এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপর বাংলা

  • আসমা বীথিতে তিন নোক্তা~

    বিপ্লব রহমান লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৩৩৫১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)

  • তার ক্যামেরার চোখে আস্থা বরাবর, লেন্সে তিনি শুধু স্থির বা চলচ্ছবি ধরেন না, প্রকাশ করেন অন্তর্দৃশ্য, মুহূর্ত বা পরিস্থিতির বিবরণ, যা আসলে চলমান ইতিহাসের দিকদর্শনও। 


    করোনাক্রান্তিতে আসমা বীথির নির্মিত বদ্ধ সময়ের স্বল্পদৈর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র-- 'ইনসাইড আউট' খুব ভাবিয়েছিল, যখন অপরিকল্পিত লকডাউনে বিত্তহীন মানুষের অন্নসংস্থান ছিল বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ। ওই ছবিতে ভাত-কাপড়ের রিপিটেড শটের ব্যবহার ছিল লক্ষ্যণীয়। 


    আর এবার "গিত্তাল মি আচ্ছিয়া" AS THE GRAIN RISES- নামক ৩৬ মিনিটের চলচ্চিত্রে বীথি উন্মোচন করেন মধুপুরে ক্ষয়িষ্ণু শালবনের ধারে চুনিয়া গ্রামে প্রাচীন প্রাকৃতিক ধর্ম "সাংসারেক" এর অনুসারী মান্দি বা গারো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিপন্ন জীবন কথা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন মহিরুহের মতো দীপ্যমান জ্ঞানীবৃদ্ধ জনিক নকরেক। 


    কবি, গণসংগীত শিল্পী কফিল আহমেদ যেমন বলেন, "আধুনিক কালের আধিপত্যের মুখে প্রাকৃতজনের  জীবনের অনেক গভীর  সত্যই  যে আজ তছনছ হয়ে গেছে।  এতো  কিছু হারাবার কালে  মধুপুরের চুনিয়া গ্রামের একশত বিশ/বাইশ বছর বয়সী জনিক নকরেক আচ্চু আজো তাঁর  প্রাকৃত সাংসারেক   জীবনধারায়  অটল। প্রত্যয়ী। মধুপুরের  চুনিয়া গ্রামের এই প্রবীন কিংবদন্তির বিশ্বাস আর মূল্যবোধকে নিয়ে চলচ্চিত্রভাষ্য 'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া '।"



    স্বীকার করি, অনলাইনে ছবি দেখার সবচেয়ে বড় বাধা বোধহয় ফোর-জিতেও বাফারিং-এর সাফারিং, তবু চলচ্চিত্রের জমিন জুড়ে চেনা চুনিয়ার অচেনা দৃশ্যপটের জন্ম হয় কেবলই, মহাজাগতিক স্রোতের বিপরীতে বৃদ্ধ জনিক নকরেকের লাঠিতে ভর দিয়ে পা ছেচড়ে শুকনো শালপাতা মাড়িয়ে চলাই যেন ইংগিত করে প্রায় দেড়শ বছরে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত, জুম চাষ ও শিকারের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলা, সাবেক যোদ্ধা মান্দি আদিবাসীর আধুনিক জীবনে বেঁচে থাকার অসম লড়াই। 


    চট্টগ্রামের "সিনে ক্লাব বিস্তার" এর আয়োজনে "বিক্ষণ ও বাহাস" পর্বে অনলাইন প্রদর্শনীর শুরুতে বীথি নিজেই বলেন ছবি নিয়ে সূচনা কথা, যা অনেকটা এরকম, আসলে সাংসারেক ধর্মটি প্রকৃতি নির্ভর ধর্ম, এই মানুষগুলো মারা গেলে এই ধর্মটিও হারিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে প্রাচীন সংস্কৃতি, বোধ ও বিশ্বাস...ইত্যাদি। 


    সে দিক থেকে বিচারে এই ডকুমেন্টশনটি জরুরি, ইতিহাসের আর্কাইভ, আবার ইতিহাসের সাথে পথযাত্রাও। 


    ধোঁয়াশার মতো ভোরের আলোকচ্ছটা, বৃদ্ধ জনিক, আরেক সহ বৃদ্ধ, তরুণ বুদ্ধিজীবী, বন্ধুবরেষু পরাগ রিছিল, আন্তনী রেমা, জুয়েল বিন জহিরসহ বেশ কিছু টুকরো সাক্ষাৎকার, মান্দি শিশুদের দলবদ্ধ সংগীত চর্চা, 'তানা বাবা তানা ফিরিংগী দেয় হানায়' কুকুর-বেড়ালের লড়াইয়ের মন্তাজ, ঘুনে ধরা খুঁটির পাশেই চামড়া কুচকে আসা জনিক আচ্চু, শষ্য উৎসব ওয়ানগালার কিছু অনুসর্গ, বন চিরে চলে যাওয়া ঘোড়া টানা মালবাহী গাড়ি, যুদ্ধ নাচের দু-একটি দৃশ্যকাব্য আদিবাসীর জীবনাচারকে প্রকাশ করে নান্দনিক উপস্থাপনায়। 



