সিনেমার আলো কতরকম হয়? স্বেন নিকভিস্ট এর উত্তরে বলেছিলেন যে আলো অনেকরকম হয়। সম্ভ্রান্ত, স্বপ্নবৎ, নিঃস্ব, জীবন্ত, মৃত, পরিচ্ছন্ন, দৃঢ়, তীর্যক, যৌনময়, আবছা, বিষাক্ত, রহস্যময়, উত্তপ্ত, অন্ধকারাচ্ছন্ন, হিংস্র, প্রেমময়, পতনশীল, শান্ত এবং বিবর্ণ! নিকভিস্ট বার্গম্যানের কুড়িটি ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। দুবারের অস্কার বিজয়ী। এই যতরকম আলোর কথা বলা হল তারমধ্যে সবচেয়ে পরিচিত আলো কোনটা জানি না! আলোর গভীরে একটা ইমেজ থাকে,যেটা শুধুই অনুভূতিগ্রাহ্য! যেমন ধরুন "শান্ত আলো"! আপাত ভাবে এর কোনো অর্থ হয় না। এবার এই "শান্ত আলো" শব্দ দুটিকে নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। ধরে নিন একটা মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে নিঝুম অপরাহ্নের আলো এসে পড়েছে। একটা বিড়াল ঘুমোচ্ছে। গৃহস্থের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ! এই নিবিড়তাকে শান্ত ভাবা যেতেই পারে। অর্থাৎ আলোর চরিত্র নির্ভর করছে তার সাবজেক্টের ফর্মের ওপর। ... ...
পায়েল কাপাডিয়ার ছবিতেও এই রাজনৈতিক সচেতনতার আভাস পাওয়া যায়। তাঁর ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রাজনীতি আর ব্যক্তিগত জীবন সমান্তরাল ভাবে চলে, এমনও মনে হতে পারে যেন দুটো ভিন্ন কাহিনি। রাজনীতি বলতে দলীয় মিটিং, মিছিল নয়, কোন ইস্যু, বিক্ষোভ, প্রতিবাদকে পূর্বনির্ধারিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা নয়, নির্মোহ ভাবে বৃহত্তর ও ব্যক্তিগত পরিসর কে ফুটিয়ে তোলা। পায়েল আগেও কান উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন, পুরষ্কার জিতেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর ‘আফটারনুন ক্লাউডস’ একমাত্র ভারতীয় ছবি যা উৎসবে নির্বাচিত হয়েছিল। ২০২১ সালে তাঁর তথ্যচিত্র ‘আ নাইট অফ নোইং নাথিং’ সেরা ডকুমেন্টারি ছবির জন্য ‘গোল্ডেন আই’ পুরষ্কার পায়। এই ছবিতে ২০১৫ সালে FTII এ মহাভারত-খ্যাত গজেন্দ্র চৌহানকে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ করার প্রতিবাদে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা দেখান হয়েছে। প্রসঙ্গত পরিচালক নিজে এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন যার জন্য তিনি প্রায় সাড়ে চার মাস ক্লাস বয়কট করেছিলেন এবং তাঁর অনুদানও বন্ধ হয়ে গেছিল। ছাত্রদের এই প্রতিবাদ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে এক কলেজের ছাত্রী তার প্রেমিকের অনুপস্থিতি অনুভব করছে। একই চিঠিতে সে লিখছে ক্যাম্পাসে কী হচ্ছে সে বুঝে উঠতে পারছে না, হয়তো স্ট্রাইক করার জন্য তাঁদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। মুসলিম যুবককে চোখ বেঁধে, কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে পুলিশের জিপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, একই সাথে মেয়েটি চিঠিতে তার চারিপাশের বাস্তব, কল্পনা, স্বপ্ন, ফ্যান্টাসি উজাড় করে দিচ্ছে। এই ভাবে পরিচালক পলিটিকাল আর পারসোনালের মধ্যে আন্তসম্পর্ক খুঁজছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন। ... ...
