বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। সেখানে রুমা বাজার পেরিয়ে বগালেকের পারে গড়ে ওঠা বম আদিবাসী গ্রামের রেস্ট হাউজে রাত্রিবাস। দূর পাহাড়ে ডিসেম্বরের ভোরে হীমেল বাতাসের কামড় ও ধোঁয়াশার দাপট খানিকটা কমে এলে সহযাত্রী সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমাসহ পরিকল্পনা করা হয় আরো দূর যাত্রার।
সে দফায় বর্ষিয়ান বম নেতা সাংলিয়ান কারবারী (গ্রাম প্রধান) গাইড করবেন আমাদের, মেঘপুঞ্জি ভেদ করে খাড়া উঠে যাওয়া ক্রেওক্রাডং পর্বত-লঙ্খন পর্বে। এর আগেই সাংবাদিক কাম অভিযাত্রীদ্বয় কাটিয়ে উঠছে বগালেকের অপার বিস্ময়।
যাত্রায় সঙ্গে নেওয়া হয় হালকা ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগে থাকছে জলের বোতল, টর্চ (হঠাৎ রাত্রিযাপনের প্রয়োজনে), প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, ওরস্যালাইন, ডেটল-ব্যান্ডেজ, কয়েক প্যাকেট বিস্কুট, এক ছড়া পাহাড়ি কলা, সিগারেট-ম্যাচ ইত্যাদি।
এর আগে দুজন কারবারীদার কিশোরী কন্যা ময় মহাজনের আপ্যায়নে শাপলা লতা-সিঁদোলের (সিঁদোল বা নাপ্পি, একধরণের শুটকি মাছ) ঝোল তরকারি ও খানিকটা গরম ভাতে সেরে ফেলা হবে সকালের খাবার। একফাঁকে “ময়” কথাটির অর্থ জানতে চাওয়ায় লাজুক কিশোরীর চতুর উত্তর হবে এ রকম:
“যখন আপনারা ক্রেওক্রাডং-এর চুড়ায় পৌঁছাবেন, তখনই জানতে পারবেন এই নামের অর্থ!”
অবশ্য আরো পরে জানা হয়েছে, বম ভাষায় “ময়” কথাটির মানে সুন্দরী।
ক্রেওক্রাডং-এর খাড়া পাহাড়ি পথ ধরে ঘন্টা পর ঘন্টা চলা শুরু। দীর্ঘতর পাহাড়ের পথযাত্রায় মুগ্ধ হতে হয় বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। চারপাশে সুনসান নীরব পাহাড়ের পরে পাহাড়, মেঘের পরে মেঘ, অরণ্যর পরে অরণ্য, সবুজের পর আরো সবুজ...যেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি টেলিভিশনের ভেতর ঢুকে পড়া গেছে।…
মাঝে মাঝে যাত্রা বিরতির ফাঁকে সাংলিয়ান দা’ বলবেন পাহাড়ের ভয়াবহ “ইঁদুর বন্যা”র কথা। বাঁশের পাকা বীজ খেয়ে বেড়ে যায় পাহাড়ি ধেড়ে ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা, দ্রুত বংশবিস্তার ঘটে বাহিনীর। এরপর বন্যার পানির মতো ধেয়ে আসা ইঁদুরের পাল পাহাড় জুড়ে আক্রমণ চালায় জুম ফসলের ক্ষেতে। নিমেষে ইঁদুর-উদর পূর্তিতে শুন্য হয় সাজানো বাগান। পাহাড় জুড়ে দেখা দেয় নীরব দুর্ভিক্ষ, হাহাকার। ...চাকমা ভাষায় এরই নাম “ইঁদুর বন্যা”, বম ভাষায় “মাওথাম”। অনেক বছর পর পর পাহাড়ে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে।
পথের দুপাশের বনে বিমোহিত করা বুনো ফুলের ঝাঁক মন কাড়বে নির্ঘাত। আরো কতো নাম না জানা পাখির ডাক, প্রজাপতির উড়াল। চমক ভেঙে হঠাৎ দেখা ও কুশল বিনিময় হয় একদল জুম চাষীর (জুম, পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ) সঙ্গে। তারা সকলেই সাংলিয়ান কারবারী দা’র আত্নীয়-স্বজন। নিকট পাহাড়ের জুম চাষী এইসব নারী-পুরুষ সে বছরের ইঁদুর-বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তারা তখন দল বেঁধে রওনা দিয়েছেন রুমা বাজারের দিকে -- যদি দিনমজুরির কোনো একটা কাজ জুটে যায়! চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বুদ্ধ বা এই লেখক-- কারো মুখে আর বাক্য সরে না। ...
