-ই। আমার সমগ্র সত্তা জুড়ে দাপাদাপি করে আমার যুক্তিবাদী প্রাণ। তাই কাছের হয়েও দূরে সরে থাকাতেই আমার স্বভাব-ধর্ম সক্রিয় থেকেছে বরাবর বহু ব্যক্তি-মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। সাহিত্যজগতে এবং নাগরিক সমাজেও বিরল খ্যাতির আলোয় উদ্ভাসিত শঙ্খ ঘোষ নামের প্রতিভাধর মানুষটির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিস্ময়কর প্রতিভা আমাকে মুগ্ধ করে যত, তার থেকে অনেক বেশি অভিভূত হই নিখাদ মানুষের দর্শন পেলে। দর্শন মেলে না। হৃদয়ের কাঙালপনাও তাই দূর হয় না! এমন প্রাণের অধিকারী আমি প্রথিতযশা কবি শঙ্খ ঘোষের সান্নিধ্য লাভ করেছি বলে গর্বিত হওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি বা আবেগ খুঁজে পাইনি। তবু কিছু কথা বলার থাকে! নড়াচড়া করে স্মৃতির ঝাঁপি। সেখানে জড়ো করা আছে কিছু সংশয়ও। প্রকাশের অপেক্ষায়। সে সঞ্চয় থেকে কিছু তুলে ধরা যাক।
এক: শঙ্খ ঘোষ তাঁর নিজ নির্বাচিত নাম। সেই নামের আড়ালে থেকে গেল ‘চিত্তপ্রিয়’ নামটি—পরিবার-সূত্রে প্রাপ্ত তাঁর নামটি চিরদিনের জন্য। তাঁর অর্জিত গুণাবলিও একটি পরিচয়ের আড়ালে সবটুকু না হলেও অনেকাংশে আবৃত থেকে গেছে। অসাধারণ শিক্ষক। নিপুণ গদ্যকার। নিখাদ কবি। বিবেকবান, সত্যভাষণে পারঙ্গম নাগরিক। বিরলদর্শন মৃদুভাষী বাঙালি। উচ্চাসনে অবিচল ব্যক্তিসত্তা। বিশ্লেষণে টের পাওয়া যায় বহুবিধ আরও সব অলংকার, যেসব তিনি লাভ করেছিলেন সযত্ন প্রয়াসসাধনে। কিন্তু সেসকল সঞ্চয় তাঁর বিপুল কবিখ্যাতির অন্তরালে আশ্রয় পেল অবিশ্বাস্য বাস্তবতায়।
আমি তাঁর প্রথম দর্শন পাই বাঙলা সাহিত্যের অধ্যাপক রূপে, দর্শনশাস্ত্রের ছাত্রী হিসেবে এমএ পড়াকালীন সময়ে। ১৯৬৯ সালের কথা, দূর থেকে দেখতাম। শ্বেতশুভ্র পোশাক পরিহিত নির্ভেজাল বাঙালি। আপাদমস্তক শ্বেতবসনাবৃত কৃষ্ণবর্ণের চেহারা মানুষটিকে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছিল। নাম-খ্যাতি তো ছিলই, কিন্তু আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তাঁর শিক্ষকতার পটুত্বের প্রশংসা শুনে। ছাত্রীজীবন শেষ হয়েছে। পিএইচডি গবেষণাকর্মে যুক্ত হয়েছি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি অধ্যাপনা করেন শিক্ষার্থীদের ভক্তি-ভালোবাসার নৈবেদ্য-লাভে সার্থক হয়ে।
অঞ্জনা নৈশবিভাগে বাঙলা সাহিত্যের ছাত্রী। দিনে সাউথ পয়েন্টে পড়ায়। মেধাবী ছাত্রী। প্রায়ই বলে শঙ্খ স্যারের কথা। উচ্চকিত উচ্ছ্বাসে বলে ওঠে একদিন—“জান মীরাদি, স্যার যখন পড়ান, তখন তাঁকে একজন অপূর্ব রূপবান ব্যক্তির মতো দেখায়! চোখে ঘোর লাগে! কী আশ্চর্য ক্ষমতা বল?” শুনতে শুনতে মুগ্ধ চিত্তে বলি, “আমি একদিন ওঁর পড়ানো শুনতে যাব তোমাদের ক্লাসে।” সে শখ আমার মেটেনি উদ্যোগ নেওয়ার অভাবে। কোনোদিন ওঁর বক্তৃতা শোনা হয়নি! এই আক্ষেপ আমার রয়েই গেল মনের গভীরে! তাঁকে কখনও জানানো হয়নি সে কথা। তাঁর শিক্ষক সত্তার এমন সার্থকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে বেশি মাত্রায় আর সব গুণাবলি বাদ দিয়ে। শিক্ষার্থীদের মন ভরিয়ে দেওয়া অ-সহজ কর্ম নিঃসংশয়ে। তারপর অধ্যাপনাজীবনে প্রবেশ ও তজ্জনিত ব্যস্ততার কারণে শঙ্খ ঘোষকে নিকট থেকে দেখা হয়নি বহুদিন। তবুও মুগ্ধতার রেশ কমেনি। স্মৃতির ঝাঁপিতে স্থান পেয়েছিল সেই অনুভব আজও যা অনিঃশেষ।
দুই: কলেজ-শিক্ষক জীবনে ব্যস্ততার শেষ নেই। লেখালিখির ক্ষেত্রে একটু-আধটু পরিচিতি ঘটতে চলেছে। সংসার-জীবনেও প্রবেশ করতে হয়েছে। তারুণ্যে ভরপুর জীবন। মহাপ্রাণা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবদান দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার তাগিদে সর্বজনশ্রদ্ধেয়া গৌরী আইয়ুবকে সভানেত্রী করে কয়েকজন মিলে গড়ে তোলা হল একটি সংস্থা—‘সুরাহা-সম্প্রীতি’। তিনধরনের কাজ করা শুরু হল—(১) মাসিক রোকেয়া বৃত্তিদান দরিদ্র-মেধাবী কিছু শিক্ষার্থীকে, (২) বার্ষিক রোকেয়া স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা, বিষয়: আমাদের দেশের উপেক্ষিত ও বিস্মৃতপ্রায় ব্যক্তিত্বের অবদান, (৩) জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করা কোনো মহিলাকে রোকেয়া-পুরস্কার প্রদান। যত দূর মনে পড়ে তৃতীয় বার্ষিক অনুষ্ঠানটির সভাপতি হিসেবে শঙ্খ ঘোষের কথা ভাবা হল। গেলাম তাঁর বাসভবনে। সেই প্রথম সাক্ষাতালাপ। ১৯৯১ সালে সম্ভবত। আমার সংক্ষিপ্ত নিবেদন শুনে স্বল্পবাক মানুষটি মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলেন, “আমি তো কোনো সভায় যাই না।” সে বাক্য তীব্র আঘাত হানল হৃদয়গহনে। কিছু বলতে ইচ্ছে হল না। ঘর ছাড়ার আগে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—“আপনার সদিচ্ছার উপর ছেড়ে দিলাম।” উনি যেন একটু থমকে গেলেন। অকস্মাৎ বলে উঠলেন, “আমি যাব।” বললাম, “আপনি তো যান না। তবে?” শুনতে পেলাম—“ওই যে বললেন সদিচ্ছার কথা!” মৃদু হেসে বললাম, “আমন্ত্রণপত্রে নাম দিচ্ছি তাহলে।” ব্যথা পেয়েছিলাম। তবু শেষপর্যন্ত জয় ঘটল বুঝে প্রলেপ পড়েছিল সে ব্যথায়।
তবু শেষরক্ষা হল না। অনুষ্ঠানের মাত্র দু-একদিন আগে তাঁর এক ছাত্র আমার ঠিকানা না জানার কারণে সন্ধান করে হয়রান হয়ে অবশেষে আমাদের বাসগৃহে পৌঁছে জানালেন, মাতৃবিয়োগ ঘটার কারণে তার স্যার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন না। সুবিখ্যাত মানুষটির দায়িত্ববোধ এবং তাঁর ছাত্রের কর্তব্যনিষ্ঠা আবারও আমাকে মনে করিয়ে দিল তাঁর সার্থক শিক্ষক সত্তার কথা। মনে মনে ভাবলাম, তাঁরই ইচ্ছাপূরণ ঘটল বুঝি এভাবে! নিরানন্দ ভাব গ্রাস করল মনকে। একধরনের সংশয়ও সেইসঙ্গে আশ্রয় করে নিল মনে।
