বহু পুরোনো এক ছড়া। ঠিক ছেলেভুলানো ছড়া নয় - বাচ্চারা খেলার সময় নিজেদের মধ্যে বলত এই কথাগুলো - ছুটোছুটি করার সময়, স্কিপিং দড়ির ছন্দে লাফানোর মুহূর্তে -
“I had a little bird
Its name was Enza
I opened the window
And in-flew-enza,”
অনুবাদ করা গেল না। তবে ইন-ফ্লিউ-এঞ্জা যে আদতে ইনফ্লুয়েঞ্জা - সেটুকু অনুমান করা গিয়েছে নিশ্চিত।
এ ছড়া একশো বছর আগেকার - সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় আট কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছিল যে স্প্যানিশ ফ্লু, সেই দিনগুলোর প্রেক্ষিতে এই ছড়া, যা কিনা, আগেই বললাম, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি-লাফালাফি করার সময় আওড়াতো - জানালা খুলে রাখার মতো একেবারে সাধারণ দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়েও যে ঢুকে পড়তে পারে সাক্ষাৎ মৃত্যু, শিশুদের এই ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই আতঙ্ক।
ছেলেমানুষি ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে সমাজের ছবি - এই ছড়ার ক্ষেত্রে সে ছবি আতঙ্কের - মানুষের অস্তিত্বের যে বুনিয়াদি আশঙ্কা, সেই মৃত্যুভয়ের। শিশুরা কি ওইটুকু বয়সেই অনুভব করেছিল মৃত্যুর হিমশীতল চাহনি? নাকি এ স্রেফ ছোটবেলার সবকিছুর মতোই খেলার ছলে দেখা ও বলা? শৈশবের গভীর কোনো শোক বা আতঙ্ক কি আজীবন তাড়া করে ফেরে না মানুষকে? শিশুবয়সে মৃত্যুকে নিয়ে ছড়া কেটে বড় হয়ে উঠল যারা, তারা প্রাপ্তবয়সে মৃত্যুকে দেখতে অভ্যস্ত ঠিক কোন চোখে??
আর সংবেদনশীল মানুষজনের মধ্যে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই মারণরোগে? তাঁরাই বা কেমন চোখে দেখেছিলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাক্ষাৎ মৃত্যুকে? কেমনভাবে দেখেছিলেন অসুস্থতা আর আরোগ্যকে? অনিবার্য গৃহবন্দিত্বকে??
একই সাথে সবধরণের শিল্পচর্চার আলোচনা সম্ভব নয় - এমনকি একটি সংক্ষিপ্ত লেখার পরিসরে শুধুমাত্র চিত্রশিল্পে এই অতিমারীর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও কঠিন। আপাতত, একজন শিল্পীর দুখানা ছবি একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। দুটি ছবি - একটি রোগগস্ত অবস্থায় - অপরটি সদ্য আরোগ্যের।
শিল্পীর নাম এডওয়ার্ড মুনখ বা এডভার্ড মুঙখ (Edvard Munch) - এ লেখায় প্রথম বানানটিই ব্যবহার করলাম - নরওয়ের মানুষ তিনি। মুনখ-এর নাম যাঁরা শোনেননি, তাঁদের একটা বড় অংশ তাঁর আঁকা আর্তনাদের ছবি দেখেছেন (The Scream) - সে ছবি প্রথাগত চিত্রশিল্পের গন্ডী ছাড়িয়ে জনসংস্কৃতি এবং বিজ্ঞাপনী সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই - চিত্রশিল্পের ইতিহাসে খুব কম ছবিই এমনকি ইমোজি হিসেবে বহুব্যবহারের তুল্য জনপ্রিয় উঠতে পেরেছে - আমাদের রোজকার ব্যবহারের ওয়াও এবং ভয়ার্ত ইমোজি, দুটিতেই এই ছবির ছায়া - আর, এই বহুমূল্য ছবি একাধিকবার চুরি যাওয়ার গল্প তো অনেকেই জানেন। কিন্তু, এডওয়ার্ড মুনখ-এর জীবন, তাঁর শিল্প বা শিল্পীমনন নিয়ে একটা সামগ্রিক আলোচনা করতে বসিনি এযাত্রা। আজ কথা বলব, তাঁর দুখানা ছবি নিয়ে - প্রসঙ্গক্রমে আসবে আরো একখানা ছবির কথাও - কিন্তু, মূল আলোচনা দুটি মাত্র ছবি নিয়েই।
ছবি দুটি - স্প্যানিশ ফ্লু-তে ভোগার সময় আত্মপ্রতিকৃতি (সেল্ফ-পোর্ট্রেট উইথ দ্য স্প্যানিশ ফ্লু) এবং স্প্যানিশ ফ্লু থেকে উঠে আত্মপ্রতিকৃতি (সেল্ফ-পোর্ট্রেট আফটার দ্য স্প্যানিশ ফ্লু)।
"শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক অসুস্থতা, মৃত্যু প্রায় আমার জীবনের শুরুর দিন থেকেই আমার শিশুবয়সের দোলনার ওপরে উঁকি মেরে দাঁড়িয়ে থেকেছে - সারা জীবন আমার সঙ্গী হয়েছে।' নিজের জীবন প্রসঙ্গে বলেছিলেন তিনি। পাঁচ বছর বয়সে মা-কে হারান তিনি - পিঠোপিঠি দিদিকে হারান চোদ্দ বছর বয়সে। দুটি মৃত্যুই গভীর প্রভাব ফেলে তাঁর মনে। নিজেও মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়ে ভর্তি ছিলেন অ্যাসাইলামে। তাঁর শিল্পীমানস এসব মিলিয়েই। কাজেই, নিজের সম্পর্কে তাঁর যে কথাটি উদ্ধৃত করলাম এই অনুচ্ছেদের শুরুতেই, সে বিন্দুমাত্র অতিকথন বা দুঃখবিলাস নয়। নিজের জীবন আর নিজের ছবি নিয়ে বলতে গিয়ে মুনখ আরো বলেছিলেন - "নিজের জীবনের যতটুকু মনে পড়ে, আশৈশব আমি ভুগেছি এক চূড়ান্ত উৎকন্ঠায়, যে উৎকন্ঠাকে আমি প্রকাশ করতে চেয়েছি আমার ছবির মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার জীবনে এই অসুস্থতা-রোগভোগ আর উৎকন্ঠা যদি না থাকত, তাহলে আমি হয়ত মাস্তুলহীন এক জাহাজের মতো দিগভ্রান্ত হয়ে থাকতাম।"
কিন্তু, এই করোনার বাজারে শুধুই অসুস্থতা-রোগভোগ-মৃত্যু বা তজ্জনিত উৎকন্ঠার ছবি নিয়ে কথা বলব না - বলব সেরে ওঠার কথা - সেরে ওঠার ছবির কথাও।
প্রথম ছবিটি - সেল্ফ-পোর্ট্রেট উইথ দ্য স্প্যানিশ ফ্লু। ক্যানভাসের উপর তেলরঙ। ছবির প্রতিরূপ থেকে মূল ছবির আন্দাজ পাওয়া মুশকিল - কিন্তু, এ ছাড়া তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপায় থাকে না। ছবির বিস্তৃতি বিষয়ে একটা আন্দাজ পেতে গেলে মূল ছবির মাপ জানা জরুরী - এ ছবি বেশ বড় মাপের - উচ্চতায় প্রায় পাঁচ ফুট - চওড়ায় সাড়ে একান্ন ইঞ্চি, অর্থাৎ প্রায় সোয়া চার ফুট।
এ ছবি আঁকা হয় ১৯১৯ সালে - স্প্যানিশ ফ্লু প্যান্ডেমিক তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে - আক্রান্ত মুনখ-ও।
ছবির একপাশে একটি চেয়ারে বসে রয়েছেন মুনখ - একটু ওপাশে অবিন্যস্ত বিছানা - বুঝতে অসুবিধে হয় না, বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছেন তিনি - কিন্তু, সে বসে থাকা তাৎক্ষণিক - অনতিবিলম্বে তিনি ফিরবেন ওই বিছানায়। অসুস্থতা আমাদের একাকী করে - ছোঁয়াচে অসুখ তো আরো বেশী করে নিঃসঙ্গ করে দেয় - মুনখ-এর এই ছবিও একাকিত্বের - ছবির একটা বড় অংশ জুড়ে দেওয়াল - বিবর্ণ দেওয়াল - সে দেওয়ালের রঙ বিবর্ণ হলদেটে কমলা - প্রায় গেরুয়ার কাছাকাছি - আকাঙ্ক্ষাহীনতার প্রতীক যে গেরুয়া, সে রঙের ব্যবহার ছবিতে এনেছে দৈনন্দিন জীবন বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলার আভাস - দেওয়ালের অংশত লাল রঙের উত্তাপে যেন প্রতিফলিত শিল্পীর জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীর - ছবিতে পার্সপেক্টিভের ব্যবহার এমন, যে ছবির মধ্যে ত্রিমাত্রিকতার আভাস ন্যূনতম - ছবি প্রায় চেপ্টে দ্বিমাত্রিক - অসুস্থ শিল্পীর অবসন্ন অস্তিত্ব যেন জরুরী তৃতীয় মাত্রাটুকু হারিয়েছে।
ছবি জুড়ে বেশ কিছু আঁকাবাঁকা লাইন - রঙ চাপানোর ক্ষেত্রেও তাই - কিন্তু দ্য স্ক্রীম (আর্তনাদ) ছবির মতো বাঁকা লাইন ছবিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না - যে আঁকাবাঁকা, প্রায় বর্তুলাকার লাইন, মুখ্যত, আবেগের প্রকাশ (ভ্যান গগ-এর তারাভরা রাত্তিরের কথা মনে করুন) - এ ছবি, সে দিক থেকে দেখলে, আবেগ হারিয়েছে। না, ছবি আবেগ হারায়নি - অসুস্থতা আর একাকিত্বের ক্লান্তিতে শিল্পী অবসন্ন - শিল্পীর মুখের রঙ লক্ষ্য করুন - সে রঙ প্রায় দেওয়ালের রঙের সাথে মিশে থাকা পাণ্ডুর, বিবর্ণ - আবেগ বলতে, ঘরের ওই দেওয়াল যেন তাঁকে উত্তরোত্তর গিলে খাচ্ছে। বিছানার পাশে চেয়ারে ক্লান্ত শিল্পী বসে আছেন - নীরক্ত মুখ - দৃষ্টিতে প্রায় শূন্যতা - প্রতীক্ষা যদি থেকেও থাকে, সে প্রতীক্ষা মৃত্যুর নাকি আরোগ্যের, বলা মুশকিল।
মাথায় রাখা যাক, এ ছবি ক্যানভাসে আনার আগে প্রাথমিক ড্রয়িং-এ মুনখ নিজেকে এঁকেছিলেন বিছানার মধ্যে উঠে বসা অবস্থায় বা খাটের একপ্রান্তে বসে থাকা অবস্থায় - কিন্তু, চূড়ান্ত ছবিটিতে মুনখ রয়েছেন চেয়ারে - প্রায় সেইভাবেই চেয়ারে বসে, যেভাবে তিনি এঁকেছিলেন কৈশোরে মৃত দিদির পোর্ট্রেট - অতএব, এ থেকে অসুস্থ অবস্থায় মুনখের মানসিক অবস্থার একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে।
অসুস্থতা নিয়ে বলতে গিয়ে সুসান সন্তাগ লিখেছিলেন - জীবনের রাত্রির দিকটা হল অসুস্থতা। জন্মের সাথে সাথেই সবাই অর্জন করে দ্বৈত নাগরিকত্ব - একটি দেশে সুস্থ মানুষদের রাজত্ব, অপরটি অসুস্থদের। যদিও আমরা সবাই সুস্থ রাজত্বের পাসপোর্টটিই কাজে লাগাতে চাই সর্বদা, কখনও না কখনও, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও, আমাদের মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়, হ্যাঁ, আমরা আপাতত অসুস্থদের জন্যে নির্ধারিত দেশটির নাগরিক।
পূর্ববর্ণিত ছবিটিতে মুনখ যদি অসুস্থদের জন্যে নির্ধারিত দেশটির নাগরিক থাকতে বাধ্য হন, তাহলে তার পরের ছবি - সেল্ফ-পোর্ট্রেট আফটার দ্য স্প্যানিশ ফ্লু। না, এখানে মুনখ সুস্থদের দেশটিতে পুরোপুরি প্রবেশাধিকার পাননি - বলা যায়, সে দেশে প্রবেশের জন্যে অভিবাসন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছেন।
একই বছরে আঁকা - অর্থাৎ ওই ১৯১৯ - মাপেও কাছাকাছি - অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট, চওড়ায় সোয়া চার - মাধ্যমও একই, ক্যানভাসে তেলরঙ।
কিন্তু, আগের ছবিটির সাথে ফারাকটা দেখুন। এ ছবি দীর্ঘ অসুস্থতার শেষে সুস্থ সবল জীবনে ফিরে আসার - মারণরোগ থেকে আশাময়তায় ফেরার।
এ ছবি রঙবহুল - সবুজের ব্যবহার প্রচুর। না, নতুন প্রাণের কচি সবুজবর্ণ নয় - জটিল অসুস্থতা থেকে ফিরে আসার ক্লেদ আর ক্লান্তি মিলে গাঢ় বর্ণ - অন্ধকারের - তবু সে অন্ধকার সবুজের - প্রাণের। ছবির একেবারে সামনে পুরোটা জুড়ে শিল্পী - আগের ছবির তুলনায় মুখে রঙ ফিরেছে - উসকোখুসকো, না-কাটা দাড়ি, কোটরে ঢোকা চোখ - তবু আগের ছবির বিবর্ণ নিরক্ত পাংশু মুখের তুলনায় আরোগ্য এবং নবজীবনের ছাপ স্পষ্ট।
পার্সপেক্টিভের ব্যবহারটাও লক্ষ্যণীয়। আগের ছবি যেমন ফ্ল্যাট, দ্বিমাত্রিক, সে তুলনায় এ ছবি স্পষ্টতই ত্রিমাত্রিক - পুরোভাগে শিল্পী - পিছনে দেখা যাচ্ছে তাঁর ঘরের কিছু অংশ - পার্সপেক্টিভের চতুর ব্যবহারে সে ঘর যেন বেশ কিছুটা পেছনে রয়ে যাচ্ছে - অসুস্থ জীবনের ঘরবন্দী দশা থেকে বেরিয়ে আসছেন শিল্পী - এ ছবি আরোগ্যের দিকে এগোনোর। আরো লক্ষ্যণীয় - আগের ছবির দমচাপা ভাব এ ছবিতে উধাও - সবুজ ছড়িয়ে পড়েছে নিজের মুখ থেকে দেওয়ালে, আসবাবে - দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে জানালা, বহির্জগতের আভাস। রোগগ্রস্ত অবস্থায় যে চেয়ারে নিজেকে এঁকেছিলেন তিনি, সে চেয়ার যেন পেছনে রয়ে গিয়েছে - দেওয়ালে বইয়ের সারি - স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইঙ্গিত।
সম্মুখভাগে শিল্পী নিজেই ছবিখানাকে এমনভাবে ভরে রেখেছেন, যে পেছনে দেখা যাওয়া ঘর আপাত শূন্য হলেও, এ ছবি তেমনভাবে নিঃসঙ্গতার বার্তা দেয় না - ছবিখানা সচল জীবনের।
একশো বছর আগে, এমনই এক অতিমারীর সময়ে এক যুগন্ধর শিল্পী ধরেছিলেন নিজের অসুস্থতাকে - সেই অসুস্থতা অতিক্রম করে সুস্থতার দিকে যাত্রাকে - রোগভোগ ও আরোগ্যলাভ, দুটি অনুভবকে পৃথক দুই ক্যানভাসে।
আর, ঠিক তার পরেপরেই, সেই অসুস্থতার দিনগুলির মানসিক অভিঘাত-ও ফুটিয়ে তুলেছিলেন পৃথক আরো একখানা আত্মপ্রতিকৃতিতে - সেল্ফ-পোর্ট্রেট ইন ইনার টারময়েল - সে ছবি এই দুই ছবির ঠিক পরেই আঁকা - মাপ ও মাধ্যমও একই।
স্প্যানিশ ফ্লু-তে ভোগার সময় মুনখ ভুগতেন অনিদ্রায় আর মানসিক অস্থিরতায় - সে সমস্যা চলেছিল ফ্লু থেকে সেরে ওঠার পরেও আরো কিছুদিন। মুনখ সৌভাগ্যবান - তাঁর ফ্লু পরবর্তী মানসিক সমস্যা সেভাবে দীর্ঘমেয়াদী হয়নি - অনেকের ক্ষেত্রে সেই ফ্লু-জনিত মানসিক অসুস্থতা পুরোদস্তুর রোগের আকার নিয়েছিল।
মানসিক বিপর্যয়ের আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করব না এখন। এ ছবি স্পষ্টতই রাতের দৃশ্য - অনিদ্রায় ভুগছেন তিনি। ফ্লু-এর সময় বা ফ্লু-এর পরে - দুটি আত্মপ্রতিকৃতির কোনোটিতেই এমন করে দমচাপা ভাব নেই - এই ছবিতে লক্ষ্য করুন, রঙ বা জ্যামিতিক তল বা লাইন, সবই যেন ব্যবহৃত হয়েছে একটা ক্লস্ট্রোফোবিক পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্দেশে - এমনকি, ছবির মধ্যেই চোখ বাইরে যাওয়ার যে রাস্তাটুকু খুলে রেখেছেন তিনি, তার মধ্যেও রাখেননি কোনোরকম মুক্তির সুযোগ - সে উন্মোচন যেন স্রেফ বর্তমানের অস্থিরতা আর সঙ্কোচনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর লক্ষ্যে। এই আত্মপ্রতিকৃতি ত্রিমাত্রিক - অবশ্যই ত্রিমাত্রিক - কিন্তু গাঢ় রঙের ব্যবহার, কোণে অন্ধকার, ছবির বাইরে বেরোনোর পথটিতেও অনিশ্চিত অন্ধকার - পুরো দৃশ্যটিকেই সমতলে রূপান্তরিত করা প্রায় - পুরো ছবিটি নিয়ন্ত্রণ করছে কমলা ও লালের বিভিন্ন স্তর - এক দমবন্ধ করা অস্থিরতা যেন ছবিটাকে ছেয়ে আছে। আগের দুটি ছবির থেকে আরেকটি ফারাক - এ ছবিতে শিল্পী নিজেকে এঁকেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্যে - এবং সেই সুবাদে তিনি নিজের শারীরিক ভাষাকে আরো বেশী করে আমাদের সামনে আনতে পেরেছেন - দুপায়ের অবস্থান, দুহাত দিয়ে নিজের কোট চেপে ধরে থাকা, এমনকি নিজের ছায়া সীমিত দুপায়ের মাঝের অংশটুকুতেই - অস্থিরতা আর হতাশা আচ্ছন্ন করেছে এ ছবির সর্বত্র।
এই মুহূর্তে, এমনই ঘরবন্দী হয়ে কাটাচ্ছেন তামাম বিশ্বের এক বিরাট অংশের মানুষ - কয়েক লক্ষের বেশী মানুষ আক্রান্ত, সংক্রামিত বহুগুণ - মুনখের প্রথম ছবিটির মতো বিবর্ণ পাণ্ডুর জীবন এই মুহূর্তে এ পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায় অসংখ্য মানুষের। যাঁরা সুস্থ, বা যাঁরা অসুস্থ বা যাঁদের পরিজন আক্রান্ত বা যাঁরা ঘরে বসে থেকে জীবিকা হারাচ্ছেন, গ্রাসাচ্ছদনের বন্দোবস্ত করে উঠতে পারছেন না - এই দিনগুলোর শারীরিক প্রভাব সবার ক্ষেত্রে যতখানি বা যতটুকুই হোক, মানসিক প্রভাব, সম্ভবত সর্বজনীন।
এই হতাশার ছবি, এই ক্লান্তির ডকুমেন্টেশন করে চলেছেন কোনো না কোনো শিল্পী - পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে - নিশ্চিত। শিল্পীদের মতো করে এই অনুভূতি চিরকালীন করতে পারেন আর কে-ই বা। হ্যাঁ, এই ডিজিটাল দুনিয়াতেও - হাজারে হাজারে বা লক্ষ লক্ষ ছবি বা ভিডিও - যার কতক সত্যি, কতক মিথ্যে - সেই ক্যামেরাবন্দী ছবির ভিড়ে চিত্রকরের ছবির আবেদন ভিন্ন অবশ্যই। মুনখ-ই বলেছিলেন, ফটোগ্রাফ কখনোই পেইন্টিং-এর যথার্থ বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না - অন্তত ততোদিন পর্যন্ত নয়, যতোদিন না স্বর্গে বা নরকে ক্যামেরায় ছবি তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে।
মনোজগতের ছবি পেতে হলে চিত্রকর ভিন্ন পথ কী!! এই বন্দীদশাও, নিশ্চিত, ধরা থাকছে কোনো না কোনো শিল্পীর মননে - ধরা থাকছে ক্যানভাসে। কোনো এক সুন্দর ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে - শান্ত, স্নিগ্ধ পৃথিবীতে - আমরা দেখতে বসব, এমন করেই এই প্যান্ডেমিকের ছবি - হয়ত আমরা, হয়ত বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।
কোনো বিবর্ণতা, কোনো অসুস্থতাই চিরস্থায়ী নয়। ঝরে যাওয়া ডালপালার জায়গায় ফুটে ওঠে কচি পাতা - বিবর্ণ পাণ্ডুর পারিপার্শ্বিকে আসে সবুজের ছোঁয়া। অসুস্থতা অনিবার্য হলে, আরোগ্যও তা-ই - হয়ত আরো বেশী করে সত্য, অন্তত বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তো বটেই।
এটাই জীবন। জীবন এমনই।
আগেও পড়েছি এটা। লেখকের অন্য লেখার মতোই সাবলীল, বাঙ্ময়। তথ্যের এমন পরিবেশনা অভিনব। ছবির ব্যাখ্যাও।
মুঞ্চের ছবির কথা বলতে গেলে সবাই জেনারেলি দ্য স্ক্রিম বা ফ্রিজ অব লাইফ সিরিজের কথাই বলেন। তৎপরবর্তীকালে যে সব ছবি তিনি এঁকেছিলেন সে নিয়ে বেশি কথা কেউ বলে না। এ লেখাটা তাই ভালো লাগল। টুলা লারসনের সাথে টানাপোড়েনের জীবন তাকে ব্যতিব্যস্ত করেছিল খুবই। ১৯০৮ নাগাদ যখন তিনি স্যানেটোরিয়ামে থাকতে বাধ্য হন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তখন তার বাঁদিকে পার্শিয়াল প্যারালিসিস ও হয়েছিল। এসবে তার ছবি ও চিন্তাধারা অনেকটাই পাল্টে যায়। পরবর্তীতে যে বার্লিনে এত সমাদর পেয়েছিলেন এককালে, সেইখানেই তার ছবি তিরস্কৃত হতে থাকে নাৎসি জার্মানদের হাতে। সেটাও তাকে খুব আহত করেছিল। সব মিলিয়ে যে এডোভার্ড মুঞ্চকে লোকে চিনত তার তরল অবয়বহীন অপ্রাকৃত ব্যাকগ্রাউন্ডে ইমপ্রেশানের ছায়া দেখে। রিয়েলিজমের থেকে, ইমপ্রেশানিজম থেকে সরে এসে যিনি নতুন ধারা বানালেন। তার ছবির ধরণ গেল বদলে। নিঃসঙ্গতা তাকে বদলে দিল। তাই ঐ চেপ্টে যাওয়া পার্সপেক্টিভে, খানিক যেন জলরঙের ছবির মত অয়েলের ব্যবহার করে এই ছবিগুলো তিনি এঁকেছিলেন। এর পরেও বহুবছর তিনি বেঁচেছিলেন, বহু সম্মানও পেয়েছেন। শান্তিতেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু ১৮৯৩ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত যে ভাইব্র্যান্ট ছবি তিনি এঁকে গেছেন সেই ছবিগুলোই আমাদের কাছে মুঞ্চের আসল পরিচয়, সেগুলোই তাকে আর পাঁচটা শিল্পীর থেকে আলাদা করে।