বিশাল বড় বড় বোল্ডারে ঘেরা জল কলকল উচ্ছল এক পাহাড়ি ঝর্ণার পাশে বসে বিস্কুট-কলা খেয়ে জলের বোতল ভরে নেওয়া হবে সত্যিকারের মিনারেল ওয়াটারে। এরপর অভিযাত্রীদ্বয় ক্ষণিক বিশ্রামে ধূমপানের ফাঁকে কারবারী দা’র কাছে শুনবেন এক আশ্চর্য গেরিলা নেতার নাম -- লাল ডেংগা।
ক্রেওক্রাডং-এ কখনো পাহাড়িদের সাবেক গেরিলা দল শান্তিবাহিনী ছিল না, এ কথা জানিয়ে স্মৃতি হাতড়ে সাংলিয়ান দা’ বলেন :
“আমাদের এখানে শান্তিবাহিনী কখনো স্থায়ীভাবে ছিল না। তবে এখানে তাদের যাতায়ত ছিল। আমাদের এখানে অনেক বছর ছিল মিজো বাহিনী (মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট, এমএনএফ)। কেওক্রাডং-এর এই পথটি ধরেই মিজো নেতা লাল ডেংগা চলাচল করতেন।“
কেমন দেখতে ছিলেন উনি? — শিশুসুলভ এমন কৌতুহলের জবাবে সাংলিয়ান দা’ বলে চলেন :
“লাল ডেংগা ছিলেন খুব লম্বা-চওড়া বলশালী মানুষ। বয়স প্রায় ৫০ বছর। পরনে সাদা শার্ট, আর নীল প্যান্ট। সব সময় ওনার নিরাপত্তায় থাকতো ৫০-৬০ জনের একটি গেরিলা গ্রুপ। ওদের পরনে ছিল পাতা–সবুজ পোষাক। নানা রকম ভাড়ি অস্ত্র-শস্ত্র সবার হাতে হাতে। মিজো দলে অনেক মহিলা যোদ্ধাও ছিলেন। কিন্তু মিজো বাহিনী খুব খারাপ।”…
কেন- প্রশ্নের জবাবে তার সোজাসাপ্টা উত্তর :
“১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মিজো বাহিনী আমাদের এখানে ছিল। তারা দিনের পর দিন আমাদের গ্রামে আস্তানা গেড়ে বাস করতো। আমরা তাদের খাওয়াতাম, আবার চাঁদার টাকাও দিতাম। তাদের ছাগল, মুরগী, শুকর কেটে ভাত দিতে হতো। আমাদের কোনো মেয়েকে তাদের পছন্দ হলে জোর করে ওরা বিয়ে করতো। আমাদের দিয়ে ওরা এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে বিনে পয়সায় বোঝা টানাতো।”
“একবার আমাদের গ্রামের একজন বম মেয়েকে মিজো বাহিনী বিয়ে করে ওপারে মিজোরামে নিয়ে যেতে চায়। আমি বাধা দিলে ওরা আমাদের তিনজনকে গুলি করে মারার জন্য এক সারিতে দাঁড় করিয়েছিল। পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে আমরা দৌড়ে পালিয়ে সেবার বাঁচি।”
“...আমি শুনেছি, ওপারে মিজোরাম দেশটি নাকি খুব সুন্দর। মিজো বাহিনী জয়লাভের পর ওখানে নাকি এখন খুব শান্তি। জিনিসপত্রের দাম খুব সস্তা, জুম চাষ করা যায়, ঘন বনে শিকারও মেলে প্রচুর। কিন্তু আমি কখনো মিজেরামে যাবো না। মিজো বাহিনী খুব খারাপ।”…
সাংবাদিকরা জানতে চান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সঙ্গে মিজো বাহিনীর কখনো বন্দুকযুদ্ধ হয়নি? সাংলিয়ান দা বলেন :
“আরে নাহ! পাকিস্তান আর্মি আর বাংলাদেশ আর্মিই তো মিজো বাহিনীকে এপারে আশ্রয় দিয়েছে। ওরা মিলেমিশে থাকতো। কেউ কাউকে ঘাঁটাতো না। মাঝে মাঝে এ-ওর ক্যাম্পে বসে চা-বিস্কুটও খেত!”…
পরে ইতিহাস ঘেঁটে জানা যাবে, পাক সেনারা ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনী দমনে মিজো বাহিনীকে ব্যবহার করেছিল। সে আরেক ইতিহাস।
এই সব আলাপ-চারিতা শেষে পাহাড়ের পর খাড়া পাহাড় ডিঙিয়ে ক্রেওক্রাডং-এর চুড়ায় উঠে যাওয়ারকালে কথা হবে কিশোর মুদী দোকানী সাহিত বম-এর সঙ্গে দার্জিলিং পাড়া নামক গ্রামে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সব্জি-ভাতের ব্যবস্থা হবে সেখানে দুপুরের আহার হিসেবে। পুরো গ্রামটি শুনশান, নারী-পুরুষ সকলেই কাজের সন্ধানে গেছেন এদিক-সেদিক। শিশু-কিশোর আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছাড়া নিঝুম দুপুরের গ্রামে কেউ নেই।
কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার ক্রেওক্রাডং-এর পথ বেয়ে উঠে চলা। আরো পরে একদল হাসিখুশী বম শিশু-কিশোর অভিযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানাবে ক্রেওক্রাডং-এর চুড়ায়। বড়দিনের প্রস্তুতি হিসেবে গিটার বাজিয়ে গান চর্চার ফাঁকে তারা ঝটপট আগুন জ্বেলে চুলা বানিয়ে তৈরি করবে লাল চা। অভিযাত্রীদের খুব মিষ্টি সেই চা তারা পরিবেশন করবে কাঁচা বাঁশের চোঙ দিয়ে বানানো কাপে। ...
ক্রেওক্রাডং-এর সিড়িতে শিশু-কিশোরের দল স্মার্টলি বসে পোজও দেবে ছবির জন্য। পর্বত শিখরে বুদ্ধ-সাংলিয়ান দা’র যখন ছবি তোলা হবে, তখন পাতলা কুয়াশার মতো হঠাৎ মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে পোশাক-আশাক, চশমার কাঁচ, খানিকটা চেতনা ও সর্বস্ব। দূরের তাজিনডং পর্বত শিখর দেখে মনে পড়বে কাজী নজরুল :
“আকাশে হেলান দিয়ে
পাহাড় ঘুমায় ওই”...
(লেখকের “পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ” বই থেকে, অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৬ ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পুনর্লিখিত।)
*কেওক্রাডং বা কেওকাড়াডং। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, জিপিএস সমীক্ষায় এর উচ্চতা ৯৭৪ মিটার (৩,১৯৬ ফুট)। সরকারিভাবে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। উচ্চতা ১,২৮০ মিটার (৪,১৯৮.৪ ফুট)। তবে বেসরকারি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল সাকা হাফং। এর উচ্চতা ১,০৫২ মিটার (৩,৪৫১ ফুট)। এই পর্বতশৃঙ্গ তিনটি পর পর দুর্গম বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত।
*ছবি (c) : [ক্রমানুসারে] বগা লেক, ক্রেওক্রাডং-এর চুড়া, জুম চাষের মোনঘর (মাচাং ঘর),পাহাড়ের পথে বুনো ফুলের ঝাঁক, ক্রেওক্রাডং এর সিড়িতে হাসিখুশী বম শিশুর দল, বুদ্ধজ্যোতি ও লেখক।
চমৎকার উপস্থাপনাা র সাথে ইতিহাসের মেলবন্ধন।
লেখাটায় যেন মানসভ্রমণ সম্ভব হল। কী অপূর্ব সব ছবি ! এখুনি পাড়ি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু দুপায়ে দুই শেকল - রাষ্ট্রীয় পরিচয় আর অতিমারি।
সৈকত মিস্ত্রী,
সংগে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
প্রতিভা দি,
করোনাকালের পরে অবশ্যই চলে আসবে। রাষ্ট্রীয় বাধা এড়ানো কঠিন হবে না। আর এপারে সব দায়িত্ব আমার, তোমার নিমন্ত্রণ বছর দুয়েক ধরে বুকিং করা আছে, জানই তো। আশির্বাদ রেখ।
কুশান,
কবি চোখ বলে কথা। মূল লেখাটি আরও দীর্ঘ। এটি সংক্ষিপ্ত রূপ। আসলে অনলাইনে দীর্ঘ লেখায় চোখ ধরে আসে ভেবে এই ব্যবস্থা। তবে ইচ্ছে আছে, আগামীতে এর বাকী পর্বটি দেওয়ার।
করোনাক্রান্তিতে ব্যক্তিগত সময় সামান্যই। অফিসে কাজের ফাঁকে এই লেখাটি লিখতে গিয়ে বিপত্তি। যতটা সম্ভব টাইপো ঠিক করেছি। আরও কিছু বানান ভুল চোখে পড়লে না হয় ধরিয়ে দেবেন, সত্যিই খুব খুশী হবো।
শুভেচ্ছা
বরাবরের মতই সুলিখিত। ভাল লাগল, বরাবরের মতই। :)
ছবিগুলোও ভালো লেগেছে।
শিবাংশু, একলহমা,
বিনীত পাঠের জন্য ধন্যবাদ। আগামীতেও সাথে থাকুন