এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • বকুলকথা 

    ইন্দ্রাণী লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৫ এপ্রিল ২০২১ | ২২৬৯ বার পঠিত
  • দূর গগনের সে কোন সুউচ্চ স্তর হইতে স্যাটেলাইট ক্যামেরায় এই অঞ্চলের  চিত্রগ্রহণ করিয়া জুম করিলে একটি বকুলগাছের  নিকট পৌঁছন সম্ভব। চিত্রে ক্ষুদ্র আয়তাকার ক্ষেত্রসমূহ দেখা যায়- যাহা বস্তুত বাটিকার উপরিভাগের আচ্ছাদন, তাহার পর উঠান, চতুষ্কোণ হরিদ্রাভ ক্রীড়াস্থল, বালিকার মলিন রিবনের ন্যায় বিস্তর গলিঘুঁজি; আরো নিকট হইতে দেখিলে একখানি  ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ, কৃশ সরণি, তাহার উপর এক, দুই, তিনখানি একতল অথবা দ্বিতল গৃহ, ভগ্ন প্রাচীর, মরিচা পড়া অপরিসর লৌহফটক। জুম করিয়া  তিন নম্বর প্রাচীরটি অতিক্রম করিলে,  অপরপ্রান্তে পীতাভ হরিৎ  ক্ষুদ্র তৃণভূমি,  নিতান্ত ম্লান নতমুখ করবী, জবা, টগর  এবং একখানি একতল গৃহ;  সম্মুখস্থ  উঠানে ভগ্ন মৃত্তিকাপাত্রে গত রাত্রির বৃষ্টিসলিলে তৃণরাজি , মশককুল  ইত্যাদি শোভা পাইতেছে;   স্থলে স্থলে আস্তর  উঠিয়া গভীর খোন্দল, তাহাতে  দীর্ঘ ধারালো তরবারির ন্যায় তৃণগুচ্ছ, কর্দম,  কত বরষের সঞ্চিত বারি - সামান্য অসাবধান হইলেই আছাড় খাইবার সম্ভাবনা। সর্প দংশনেরও ভয় রহিয়াছে। ফলে এইস্থলে মানুষ নিম্ননেত্রে চলিতে থাকে। তাহার পর  গৃহের সম্মুখে  আসিয়া বকুল ফুলের যে সুবাসে থমকিয়া দাঁড়ায়,  স্যাটেলাইট ক্যামেরা তাহার সন্ধান পায় না। সুগন্ধের উৎস সন্ধানে মানুষ যখন দক্ষিণে দৃষ্টি ফিরায়, এক ঘন কৃষ্ণবর্ণ কর্কশ কান্ড তাহার  দৃষ্টিগোচর হয়-  বৃক্ষের  উপরিভাগ আকাশ স্পর্শ করিয়াছে, সজীব তরুণ পত্রগুচ্ছে  নীলাম্বরতলে যে হরিদ্রবর্ণ ঘন চন্দ্রাতপের আয়োজন , তাহা ভেদ করিয়া দৃষ্টি চলে না। প্রভাতকালে উঠান ভরিয়া বকুলের পত্র, ঝরা পুষ্প, রক্তবর্ণ ফল- গত বৈকালে ঝড় উঠিয়াছিল।
    অর্গলবদ্ধ জালিকার ভিতর দিয়া গৃহের ভগ্ন রোয়াক  দেখা যাইতেছে- সে স্থলের রং বুঝা যায় না , শিরা উপশিরার ন্যায় ফাটলের দাগের উপর বহু বৎসরের জমা ধূলি বর্ষণের পর কর্দমাক্ত, মধ্যাহ্নে সূর্যের তেজ বাড়িলে কর্দম শুকাইয়া  আবার ধুলিকণা হইবে।  পশ্চিমকোণে বিবর্ণ কপাটের সম্মুখে বকুলপাতা, পুষ্প, ভগ্ন শাখা স্তূপ হইয়া আছে।  এইস্থলেই বীথিকা বসিত।
     
    প্রতিটি মানুষের একটি নির্দিষ্ট  ভরকেন্দ্র থাকিবার কথা-  যাহার  চতুর্দিকে সে ঘুরিয়া ফিরিবে সমস্তজীবন। বিবাহের বৎসর না ঘুরিতেই বকুলবৃক্ষটি যে  বীথিকার একান্ত  ভরকেন্দ্র  হইয়া উঠে,  ইহার  নিজস্ব আখ্যান ছিল। বীথিকা -সমরেন্দ্রর যৌবনে এই সকল অঞ্চলে প্রান্তরের আয়তন ধু ধু বিশেষণে বিভূষিত হইত, 'বীরপুরুষ' পঠনকালে বালক বালিকার এ'মত প্রান্তর স্মরণে আসিত অবশ্যম্ভাবী। বীথিকা, সমরেন্দ্রর বাটির নিকটবর্তী যে প্রান্তর, তাহার দুইপ্রান্তে গোলপোস্ট;  বামে মাটির পথ ছিল- কর্দমপ্রাবল্য এড়াইতে তাহাতে খন্ড ঈষ্টক সজ্জিত , অন্যপ্রান্তে পাকা স্কুল বাড়ির নির্মাণ সদ্য আরম্ভ হইয়াছে;  দক্ষিণের দিকে অশ্বত্থ বৃক্ষতলে কষ্টি পাথর ও ত্রিশূল প্রোথিত - তাহারই উপরে চন্দ্রাতপ টানাইয়া  শিবরাত্রি হইত, আর ক্রীড়াক্ষেত্রটিতে রথের মেলা।  বিবাহের বর্ষপূর্তিতে সমরেন্দ্রর সহিত মেলা প্রাঙ্গণ হইতে বকুলের ক্ষুদ্র চারাটি ক্রয় করিয়াছিল পূর্ণগর্ভা বীথিকা। স্বামী স্ত্রী একত্রে চারাটি তাহাদের বসতবাটিকার  আঙিনায় রোপণ করে। সারে জলে, যত্নে তাহা লকলক করিয়া বাড়িতে থাকে।
     
    কিয়ৎকাল পরে শ্রাবণের পূর্ণিমায় ঘন কৃষ্ণমেঘরাজি আকাশ ও চন্দ্রমা ঢাকিয়া ফেলে। তুমুল দুর্যোগের পূর্বাভাষ বেতারে ও সংবাদপত্রে সেইদিন প্রভাতেই আসিয়াছিল। বীথিকা কহিল," বাঁচবে তো?" সমরেন্দ্র ঈষৎ অন্যমনস্ক ছিল- এই দুর্যোগে, রাত্রিকালে বীথিকার প্রসববেদনা উঠিলে সে কী করিবে ভাবিতেছিল। গৃহে সমরেন্দ্রর জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা , তাহাদের স্ত্রী, পুত্রকন্যা বিদ্যমান; কনিষ্ঠ ভ্রাতার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধব ধনী ও মোটরকারের অধিকারী- সমরেন্দ্র আশা করিতেছিল, কনিষ্ঠকে নিজ দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করিলে সে হয়ত উক্ত ধনী যুবককে সম্ভাব্য সংকট সম্পর্কে অবহিত করিয়া আপৎকালে গাড়িটি নিশ্চিত করিতে পারিবে। আবার  ভ্রাতাদিগের সম্মুখে স্ত্রীর আসন্ন প্রসব লইয়া নিজ উদ্বেগ ব্যক্ত  করিতে সমরেন্দ্র কিঞ্চিৎ কুণ্ঠাও বোধ করিতেছিল।  স্ত্রীর প্রশ্নে সে চকিত হইয়া উত্তর করিল,"সর্বনাশ! ব্যথা উঠলো নাকী?"
    বীথিকা হাসিয়া বলিল, " বকুলের কথা বলছি।  ঝড় উঠলে বকুলের চারা বাঁচবে তো?"
    সমরেন্দ্র শ্বাস ফেলিয়া কহিল- "একটা ঝুড়ি টুড়ি দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলেই হবে। দাঁড়াও আমি দেখছি।"
     
