গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাঙ্গালোরনিবাসী পরিবেশকর্মী দিশা রবিকে দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁর বাড়ি থেকে। দিশার বয়স ২১ বছর, কিছুদিন আগে বিজনেস এডমিনস্ট্রেশনে স্নাতক স্তরের পড়াশুনো শেষ করেছেন। পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ নেতৃত্বে সারা বিশ্ব জুড়ে চলা পরিবেশ আন্দোলন ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’-এর অন্যতম সংগঠক(ভারতে) দিশা রবি।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেটা থুনবার্গ নিজের টুইট একাউন্ট থেকে একটা ‘টুলকিট’ শেয়ার করেন। যা বর্তমানে কয়েকমাস ধরে চলা ভারতের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত। উক্তদিনে দিল্লি পুলিশ উক্ত ‘টুলকিট’ কারা তৈরি করল বা ছড়িয়ে দিল তার অনুসন্ধান করার জন্য এফ আই আর লিপিবদ্ধ করে এবং তদন্ত শুরু করে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ব্যাঙ্গালোর থেকে দিশা রবিকে গ্রফতার করে এবং আরো দুজন মুম্বাই হাইকোর্টের উকিল নিকিতা জ্যাকব এবং শান্তনু নামের একজনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে দিল্লি পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা প্রো-খালিস্তানি গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে চক্রান্ত করে টুলকিট শেয়ার করার মধ্যে দিয়ে সারা বিশ্বের সামনে ভারতের মর্যাদার অবমাননা করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। [ধারা 124A, 153, 153A, 120B : Farmers’ protests | 22 year-old activist Disha Ravi arrested, sent to Delhi Police custody, 14 February 2021: The Hindu] দিশাকে দিল্লি কোর্ট পাঁচদিনের দিল্লি পুলিশের হেফাজতে পাঠিয়েছে। অন্যদিকে ১১ ফেব্রুয়ারি আইনজীবি নিকিতা জ্যাকবের বাড়ি তল্লাশি চালায় এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তিনি এই মামলার বিরুদ্ধে বোম্বে হাইকোর্টে একটি অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করেছেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বোম্বে হাইকোর্ট তাঁর এবং শান্তনুর দশদিনের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করেছে।
দুই.
গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে সংসদীয় বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের ডাকে ‘নবান্ন অভিযান’ ছিল। কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল শুরু হয় এবং পুলিশ তা এস এন ব্যানার্জী রোডের মুখে আটকে দিলে ছাত্র-যুবরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। পুলিশ যথারীতি বিক্ষোভ দমনের নামে আক্রমণ চালায় আন্দোলনকারীদের উপর। লাঠিচার্জ, জলকামান কিছুই বাদ পড়েনি। পুলিশের আক্রমণে বহু আন্দোলনকারী আহত হয়। তার মধ্যে বাঁকুড়ার যুব সংগঠনের কর্মী এবং পেশায় অটোচালক মইদুল ইসলাম মিদ্যা গুরুতর আহত হন পুলিশের আক্রমণে। ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান।
গণআন্দোলন কর্মীদের উপর আক্রমণ ভারতে নতুন ঘটনা নয়। বিশেষকরে দ্বিতীয়বার নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর গণআন্দোলন কর্মীদের উপর আক্রমণ বেড়েছে কয়েক গুণ। এই আক্রমণের দুটি দিক, একদিকে রাষ্ট্র তার পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গণ আন্দোলন, বিক্ষোভ, মিছিল ইত্যাদিতে সরাসরি আক্রমণ নামাচ্ছে লাঠি জল কামান কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। অন্যদিকে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভরতদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। উপরোক্ত দুটি ঘটনা এই দুটি দিককে নির্দেশ করছে।
ভীমা কোরেগাঁও মামলা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হত্যা ষড়যন্ত্রের যে মামলা সেখান থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি বারবার গণ আন্দোলনেরকর্মীদের নানা মিথ্যা মামলায় আটক করা হচ্ছে। তার নবতম সংযোজন বর্তমানে পরিবেশকর্মী দিশা রবির গ্রেফতারী। এই প্রত্যেকটি মামলার ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি বারবার কোন না কোন রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিবন্ধিত বা নিষিদ্ধ সংগঠনের নাম সামনে আনা হচ্ছে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ আছে এরকম কিছু ভুয়ো প্রমাণ দেখিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। ভুয়ো প্রমাণ বলছি তার কারণ, কিছুদিন আগেই আমরা ভীমা কোরেগাঁও মামলার ক্ষেত্রে দেখলাম আর্সেনাল ফরেন্সিক টিম উক্ত মামলায় অভিযুক্ত রোনা উইলসনের কম্পিউটার পরীক্ষা করে দেখিয়েছে যে কিভাবে তথ্যপ্রমাণ তৈরি করা হয়েছে। তথ্যপ্রমাণ পুলিশ বরাবরই তৈরি করে এই ঘটনা ভারতে নতুন কিছু নয়। কিন্তু বিচারব্যবস্থাও যদি পুলিশের দ্বারা তৈরি মিথ্যা তথ্যপ্রমাণের উপর ভর করে আদেশ দেয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে বলে মনে হয়।
দিশা রবির ক্ষেত্রে বিষয়টি জলের মত পরিষ্কার। প্রথমে এল টুলকিটের প্রশ্ন, টুলকিটের মধ্যে ছিল কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত কিছু ছবি, পোস্টার লেখা। আর ছিল কিভাবে আন্দোলনের প্রচার করা যায় তার দিশা নির্দেশ। এবং এই টুলকিটের মধ্যে সামান্য কিছু সম্পাদনা করেছিলে দিশা। কিন্তু এখন তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে তার সাথে যুক্ত করা হল ‘প্রো-খালিস্তানি’ গ্রুপ। কৃষক আন্দোলনের প্রথম থেকেই আমরা দেখছি মিডিয়া, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলি চেষ্টা করছে এই আন্দোলনের সাথে ‘খালিস্তান’ পন্থীদের নাম যুক্ত করা।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে আমরা দেখলাম ন্যায্য দাবি দাওয়ার আন্দোলনে পুলিশের সন্ত্রাসে শিকার হলেন এক যুবক। এই ঘটনা ভারতের বুকে নতুন নয়। গণ আন্দোলনের উপর পুলিশি সন্ত্রাসের বহু ঘটনা আমরা দেখেছি। চলেছে লাঠি চার্জ থেকে গুলি চালানো। অথচ, ভারতের সংবিধানের ১৯এ ও বি ধারায় পরিষ্কার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ জমায়েতের অধিকার দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালে রামলীলা ময়দানে জমায়েতের উপর পুলিশি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট একটি সুয়ো মোটো কেস করে এবং অভিযুক্ত পুলিশদের উপর এফ আই আর করার নির্দেশ দেয়। সমস্ত আহত মৃত ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক সাহায্যের নির্দেশও দেয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখলাম মইদুল ইসলাম মিদ্যা হত্যার ঘটনায় কোন পুলিশের উপর কোন প্রকারের অভিযোগ তো দূরের কথা কোন সামান্য ব্যবস্থাও নেওয়া হল না। গত দশকের বিভিন্ন গণ আন্দোলনের উপর পুলিশি জুলুম, সে নন্দীগ্রামের মিছিলে গুলি চালানো হোক বা লালগড়ে আদিবাসী নেতা লালমোহন টুডুর হত্যা অথবা বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে ভাঙর জমি আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো হোক; কোন ঘটনাতেই পুলিশের কোন শাস্তি হয়নি। কিছু তদন্ত কমিটি তৈরি হলেও তার কোন রিপোর্টের খবর কেউই জানেনা।
