ষড়যন্ত্র নিয়ে লিখব। সেজন্য প্রথমে ছোট ছোট করে কতগুলো ফিরিস্তি দিয়ে দিচ্ছি। ষড়যন্ত্র আসবে। এসে যাবেই, কারণ তাই নিয়েই লিখছি। যন্ত্রণা তো বলাই বাহুল্য।
১.
মহামারীতে, একলপ্তে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর করুণ ইতিহাসের একটা ধারাবিবরণী হয়। পাশাপাশি যুদ্ধ, গণহত্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চিকিৎসাহীন রোগের দীর্ঘ প্রকোপ ইত্যাদি মিলিয়ে পৃথিবীর জনসংখ্যায় ধস নামানোর ঘটনারও বিবরণ দেওয়া যায়, বরং ইতিহাসে সেগুলোই অধিক চর্চিত। তবে মহামারীর ইতিহাস সমান গুরুত্বের সাথে চর্চার দাবী করে। শিল্পবিপ্লবের উন্মাদনার মধ্যেই এসেছে ১৮২০ আর ১৮৫৫-র কলেরা মহামারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানব সভ্যতা যখন প্রযুক্তিবিজ্ঞানে মারকাটারি সব আবিষ্কারের সাক্ষী হতে চলেছে, দেখা দিয়েছে ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাস। সেই প্রথম এইচ১এন১ মহামারী। তার উৎপত্তি যদিও আমেরিকায় তবে ছড়িয়ে পডল দ্রুত। দীর্ঘস্থায়ী হল না বটে তবে পাঁচ কোটি মতন মৃত্যুর সাক্ষী হল বিশ্ববাসী। তারপর যখন কম্পিউটার জগতে আমূল পরিবর্তনের সূচনা হয়ে গেছে, এল এইচআইভি। সে মারণ রোগ এখনও থাবা বসিয়ে রেখেছে। আর আধপোড়া কপাল! যখন আলপিন থেকে নভোযান প্রায় সব কিছু রোবট সামলাতে চলেছে, আর কম্পিউটারকেও অবশিষ্ট জাগতিক কষ্ট লাঘব করবার মত পর্যাপ্ত বুদ্ধিমান করতে পারা গেছে তখনই ভয়ানক আকার ধারণ করতে শুরু করল কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রকোপ। কোরোনা ভাইরাস মহামারী এখন চীনের প্রাচীর টপকে সারা বিশ্বের অন্তত তিপ্পান্নটা দেশে ছড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বা আভ্যন্তরীণ যেকোন বাণিজ্য ধাক্কা খেয়েছে সজোরে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে দেশের সমস্ত ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আপাতত বাতিল করে দিতে হয়েছে। ইতালি, ইরান সহ ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো আক্রান্ত। আমেরিকাতেও প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইজরায়েল যদিও এখনও পর্যন্ত নিরাপদ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যাকসিনের খোঁজে দিনরাত এক করছে। মৃত্যুমিছিল আগের সার্স ভাইরাস মহামারী কে পেরিয়ে গেছে। কোথায় গিয়ে থামবে আন্দাজ করা মুশকিল। এর আগে আফ্রিকার ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণ মহামারীর রূপ নিতে পারেনি কিন্তু পাঁচ বছর পরেও হতভাগ্য দেশগুলোর অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্হায় তার প্রভাব মারাত্মক। ট্রপিকাল মেডিসিন অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল হেল্থ পত্রিকায় প্রকাশিত কোরোনা মহামারী নিয়ে প্রবন্ধে আফ্রিকাসহ বাকি দরিদ্র দেশগুলোর অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য কাঠামোতে মহামারী আক্রমণ নিয়েও চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে।
২.
প্রেমে সব চললেও চলতে পারে কিন্তু যুদ্ধে সব চলে না। অন্ততঃ আইন করে তা বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৭৫ সাল থেকে সংক্রামক জীবাণুকে অস্ত্র বানানো, মজুত ও অবশ্যই ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় যাতে কয়েকটি দেশ বাদে সবারই সম্মতি স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু জীবাণু যুদ্ধে দুদেশের জড়িয়ে পড়া বা জৈবসন্ত্রাসীদের জৈবাস্ত্র আক্রমণ বন্ধ হয় নি। আদিতে তীরের ফলায় বিষের ব্যবহার থেকে ক্রমশ যুদ্ধে বিপক্ষের খাবার, পানীয়ে বিষ মিশিয়ে দেওয়া, প্লেগাক্রান্ত দেহকে শত্রুপক্ষে নিক্ষেপের মত একাধিক ঘটনা জীবাণু যুদ্ধের অমানবিক ইতিহাস গড়েছে এবং আধুনিক অণুজীববিদ্যার বিকাশের যুগে অ্যানথ্রাক্স, কলেরা, প্লেগসহ নানান ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াকে যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই যুদ্ধের কৌশল, প্রয়োগ ক্রমশ ক্ষুরধার ও ভয়ংকর হয়েছে। আলাদাভাবে এক যুদ্ধ ব্যবস্থা, পরিকাঠামো, আন্তঃসম্পর্ক তৈরী হয়েছে। জৈবাস্ত্র তৈরীর ফর্মুলা, জীবাণু গবেষণার গোপন তথ্য বা নির্দিষ্ট জীবাণুর প্রতিষেধক হাতানোর জন্য গুপ্তচরবৃত্তি, অন্য দেশের আক্রমণের মুখে সুরক্ষা ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক গবেষণাগার তৈরী ও তার কর্মকান্ডের গোপনীয়তা রক্ষা- সব মিলিয়ে জৈবযুদ্ধের ব্যাপকতা আজ বিশ্বের হর্তাকর্তাদের দৌলতে পরমাণু যুদ্ধের মারাত্মকতার থেকে কোনও অংশে কম না। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর এক সভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও জৈবসন্ত্রাস, জৈবযুদ্ধের বিরুদ্ধে তৈরী থাকার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন এবং সেনাবাহিনীকে তৎপর হতে বলেছেন। যেকোনো যুদ্ধের মতই এই মারাত্মক জৈবযুদ্ধ প্রাণহানির পাশাপাশি আক্রান্ত দেশকে আর্থসামাজিক ভাবেও পঙ্গু করে দেবে।
৩.
বিল গেটস সবার সামনে বক্তব্য রাখছেন বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে। একটা ফর্মুলা দিয়ে বোঝাচ্ছেন যে জনগণ, আর তাদের জীবনের প্রয়োজনে জিনিসপত্রের যাবতীয় ব্যবহার, সেই জিনিস উৎপাদনে লাগা বিদ্যুৎ টিদ্যুৎ, সেইটা আবার তৈরীতে পরিবেশে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছে। কারণ বোঝাই যাচ্ছে ফর্মুলাটিতে জনগণ উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছে, ফলে মোট গুণফল নাগাড়ে গ্রিন হাউস গ্যাস বাড়িয়ে উষ্ণায়ন, হিমবাহ-গলে-জল ইত্যাদির জন্য দায়ী। উপায় তবে জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ। কারণ এভাবে তো চলতে পারে না। সৌরবিদ্যুৎ বা বিকল্প উৎস থেকে শক্তির চাহিদা সিকি পরিমাণ মিটবে। শক্তি উৎপাদন ছাড়াও আছে অন্যান্য উৎপাদন, কৃষি, ঘরবাড়ি আরও কত কিছু, যা গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার স্বপ্ন পূরণ করতে দেবে না। সম্প্রতি বায়োসায়েন্স পত্রিকায় বিজ্ঞানীরা জলবায়ু সংকট নিয়ে সতর্কবাণীতেও শেষে ছোট্ট করে বললেন প্রতিদিন দুলাখের বেশি হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে হচ্ছে সেটি থামাতে হবে, ভালো হয় পর্যায়ক্রমে কমিয়ে যেতে পারলে, তবে কমানোর সময় অবশ্যই সামাজিক সৌহার্দ্যের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। ম্যালথুস তাঁর তত্ত্বে জনসংখ্যা ও খাদ্যের জোগানের অসাম্যের কথা, যা বহু আগে বলেছিলেন তা আমল না পেলেও নিও-ম্যালথুসিয়ান তত্ত্বে জনসংখ্যা ও অপচয়ের আধিক্য পরিবেশের সংকটের কারণ হিসেবে যথেষ্ট চর্চিত। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বে সমাধানের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সমাধানের, অর্থাৎ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দুটো দিক - একদিকে জন্মনিরোধক পদ্ধতির প্রণয়ন, অন্যদিকে যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষের আবির্ভাব।
৪.
২০১৬ সালে বারাক ওবামা এক সাক্ষাৎকারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বেকারত্ব নিয়ে যা বললেন তা নতুন নয়। তিনি বললেন আগামীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হবে যার ফলে এখন যেসব উপার্জনের রাস্তা প্রধান রূপে আছে তার আমূল পরিবর্তন হবে। সামাজিক বুনোটকে নতুন নীতির ভিত্তিতে সাজাতে হবে, তা সে সার্বজনীন আয় ব্যবস্থার প্রণয়ন করে হোক বা অন্য কোনো উপায় বের করে। তিনি বা এবিষয়ে চিন্তিত। বহু মানুষ বলছেন বলে নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মেই প্রযুক্তির উন্নয়ন, উদ্ভাব ও প্রয়োগের সাথে সাথে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হন। আবার নতুন কর্মব্যবস্হা গড়ে ওঠে এবং নতুন শ্রমশক্তির চাহিদা তৈরী হয়। কোনো দেশের সরকার নতুন প্রযুক্তির প্রণয়নের সাথে সাথে তার ফলে কর্মহীন মানুষের দলের কী হবে সে সম্পর্কে না পরিকল্পনা নিলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। ২০১৭ ম্যাকিন্সে গ্লোবাল ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে সামনে এসেছে কিভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে শিল্পে যন্ত্রের স্বয়ংক্রিয়তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ৪৬ টি দেশে মোট ৮০০ ধরনের কাজের অবলুপ্তি ঘটবে এবং যার ফলে কাজ হারাবেন প্রায় ৪০ থেকে ৮০ কোটি মানুষ। অদরকারী হয়ে পড়বেন উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সমস্ত অর্থনীতির অগণিত মানুষ।
################################
এধরনের বহু ফিরিস্তির পিছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে। খেয়াল করলে ধরতে পারা যায়। খেয়াল না করলে ধরিয়েও দেওয়া যায়। অর্থাৎ সাগর শুকিয়ে গেলে অভাগার চাহনিকে দোষারোপের দিন আর নেই। যুদ্ধ, মহামারী, মৃত্যুমিছিলের কারণ খতিয়ে দেখতে গেলে ভগবানের রুষ্ট হওয়ার থেকে, বা কৃতকর্মের ফল, ভাগ্যদোষ, শনির কোপ, পূর্বজন্ম, প্রকৃতির নিয়ম ইত্যাদির থেকেও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এখন অনেক বেশি চর্চার বিষয়। স্বাভাবিক ভাবেই। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও তথ্যের আকাশছোঁয়া উন্নতিতে কার্যকারণ সম্পর্কের বাস্তবতার ব্যাপক রূপ জীবনচর্যায় উঠে আসবে এবং বৃহত্তর সামাজিক চর্চায় তার ব্যবহার হবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অখুশি অনেকেই হতে পারেন, সে প্রসঙ্গ অন্য। বর্তমানে কোরোনা ভাইরাস মহামারীর ফলে মানব সভ্যতার আশু সংকট এবং তার চর্চাতেও তাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নানান অবতারণা। বাছাই ফিরিস্তি গুলো সেই তত্ত্বগুলিকে বিশ্লেষণে কাজে লাগানোর জন্য। বিশেষ করে ষড়যন্ত্রের অসারতা বা সম্ভাবনাময়তা বিশ্লেষণের জন্য।
প্রথম তত্ত্ব (বা তত্ত্বগুচ্ছ):
কোরোনা ভাইরাস চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে চীনের লেভেল - ৪ (সর্বোচ্চ সুরক্ষা স্তর) ভাইরাস গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। যেহেতু নিশ্চিত করে উৎপত্তির কারণ চিহ্নিত করা যায় নি, বাদুড়, সাপ বা প্যাঙ্গোলিন থেকে মানুষের দেহে সংক্রমণ ছড়িয়েছে আশংকা করা হচ্ছে তাই এর উৎপত্তির পেছনে ষড়যন্ত্রের একাধিক জোরালো তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে। যেমন, উহানের ঐ ভাইরাস গবেষণাগারে গোপন ভাবে জৈবাস্ত্র তৈরীর কাজ চলছিল এবং কোনোভাবে অসাবধানতা বা দুর্ঘটনাক্রমে তা ছড়িয়ে পড়েছে বা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইজরায়লী সেনাবাহিনীর প্রাক্তন গোয়েন্দা ড্যানি শোহাম ২৪ এ জানুয়ারি ওয়াশিংটন পোস্টে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানান তিনি চীনের জৈবযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং জৈবাস্ত্র তৈরীর তোড়জোড়ের ফসল হল কোভিড-১৯ ভাইরাস যা সম্ভবত দুর্ঘটনা বশতঃ গবেষণাগারের বাইরে চলে এসে মহামারীর জন্ম দিয়েছে। যদিও এ দাবীর সপক্ষে প্রমাণ তার কাছে নেই বলেও জানান। অন্যদিকে আইআইটি দিল্লির গবেষক দল এক প্রবন্ধে এক সম্ভাবনার উল্লেখ করেছে যেখানে সার্স আর এইচআইভির জীবাণু মিলিয়ে এক জৈবাস্ত্র হিসেবে কোভিড-১৯ ভাইরাসকে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, যদিও কড়া সমালোচনার মুখে সে প্রবন্ধ এখন প্রত্যাহৃত। আবার আমেরিকার টম কটন প্রমাণ ছাড়াই তার অকাট্য বিশ্বাসকে বারবার বলে চলেছেন যে কোরোনা ভাইরাস চীন তৈরী করেছে জৈবযুদ্ধের তাগিদেই। রুশ লিম্ব আরও এক ধাপ এগিয়ে জানিয়েছেন এ ভাইরাস অতি সাধারণ, শুধু রাশিয়া গুজব ছড়িয়ে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে, স্টক মার্কেট ফেলে দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে গদিচ্যূত করার চক্রান্ত কষেছে।
বিজ্ঞানীরা একের পর এক প্রবন্ধে এই ভাইরাস যে বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়েছে তার প্রমাণ সহ উল্লেখ করেছেন এবং এধরনের সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করে বলতে পারবে এ অভিশাপের সূচনা হল কিভাবে যাতে ভবিষ্যতে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা যায়।
দ্বিতীয় তত্ত্ব:
সাম্প্রতিক চীন ও আমেরিকা বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্মুখ সমরে নেমে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। সেটারই পরবর্তী ধাপ দুদেশের মধ্যে জৈবযুদ্ধ কিনা, তার পরিপ্রেক্ষিতে জন্ম নিয়েছে আরেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এই তত্ত্বে বলা হচ্ছে জীবাণু গবেষণার ক্ষেত্রে যোগদানের নামে চীন আসলে গুপ্তচরদের নিয়োগ করে মারণ জৈবাস্ত্র হাতিয়েছে। জানুয়ারি মাসে দুজন চীনের গবেষকের সাথে একজন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। বিজ্ঞানী চার্লস লিবার চীন থেকে দশ লক্ষ মার্কিন ডলারের গবেষণার সাহায্যমূল্য পাওয়ার কথা গোপন করেছেন আর বাকি দুই গবেষক চীনের গুপ্তচর যাদের একজন ঝাওসাং ঝেন চীন ফেরত যাওয়ার সময় বস্টন এয়ারপোর্টে ২১ টি জৈব নমুনা সহ আটক হন। অন্যজন চীনের সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় গবেষণা করতে আমেরিকা এসেছিলেন।
৩ রা ফেব্রুয়ারি এ ঘটনার প্রেক্ষিতে এবং বিজ্ঞানী লিবারের সংহতিতে নেচার পত্রিকায় বিজ্ঞানীদের আশঙ্কার এক বার্তা প্রকাশ পায়। লিবার জামিনে মুক্ত হলেও তিনি যে একা নন বরং যত আমেরিকা-চীন দ্বৈরথ বাড়ছে তত এধরনের ঘটনা বেশি করে সামনে আসছে। ফ্লোরিডার মোফিট ক্যান্সার সেন্টারে ছজনকে একই কারণে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
অন্যদিকে কানাডার ন্যাশনাল মাইক্রবায়োলজি ল্যাবরেটরি থেকে ২০১৯ মার্চে সেখানে কর্মরত চীনের এজেন্টের সাহায্যে ভাইরাসের নমুনা চীনে পৌঁছায়। কোরোনা ভাইরাসের নমুনা কানাডার ঐ ল্যাবরেটরির কর্ণধার ডঃ ফ্রাঙ্ক প্লামার জোগাড় করেন যা চীনের চরেরা চুরি করে বলে অভিযোগ। শিয়াংগুও চিউ ও তার স্বামী কেডিং চেং সহ তাদের ছাত্রদের ল্যাবরেটরি থেকে বরখাস্ত করে রাখা হয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হল এই বিজ্ঞানীই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে ইবোলা ভাইরাস চিকিৎসায় সাহায্য করেছিলেন। এখন এর কতটা সত্যি আর কতটা দুদেশের টানাপোড়েনে গবেষকদের বোড়ে বানানোর চাল বলা শক্ত, তবে কোরোনা ভাইরাস মহামারীর কারণ থেকেও আমেরিকা-চীনের জীবাণু যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে এ ষড়যন্ত্র বেশি অগ্রাধিকার পাবে।
তৃতীয় তত্ত্ব:
জলবায়ু সংকট রুখতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো আর প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কর্মহীন অদরকারী মানুষের দলের বোঝা লাঘব করার সহজ ম্যালথুসিয়ান উপায় হিসেবে মহামারীর আয়োজন। এইরকম এক ঢিলে দুই পাখি মার্কা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বীজ যদি কেউ বুনতে চায় তবে তাকে সাহায্য করে জলবায়ু সমস্যা কিংবা বেকারত্বের সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রনেতা, শিল্পপতিদের অবস্থান, বা বলা ভালো দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার অনীহা। গ্রেটা থুনবার্গের মত অনেক পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা, বৈজ্ঞানিক মহল বারবার বলেছেন জনসংখ্যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যতটা না দায়ী তার থেকে বহুগুণ বেশি দায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চালচলন, আধুনিক জীবনযাপনে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে অনীহা ও সর্বোপরি ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে পরিবেশ রক্ষার আইনের লঘুকরণ, তথা বনভূমি, বন্যপ্রাণ বাঁচানোর শপথকে প্রহসনে পরিণত করা। আর প্রযুক্তির উন্নতি ও প্রয়োগের সাথে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ, সম্ভাবনা তৈরী, বিনিয়োগ ও সামাজিক সুরক্ষানীতির মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করাই তো একটা দেশের সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত যাতে আমজনতার মনোযোগ মহামারীর মত সংকটে স্বাস্থ্য সচেতনতা বার্তায় বেশি থাকে, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের চেয়ে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল ফর ইক্যুইটি ইন হেলথের ২০১৬ সালের এক প্রবন্ধে মার্স ভাইরাস মহামারীর প্রভাব দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমিকদের কিভাবে জীবনযুদ্ধে পঙ্গু করেছে এবং ভবিষ্যতে মহামারীর প্রকোপের সময় শ্রমশক্তিকে রক্ষার গুরুত্বের কথা উঠে এসেছে।
অন্যান্য তত্ত্ব:
এছাড়াও ওষুধ কোম্পানি ও তাদের নিয়ন্ত্রক, পরিপোষক অতিধনী গোষ্ঠীর অন্যায়ভাবে স্বাস্থ্যকে পণ্যে পরিণত করা, ওষুধ ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় দূর্নীতির দীর্ঘ ইতিহাস আরেকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। ভ্যাকসিন তথা ওষুধ বাজারীদের কালো হাত এই মহামারীর পিছনে রয়েছে। সংকটের মুক্তি হিসেবে ফার্মা কোম্পানিগুলি ভ্যাকসিন চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফা কামাবে এবং সেজন্যই তারা জঘন্য চক্রান্ত করে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ধনী দেশগুলিতে ছড়িয়েছে কারণ গরীব দেশ আক্রান্ত হলে ভ্যাকসিন কিনে মুনাফা দিতে পারবে না। স্বাভাবিক ভাবেই এই দাবীর প্রমাণ হয় নি কিন্তু নৈতিক জয় হয়ত হয়েছে। ফার্মা কোম্পানিগুলির আগ্রাসন, মুনাফা লোভের উপর যদি রাষ্ট্রগুলির আর্থসামাজিক নিয়ন্ত্রণ বা রাশ থাকত তাহলে এমন সংকটের সময় ওষুধ কোম্পানিগুলিকে মানুষ ষড়যন্ত্রীর বদলে বন্ধু হিসেবে ভাবতে পারত।
শেষের কথা:
১৯ এ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ল্যান্সেট পত্রিকায় একদল বিজ্ঞানীর স্বাক্ষরিত এক পত্রে কোরোনা ভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীনের বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তারদের সমর্থন ও সংহতি জানিয়ে বলা হয়েছে এ পরিস্থিতিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অযথা ভয়, উদ্বেগ ও গুজব ছড়িয়ে প্রকোপ আটকাতে সামগ্রিক সংহতিকে নষ্ট করা ও অসংখ্য ডাক্তার, নার্সদের আত্মত্যাগ, উদয়াস্তের লড়াইকে অপমান করা ছাড়া আর কোনও কাজ করে না।
তাই এতসব ষড়যন্ত্রের পক্ষে বিপক্ষের পর একটা জিনিস বাদ পড়ে থাকে এবং পড়েই থাকে মহামারীতে নিথর মৃতদেহগুলোর সাথে। আগের মৃতদেহগুলোকে মনে করিয়ে, আগামী মৃতদেহগুলোকে আটকাতে।
যন্ত্রণা।
(শেষ)
তথ্যসূত্র
ফিরিস্তি
১.
gisanddata.maps.arcgis.com
https://doi.org/10.1111/tmi.13383
২.
https://doi.org/10.1111/1469-0691.12706
https://doi.org/10.3201/eid0809.010536
৩.
https://www.gatesnotes.com/Energy/My-plan-for-fighting-climate-change
https://doi.org/10.1093/biosci/biz088
৪.
https://www.wired.com/2016/10/president-obama-mit-joi-ito-interview/
ষড়যন্ত্র
https://doi.org/10.1101/2020.02.13.945485
https://doi.org/10.1016/S0140-6736(20)30418-9
https://doi.org/10.1101/2020.01.30.927871
DOI:10.1038/s41586-020-2012-7
DOI:10.1016/j.meegid.2020.104212
http://virological.org/t/the-proximal-origin-of-sars-cov-2/398
The role of wildlife in emerging and re-emerging zoonoses.
doi: 10.1038/d41586-020-00291-2
শেষের কথা
https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/advice-for-public/myth-busters
https://doi.org/10.1186/s12939-016-0483-9
ভালো লাগলো !
তবে যেহেতু অনেকগুলো তত্ত্ব আছে, যেগুলো সব একদম এক কথা বলে না, রেফারেন্স-টা বোধহয় আরেকটু পালিশ করা যেতো, মানে কোনটা কিসের এই আর কি ... আর লিঙ্কগুলোর মধ্যে সেটা প্রথম (gisanddata.maps.arcgis.com) সেইটে খুললো না এখানে, আমি gis দেখে উত্তেজিত হয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম ...
আর কেউ একটু টেকনিক্যাল ডিটেইলসগুলো নিয়ে সহজ করে লিখলে খুব ভালো হয় ... যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, সেইটুকু নিয়েই !
এই তো এবারে পাচ্ছি ! ধন্যবাদ এস !
আচ্ছা জীবাণু যুদ্ধ কী শেষ হয়ে গেছে? এরই মধ্যে জাপানি মিডিয়া দাবি করেছে, যুক্তরাষ্ট্রই করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে!!
দেখুন :
https://m.banglanews24.com/international/news/bd/773083.details
https://www.biorxiv.org/content/10.1101/2020.01.30.927871v1
@pi দি,
https://www.statnews.com/2020/02/03/retraction-faulty-coronavirus-paper-good-moment-for-science/
ইনফোডেমিকের বিরুদ্ধেও হু লড়ছে। ইউজেনিক্সদের তত্ত্বটা বাদ গেছে ।ঐটাই মনে হয় সত্যি :)
ঋক এটা লিখেছেন ১২ মার্চ ২০২০ ২০:৩৬
"The Eyes of Darkness" নামক একটি পুস্তক। যেটা 1981 সালে প্রকাশিত হয়। লেখকের নাম "Dean Koontz"
উক্ত পুস্তকের 353 থেকে 356 নম্বর পৃষ্ঠায় করোনা ভাইরাস সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটিতে লেখা রয়েছে, করোনা ভাইরাস বুহান এলাকার একটি ল্যাবরেটরিতে গোপনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। পরবর্তীকালে চীন এটা ব্যবহার করবে সে দেশের গরীব জনগণকে হত্যা করতে। করোনা-র কারণে চীনের বহু দরিদ্র মানুষ মারা যাবে।
যার ফলে দেশ থেকে গরিবী হটানো যাবে এবং চীন বিশ্ব-দরবারে নিজেকে সুপার পাওয়ার
হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
এই পুস্তকে করোনা ভাইরাসের নাম "বুহান-40" ভাইরাস হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পুস্তকে আরো লেখা রয়েছে--
ভবিষ্যতে চীন এই ভাইরাসকে "বায়োলজিকল মারণাস্ত্র" হিসাবে ব্যবহার করবে।
এই হচ্ছে বইটার লিঙ্ক
https://drive.google.com/file/d/1UOr9x24kNqOjrr1_8unAVAlsPl36SUis/view?usp=drivesdk
দেবব্রত চক্রবর্তীও করোনা ভাইরাসের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ নিয়ে খানিক লিখেছেন। শরীর অসুস্থ থাকায় পুরো লেখাটা এখানে দিতে পারছেন না আপাতত। তবে অ্যাঙ্গেলটা কিন্তু ঋকের দেওয়া বইটাকে সমর্থন করছে। আশা করছি পরে দেবব্রতবাবুর লেখাটা এখানে দিতে পারব।
আমি নিজে এ বিষয়ে আকাট মূর্খ। শুধু অন্যত্র এ নিয়ে আলোচনাগুলো একত্রে রাখার জন্য এখানে চিপকালাম।