"ফিরলেন? উইক এন্ডে কী করছেন?" এই অনিবার্য প্রশ্ন আসতেই আমি মনে মনে হেসে ফেলি। এক গতে বাঁধা সবকিছু। এতটুকু বৈপরীত্য নেই একটা দৃশ্যের সাথে আরেকটা দৃশ্যের। এই নিপুন অভিনয়ের পুনরাবৃত্তি আমাকে কম বয়েসের একটা পাগলামির কথা মনে করিয়ে দেয়। বক্সঅফিস-হিট হিন্দি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি মফঃস্বলী সিনেমা হলে। পরপর তিনবার। তিনবারই আলাদা করে রিকোয়েস্ট এসেছে শুধু আমার জন্য। কারণ, আমি স্মার্ট, আমি কথা বলতে জানি। ওদের ভাষায় বললে, আমি 'অ্যাকটিং ভালোই জানি।' এসব ক্ষেত্রে কী করে অজুহাতকে প্রায়োরিটি হিসাবে সেট করতে হবে তা আমার জানা। কোন গলি দিয়ে অভিসারিকাকে নিয়ে গেলে সবচেয়ে কম লোক দেখবে, কোন চায়ের দোকানের পিছনে নিভৃত গুমটি আছে, মেলার মাঠের কোন দিকটার লাইটপোস্টের আলোটা জনস্বার্থে ভাঙা থাকে এসব নিগূঢ় তথ্য সাপ্লাই করে মফঃস্বলের প্রধান দূতী হয়ে উঠেছি তাই, এইসব গোপন অভিসারে আমি ফার্স্ট চয়েস। এ বিষয়ে অন্য ছেলেপিলেরা চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারত না। ... ...
হ্যাঁ, নটরাজনকে মাত্র ৩ টাকা ওভারড্রাফটের চার্জ লাগিয়ে সাস্পেন্ড করা হয়, যদিও সেটা ওর ক্যাশিয়ার মহিলার ভুলের ফসল। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট জানত যে নটরাজন বিধবা বাঙালি সহকর্মীটির প্রেমে পড়েছে। সে মেয়েটিকে ফাঁসাবে না। তাই হল, নটরাজন সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিল এবং দশমাস সাস্পেন্ড হল। এক ইনক্রিমেন্ট স্টপের শাস্তি পেল। শেষে বোর্ডে আপিল করে রেহাই পায়। তো সচ্চিদানন্দ একেবারে কড়া। কমিশন দূর কী বাত, কোন বিজনেসম্যানের থেকে দীপাবলীর মিঠাইয়ের বাক্সও নেয় না। স্টাফদের বিলিয়ে দেয়। ওর দোষ বড্ড মুহফট। যা ভাবে তাই বলে ফেলে। বর্তমান জিএম ওকে চেনেননি। বারবার দূত পাঠাচ্ছেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এবং ইশারায় একটাই বার্তা। ... ...
অনেক মানুষের ভিড়। ওলাই চণ্ডী বস্তির মানুষেরা এসেছে, এসেছে নতুন পাড়ার নেপালিরা, বেলগাছিয়া ট্রামলাইনের ওপারে মুসলমানপাড়ার লোকেরা, রাজা মণীন্দ্র রোডের ২১নং বস্তি, শহীদ কলোনি, সরকার বাগান, প্রচুর বিহারী মানুষজন, রানী রোড, খিলাৎবাবু লেন, বেশির ভাগ মহিলা। ভিড় সামলাতে মাকে ঘরের বাইরে উঠোনে বার করা হল, মায়ের গায়ে যাতে রোদ না লাগে, সেইজন্য মাথার উপরে শাড়ি দিয়ে সামিয়ানার মত করে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হল। তৃণমূল কংগ্রেস, সি পি এম ও কংগ্রেসের নেতারা মালা দিয়ে মাকে সম্মান জানিয়ে গেছে। চিৎপুর থানার বড়বাবু মাথার টুপি খুলে স্যালুট দিয়ে, একটা বড় মালা দিয়ে সম্মান জানিয়ে গেছে। কয়েকটি ক্লাবের ছেলেরা এসে মালা দিয়ে গেছে। শুধু ফুল আর ফুল। ফুলের মধ্যে মা যেন ঘুমিয়ে আছে। অনিমেষ ভাবছিল, এত মানুষকে খবর কে দিল। খবরটা বাতাসের মতো, ঝড়ের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ও অনুভব করল, বেঁচে থাকা, জীবন যেন শান্ত, ছন্দ সুর তাল লয় নিয়ে সংগীতের মত। আর বেদনা ভয়ঙ্কর। অশান্ত সমুদ্রে ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের মত। অনিমেষ পুনরায় মায়ের পায়ে হাত রেখে ভাবতে থাকে, মাকে এত কাছে পেয়ে মায়ের কাজকর্ম, মায়ের চিন্তাভাবনা, আমি যে অন্তরঙ্গ লাভ করেছি, মায়ের জীবন দর্শনের অনুভূতি সম্প্রসারণে আমি ঋদ্ধ হয়েছি, অভিজ্ঞতালব্ধ সম্পদ, সংগ্রাম, আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। মায়ের জীবন দর্শনকেই আমার দর্শন করে আমি এগিয়ে চলেছি। ... ...
গেটের বাইরে থেকে একটি মেয়ে খুব কুণ্ঠিত স্বরে ডাকল, “স্যার, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল, ভেতরে আসতে পারি?” মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ির ছোট্ট বাগানে একটু ঘোরাঘুরি করা ডাক্তার অমিয় সান্যালের বহুদিনের অভ্যেস। এ সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বন্ধুরাও তাঁকে বিরক্ত করে না। সকালের এই স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর বাগানে ফুটে থাকা উজ্জ্বল ফুলগুলির সঙ্গ তাঁর মনে অত্যন্ত শান্তির অনুভূতি এনে দেয়। কোন উটকো লোকের উপস্থিতি সেই শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাক – সেটা তিনি পছন্দ করেন না। বিরক্ত হন খুব। ডাক্তারবাবু বিরক্ত হয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন গেটের দিকে, বিরক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার?” “কিছু কথা ছিল স্যার, যদি একটু সময় দেন কাইণ্ডলি। বেশি সময় নেব না, – দশ-পনের মিনিট”। ওঁদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে হেমন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। হেমন্ত ডাক্তারবাবুর পরিচারক - সর্বক্ষণের সঙ্গী। সাধক সঙ্গীতজ্ঞদের যেমন দু একজন অপরিহার্য সঙ্গতদার থাকে – হেমন্তও তাই। বারান্দায় উঠে বেতের চেয়ারে বসতে বসতে ডাক্তারবাবু হেমন্তকে বললেন, “ভেতরে আসতে বল”। হেমন্ত মেয়েটিকে ডেকে ভেতরে চলে গেল নিজের কাজে। ... ...
ইরফান যখন কলেজ ওয়েব সাইটের ব্যাক এন্ডে SQL Injection পাঠিয়ে তাদের ডেটাবেস থেকে রমিলার নাম্বার তুলে এনেছিল, তখন ওর বয়স মোটে সতেরো। কম্পিউটার সায়েন্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। স্নাতকের তৃতীয় বছরে বাংলার এক নামজাদা দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসাইট হ্যাক করেছিল সে। আর মাস্টার্সের দ্বিতীয় বছরে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ অপারেটিং সিস্টেম বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল উপমহাদেশের দুঁদে কোডারদের। কিছু মানুষ থাকে এরকম, এক একটা বৃত্তি যেন ছেলেখেলা হয়ে ওঠে তাদের কাছে। ইরফান তাদেরই প্রতিনিধি। চাকরি ওর পেশা নয়, একটা মুখোশ মাত্র। বাকি সময়টা সে তার রাজারহাটের স্টুডিও ফ্ল্যাটে ফ্রিল্যান্সিং করে। হ্যাকিং সংক্রান্তই নানাবিধ কাজ। ডার্ক ওয়েবে 'লিকড' হওয়া ইনফরমেশন সরিয়ে ফেলা থেকে স্ক্যামারদের চক্কর থেকে বের করে আনা, এমনকি চাইল্ড পর্ণ ওয়েবসাইট সম্পূর্ণ নির্মূল করা পর্যন্ত। এছাড়া বড় বড় বিদেশী সংস্থা ‘বাগ বাউন্টি প্রোগ্রাম’, ‘পেনিট্রেশন টেস্টিং’ এর কাজে ইরফানদের মতন হ্যাকারদের সাথে চুক্তি করে। বৈধ কাজ, তবে আয়ের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রাখতে হয় অবৈধ খাতে। ট্যাক্সের ভয়ে নয়, বেনামী থাকার সতর্কতায়। ডিজিটাল দুনিয়াতে কে কাকে কিভাবে নজরে রাখছে একথা বলা প্রায় অসম্ভব। অজ্ঞাতকুলশীল থাকাটাই একজন হ্যাকারের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং আবশ্যিক শর্তও। ... ...
দিনটা স্পষ্ট মনে আছে শিখার। বৌদি টাকাটা দিয়ে বলেছিল, অ্যাডভান্স নিয়ে আবার কামাই করা শুরু করো না। শিখা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলেছিল, একদম কামাই হবে না। আমার লোহার শরীর। যদি দু একদিন ছুটি নিই, আনিসুলের মা এসে ঠেকার কাজ চালিয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না। এ তো আর ফ্ল্যাট বাড়ি না যে আনিসুলের মা ঢুকতে পারবে না। বিকেলে শিখারা যখন গপ্পে বসেছিল একসঙ্গে, টিভিতে বারবার ডাক্তার মেয়েটার কথা বলছিল। তার বাপ মা বন্ধু বান্ধব সবাইকে দেখাচ্ছিল। শিখারা মুড়ি মাখা খেতে খেতে সাধারণত এইসময় "বাঁশরির বিয়ে" বা "নয়নতারা" সিরিয়াল দেখে। সেদিন কেউ সিরিয়াল দেখেনি। শিউলির মা বলেছিল, "মেয়েমানুষ ঘরে থাকাই ভালো, কোন দরকার ছিল ডাক্তার হবার?" শিখাও একরকম তাইই ভাবছিল। আর ভাবছিল , ডাক্তার মেয়েটা ডিউটি দিয়ে পেশেন্টদের ঘরেই থেকে গেলে পারত টেবিলে মাথা টাথা দিয়ে ঘুমিয়ে। প্রাণটা বেঁচে যেত। বড় বৌ বলেছিল, ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি মা, শরীরে সয় না। বেচারা ঘুমাতে গিয়েছিল। ... ...
দিন দুয়েক কাটলো, এক একদিন কাটে আর পাহাড় প্রমাণ টেনশন বাড়তে থাকে, পরীক্ষা চলে এলো। সার্জারী একটা সাগর, medicine একটা সাগর। কি কি করে পেরবো, যদি বা উৎরে যাই, biostat বই চাপা পড়ে বোধয় গত জন্মে মরেছিলাম, কিছুতেই মাথায় ঢোকেনা। হোস্টেল থেকে বেরোনো বন্ধ, লোকজনের মুখ দেখিনা, ফুট খানেক দাড়ি হয়েছে, সেই নিয়েই সাপ্তাহিক অন কল করতে যাই। তার আবার সুবিধে ও আছে! সেই বাসি দাড়ির শোনা গল্প; আমাদের এক সিনিয়র ডিউটিতে, সেদিন নার্সিং হোম এ তুলকালাম শুরু হয়েছে কি একটা কারণে, আগুন টাগুন লাগিয়ে দেয় আর কি! কই ডাক্তার, শুয়োরের বাচ্চা ডাক্তার কোথায়! এইসব হাকডাক চলছে। সেই দাদা হেলথ সার্ভিস করা লোক, বাঘা বাঘা জায়গায় একা নাইট ডিউটি করে এসেছে, যেখানে দিনের বেলা লোকে দল বেঁধে চলে সমাজবিরোধীদের ভয়ে। তাকে এই শহুরে শখের ঝামেলাবাজরা কি করবে? তো সেই দাদা, শার্ট টার্ট আউট করে, চুল উস্কো খুস্কো করে, ১৫ দিনের না কাটা দাড়ি নিয়ে লিফট দিয়ে না নেমে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করবে যেই, দেখছে হুড়হুড় করে বানের জলের মত বিষখ্যাত জায়গার লোক ঢুকছে ওয়ার্ডে। হাতে পেলে একটা মার ও মাটিতে পড়বেনা, কার ভুল, কি গন্ডগোল, কিচ্ছু বলার জো নেই। বেশ কিছু লোক সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে সেই দাদাকে দেখলো বটে, দামী শার্ট প্যান্ট, যদিও আউট করা। কিন্তু ওই যে বাঁচিয়ে দিল ১৫ দিনের অশৌচ মার্কা দাড়ি। ... ...
কৌতুহলে উবু হয়ে বসে পড়ে বুড়ো, ‘লোকে পড়ে?’ ‘না পড়ে যাবেটা কোথায়? মাথাটা তো বাঁচিয়ে খাঁচিয়ে রাখতে হবে! না পড়ে পড়ে, না ভেবে ভেবে মগজ তো সব মশারির মত জ্যালজেলে হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারে সব প্রেসক্রিপশনে কি দাওয়াই লিখছে আজকাল, দেখেননি? রিজিউম রিডিং। শর্টে লেখে, খেয়াল করে দেখবেন - ডাবল আর। দ্য ওল্ড গোল্ড বং হবি।' বুড়ো চোখ কুঁচকে, ‘সকাল থেকে আজ বউনি হয়েছে?’ হাতে তালি দিয়ে দোকানী, ‘আলবাত হয়েছে! এই যে, 'অধর্ম'র এ সংখ্যাটা। হেএবি ডিমান্ড। অলমোস্ট সবকটা পাতা আপনারই মত একজন খুঁজে পেতে নিয়ে গেলেন। খেয়াল করে দেখুন, এ সংখ্যাটা আবার পঞ্চমুখী হনুমানের লেখা৷ বাহিনীর লোকেরা কভারে এসব দেখলে খুব খুশি হয়। এরম কিছু থাকলেই হল। ভেতরের ব্যাপার নিয়ে অত মাথা ঘামায় না৷ বাইরের র্যাপারটা সেফ থাকলেই হল - মাল সেফ।' ... ...
মীরজাফর তো শুনে হাঁ। কুচ মানে? এ কি রাজকার্য না ফুক্কুড়ি, যে সক্কালবেলা একটু মেজাজ খারাপ হয়েছে বলে লালমুখোদের সঙ্গে একদম যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে? রাজা-বাদশাদের খেয়ালকে একটু তোয়াজ করতে হয়—সবাই জানে, কিন্তু এই আস্ত গাছপাঁঠাটা যেমন আহাম্মক, তেমনই বদমেজাজি—রাজনীতি তো বোঝেই না, আদবকায়দাও না। নবাব না হনুমান বোঝা মুশকিল, ওদিকে ধড়িবাজি আছে দুশো আনা। কোন এক ভাগাড় থেকে তুলে এনে মোহনলালকে মহারাজা বানিয়ে মাথার উপর বসিয়েছে, সেটা আবার ওর চেয়েও এককাঠি বাড়া। সে মালটা বিষ খেয়ে অবশ্য এখন আধমরা, দরবারে নেই—এই এক রক্ষে। ... ...
সকাল সকাল একটা আম পাই। তার গায়ে সদ্য পাড়া আঠার গন্ধ। যাঁরা এই গন্ধ জানেন, তাঁরা মানবেন, কীভাবে মাতাল করে তোলে এই গন্ধ। কোনও কৃত্রিম গন্ধ একে প্রতিস্থাপন করতে এখনও পারে নি। অন্তত আমার জানা মতে। সোঁদা মাটির গন্ধ একেক জায়গায় একেক রকম। একেকটা আমের জাতের একেক রকম গন্ধ। কিন্তু আঠার গন্ধ বোধহয় এক। নাহলে ৬-১০ বছরের এক বালকের নাকে স্মৃতিতে ডুব মেরে থাকা গন্ধ কীভাবে আজ ঝড় তুলে দিলে প্রৌঢ় মনে! মায়ের গায়ের গন্ধ যেমন শিশুকে চিনতে শেখায়, তেমন আমের গন্ধ সাবালকত্বকে। একা একা আম পাড়া ঢিল মেরে, গুলতি ছুঁড়ে, আঁকশি দিয়ে, আরেকটু বড় হলে গাছে উঠে--সাবালকত্বের লক্ষণ। বয়স নয়, আনন্দের। পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া যেমন আরেক আনন্দ। আনন্দের কী কোনও ব্যাঙ্ক আছে? এআই কী এই আনন্দ কোনও দিন দিতে পারবে? পারবে লিখতে সহজ সহজ সুখ আর অতি সরল আনন্দের গন্ধের কথা। মায়ের হলুদ মাখা আঁচলের, গায়ের গন্ধ কি দিতে পারবে কোনও রোবট? ... ...
জলের মধ্যে গোলা নীল রংটা নিজের গালে ঘষছে সুদাম।ঘষতে ঘষতে একটা মুখ মনে পড়ছে। সিনেমার মত। তারপর হঠাৎ নিজের আয়না দেখা মুখটা মনে পড়েছে। শুষ্ক, খড়খড়ে। একটা যন্ত্রণা ঠেলে উঠে আসছে। রংটা জোরেই ঘষে দিচ্ছে ও। হঠাৎ ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। ওঠারই কথা। তবে গালের ব্যথায় নয়, মনের ব্যথায়। গৌরী যদিও ইচ্ছে করে মারেনি। সুদাম এক বুক কাদার মধ্যে একেবারে পা ডুবিয়ে সিনেমার হিরোদের কায়দায় গৌরীকে কথাটা বলতে চেয়েছিল। "এখুনি আন্ধার নামবে, তুই পাড়ার ওই ম্যাদামারা ছেলেটা না! কথা বলার মুরোদ নেই, এমন গায়ের কাছে এসেছিস কেন? দেখছিস লা কাজ করতিছি ক্ষেতে! যা এখান থেকে!" কথাগুলো বলেই কোদালটা হাতে তুলে নিয়েছিল গৌরী। কাজ করার জন্যে। সুদাম এত কাছে এসে পড়েছিল যে কোদালের বাঁটের আঘাত লাগতে একটুও দেরী হয়নি। ... ...
ফোন বেজে উঠতেই শ্যামশ্রীর গলা ভেসে এলো। ছটফটে, তরতরে শ্যামশ্রীর গলা নয়। রাগী, কড়া শ্যামশ্রীর গলাও নয়। চটপটে, স্মার্ট নয়। একটু ভেজা ভেজা। দরদী। নরম। ত্রিলোকেশের এখন ঠিক যেমন দরকার তেমনটি। যখন যেমন দরকার, তেমনটি। যখন খোলামেলা চাই তখন খোলামেলা। যখন লাজুক চাই তখন লাজুক। যখন লাস্য চাই তখন লাস্য। এইভাবেই। ঠিক এইভাবেই প্রোগ্রামড করা আছে। কন্ঠস্বর, চলাফেরা, ওঠাবসা, ফুড হ্যাবিট, যৌনতা , এমনকি পটি টাইমিং পর্যন্ত। শ্যামশ্রী না। শ্যামশ্রীর ক্লোন। শ্যামশ্রী দত্তগুপ্ত টু। হাইট পাঁচ পাঁচ। রঙ মাজা। চুল স্ট্রেইট। গোল্ডেন হাইলাইট। অবিকল ওরিজিনাল শ্যামশ্রী। ... ...
তার স্ত্রী তাকে ফিরে আসতে না করেছিল, অনেক অনুনয় করেছিল, কিন্তু সে শোনেনি। বিমানবন্দরে নামামাত্রই তাকে আটক করা হয়েছিল। নিয়ে আসা হয়েছিল রাজধানী থেকে বহু দূরে এই বন্দিশিবিরে। সে জানত এরকমই হবে। সকালে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো অন্য একটি ঘরে, পার হতে হতো একটি করিডর, এক পাশে দেয়াল, অন্য পাশে পর পর আটটি কামরা, এর মধ্যে একটি ছিল তার। কিন্তু সেটা সে বুঝতে পারত না, কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকত চোখ। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগলে বুঝতে পারত বাড়িটি থেকে সে বের হয়েছে। এর পরে ত্রিশটি পদক্ষেপ, অন্য একটি বাড়িতে ঢোকা। সেখানে একটি ঘরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে চোখের বাধন সরিয়ে নেওয়া হতো। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর আসত কমিসার। প্রথম দিন সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি কে আপনি জানেন?’ কমিসার বলেছিল, ‘আমি জানি আপনি জনগণের শত্রু, এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।’ বেশি জানা কমিসারের জন্য ভালো নয়। ... ...
কলকাতার মানুষজনেরা এইসবের হুজ্জোতির খবর রাখে না। তাদের মন ভুলোবার হরেক চিজ আছে। এইরকম ঝামেলাওয়ালা জায়গায় দুদিনের ছুটি কাটাতেও কেউ আসে না, যতই জাগ্রত তীর্থস্থান হোক না কেন! এটা একেবারেই সীমান্ত-এলাকা, কাঁটা তারের এ পাশে লাল নিশান ওড়া ভ্রামরী দেবীর মন্দির, খুব জাগ্রত জ্যান্ত তীর্থ, ওপাশে সবুজ মাথাওয়ালা গম্বুজ, সোনা পীরের থান। মানত রাখলে নাকি কেউ খালি হাতে ফেরে না। দুপাশেই যতদূর চোখ যায় সবুজ খেত, যার বুক চিরে দৌড়ে চলে গেছে মানুষ সমান কাঁটাতার। ছুঁচলো কাঁটা, খুব শক্ত তার, আর দবেজ। সেই ছুটন্ত তারের লাইন বরাবর রাতবিরেতে বুটজুতোর মসমস, সন্দেহ জাগলেই ঘন ঘন হুইসিলের আওয়াজ। তবে তাতে কী আর কিছু বন্ধ থাকে! যার যা করার সে তাই করে যায়, কাজের মতো কাজকাম চলে, নদীর মতো নদী বহে যায়। শুধু মাঝেমধ্যে কাঁটাতারের এপাশে ওপাশে আচমকা দুম শব্দের সঙ্গে লাশ পড়ে। চাপা আর্তনাদ, দৌড়োদৌড়ির শব্দ। তারপর সব চুপচাপ। ... ...
প্রশ্নটা হল, কিভাবে নিকেশ করবে আমায় ? গলা টিপে শ্বাসরোধের সাবেকি পন্থায়? আমার কুতকুতে চোখগুলো কি তখন বল্লমে গাঁথা শুয়োরের মতো ঠিকরে বেড়িয়ে আসবে ? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বিস্ফারিত দৃষ্টি প্রাণপণে ধরে রাখতে চাইবে আততায়ীর শেষ ছবি? নাকি মরবো খাদ্যে বিষক্রিয়ার মতো দীর্ঘ যন্ত্রণাময় কদর্য কায়দায়? কাটা পাঁঠার মতো জগঝম্প জুড়ে, শ্বেত পাথরের তেলা মেঝেয় বমি -পায়খানায় একাকার হয়ে ? আর নাকি প্রকাশ্য রাস্তায় পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জের গরম বুলেট ফুঁড়ে দিয়ে যাবে মগজ? কিছু রক্তমাখা ঘিলু ছিটকে গিয়ে লাগবে কি কোন বেনামী ল্যাম্পপোস্টের গায়ে? কে জানে হয়তো দু একটা অশ্লীল স্মৃতিও তখন গড়িয়ে নামলো পোস্টের গা থেকে। আমার পড়ে থাকা নিথর লাশের দিকে চেয়ে রাস্তার লোক কি চমকাবে খুব? খুব ? বোধহয় পুরনো প্রফেসিকে সমর্থন জানিয়ে বলে উঠবে, – এ তো জানাই ছিল! আজ নয়তো কাল এটা হওয়ারই কথা! বেশ হয়েছে শালা! ... ...
সলিলের পড়াশোনায় মাথা ছিল না। তাই মাধ্যমিকের পর কাকা ওকে একটা বিলেতি মালিকানাধীন ফ্যাক্টরিতে হেল্পার হিসাবে ঢুকিয়ে দিলেন। সুপারিশ ছাড়া ওখানে ঢোকা মুশকিল। কাকা বলেছিলেন, পড়ায় যখন তোর ইচ্ছা নেই ভালো করে হাতের কাজটা শেখ। সেটা মন দিয়েই শিখেছিল সলিল। ফলে ক্রমশ হেল্পার থেকে মেকানিকে পদোন্নতি হোলো। মাইনে, ওভারটাইম মিলিয়ে রোজগার মন্দ নয়। তিনকূলে ঐ কাকাই সলিলের একমাত্র আপনজন। কাকার বাড়ীতেই ছোট থেকে মানুষ। কাকার অবস্থা ভালো। মনটাও দরাজ। তাই চাকরি পাওয়ার পরেও সলিলের থেকে এক পয়সাও নিতেন না তিনি। বলতেন, আমি আর কদিন, পয়সা জমা, তোর একটা নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই তো দরকার। ... ...
‘আমি কক্ষনো অন্য কারুর জন্য কাঁদি নি জানো। যতবারই কেঁদেছি তা কেবল নিজের জন্য, নিজের না পাওয়া, ক্ষোভ, দুঃখ থেকে চোখে জল এসেছে। বাবা মা মারা যাওয়ার পরেও না, দাদা বৌদি সম্পর্ক কেটে চলে যাওয়ার পরেও না।‘ প্রায় একদমে বলে ফেলে একটু থমকে যায় ও, আঁচল ঘুরিয়ে এনে মুখটা মোছে। মাঝারি হাইটের গাঁট্টাগোট্টা মেয়েটির নাম দেওয়া যাক ‘আমি’। ... ... ‘তুমি যেমন অন্যের জন্যে কাঁদো নি কখনো আমার ঠিক তার উলটো। আমি নিজের লোকদের জন্য মাসের পর মাস কেঁদেছি, পাড়ার লোক যাদের রোজ দেখি তাদের কারুর কিছু হলেও কেঁদেছি। এমনকি কাগজে, টিভিতে কোথাও আগুন লেগে, জলে ডুবে, বিল্ডিং ভেঙে, ঝড়ে বন্যায় মানুষ মারা যাবার খবরেও হাউ হাউ করে কেঁদেছি। সেই থেকেই আমার নাম হয়ে গেছে খোলাকল। ... ... লম্বা চওড়া খেলোয়াড়ি ধরণের চেহারার মেয়েটির নাম দেওয়া যাক ‘তুমি’। ... ... সে মুখে একটা মিচকে হাসি ঝুলিয়ে চুপচাপ দেখছিল এদের। আমি বা তুমি কেউ কোন কথা বলছে না দেখে আস্তে করে গলা খাঁকারি দিল। ... ...
“বহনোঁ অওর ভাইয়োঁ...আজ আমরা যে বিষয় শিখবো – সে বিষয় প্রত্যেক লেডিস ও জেন্টসের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী শিক্ষণীয় বিষয়। পরন্তু আমাদের দেশে যে শিক্ষাবেওস্থা আছে, তাতে এই শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয় না। আমাদের দেশের বাচ্চারা পচ্চিমদেশের অনুকরণ করে যে শিক্ষা লাভ করে, তাতে তারা যে শুধু ভোগময় জীবনের প্রতি লালচি হয় তাই নয়, বরং পাপের দিকে নিরন্তর দৌড়তে থাকে। তারা কদাপি মনমে শান্তি পায় না, দিনরাত পয়সা, প্রমোশন, আলিসান ফ্ল্যাট, লেটেস্ট মডেলের দামি গাড়ি, বছরে একবার ফোরেন টুরের স্বপ্ন দেখতে দেখতে, অন্দরসে খোকলা হয়ে যায়, পরেসান হতে থাকে। বাড়তে থাকে স্ট্রেস – মান্সিক চাপ। মেরেকো আকসর পুছা যাতা হ্যায়, বাবা, ইস সে ক্যায়সে মিলেগি ছুটকারা? কেয়া মুক্তি কি কোই ভি উপায় নেহি হ্যায়? আমি বলি, কিঁউ নেহি, বেটা, অবশ্য উপায় হ্যায়। .." ... ...
অহনা হাঁটতে আরম্ভ করে দিল। সে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের খাঁজে চলে গেল। দু পাহাড় যেখানে জোড় খেয়েছে আর দুটো দেশ তৈরি হয়েছে গাছেদের। হ্যাঁ, গাছেদের আর বৃষ্টিদের। সেখানে প্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেইখানে অহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব বলে বলে ভাবছি আর দেখি সে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটা দিয়েছে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকটা পাহাড় দেখার মত এক দূরত্ব। মনে হয় কাছে কিন্তু দূরত্বটা বেশ। যত কাছে যাওয়া যায় ততো দূরত্বটা থেকে যেতে থাকে, থেকে যেতে থাক – দূরত্বটা শেষ হয় না। বোঝা যায় না পাহাড়টা দূরে, বোঝা যায় না পাহাড়টা কাছে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়। সে রকমই হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না জোরে কথা বলব না আস্তে কথা বলব। তাই দেখতে লাগলাম। প্রথমে গাছেদের এ ওর পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তারা ফুল দেয় না আর দিলেও দেখাতে চায় না যে ফুল দিয়েছে। ছোট ছোট গাছ না কিন্তু তাদের ছোট ছোট লাগে। পাশে একটা বড়ো গাছ ছিল। সেই গাছ দেখে আশ্বস্ত হয়েছি, সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম গাছ কথা কইছে আর আওয়াজ হচ্ছে কথাদের। ... ...
এগারোটার সময় মৌলিকের অফিসের শেষ ডিনার পাওয়া যায়। তারপর শুধু এককোণে কফি, কেক, স্যান্ডউইচ ইত্যাদির কাউন্টারে একজন বসে বাকি রাত ঝিমোয় আর খুচরো প্যাকেটের চানাচুর, মধু মেশানো ওট বার উগরে দেওয়া ভেন্ডিং যন্ত্রগুলোতে সারারাত কাঁচের ভেতর নীল আলো জ্বলে থাকে। কিউ আর স্ক্যান করে টাকা দিলেই প্যাঁচানো স্প্রিং ধাক্কা মেরে কাঙ্খিত প্যাকেটকে নীচে ফেলে দেয়। রাতে কাজ করা বাধ্যতামূলক নয় অথচ রাতে একজন থাকলে ভালো হয়, সমুদ্রের ওপার থেকে বারো ঘণ্টা এগিয়ে থাকা দেশ থেকে ভেসে আসা এমনই অনুরোধ। এই শিফটে কেউ রাজি হলে প্রতি রাতে অতিরিক্ত টাকা, বিনামূল্যে খাবার এবং যাওয়া আসার গাড়ি পাওয়া যায়। রাত দশটা থেকে ভোর ছটা এই শিফটটাকে দিনের বেলা অফিসের বাকি সবাই বলে গোরস্থানের সময়। ... ...