    ছবিটি দেখতে দেখতে চুনিয়ার মান্দি গ্রামে বেশ  খানিকটা মানসভ্রমণ হয়ে যায়, যা দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রাখে। 


    জনিক নকরেকের টুকরো সংলাপে নাম না জানা কোনো পাখির ডাক যেমন ন্যাট সাউন্ড হিসেবে সুন্দর মানানসই, তেমনি আন্তনী, পরাগ ও আরেকজনের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে বাইরের কথোপকথনের ওভারল্যাপিং কখনো হাউলিং তৈরি করে, হয়তো এসবই উৎসবের অনুসংগ, তবে ডকুমেনটশনের স্বার্থেই আলাপচারিতাগুলো বোধকরি নির্জনতা দাবি রাখে, যখন তা গোবিন্দগঞ্জের সংগ্রামী সান্তলদের নিউজ ডক নয়। 


    ছবিতে বিপন্ন বনচারী মান্দি আদিবাসী যেমন উদ্ভাসিত, সমান্তরালে  বিপন্ন বনের ছবি তেমন প্রকাশিত নয় বলেই মনে হয়েছে, বরং শাখে শাখে বানরের দোল, সবুজ শালবনবিহার, বন চিড়ে অশ্বযানের গমনাগমন বিপরীত ধারণাই যেন দেয়। 


    এছাড়া জুয়েলের ভাষ্যে মিশনের উদ্যোগে নাগরিক ওয়ানগালা চালুর কথা উঠে এলেও মিশন ও নগরজীবনই যে ওয়ানগালার মৃত্যুদূত সে কথা যেন প্রচ্ছন্নভাবে চাপা পড়ে যায়। এছাড়া ইদানিং চুনিয়ার ওয়ানগালার উদ্যোক্তা রুরিরা না হলেও আদিবাসী বান্ধব পাপারাই, চুনিয়াবাসী মান্দিদের এতে নিত্য অংশগ্রহণ মাত্র, এই রূঢ় সত্যও চাপা পড়ে যায় মাইকে ভেসে আসা ঢাক, শিংগা ও ঘন্টা ধ্বনিতে। 


    সংক্ষেপে, বীথির এই নির্মাণ শিল্পের জন্য শিল্প নয়, বরং শিল্পকেন্দ্রিক ইতিহাস ধারণ, মান্দি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় অকথিত অধ্যায়, এইখানে আদিবাসীর জয়, ব্রেভো! 


    ছবি নিয়ে আলাপচারিতা :


    ____


    সংংযুক্ত : রংচুগালা : বিপন্ন আদিবাসী উৎসব 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপর বাংলা | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৩৩৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ০৩ মার্চ ২০২১ ০৬:২১103149
  • পড়লাম আপনার দুটো লেখা। খানিক পরিচয় হল গারো লোকসংস্কৃতি এবং আধুনিক নগরসভ্যতার আগ্রাাসনের মুুখে তাঁদের অস্তিত্বের লড়াইয়ের। আমার মা নেত্রকোণার।


    আজ সিনেমা নিয়ে আলোচনাটিও দেখব।

  • বিপ্লব রহমান | ০৪ মার্চ ২০২১ ০৩:৫৭103159
  • রঞ্জন দা, আপনার আগ্রহের জন্য অনেক ধন্যবাদ। 


    কি বিভৎস সাংস্কৃতিক আগ্রাসন! 

  • শঙ্খ | 2402:3a80:a6f:207e:ab03:973c:59c:***:*** | ০৪ মার্চ ২০২১ ০৯:৫৫103160
  • শিরোনামের মানে বুঝলাম না। নোক্তা মানে কী?

  • বিপ্লব রহমান | ১১ মার্চ ২০২১ ০৫:৪৪103478
  • আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ শংখ। নোক্তা-- একটি আরবি হরফ, যায় আক্ষরিক রূপ "বিন্দু", এখানে এটি "পয়েন্ট" অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। 


    শিরোনাম ছাড়াও লেখা নিয়ে দুকথা লিখলে আরও ভাল হতো। শুভ 

  • Prativa Sarker | ২১ মার্চ ২০২১ ১০:২৫103928
  • এ-ই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তোমার এবং সমমনস্কদের সংগ্রামকে কুর্ণিশ জানাই। ছবিটি কিভাবে দেখতে পাব? 

  • বিপ্লব রহমান | ২১ মার্চ ২০২১ ১৬:৪৭103941
  • প্রতিভা দি, 


    অপরাধী করে দিলে ভাই। 


    প্রথমত, কুর্নিশ আবার কি! সামান্য সামাজিক দায়বোধ মাত্র। দ্বিতীয়ত, ছবিটি ফেসবুকে প্রচার ও আলোচনার পর এই রিভিউ লেখা। তখন ধারণা ছিল, ছবিটি ইউটিউব বা অন্য সাইটে মুক্ত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অজ্ঞাত কারণে এখনো তা হয়নি। 


    তাই আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে বোধকরি। :/

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন