ফাগুন লেগেছে বনে বনে…রবি ঠাকুরের এই গানের কলি বসন্তের হাওয়ায় কী যেন এক বার্তা নিয়ে আসে। বসন্ত পঞ্চমীতে যত না সরস্বতীর আরাধনা হত, তার থেকে বেশি হত মদন দেবের পুজো। আমাদের ছোটবেলায় 'ভ্যালেন্টাইনস ডে' শব্দটার তেমন চল ছিল না। কিন্তু ওই সরস্বতী পুজোর দিনে ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় মনের আদান প্রদান হত বৈকি। পরে আর্চির কার্ডের দৌলতে গোলাপের বিক্রিও বাড়ল, ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ নির্ধারিত হল ভ্যালেন্টাইনস ডে, মন দেওয়া নেওয়া দিবস। কিন্তু বাঙালি আজও সরস্বতী পুজোকে বাংলার 'ভ্যালেন্টাইনস ডে' হিসেবে ধার্য করে রেখেছে।
প্রেম এমন দিনক্ষণ দেখে হয় না জানি, কিন্তু বসন্ত বাতাসে কিছু একটা থাকে যেখানে মনের আনাচে কানাচে রং ধরায়। সেই রঙে কার মন কার প্রতি রাঙা হবে তা কি তৃতীয় জন বলতে পারে?
ভালবাসা জাত দেখে না, ধর্ম দেখে না, বয়স দেখে না, লিঙ্গও দেখে না। হয়ে যায়। কেন কখন কার মনে কী অঘটন ঘটে যাবে হয়ত আগের মুহূর্তে সে নিজেও জানে না।
প্রায় তিরিশ বছর আগে আমার জীবনেও এমন একটা অঘটন ঘটে গিয়েছিল। সে আমার কলেজের সহপাঠী, স্কুলে এক বছরের সিনিয়র। চরিত্রে আমরা বিপরীত, কিন্তু সেটাই বোধহয় আকর্ষণের অন্যতম কারণ ছিল। আমার থেকে বছর দেড়েক'এর বড়, ডাক্তার, বাবা উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরীজীবী, পাত্র হিসেবে তো মন্দ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু আমার বাড়িতে ঘোর আপত্তি। সমস্যাটা কোথায়? আমার জন্ম হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। সেই সময়ে অন্য জাতে বিয়ে নিয়েই সমস্যা ছিল, সে জায়গায় আমি একেবারে মুসলমান ছেলেকে পছন্দ করে বসলাম। মা বাবার মুখ গম্ভীর, অনেক আলাপ আলোচনা, অনুনয় বিনয়, কান্নাকাটি চলল। তার আগে পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আমরা তেমন অনুভব করতাম না। বিভিন্ন ধর্মীয় মতালম্বী বন্ধুরা মিলে একসাথে হৈ হৈ করে দিন কাটিয়েছি। কিন্তু দুটি ধর্মের ছেলেমেয়ের বিয়ে হলে সমাজ কী বলবে এই নিয়ে উদ্বেগের সীমা ছিল না। বলে রাখা ভাল আমাদের দুই পরিবারকে একেবারেই রক্ষণশীল বলা যায় না।
এরই মধ্যে ভারতের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচিত হয়ে চলেছিল। বাবরি মসজিদ ভাঙার সাথে সাথে ধর্ম আর রাজনীতি গেল গুলিয়ে। তার আঁচ লাগল সাধারণ মানুষের মনে। তখন আমরা পার্ক সার্কাসের ন্যাশনাল মেডিকেলের ইন্টার্ন। একদিকে পাশের বস্তিতে আগুন জ্বলছে, গুলি খেয়ে আহতরা আসছে হাসপাতালে আর কারফিউ এর মধ্যে আমরা আটকা পড়েছি এমার্জেন্সি ডিউটিতে। বলাই বাহুল্য আমাদের সম্পর্ক ঘনীভূত হচ্ছে সেই দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে।
বিয়ে হল সই সাবুদ করে আদার ম্যারেজ অ্যাক্ট'এ, কোন ধর্ম পরিবর্তনের প্রশ্ন ওঠেনি। দুই বাড়ি প্রথমে মুখ ভার করলেও কিছুদিনের মধ্যে আত্মীয়তা হাসি এনে দিল দুপক্ষের মুখেই। দুই মা বাবা দিব্যি একসাথে বেড়াতে চলে গেলেন আমাদের ফেলে রেখে।
একসাথে থাকতে গিয়ে ধর্ম কখনও মাঝখানে এসে দাঁড়ায় নি। মতান্তর হয়েছে অনেক সময় অনেক বিষয়ে, যেমন অন্য যে কোন পরিবারে হয়। তাই বলে কেউ কারো ধর্মীয় মত অন্যজনের ওপর চাপিয়ে দেয় নি। ঈদ বা দুর্গাপুজো দুজনের কাছেই ছিল উৎসব। তাই ঈদে সিমাই রান্না করেছি যেমন আবার পুজো মণ্ডপে বসে ভোগ'ও খেয়েছি সবার সঙ্গে বসে। তবে এটাও ঠিক একটু আলাদা নজরে দেখত অনেকেই, মুখে তমন কিছু বলত না।
পরে অনেকগুলো বিয়ে এমন দুই ধর্মে হতে দেখেছি। ক্রমে আপত্তি উঠে গিয়ে দেখেছি বেশ ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছে দুই বাড়ির লোক, পেটপুরে নেমন্তন্ন খেয়েছি। তারা এখনও পর্যন্ত সবাই সুখে আছে বলেই শুনেছি।
সামাজিক ভাবে একদিকে যেমন এই বাধাগুলো ক্রমশ কমে আসছিল, ঠিক তখনই নিঃশব্দে কখন ধর্মীয় বিষ আমাদের মধ্যে দেওয়াল তুলতে শুরু করেছিল আমরা বুঝতেই পারিনি। খাওয়া নিয়ে আমাদের দুজনের কিছু বাছবিচার ছিল না, তবু মা বাবাদের সামনে কখনও তাদের অপছন্দের খাবার নিয়ে বসে খাইনি। বন্ধুরা যারা স্বেচ্ছায় সব কিছু খাবার চেখে দেখতে চেয়েছে, দিয়েছি, কখনও কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না, জোর করার তো প্রশ্নই নেই। তাই যখন আইন করে বিভিন্ন শহরে কোন কোন খাবারে নিষেধাজ্ঞা জারি হল, অবাক হয়েছি, খারাপও লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গবাসী এখনও খাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাধীনতা উপভোগ করেন, কদিন করবেন জানি না।
কথা হচ্ছিল প্রেম ভালবাসা নিয়ে, তার মধ্যে এই আলোচনা কেন? ইদানিং একটা চিন্তার জায়গা তৈরি হচ্ছে যখন দেখি ধর্মের নামে ভালবাসার জায়গাতেও বেড়ি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি আইনের নাগপাশে জড়িয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে স্বতস্ফূর্ত সম্পর্কগুলোকে। 'লাভ জিহাদ'এর ধুয়ো তুলে দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের বিবাহ বন্ধ করাটিকে আইনের আওতায় আনার জন্য বিশেষ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রদেশে বলবৎ হয়েছে আইনটি। কত 'শো বছর পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা! একদিকে আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে আমরা ঘর ভরিয়ে ফেলছি, অন্য দিকে মানসিক চিন্তাধারায় পেছনের দিকে হেঁটে চলেছি, এ কেমন আশ্চর্য কথা!
ভাবতে চেষ্টা করি যদি আমাকে এমন আইন দেখিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হত ঠিক কী করতাম? মেনে নিতাম? তেমন সহজ মেয়ে তো আমি কোনকালেই ছিলাম না। জেলে যেতাম? হয়ত যেতাম। আমি তো একা নই। আমার মতো এমন হাজার হাজার মেয়ে আছে যারা জাত ধর্ম দেখে ভালবাসে না। তাদের কী পরিণতি হবে? আইন দিয়ে ভালবাসার শ্বাস রোধ কি এই প্রজন্ম মেনে নেবে? নাকি রাজনীতির এমন আফিম আমরা খেয়েছি যেখানে আর সব রঙ ফিকে?
Very well expressed Adrija..Love is unconditional.
অদ্রিজা, অজস্র অভিনন্দন জানাই ব্যক্তিগত উপলব্ধির সুন্দর প্রকাশের জন্য ! অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা ! মনকে নাড়া দিল ভীষণভাবে ! প্রার্থনা করি - খুব ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন ! আন্তরিক শুভেচ্ছা আপনাদের জন্য ! ভালোবাসা চিরন্তন !
ভালো থাকুন। ভালবাসুন। বাকি সব শূন্য।
ভালোবাসার ধর্ম ভালোবাসা।ধর্মের পিটুলি গোলা খাওয়ালে কিচ্ছু হবেনা।
ভালো লাগলো,অদ্রিজা।
ম্যাডাম
আপনার লেখা অত্যন্ত ভালো লাগলো
খুব সুন্দর করে নিজের কথা লিখছেন .
অসম্ভব সময়োপযোগী লেখা!
লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো .
আপনাকে দেখিয়ে সেরেছিলাম একদা .