এরপর তাঁকে বেশ কিছু সভায় উপস্থিত থাকতে দেখেছি। বলতে শুনেছি—“মঞ্চে উঠি না।” মঞ্চেও দেখেছি অতঃপর। বলতে শুনেছি—“বলব না কিছু।” তারপর বলতেও শুনেছি। মেলাতে পারিনি এসবকে। তবে কি তিনি দোদুল্যমানতায় ভুগতেন! একই মঞ্চে পাশাপাশি বসার পরিস্থিতিতে এসব কথা তোলপাড় তুলেছে মনে। সংশয়াচ্ছন্ন মন জবাব পায়নি। এত স্পষ্টবাক তিনি। কোনো জড়তা বা অস্বচ্ছতা থাকে না তাঁর উক্তিতে। তবু কেন এমন স্ববিরোধিতা ঘটে যায় প্রায়শই! উত্তর মেলেনি।
তিন: এভাবে অসামান্য ও সামান্যের ফাঁকটুকু ঘোচেনি বহুদিন ধরে। তবু কত অঘটন ঘটে যায় মানুষের অজান্তেই। এক্ষেত্রেও ঘটল। ফোনে কথা হয়েছে। তিনি আমার লেখার অকপট প্রশংসা করেছেন। একজন নামি ব্যক্তির কারসাজিতে আমার সম্পাদিত গৌরী আইয়ুব স্মারক গ্রন্থের প্রকাশ দু-বছর ধরে আটকে থাকে। শঙ্খ ঘোষ-এর মধ্যস্থতায় সেই জটিল সমস্যার সমাধান ঘটে যায় জাদুমন্ত্রের মতো! তারপর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলাকালে এবং তার পরের সময়কালে তিনি বেশ কাছের মানুষ হয়ে গেলেন আমার। মনে মনে এবং বাইরেও। তাঁর মুখে বিরল হাসি ফোটে দেখি সাক্ষাৎ দর্শনে। পরিমিতি বজায় রেখে অবশ্যই। একটি অনুষ্ঠানে সেটুকুও রইল না। মনখোলা হাসি তাঁর মুখে। কেটে গেল আমার মনের ধূমায়িত কুয়াশা!
চার: ২০১১ সালে নতুন সরকার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হয়েছে। অতঃপর বিভিন্ন সরকারি পদ বণ্টন করে সরকার-ভক্ত মহল গঠন করার হিসেবি প্রক্রিয়া চলছে তখন। আমার কাছে এক খ্যাতনামা অভিনেতা মারফত বেশ কিছু পদ গ্রহণের প্রস্তাব এল। স্পষ্ট উত্তরে ‘না’ বলে দিলাম। এরপর একজন জনপ্রিয় কবি একেবারে বাড়িতে চলে এলেন। একটি পদ গ্রহণের জন্য লিখিত চিঠি নিয়ে। সম্মতি জানাতে পারিনি। পরের দিন মনে হল শঙ্খ ঘোষকে জিজ্ঞেস করি—কী করব? কবি-মানুষটিকে অসম্মান করে ফেলি পাছে! তাই বড়ো মাপের এই কবির শরণ নিই। তিনি বললেন—“নিয়ে নিন। ভালো না লাগলে ছেড়ে দেবেন।” আরও জটিল হল পরিস্থিতি! মনের সম্মতি না থাকলেও যোগদান করে ফেলতেই হল। কিছু পরেই এল গভর্নরের চিঠি—কলেজ সার্ভিস কমিশনের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণপত্র। একই মন্ত্র মেনে সম্মতিপত্র পাঠালাম। কোনোমতে দুটি ক্ষেত্রেই একবছর কাটানো গেল। তারপর একটি ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে দুটি পদেই ইস্তফা দেওয়ার সুযোগ মিলে গেল। তাতে সুফল মিলল বহু চাকরিপ্রার্থীর জীবনে। সে ভিন্ন সংবাদ।
স্মৃতিচারণায় সংশয় জমা হয়ে ওঠার কথা বলেই শেষ করা যাক। দুজন কবির মধ্যস্থতার জন্য যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদান করলাম, সেখানে গিয়ে দেখি শঙ্ঘ ঘোষের প্রিয়ভাজন ছাত্র ক-জনকে সদস্য করা হয়েছে। সরকারের প্রতি তাদের বশংবদ ভাব দেখে বিস্ময়ের অবধি মিলল না মনের মধ্যে। শেষপর্যন্ত অনেক কিছু মেলাতে না পেরে, অনেক অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব না পেয়ে অন্তরাত্মা বিরূপ হয়ে উঠতে থাকল। আবারও মনে জমা হতে থাকল সংশয়ের বাষ্প। নানা ঘটনায়। সে বাষ্প দূর হয়নি কোনো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি বর্ষণে। নৈকট্য দূরে সরল। বিষণ্ণতা স্থান করে নিল অন্তর-গভীরে। মাঝে মাঝে নাগাল না-পাওয়া উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত কবির অকম্পিত প্রতিবাদী স্বর শোনে দেশবাসী। আমিও শুনেছি। হেঁটেছি মিছিলে তাঁর পশ্চাতে। তবুও দেখেছি তাঁর স্নেহভাজনরা ক্ষমতার ধারে-কাছে থাকা মানুষদের পিছে পিছে ধাবিত হওয়া বন্ধ করেননি। তাই সংশয় আবারও জায়গা পায় মনে। ঘাঁটি করে নেয় একান্তে।
পাঁচ: তারপর কবি ব্যাধির আক্রমণে নাজেহাল থেকেছেন। তবুও তিনি সত্যভাষণে অনড় থেকেছেন উচ্চাসন থেকে একটুও না সরে। আমার তাঁর কাছে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। ব্যাধিকবলিত দেহে করোনা ঠাঁই পেল বিনাবাধায় একরকম। তিনি চলে গেলেন প্রায় নব্বই বছর বয়সে। স্মৃতির ঝাঁপিতে আমার সংশয় আরও জমা হয়েছে।
আমি কবিতানুরাগী যত, তার থেকে অনেক বেশি দর্শনানুরাগী। আমার সেই সত্তা আমাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে সংশয় জমিয়ে তুলে সেসবের উত্তর খুঁজে ফেরে। উত্তর মেলে না। খোঁজা চলে তবুও। আমৃত্যু চলতে থাকবে সেই খোঁজার পালা। সে প্রচেষ্টায় প্রবাদপ্রতিম কবি ও নাগরিক এবং সেইসঙ্গে শিক্ষক মানুষটিও আমার বড়ো চেনা হয়েও অচেনাই রয়ে গেলেন!
তিনি নিজেকে কি খুব ভালো করে চিনতেন! তাই লিখে গিয়েছেন—
“নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী
আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা—
মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে
অস্ত্র গোড়ো, আমায় কোরো ক্ষমা।”
(কবর)
বড়ো জানতে ইচ্ছে করে শঙ্খ ঘোষ নামের পর্বতপ্রমাণ উঁচু মানুষটির আড়ালে চিত্তপ্রিয় নামের মানুষটি আসলে কেমন ছিলেন? কবিতায় নয়, প্রখর বাস্তবে ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন কি তিনি?
উত্তর মেলে না। জীবনের পথচলা থামে না তবুও।
"তবুও দেখেছি তাঁর স্নেহভাজনরা ক্ষমতার ধারে-কাছে থাকা মানুষদের পিছে পিছে ধাবিত হওয়া বন্ধ করেননি।"
সে দায়টা কি শঙ্খ ঘোষের ।
ঠিকই, এখানে শঙ্খ ঘোষের দায়টা কোথায় ?
সমালোচনা করবেন তো মন খুলে করুন। এত রেখে ঢেকে করার কী আছে? যত্ত সব বাজে লেখা!