    বীথিকাকে আশ্বস্ত করিয়া সমরেন্দ্র কনিষ্ঠ ভ্রাতার কক্ষে গেল- সেইখানে ঘন্টাখানেক আসন্ন সংকট সম্বন্ধে আলোচনা করিতে করিতে বকুলচারা সংক্রান্ত কথোপকথন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইল। ততক্ষণে বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে। হাওয়ার তেজও বিস্তর। বীথিকা  ক্যাসাবিয়াঙ্কা নহে, সে দ্রুত কক্ষের বাহিরে স্বামীকে খুঁজিল-সমরেন্দ্র দৃষ্টিগোচর হইল না,  উপরন্তু  বাটির অন্যান্য  কক্ষগুলির জানালা ও কপাট অর্গলবদ্ধ। বীথিকা এযাবৎ সমরেন্দ্রর নাম ধরিয়া উচ্চকন্ঠে ডাকে নাই- সে দস্তুরই  ছিল না, তাই কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিয়া রোয়াকে গেল- বৃষ্টির ছাঁটে জলসিক্ত বারান্দায় তাহার পা পিছলাইয়াছিল-  সে বামহস্তে একটি বদ্ধকবাটের শিকলি ধরিয়া  নিজেকে সামলাইল , তাহার পরে উদ্যানে  বকুলচারার নিকট গিয়া এক্ষণে ঠিক কী করণীয় ভাবিতে বসিল - সত্ত্বর কিছু করিতে হইবে । একটি ক্ষুদ্র ঝুড়িতে মৃত্তিকা, বালু, কিছু সার রাখা ছিল, বীথিকা, ঝুড়ি খালি করিয়া বকুলচারাকে ঢাকা দিল। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র হাওয়ার তোড়ে  ঝুড়িটি উড়িল- প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশবর্তী হইয়া বীথিকা  তাহা  ধরিয়া ফেলিল বটে, কিন্তু উদ্বেগে তাহার চিত্ত অস্থির, নিঃশ্বাস দ্রুত হইল। এদিকে অঝোরবর্ষণ শুরু হইয়াছে; প্রাচীরের নিকটে দুই এক খ্ন্ড  ইষ্টক ছিল- বীথিকা ঝুড়ির উপর তাহা স্থাপন করার কথা ভাবিল। একহস্তে ঝুড়ি অন্য হস্তে ইষ্টকটি আনিতে তাহার হাঁফ ধরিয়াছিল,  এতদসত্ত্বেও  সিক্ত চারাটির উপর ঝুড়ি স্থাপন করিয়া তাহার উপর ইষ্টকটি রাখিল। ভাবিল- "যাক"।
    এমন সময় গগন বিদীর্ণ করিয়া বিদ্যুৎ !  বীথিকার শরীর ভারসাম্য হারাইয়াছিল তন্মুহূর্তে এবং তাহার পার্শ্বে অবলম্বনের নিমিত্ত কিছুই ছিল না। বীথিকার উদর পড়িল ইষ্টকের উপর- বৃষ্টির বারিধারায়  রক্ত মিশিয়া বকুলের মাটি সিঞ্চিত করিয়া দিল। শিশুটি কন্যা ছিল। সমরেন্দ্র আর বীথিকার প্রথম ও শেষ সন্তান।
     