স্টেট ও চার্চকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দিতে হবে। রাজ্য পরিচালনার কাজে চার্চ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এবং রাজ্যও চার্চের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। রাজ্য পরিচালনার কাজে রোমান ক্যাথলিক চার্চ সরাসরি হস্তক্ষেপ করত। নিয়ম-শৃঙ্খলা বলবৎ ছিল, যাকে বলা হত খৃষ্টীয় অনুশাসন। কিন্তু পরবর্তীতে স্টেট ও চার্চের এই বিযুক্তিকরণই ছিল সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার আদি সংজ্ঞা। নিয়ম-শৃঙ্খলা অর্থাৎ অনুশাসনের ভাবনা নিশ্চয়ই আদিম যুগে ছিল না, গুহামানবের যুগে ছিল না। জৈবিক বিবর্তনের পথ ধরে সমাজ তৈরি হয় এবং সেই পথেই কোনো একসময় নিশ্চয়ই নিয়ম- শৃঙ্খলা বা অনুশাসনের ভাবনা এসেছিল। ধর্মের উৎপত্তি ও সামাজিক অনুশাসন কি যমজ সন্তান! প্রাচ্যের প্রাচীন ধর্মগুলিই হোক বা আব্রাহামিক (সেমেটিক) ধর্মগুলিই হোক, পাপ-পুণ্যের ভয় দেখানো ব্যাপারটা ধর্মীয় অনুশাসন কায়েম রাখার পিছনে কাজ করত, তা হয়ত অস্বীকার করা যাবে না। ... ...
‘দ্য ম্যান উইথ নো নেমে’র মাথায় উঠল ছেঁড়াফাটা বাদামি টুপি, গায়ে কোঁচকানো কাপড়চোপড়, হাতে রইল পুরনো ০.৪৫ রিভলভার। এমনই এক চরিত্র যে নিজের আর্থিক মুনাফা ছাড়া অন্য কোন বিষয়েই আগ্রহ দেখায় না বিশেষ। এবং যার নৈতিকতা পেন্ডুলামের মত সতত দোদুল্যমান। তাকে একবার মনে হয় ন্যায়পরায়ণ, আবার পরমুহূর্তেই মনে হয় দুর্নীতিগ্রস্ত। ছবির সর্বত্র ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’কে ভাল এবং খারাপের মধ্যে যে কোন একটা দিককে বেছে নিতে হয়। দর্শক হিসেবে আমরাও ধন্দে থাকি, কোনও এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী হবে তার প্রতিক্রিয়া? দর্শকের পক্ষে গল্পের ভবিষ্যদ্বাণী খাড়া করাটাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। আর এটাই হল ছবিতে তৈরি হওয়া বেশ কিছু শক্তিশালী মুহূর্তের জ্বালানী। এই নামহীন মানুষটি আগ বাড়িয়ে অন্যদের রক্ষা-টক্ষা করে না, অন্যায়-টন্যায় সংঘটিত হচ্ছে দেখলেও থাকে নিরুত্তাপ উদাসীন, এবং ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের উপকার করে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে নিশ্চিত হচ্ছেন এই উপকারের বিনিময়ে সেও উপকৃত হবে। ... ...
"He has avenged the great Argentine people oppressed by ignoble imperialist in the Malvinas..It's a political act..he humiliated them, you understand?" - বৃদ্ধ আঙ্কল আলফ্রেডো উত্তেজনায় ফ্যাবিয়েত্তর হাতটা চেপে ধরেন! মালভিনাস হল ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের প্যাটাগোনিয়ান শেল্ফে অবস্থিত। এই দ্বীপপুঞ্জের আবিষ্কার ও ইউরোপীয়দের দ্বারা এর উপনিবেশায়ন নিয়ে প্রভূত বিতর্ক আছে। ফরাসিরা, স্প্যানিশরা ও আর্জেন্টিনীয়রা বিভিন্ন সময়ে এই দ্বীপগুলিতে বসবাস করলেও ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশরা তাদের শাসন পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু আর্জেন্টিনা এই দ্বীপপুঞ্জের উপর তাদের দাবি বজায় রাখে। ১৯৮২ সালে ২রা এপ্রিল আর্জেন্টিনা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করে ও দখল করে। তাদের দাবি ছিল দ্বীপগুলি আর্জেন্টিনার ভূখণ্ডেরই অংশ এবং এই আক্রমণের দ্বারা তারা আসলে নিজস্ব ভূখণ্ডই পুনরুদ্ধার করতে চাইছে। ৫ই এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার পাল্টা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অঘোষিত এই যুদ্ধ চুয়াত্তর দিন স্থায়ী হয়েছিল। ১৪ই জুলাই আর্জেন্টিনা আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বীপগুলিতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে। আঙ্কল আলফ্রেডো এই ফকল্যান্ড যুদ্ধের কথাই বলছেন। ... ...
আমাদের নিউটনবাবু মিলিটারি ও পুলিশ পরিবৃত হয়ে শেষমেশ পৌঁছলেন তার গন্তব্যে। যদিও ইতিমধ্যে সঙ্গী আইনরক্ষকরা তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন দূরবর্তী ক্যাম্পে বসেই কাগজেকলমে ভোটপর্ব সেরে নিতে। কারণ জঙ্গি হানায় কুঁকড়ে থাকা ঐ আদিবাসী গ্রামের নিরক্ষর স্বল্পসংখ্যক মানুষদের মধ্যে কেউ-ই কোনো কালে এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে অভ্যস্ত নন। নিউটনও ছাড়ার পাত্র নন। ‘স্বদেশব্রত’-ই যে তখন তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান! হয়তো তেমনটাই যৌক্তিক। প্রথমবার ইলেকশন ডিউটি পেয়ে হয়তো এমনই গরম রক্তে আমিও ফুটেছিলাম গণতন্ত্রের মহান উৎসবে সামিল হতে। কিন্তু পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা বড় নির্মম। মানুষকে কাপুরুষও করে তোলে। বাস্তবে এমন আশাতীত প্রস্তাব পেলে হয়তো বুদ্ধিমান প্রিসাইডিং অফিসার তা দু’হাতে লুফে নিতেন। আবারও সিনেমা-প্লটের অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে ব্যক্তিগত হিসেবনিকেশের দুস্তর ব্যবধান। তবু শিল্পমাধ্যম তো তখনই যথার্থ হয়ে ওঠে, যখন হৃদয়-উৎসারিত বেদনা উন্মোচনে তা অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ... ...
তবু একদিন যাবার সময় হয় রঘুর। বনবিভাগ ফেরত চায় হাতিকে। তারা মিনতি করে হাতিটিকে রেখে দেবার কিন্তু নিষ্ফল সে আবেদন। রঘু চলে যায়। নীরবে চোখের জল ফেলে বোমান আর বেলি। সন্তানকে দূরে পাঠাতে হলে যেভাবে দুমড়ে যায় মন। কিন্তু ততোদিনে এসে গেছে নতুন একটি হস্তিশাবক, তারা নাম দিয়েছে আম্মু। হাতির সেবায় উৎসর্গীকৃত জীবন থেমে থাকে না। দূরের বন থেকে কখনো দেখা করতে আসে রঘু। বোমান হাঁক দেয়, কেমন আছিস রে রঘু? রঘু তার শরীরী ভাষায় জবাব পাঠায়। আশ্চর্য মুহূর্ত ধরে ক্যামেরা। ... ...
শ্রেণি বিভাজনে আজ যদি প্রলেতারিয়েত, লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত, লুম্পেন-বুর্জোয়া, বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া ইত্যাদি বলা হয় তাহলে মানুষ যার পর নাই বিরক্ত হবেন। আবার সেইসব বস্তাপচা বিশেষণ! এসব বিংশ-শতাব্দীর ব্যাপার, একবিংশ শতাব্দীতে এইসব চলে না। একবিংশ শতাব্দী হল উত্তরাধুনিকতার যুগ এবং উত্তরাধুনিকতা বামপন্থা বা মার্কসবাদকে আধিপত্যকামী বা হেজিমনিক মনে করে ও বিরোধিতা করে। ব্যাপার যে এখন আরও অনেক জটিল এবং উক্ত বিশেষণগুলি যে এখন আর এদের সম্যক পরিচয় বহন করে না জগার মত সিন্ডিকেট-বস বা বিউটি (দেশান্তরিত ও অত:পর স্বামী কর্তৃক বিক্রিত), মালাদের মত একবিংশ শতাব্দীর শহুরে যৌনকর্মীদের দেখলে অবশ্যই বোঝা যায়। সত্য বিউটিদের সঙ্গে জগা গণেশ এবং চাঁদু সোমাদের সঙ্গে সুধাময়দের পরিবার - দুটি আলাদা উলম্বে স্থাপিত। ... ...
৬০-র দশক। ইতালির অর্থনীতিতে জোয়ার আসে এই সময়। উত্তর ইতালিতে তৈরি হয় সেই সময়ের বিচারে ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং। অন্যদিকে ইতালির দক্ষিণ ভাগে ক্যালাব্রিয়ান অন্তঃভূমিতে এই সময়ই একদল স্পিলিওলজিস্ট অভিযান চালান বিফুর্তোর অতলে। আবিষ্কৃত হয় ইউরোপের গভীরতম গুহা! ইতালির চলচ্চিত্র পরিচালক মাইকেলেঞ্জেলো ফ্র্যামার্টিনো(১৯৬৮-) স্পিলিওলজিস্টদের এই অভিযানকে কেন্দ্র করে ২০২১ সালে তৈরি করেছেন 'ইল বুকো' বা 'দি হোল'। বলা-বাহুল্য ছবিটির প্রেক্ষাপট ৬১-র ইতালি অর্থাৎ ছবিটি একটি পিরিয়ড ছবি। এই গুহাটি লাইমস্টোনের অর্থাৎ গুহাটির একটা বিশাল ভূতাত্ত্বিক সময় পরিসীমা আছে যা প্রকৃত-প্রস্তাবে বর্তমানের চোখে পৃথিবীর দীর্ঘ ইতিহাসের এক অফস্ক্রিন উপস্থিতি। ভেনিসে ছবিটি প্রদর্শিত হওয়ার পড়ে একটি সাক্ষাৎকারে ফ্র্যামার্টিনো জানান, তিনি মনে করেন মানুষের কাছে চলচ্চিত্রের সবথেকে আকর্ষণীয় ও অভিনব ব্যাপার হল অফস্ক্রিন উপস্থিতি বা অফস্ক্রিন স্পেসের যথোপযুক্ত প্রয়োগ। এর থেকে বোঝা যায় ক্যালাব্রিয়ান অন্তঃভূমির ঐ গুহাকে কেন তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছবির বিষয় হিসেবে। কিন্তু শুধু তাই নয়। ... ...
ফিল্ম আর্কাইভের প্রতিশ্রুতি থাকতো প্রত্যেক বুধবার করে। প্রত্যেক বুধবার সন্ধ্যা ছ-টায় দেখানো হত ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক, নন্দন তিন-এ। তবে সব বুধবার হত না। আর্কাইভের একটা ফোন নম্বর জোগাড় করেছিলাম আমরা। বুধবার শো-য়ের ঘণ্টা তিনেক আগে ফোন করে কি ছবি এবং তার থেকেও বড় হল আজ দেখানো হবে কিনা সেটা নিশ্চিত করে নেওয়া হত। ৯৮-৯৯ সাল ও শূন্য দশকের শুরুর দিকে নন্দনের অধিকর্তা ছিলেন অংশু শূর। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব, সিনে সেন্ট্রাল, আইজেন্সটাইন সিনে ক্লাব, আর্কাইভের শো ও আরো অনেক ফিল্ম সোসাইটি - এসব মিলিয়েও আমরা পরিমিত আহার পাচ্ছি না মনে করেই সম্ভবত নন্দনে শুরু হল মাসিক রেট্রোস্পেক্টিভ! নন্দনের অধিকর্তা বদলে গিয়ে তখন নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। প্রত্যেক মাসে না হলেও মোটামুটি নিয়মিতভাবেই মাসের শেষে নির্দিষ্ট পরিচালকের এক-গুচ্ছ ছবি দেখানো হত। নন্দনের মূল গেট দিয়ে ঢোকার আগে বাঁ-দিকের কাঁচের শোকেসে নতুবা ডান দিকে দাঁড় করানো স্ট্যান্ডে আটকানো থাকতো এই কর্মসূচির কাগজ। ছবিগুলি দেখানো হবে নন্দন দুই-এ। যারা দেখতে ইচ্ছুক তাদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ থাকত নন্দনের লাইব্রেরি থেকে বিনি পয়সার পাস জোগাড় করে নেওয়ার! প্রথম রেট্রোস্পেক্টিভ দেখানো হয় অ্যালফ্রেড হিচককের (১৮৯৯-১৯৮০)! চারটি ছবির কথা পরিষ্কার মনে আছে, 'রোপ'(১৯৪৮), 'রিয়ার উইন্ডো'(১৯৫৪), 'সাইকো'(১৯৬০) এবং 'দা বার্ডস'(১৯৬৩)! ... ...
এই যে বৃন্দাবনের খোঁজ তা চিরন্তন আর সেই বৃন্দাবন সশরীরে এই পৃথিবীর বুকে খুঁজে চলার কাজটি করে চলে মায়াভূত রাশি রাশি কল্পনা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রায় যে কোন ছবিতেই এই কল্পনা নামক মায়াদণ্ডটির ক্রীড়া একান্ত আবশ্যক। আর তাছাড়া আজকের এই মৃত পশুর দেহ নিয়ে মাছির ভনভন করা দুনিয়ায় আর আছেটাই বা কি! তবু শুধু প্রলাপের মতন কিছু অন্তহীন ভালোলাগাকে নিয়ে কলম ক্ষয় না করে কালপুরুষ ছবিটিকে নিয়ে কিছু বাক্য ব্যয় করবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ এই ছবির অসামান্য বিশ্বজনীন এক আবেদন যা যত সময় অগ্রসর হবে তৃতীয় বিশ্বের শরীরে ক্রমশ: সঞ্চারিত করবে জীবনবোধ এটুকু আশা হতাশ হয়েও করাই যায়। ... ...
হলিউডের অতি-জাগতিক সিনেমার আকর্ষণে এসপ্ল্যানেডের হল গুলিতে কলেজের কত ক্লাস যে আমরা করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ক্রমে-ক্রমে অন্য-ধারার সিনেমার প্রতি আকর্ষণে এ.জে.সি বোস রোডের একটি স্থান আমাদের কাছে হয়ে ওঠে তীর্থক্ষেত্র। সময়কাল শূন্য-দশকের শুরুর বছর গুলি। টরেন্ট, ওটিটি এসবের তখন কল্পবিজ্ঞানের গল্পেও অস্তিত্ব নেই। ফলে অন্য-ধারার একটা ভালো ছবি অমুক জায়গায় দেখানো হচ্ছে, এসব ছিল লাখ-টাকার খবর! ... ...
আধুনিক নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘The work of art in the age of mechanical reproduction’-এ এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। আমরা মোটামুটিভাবে এই সূত্রকে কেন্দ্রে রেখে আলোচনা করব ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামির (১৯৪০-২০১৬) মূলত দুটি ছবি নিয়ে, Certified copy (২০১০) এবং Like someone in love (২০১২)। ২০০০ সালে দেখা The wind will carry us(১৯৯৯)-র স্মৃতি আজও টাটকা। সেই আমাদের প্রথম কিয়ারোস্তামির ছবি দেখা। ... ...
সাহিত্যে লিখে দেওয়া যত সহজ চলচ্চিত্রে করে ফেলা ততটাই কঠিন। চলচ্চিত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণত ভাঁড়ামোয় পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। এব্যাপারটা আমাদের দেশে সত্যজিৎ রায়ের থেকে ভালো আর কেউ বুঝতেন না। এর কারণ শুধুমাত্র এই নয় যে সিনে-টেকনিক বা সিনে-প্রকরণবিদ্যার উপর তাঁর দখল ছিল ঈর্ষণীয়, এর সঙ্গে এটাও সত্যি যে তাঁর আঠাশটি পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের ছবির মধ্যে কমবেশি বাইশটিই অন্যের লেখা সাহিত্য থেকে করা! ফলত তুলসীর সহজাত অভিনয় ক্ষমতা ও মৌখিক-দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে যতটুকু করা যায় তাই করেছিলেন সত্যজিৎ ... ...
২৪শে অক্টোবর ১৯১৭, দুর্গা পুজোর মহানবমীর দিন আগুন লেগেছিল রায়বাগানের মতিলাল সেনেরবাড়িতে। সেখানেই থাকত রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানির সমস্ত ছবির ফিল্ম। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলভারতের প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের সারাজীবনের পরিশ্রমের যাবতীয় ফসল। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল এক অবিশ্বাস্য ইতিহাস! পরের এক শতাব্দী জুড়ে মান্যতা এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এক ঐতিহাসিক ভুল তথ্য! না! দাদাসাহেব ফালকে নন! ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রকৃত পথিকৃৎ ছিলেন এক বঙ্গসন্তান। তাঁর নাম হীরালাল সেন। ... ...
অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে জাঁ লুক গোদারের পার্থক্য যে তিনি এতে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি। তারঁ নিজের সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ককে, ইমেজের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ককে, জীবনের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ককে বরাবর প্রশ্ন করে গিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতি এই সিনেমা। গোদার নিজেই বলেছেন "এটা ফিল্ম নয়। ফিল্ম করার এক প্রচেষ্টা এবং সেইভাবেই এটা উপস্থাপিত।" এটা কি কোনো গিমিক? তা নয়, আসলে গোদারের মতে শুধু ফিকশন শিল্পীকে বাঞ্চিত স্পেস এবং তাঁর কণ্ঠস্বর দেয় না। এখানেই ফিকশনের অসম্পূর্ণতা। ... ...
মেহমুদের সংসার জীবন অনুল্লেখিত, বোঝা যায় তার সচ্ছলতা আছে কিন্তু চিত্তে শান্তি নেই। রাতের একটি দৃশ্যে দেখানো হয় – ইউসুফ ও মেহমুদ দুজনেই দেখছে রান্নাঘরে ইঁদুর-কলে একটা ইঁদুর আটকে পড়েছে। ব্যাস, আর কিছু বলা হয় না। ঘর গৃহস্থালিতে এ খুবই সাধারণ ঘটনা, ফলে দৃশ্যটিকে মূল গল্পে আরোপিত বলে মনে হয় না। অথচ বহুবিধ অর্থের ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ দৃশ্যটি। এই সৌন্দর্য-ব্যঞ্জনা কিন্তু শুধুমাত্র বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে তৈরি হয়নি, বরং নির্মাণ রীতিই অনেকাংশে একে দিয়েছে মহার্ঘ্যতা। পরিচালকের নাম ‘নুরি বিলজ সেলান’ (Nuri Bilge Ceylan) (১৯৫৯-)। ... ...
মনিকা ভিত্তিকে আন্তনিওনির মানসকন্যা বলার কারণ শুধুমাত্র এই নয় যে ওঁর একক নির্দেশিত চোদ্দ পনেরটি ছবির মধ্যে পাঁচটিতেই মনিকা অভিনয় করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রধানতম ছবি গুলির তালিকায় নিশ্চয়ই সব ছবি পড়বে না। পড়বে ‘অপুত্রয়ী’, পড়বে ‘চারুলতা’, পড়বে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ইত্যাদি। কারণ, এগুলিতেই সত্যজিৎ-বীক্ষার সর্বোত্তম প্রকাশ ও বিকাশ দেখা গেছে। একই ভাবে আন্তনিওনির ক্ষেত্রে নাম করতে হবে তাঁর প্রখ্যাত ট্রিলজি – ‘লাভেন্তুরা’(১৯৬০) , ‘লা-নত্তে’(১৯৬১), ‘লা-এক্লিপ্স’(১৯৬২)-এর, নাম করতে হবে ‘দি রেড ডেসার্ট’(১৯৬৪)-এর। মনিকা ভিত্তিকে ছাড়া এই ছবিগুলোর কথা স্রেফ ভাবা যায় না! ... ...
আমাদের প্রথম ওজু-অভিজ্ঞতা কিন্তু ওজুর নামকরা ছবি গুলির মধ্যে থেকে হয়নি। কোন উৎসব মনে নেই, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব হতে পারে আবার স্বতন্ত্র কোনো প্রদর্শনীও হতে পারে। এক দশকের একটু বেশি আগে হবে, সন্ধ্যা-বাসর, যতদূর মনে পড়ছে বিকেল চারটে বা সন্ধ্যা ছটার প্রদর্শনী, নন্দন দুই (তখন আলাদা আলাদা চেয়ার পাতা থাকত, এখনকার মত ফিক্স সুইঙ্গিং চেয়ার নয়)। ওজুর নামের সাথে পরিচিতি তখনও পর্যন্ত উপরের ঐ সত্যজিতের বক্তব্যটি। ... ...
হইচইয়ের 'মন্দার' নামক এই সিরিজ দেখতে বসে, সমকালীনতা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশই থাকেনা একদম প্রাথমিক কিছু দৃশ্যের পর। দেখা যায় সমুদ্রতীর, দেখা যায় মোটরসাইকেল। দেখা যায় পোলানস্কিসুলভ 'আধুনিক' হিংস্রতা। সিরিজের একদম শুরুতে সমুদ্রতীরে ডাইনি এবং তার চেলা যখন মাছকে গেঁথে ফেলে বর্শায়, সেই দৃশ্যের সঙ্গে পোলানস্কির প্রথম দৃশ্যের অদ্ভুত মিল। আলোর তফাতটুকু বাদ দিলে স্কটল্যান্ড এবং বঙ্গের সমুদ্রতীর একদম এক হয়ে যায় মরা মাছ আর মরা সৈনিকের ছটফটানিতে। ডাইনিদের পদচারণা এবং আচার-অনুষ্ঠানে। পোলানস্কির সিনেমায় ঘোড়সওয়াররা টগবগিয়ে আসে সৈকতে। মন্দারে ঘোড়া নেই, তার জায়গায় আছে মোটর সাইকেল। ধূধূ সমুদ্রসৈকত দিয়ে মন্দার মোটরসাইকেল চালিয়ে যায় পিছনে একজন আরোহীকে নিয়ে। ... ...