তিব্বত সম্বন্ধে অনেকের মতোই আমারও বহুদিনের কৌতূহল – কারণ কয়েকশ বছর ধরে চিন ছাড়া বিশ্বের সবার কাছেই দেশটি নিষিদ্ধ ছিল এবং রয়েছে। ছাত্রাবস্থার শেষ দিকে আমার হাতে আসে শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র দাশের Journey to Lhasa and Central Tibet নামক কিংবদন্তি গ্রন্থটি। শুধু গ্রন্থটি নয়, এটির রচয়িতা শ্রীযুক্ত দাশও একজন কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব।
তিনি একাধারে সংস্কৃত ও তিব্বতি ভাষায় সুপণ্ডিত, বৌদ্ধ শাস্ত্রে বিদগ্ধ, এবং মানুষ হিসেবে অত্যন্ত বিনয়ী ও সজ্জন, যে কারণে তিব্বতের ধর্মগুরুরা তাঁর তিব্বত ভ্রমণে সাদরে এবং সসম্মানে সহযোগিতা করেছিলেন। এই তিব্বত অভিযানে তাঁর ছদ্মবেশ ছিল “কা-চে-লামা” – অর্থাৎ কাশ্মীর থেকে আগত লামা। লাসার পোতালা প্রাসাদে মহালামা – আট বছরের বালক - তালে লামার দর্শন ও তাঁর আশীর্বাদী প্রসাদ লাভের বিরল সৌভাগ্যও তাঁর হয়েছিল। প্রায় চৌদ্দ মাসের অভিযান শেষে তিনি ভারতে ফিরেছিলেন, তিব্বতি ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা প্রচুর পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি নিয়ে। এই পুঁথিগুলি থেকে এদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতদের লেখা বৌদ্ধ দর্শনের অনেক তথ্য মিলেছে। এছাড়াও তিনি আবিষ্কার করেছেন, সংস্কৃত ভাষায় লেখা কবি ক্ষেমেন্দ্র রচিত “অবদান কল্পলতা”, আচার্য শ্রী দণ্ডীর “কাব্যাদর্শ”, চন্দ্রগোমির “চন্দ্র ব্যাকরণ” এবং আচার্য অমির “সারস্বত ব্যাকরণ”-এর পুঁথি।
তবে বৌদ্ধ শাস্ত্র-চর্চা এবং বৌদ্ধ পুঁথি সংগ্রহই তাঁর এই তিব্বত ভ্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর আরও উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সরকারের হয়ে তিব্বত সম্পর্কে যথা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা। সে দেশের শাসন ব্যবস্থা, বাণিজ্যনীতি, সামাজিক বিন্যাস, তিব্বতের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক তথ্য। তিব্বতি সভ্যতার ইতিহাস। চিনের সঙ্গে তিব্বতের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের খুঁটিনাটি। এমনকি সার্ভেয়ার হিসেবে, তাঁর যাত্রা পথের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সহ route map তৈরি করা, কাঞ্চনজঙ্ঘার উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশের অনেক অজ্ঞাত তথ্য সংগ্রহ এবং তিব্বতের পালতি সরোবরের সার্ভে সম্পাদন।
প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে সেই অমূল্য গ্রন্থখানির বাংলায় অনুবাদ হয়েছে দেখে, বইটি সংগ্রহ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। তার কারণ, প্রথমতঃ অর্বাচীন ছাত্রাবস্থায় যে বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেটিকে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া। তাছাড়া সম্প্রতি প্রকাশিত আমার “ধর্মাধর্ম” গ্রন্থটি রচনার সময় – গৌতমবুদ্ধর জীবন ও তাঁর বাণী, সম্রাট ধর্মাশোকের ধর্মীয় আচরণ, তৎ-পরবর্তী বৌদ্ধদর্শনের বিবর্তন এবং মধ্য যুগের আগেই ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধভাবনার অবলুপ্তি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ পরিচয়ের অবকাশ হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষীতে এই বঙ্গদেশের তন্ত্রধর্মের প্রভাবে বিবর্তিত বৌদ্ধধর্মের তিব্বতি শাখার ধর্মাচরণ - ঊণবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কেমন ছিল? যেহেতু ছাত্রাবস্থায় এইদিকে দৃষ্টিপাত করার মতো ইতিহাস জ্ঞান আমার ছিল না, সেহেতু আমার এই নব্য কৌতূহলটি দ্বিতীয় হলেও মুখ্য কারণ।
শ্রীযুক্ত দাশ আমার এই কৌতূহল নিরসনে চেষ্টার ত্রুটি করেননি, অজস্র খণ্ড দৃশ্যে তিনি তিব্বতি ধর্ম ও সামাজিক আচরণের নানান চিত্র তুলে ধরেছেন, তার মধ্যে দুটি ঘটনার উল্লেখ করব-
১. তাশিলুনপোতে চামনৃত্যের অনুষ্ঠান – অষ্টম শতাব্দীতে চাম নৃত্যের প্রচলন করেছিলেন পদ্মসম্ভব। এটি এক ধরনের মুখোশ নৃত্যের অনুষ্ঠান। প্রথমে এল ঈগলের মাথার মতো মুখোশ পরা বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, তাদের গায়ে বড়োবড়ো পকেট ওয়ালা জামা। এরপর এগিয়ে এল কালচে রঙের মুখোশধারী এক সন্ন্যাসী। এরপর চারজন রাজা বেরিয়ে এলেন চারটে প্রধান ফটক দিয়ে, পরনে তাঁদের জংলি পোশাক। তারপর এলেন ঈশ্বর-পুত্রেরা। পরনে তাঁদের সোনার সুতোর কাজ করা এবং দামি রত্ন-পাথর বসানো লম্বা আংরাখা। তাঁদের পিছনে এসে ঢুকল ভারতীয় রীতির আতসারারা। তাদের শ্যামল মুখমণ্ডল আর ঘনকৃষ্ণ দাড়ি, বিদঘুটে তাদের সাজপোশাক। তাদের দেখে দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল উঠল। এরপর এল নরকের চার মাতব্বর – তাদের কঙ্কালের মতো পোশাক দর্শকদের মুখে স্পষ্ট মৃত্যু-ভয়ের ছাপ ফেলল। এরপর চাম নৃত্যের শেষ অনুষ্ঠান শয়তানের কুশপুত্তলিকা দহন। ভারতীয় পণ্ডিতদের তিব্বতে “আতসারা” বলে, শব্দটি সংস্কৃত “আচার্য” শব্দের সমার্থক। যে শয়তানের কুশপুত্তলিকা দহন করা হল, সেটি নাকি আতসারার প্রতীক। ভারতীয় বৌদ্ধদের ওপর হিন্দু পণ্ডিতদের অত্যাচারের স্মৃতিই কি এই নৃত্য পরম্পরায় ঢুকে পড়েছিল সেই অষ্টম শতাব্দী থেকে! (পৃ ১৬১-১৬৩)
২. তিব্বত ভ্রমণ কালে শ্রীযুক্ত দাশ একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন – ধূম জ্বর আর কাশিতে তাঁর বেহাল অবস্থা। বহুজনের বহুবিধ টোটকা ওষুধে তাঁর নিরাময় হল না। জনৈক উচ্চস্তরের অবতার লামা (খ্যাব-গং - Khyab-gong) হলেন দোরজে ফাগমো। শ্রী দাশকে সুস্থ করে তুলতে, তিনি বহুবিধ চেষ্টা করলেন, কিন্তু সবই ব্যর্থ হল। শেষে তিনি, “প্রাণ দেবতার তুষ্টি সাধন” নামক এক অনুষ্ঠান করার বিধান দিলেন, সে অনুষ্ঠানের আচারগুলি এরকম –
ক. প্রথম পর্ব - বারোজন ভিক্ষু দুদিনে প্রজ্ঞাপারমিতার ৮০০০ শ্লোক পাঠ করবে।
খ. এর পরের পর্ব – চা-গ্সুম। একটা সিধে তিনটে ভাগ করে – প্রথম অংশ উৎসর্গ হবে দশ মহেশ্বর, গ্যা-জিন (ইন্দ্রদেব), অগ্নিদেব, হাদিস, পবনদেব প্রমুখ দেবতাদের উদ্দেশে। দ্বিতীয় অংশ নিবেদিত হবে আত্মা-পরমাত্মাদের উদ্দেশে। আর তৃতীয় অংশ উপদেবতাদের।
গ. তৃতীয় পর্ব - নির্দিষ্ট কোন এক জিনকে সন্তুষ্ট করতে হবে, যাতে পীড়িত ব্যক্তির গভীর ঘুম হয় এবং ভালো ভালো স্বপ্ন দেখে।
ঘ. চতুর্থ পর্ব - ঈশ্বরের উদ্দেশে তর্পণের অনুষ্ঠান।
ঙ. পঞ্চম পর্বে রোগীর একটা প্রতিকৃতি, সঙ্গে কাপড়চোপড়, খাদ্যসামগ্রী অর্ঘ্য দেওয়া হবে মৃত্যুর দেবতাকে। তাঁর কাছে মিনতি, তিনি যেন এই সব বস্তু-সামগ্রী গ্রহণ করে রোগীকে মুক্তি দেন।
চ. ষষ্ঠ পর্বের নাম জীবন ফাঁকি – স্রোগ-স্লু, অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণী যেমন মানুষ, জীবজন্তু আর বিশেষতঃ মাছের জীবন রক্ষা করা। তাতে নাকি মুমূর্ষুর আয়ু বাড়ে!
শ্রীযুক্ত দাশ পাঁচশো মাছের জীবন রক্ষার জন্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়াতে, খ্যাব-গং দোরজে ফাগমো তিন মাইল দূরের জেলে বস্তিতে গিয়ে পাঁচশ মাছ কিনে শ্রীদাসের সংকল্পে সেই সব মাছ নাকি জলে ছেড়ে দিয়েছিলেন! (পৃ ১৮৫-১৮৬)
তবে গ্রন্থটি পাঠের পর গৌতম বুদ্ধ এবং সম্রাট অশোকের ধর্মোপদেশ থেকে এতটা বিচ্যুতি দেখে এতটুকু আশ্চর্য হই না। যেমন হই না উপনিষদের প্রজ্ঞা থেকে গোমাতার দুধে সোনা, গোবরে সর্বরোগহর মহৌষধ এবং গোমূত্রে ক্যানসারের প্রতিষেধক খুঁজে পাওয়ার কৃতিত্ব দেখে।
পরিশেষে বলি, শ্রী রাজীবকুমারের অনুবাদ এতটাই অনাড়ম্বর ও সাবলীল যে, গ্রন্থটি একবার পড়তে শুরু করলে, আর ছাড়া যায় না, সায়েবি ভাষায় যাকে বলে unputdownable। অজস্র অপরিচিত তিব্বতি শব্দগুলির অর্থ ও ব্যাখ্যাগুলি বহু পরিশ্রমে তিনি আমাদের বোধগম্য করেছেন। আশা করি কৌতূহলি পাঠকের কাছে মূল গ্রন্থের মতোই, এই অনুবাদ গ্রন্থটিও একটি আকর গ্রন্থ হয়ে উঠবে।
গ্রন্থঃ জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট - শরৎচন্দ্র দাশ অনুবাদঃ রাজীবকুমার সাহাপ্রকাশকঃ একপর্ণিকা প্রকাশনীঅনলাইন প্রাপ্তিঃ http://www.ekparnika.in
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।