আসলে না জানাটাই স্বাভাবিক, দোষী পুলিশের উপর কোন ব্যবস্থা না নেওয়াটাই স্বাভাবিক। এই রাষ্ট্রের পেটোয়া বাহিনী হল এই পুলিশ। রাষ্ট্রের সমস্ত ভুল ত্রুটির বিরুদ্ধে সমস্ত স্বরকে দমনের অন্যতম হাতিয়ার হল পুলিশ। ফলে ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন রাষ্ট্র তাঁর দস্যি ছেলেকে রক্ষা সবসময় করে আসছে এবং করবেও।
সারা দেশ জুড়েই এক ফ্যাসিস্ট আবহাওয়া বিদ্যমান। সেই রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় অন্য দল থাকুক না কেন, কেন্দ্রের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নে সমস্ত রাজনৈতিক দল, শাসক অংশ একমত। মানবাধিকার লঙ্ঘন সমস্ত শাসকের কাছেই অতি প্রিয় একটা বিষয়। ফলে আমাদের লড়াইও এই সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে।
শুভময় মৈত্র এর গোটা লেখাটায় অনেক দামি দামি কথা আছে কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ সিবিসি ("চালচোর বাঁচাও কমিটি).এর মুখপাত্র হিসেবে একবারও "মমতা ব্যানার্জি" শব্দটা নেই, "তৃণমূল" শব্দটা নেই "পশ্চিমবঙ্গের সরকার" শব্দটা নেই। অধচ নন্দীগ্রাম আছে। জানতাম থাকবে না। ক্যালি কাকে বলে। সাবাস।
"গত দশকের বিভিন্ন গণ আন্দোলনের উপর পুলিশি জুলুম, সে নন্দীগ্রামের মিছিলে গুলি চালানো হোক বা লালগড়ে আদিবাসী নেতা লালমোহন টুডুর হত্যা অথবা বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে ভাঙর জমি আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো হোক; কোন ঘটনাতেই পুলিশের কোন শাস্তি হয়নি। কিছু তদন্ত কমিটি তৈরি হলেও তার কোন রিপোর্টের খবর কেউই জানেনা।"
আছে তো!!!
''লালগড়ে আদিবাসী নেতা লালমোহন টুডুর হত্যা অথবা বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে ভাঙর জমি আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো হোক; কোন ঘটনাতেই পুলিশের কোন শাস্তি হয়নি। কিছু তদন্ত কমিটি তৈরি হলেও তার কোন রিপোর্টের খবর কেউই জানেনা।"
দিব্যি আছে তৃণমূলের নাম। শান্তভাবে আরেকবার পড়ে দেখতে পারেন। :-)
Saikat Bandyopadhyay
(১) মমতা ব্যানার্জি
(২) তৃনমূল এবং
(৩) পশ্চিমবঙ্গের সরকার এই তিনটি শব্দের মধ্যে কি কি পাওয়া গেল ?
তৃনমূল আর সরকার। তা আপনার দাবী করা শব্দের মধ্যে একটা আস্ত আরেকটার অর্ধেক (যদিও অর্থবোধক দিক থেকে পুরো) পাওয়া গিয়েছে।
বর্তমান তৃণমূল সরকারের
শুভময় মৈত্র এর গোটা লেখাটায়
শুভদীপ ঘোষ ,
সিপিয়েমের বরং নাম নেই
তিন খানার মধ্যে দেড় খানা খুঁজে দেওয়াতে আন্তরিক কৃতজ্ঞ
সমুদ্রবাবুর দাবীটা কী? আপনার বেঁধে দেওয়া কীওয়ার্ড ব্যবহার করে প্রবন্ধ লিখতে হবে? তা আপনি নিজেই লিখুন না। আপনার তো ব্লগ অ্যাক্সেসও আছে মনে হয়। নইলে আমাদের খেরোর খাতা আছে। লগইন করুন আর লিখে ফেলুন।
পুলিশ রাষ্ট্রের, এই সরকার বা ঐ সরকারের নয়। তবে যে যখন সরকারে থাকে পুলিশের সব কাজকর্মের দায় সেই সরকারের। মজা হলো, পুলিশের অত্যাচার নিয়ে তদন্ত করে খুব কিছু হয় না। বাম আমলের ঘটনার তদন্ত হলো তৃণমূলের আমলে। প্রসব অশ্বডিম্ব। কাংগ্রেস আমলের (৭২-৭৭) অত্যাচারের তদন্ত হলো বাম আমলে। প্রসব অশ্বডিম্ব। বাম আমলে মন্ত্রী পুলিশকে ঘূষ নিতে হাতেনাতে ধরলেন। তাতেও অশ্বডিম্ব প্রসব হলো। এখানে তৃণমূল সরকার ছাত্রদের পেটাচ্ছে, ত্রিপুরায় বিজেপির সরকার শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, কেরালায় বাম সরকার ছাত্রদের পেটাচ্ছে। কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পুলিশের শাস্তি হলে নাকি "ফোর্সের মনোবল ভেঙ্গে যাবে"। ক্ষমতা এরকমই। ক্ষমতার ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টাটাই নেই কারুর।