    এই দুর্ঘটনার পরে, বীথিকার শরীর ও মনের স্বাস্থ্য ফিরাইতে সমরেন্দ্র সস্ত্রীক  লন্ডন যাত্রা করিবে ভাবিল। সে প্রযুক্তিবিদ- এহেন চাকুরির প্রস্তাব পূর্বেও আসিয়াছিল- সে  রাজি হয় নাই। পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। প্রস্তাব শুনিয়া বীথিকা সজোরে মাথা নাড়িয়া ঘোর অসম্মতি জানাইল। তাহার পর কহিল," বকুলকে নিয়ে যেতে পারব?" সমরেন্দ্র নিজের অশ্রু আড়াল করিল -" সাধন, উমা সবাই বকুলের যত্ন নেবে। তারপর আমরা তো ফিরেই আসব খোকা খুকী কোলে নিয়ে। কী তাই না?" সমরেন্দ্র  স্ত্রীকে নিকটে টানিতে চাহিল।  বীথিকা স্বামীকে  সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া উদ্যানে  বকুলের পার্শ্বে বসিয়া  পড়িল। পরবর্তী এক মাহিনা যাবৎ সমরেন্দ্রর, তাহার ভ্রাতা, ভ্রাতৃবধূগণের সমবেত অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও  বীথিকা ইংলন্ডবাসের উপযোগিতা বুঝিতে অসমর্থ হইল।  বস্তুত এই সকল আলোচনা আরম্ভ  হইলেই , সে বারান্দায়  বকুলের তরুণ সবুজ কান্ডের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকিত; কাহারও কোনো বাক্য তাহার কর্ণগোচর হইয়াছে -এমন বোধ হইত না। সমরেন্দ্র অনেক ভাবিয়া একাকী রওনা হইল- এক বৎসর পরে আসিয়া বীথিকাকে লইয়া যাইতে চেষ্টা করিবে।
     
    সমরেন্দ্রর বিদেশযাত্রার পরে বীথিকার মানসিক অবস্থার উত্তরোত্তর অবনতি ঘটিতেছিল। সে ভালো করিয়া স্নান করে না,  চুলে চিরুনী দেয় না,  খাদ্যে বিন্দুমাত্র রুচি নাই - ডাক্তার টনিক লিখিয়া দিলেন। মাসখানেক কাটিলে সে রুক্ষ চুলে তৈল প্রদান করিল, সুগন্ধী সাবান লইয়া স্নানঘরে ঢুকিল, স্নানান্তে গন্ধদ্রব্য মাখিয়া, পায়ে আলতা দিল। চুল বাঁধিয়া ঢাকাই শাড়িটি পরিলে সমরেন্দ্রর শিশু ভ্রাতুষ্পুত্র জিজ্ঞাসা করিল-" কোথায় যাও কাকিমা?"
    বীথিকা উত্তর করিল -"বিলাত"।
    শিশুটি নাচিতে নাচিতে রন্ধনশালায় খবর দিল, কাকীমা সাজিয়া গুজিয়া কাকার কাছে যাইতেছে। সেই কথা শ্রবণে সমরেন্দ্রর দুই ভ্রাতৃবধূ  ছুটিয়া আসিলেও অর্গলবদ্ধ কক্ষে প্রবেশ করিতে পারিল না। দুইঘন্টা পরে পুলিশ দরজা ভাঙিয়া বীথিকাকে কড়িকাঠের আংটা হইতে নামাইল।
    শিশু ভ্রাতুষ্পুত্র প্রতাপেন্দ্র কহিয়াছিল " বিলাত বুঝি খুব উঁচুতে মা?"
     
    সমরেন্দ্রও আর ফিরিল না। বৎসরে দুইবার নীল লেফাফায় তাহার পত্র আসিত, কখনও টাকা। সেদিনের বকুলচারাটি ততদিনে তরুণ- ফুল ফোটে, ফল ধরে। ভ্রাতৃবধূরা সেই ফুল কুড়াইয়া মালা গাঁথে, বীথিকার বাঁধানো ফটোগ্রাফে পরায়। ক্রমশঃ তাহাদের অশ্রুও সময়ের প্রলেপে শুকাইতে থাকে যদিও বকুলকে  ঘিরিয়া এই সময় কিছু জনশ্রুতি তৈরি হয়। প্রতিবেশী কার্তিকের মাতাঠাকুরাণী সন্ধ্যার ঝোঁকে এক আলুলায়িতকুন্তলাকে বকুলের তলায় বসিয়া থাকিতে দেখে, কখনও গোপাল মাস্টার কাহারও ক্রন্দন শুনিতে পায়; উঠান ঝাড়ু দিতে গিয়া চঞ্চলা একদিন বকুলতলে রক্তবিন্দু দেখিতে পাইল। বৃদ্ধ নগেনবাবুর চক্ষে বকুলের তলে বিশ্রামরত পাটকিলে বিড়ালটি নিরতিশয় সন্দেহের - মার্জারের এই রূপ রং সচরাচর লক্ষিত হয় না।
     
    যাহা হউক,  বাটির বাসিন্দাদের বয়স বাড়িতেছিল- এক্ষণে তাহাদের রূপালী কেশ, চক্ষে চশমা, চর্ম শিথিল।  সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বে বিস্তর পরিবর্তন ঘটিতেছিল; বস্তুত  দিন বদলাইতেছিল। অঞ্চলের ক্রীড়াক্ষেত্রটি অটুট থাকিলেও প্রান্তরের পূর্বে আর কেহ ধু ধু বিশেষণ বসায় না,  নব নব বাটিকায় এবং উচ্চ হর্ম্যরাজিতে অঞ্চলটি ভরিয়া  গিয়াছে;  ব্যক্তিগত মোটরকার দুর্লভ নহে,  প্রতি গৃহে অন্তত এক ব্যক্তি প্রবাসী। বকুলতলায় তরুণ তরুণীর বিশ্রম্ভালাপ দেখিলে কেহ আর ফিরিয়াও চাহে না- টীকা টীপ্পনি দূরস্থান । প্রতাপ ও তাহার ভগিনী শহরের মহাবিদ্যালয়ে পড়িতে গেল এবং সমরেন্দ্রর দুই ভ্রাতাই শহরে এক উচ্চ হর্ম্যে দুই তিন কামরা বিশিষ্ট স্বীয় মহল কিনিতে প্রবৃত্ত হইল।  ইতোমধ্যে সমরেন্দ্রর মৃত্যুসংবাদ আসিলে বকুল সংলগ্ন ও জমি ও বাটিকা প্রোমোটারের হস্তে পড়িল -পুরাতন বাটি ভাঙিয়া শহরের ন্যায় হর্ম্য নির্মাণ তাহার উদ্দেশ্য-বকুলগাছটিকে কাটিয়া ফেলিতে হইবে।
     
    যেদিন বৃক্ষ উৎপাটন হইবে, সন্নিহিত অঞ্চলের পুরাতন সকল জনশ্রুতি মুখে মুখে ফিরিল। পৌষের প্রভাতে বিশাল যান্ত্রিক করাত লইয়া প্রোমোটারের দল  উপস্থিত হইলে,  প্রাচীন অধিবাসীবৃন্দ কিছু আশ্চর্য দেখিবার নিমিত্ত ভীড় করিয়াছিল;  কেহ ভাবিয়াছিল,  বৃক্ষটিকে কিছুতেই কর্তন করা যাইবে না, কেহ বীথিকার প্রেত বকুলবৃক্ষকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইবে - এমত চিন্তা করিয়াছিল।  বৃক্ষে করাত স্পর্শ করিবামাত্র ফিনকি দিয়া রক্তস্রোত ছুটিবে- এমনও অনুমান ছিল। বস্তুত বৃক্ষের মরণবাঁচন দৈবের হাতে ছাড়িয়া প্রতিবেশীসকল নিশ্চেষ্ট ছিল সেইদিন অথচ  কোনো প্রকার আশ্চর্যই ঘটিল না। স্বল্পায়াসেই  এত বৎসরের প্রাচীন বৃক্ষটি উৎপাটিত হইল- যেন বড় অভিমানে সে নিজেকে সরাইয়া লইল। যে লতাটি এতদিন তাহার কান্ড বেষ্টন করিয়া ছিল, সে ছিন্নভিন্ন হইয়া ভূলুন্ঠিত। উচ্চ বৃক্ষশাখায় যে পক্ষীযুগল নীড় গড়িয়াছিল, গোধূলির পরে প্রত্যাবর্তন করিয়া  তাহারা  ভূমিতলে নিক্ষিপ্ত  ভগ্ন ডিম্ব ও খড়কুটার উপর চক্রাকারে কাঁদিয়া ফিরিল। দক্ষিণ দিকের আকাশ  অকস্মাৎ শূন্য হইয়া গেল, সেই দিকে চাহিয়া কাহারও ‘ধু ধু’ বিশেষণটি আবার স্মরণে আসিল । বকুলের  কান্ড, শাখা প্রশাখা সকলই  বৈদ্যুতিক করাতে খন্ডখন্ড করিয়া মালবাহী শকটে উত্তোলিত হইল। বকুলের চিহ্নমাত্র রহিল না। শকট সকলই লইয়া গেল।
     
     সেদিনই পূর্ণিমা। শ্রাবণ পূর্ণিমার মত পৌষের পূর্ণিমার তেমন গ্ল্যামার নেই। অথচ সে রাতে সমরেন্দ্রর পুরোনো পাড়ায় বিশাল বড় চাঁদ দেখা গিয়েছিল যেন এতদিন বকুল তাকে আড়াল করে রেখেছিল- এতদিনে সুযোগ পেয়ে সে নিজেকে প্রকটিত করল। চাঁদের আলো আকাশ উপচে পুরোনো মফস্সল ভাসিয়ে দিচ্ছিল। এমন আলো হয়েছিল যে মফস্সলের রাস্তা , গলিঘুঁজি বরফে ঢেকে গেছে  মনে হচ্ছিল। এই সব  আশ্চর্য পথঘাট, উচ্চতার সুবিধাহেতু ফ্ল্যাটবাড়ির লোকজন প্রথম খেয়াল করে  তারপর পটাপট মোবাইলে ছবি তোলে আর শেয়ার করতে থাকে। সেই  ছবিতে ধবধবে সাদা রাস্তার আশে পাশে ইতস্তত মৃদু আলো আর ব্যাকড্রপে অন্ধকার বহুতল দেখা যাচ্ছিল। ছবির  নিচে প্রেরকের প্রশ্ন ছিল- "বলত কোথায়?" জবাবে, মফস্সলের রাস্তাকে মিশিগান বলে ভুল করেছিল লোকজন। কেউ বলছিল নিউ ইয়র্ক। ইউরোপ, রাশিয়াও গেস ছিল। ফলে সে রাতে বহু লোকেরই ভৌগোলিক অবস্থান গুলিয়ে যেতে থাকে। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ এ ওর ঘাড়ে চড়ে  এক রাতে  মফস্সলে মহাপৃথিবীর জন্ম হয়।
    প্রতাপ ছবিটা পায় তার বন্ধুর থেকে হোয়াট্সয়াপে,  সঙ্গে কপি পেস্ট প্রশ্ন- 'কোথায়?'  সে ঈষৎ থমকায় , তারপর উত্তর টাইপ করে -'বিলাত।'
     
    [প্রথম প্রকাশঃ বাংলা লাইভ, মার্চ, ২০২১]
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৫ এপ্রিল ২০২১ | ২২৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sobuj Chatterjee | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১১:৫৭105144
  • চন্দ্রালোকিত মফস্বলের এক বিদেহী বকুল তলায় অব্যক্ত বিস্ময়ে আমার সমস্ত কথা ফুরাইলো!

  • ইন্দ্রাণী | ০২ মে ২০২১ ০৪:৩৬105349
  • এই দুঃসময়ে পাঠকের মনোযোগের আশা করি নি একেবারেই। সব লেখাগুলি একসঙ্গে তুলে রাখছি কেবল।
    অশেষ ধন্যবাদ সবুজ।
     

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন