সারাদিন আমাকে অশান্ত করে আজকের মণিপুর। ঘুমোতে দেয় না রাতে। স্যরের মেইল বা মেসেজের অপেক্ষায় আছি। এরপরেই হয়ত ফোন করবেন। এরকম যে কোনও অস্বস্তিকর ঘটনার পরেই তো উনি মেইল করে থাকেন। ফোন করে অনেক কিছু বলেন। ওঁর কথায় থাকে অস্থিরতা, বিপন্নতা। হ্যাঁ ওঁকে তো এভাবেই দেখেছি। তারপরেই মনে হয়, না, না, সেই মেইল বা ফোন কোনোটাই তো আর আসবার নয়। আসলে এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি।
সমর বাগচী স্যর, বিড়লা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাণ্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামের প্রাক্তন অধিকর্তা, বিজ্ঞান আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রথম সারির এক নাম। ওঁর ‘বিজ্ঞান ইতিহাসে’ বইয়ের প্রকাশকের পক্ষ থেকে শ্রী সঞ্জয় অধিকারী লিখছেন, ওঁর “লক্ষ্য একটাই, আগামী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী গড়তে হবে। তিনি জানেন যারা এই পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তারা সহজে কথা শুনবেনা, তাদের সাথে লড়াই করতে হবে।” হ্যাঁ ঠিকই তো। পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া এই ভোগবাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে স্যর বলেন, মানে বলতেন, “ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি কিভাবে পৃথিবীকে বিপদের মধ্যে ফেলেছে, সেটা আমাকে খুব বিচলিত করে”। সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করার প্রসঙ্গে উনি উল্লেখ করতেন গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের কথা। ‘বিজ্ঞান ইতিহাসে’ বইটির উদ্বোধনের দিনই বলেছিলেন, “আমি গান্ধীয়ান মার্ক্সিস্ট”। দ্য টেলিগ্রাফ ইন স্কুল্সের জন্য আমার নেওয়া ওঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সেই ভোগবাদ, যা কিনা প্রকৃতির ক্ষতির জন্য মূলত দায়ী, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফল বেশি করে ভোগ করছেন তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক মানুষেরা।”
এবছরেরই এপ্রিল নাগাদ বিড়লা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাণ্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, সমর বাগচীকে নিয়ে ডঃ অরিন্দম রাণা ও অভিষেক গাঙ্গুলির ‘আ লাইফ ডেডিকেটেড টু সায়েন্স’ নামে একটি তথ্যচিত্র দেখানো উপলক্ষে। জ্ঞানবিজ্ঞান জগতের অনেক বিদগ্ধ মানুষ উপস্থিত সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায়। অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম স্যরের সম্পর্কে। একজন ইংরেজিতে বললেন, ‘হিস প্রোফেশন বিকেম হিস প্যাশন।’ আরেকজন বললেন যে তাঁর সহকর্মী নিজের মেয়েকে ‘ফিরে পেয়েছিলেন’ ‘বাগচী স্যরের’ জন্য। স্যর তাঁকে বলেছিলেন, ইমিডিয়েটলি মেয়ের চিকিৎসা করান। হ্যাঁ এই হলেন সমর বাগচী স্যর। অথচ তিনি নিজের অসুখের কথা, শারীরিক কষ্টের কথা কারওকে প্রায় বলতেনই না।বি আই টি এমের অনুষ্ঠানে বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ বলেছিলেন, “এই ধরণের মানুষ আনফরচুনেটলি খুব কম। আরও বেশি হলে হয়ত সমাজ আরও উপকৃত হত।”
সেদিনও স্যর হাত ধরে আমার সঙ্গে কথা বললেন গাড়িতে উঠতে উঠতে। সেখানে দেখা হয় হাওড়া বিজ্ঞান চেতনা সমন্বয়ের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে। এঁরা স্যরের খুব কাছের। এবং আমার সঙ্গেও এঁদের একটা নিকট সম্পর্ক আছে। দিন তিনেক আগে স্যর চলে যাওয়ার পর ওই সংস্থার কর্ণধার প্রদীপ দাসের সঙ্গে শুধু স্যরকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। বললেন, “১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু যখন এসেছিল, তখন বিড়লা মিউজিয়াম হ্যালির ধুমকেতু দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। তখন আমি সবে এই বিজ্ঞানের জগতে ঢুকেছি। সেই সময়ে আমার ওঁকে প্রথম দেখা। একজন মানুষ, যিনি দৌড়ে একবার ছাদে যাচ্ছেন একবার নিচে নামছেন। কোনও সমস্যা হয়েছে কিনা দেখে তার সমাধান করতেন। এর পর অল ইণ্ডিয়া অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমার্স মিট, সারা ভারত জুড়ে অপেশাদার আকাশপ্রেমীদের সংগঠন, তার যে মিট, সেটা আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজে করেছিলাম। সেই মিটটার জায়গা খোঁজার জন্য আমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছেন কখনও নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম, কখনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। এরপর একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে সংগঠন করার পরে। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ওঁর সঙ্গে করি এবং শিখি যে বিজ্ঞান কিভাবে ডেমনস্ট্রেট করতে হয়। সমর বাগচী স্যর মারা যাননি সেটা আমাদের প্রমাণ করতে হবে। সমর বাগচী স্যরের থেকেও অনেক বড় মাপের বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান প্রচারক অনেক আছেন, ওঁর থেকে বড় মাপের শিক্ষিত মানুষও অনেক আছেন। যেটা নেই বা যেটার আমরা অভাব বোধ করব, তা হল একজন মানুষের ভেতর এতগুলো গুণের সমাহার আর সমস্ত মানুষের সঙ্গে হেসে তার সঙ্গে বন্ধুর মত কথা বলা। এটা হচ্ছে সবথেকে বড় কথা। আর সারাক্ষণ মুখের মধ্যে হাসিটা বজায় থাকত আর ছিল কাজের প্রতি ডেডিকেশন। প্রতিটা ক্ষেত্রে আমরা মানুষকে সম্মান দিতে ভুলে যাচ্ছি। সমর বাগচী স্যর সকলকে সম্মান দিতে জানতেন। সেই অন্যকে সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের ওঁর কাছ থেকে শেখা উচিত।”
মাথায় কোনও প্রশ্ন ঘুরপাক খেলে স্যরকে ফোন করতাম। কোনও নতুন বই পড়লে বা খবরের কাগজে কোনও ভাল আর্টিক্ল পড়লেও তো ফোন করতাম। হয়ত তখন তিনি বেরোবেন, “হ্যালো মঞ্জিস, এখন আমি খেলাঘরে যাব একটু। সন্ধেবেলা কথা বলব।” প্রসঙ্গত বলে রাখি উনি মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতিষ্ঠান খেলাঘর এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সন্ধেবেলা উনি নিজেই কল ব্যাক করতেন। তারপরেই দীর্ঘ ফোনালাপ। কখনও বিরক্ত হয়ে বলেননি, এবার রাখো, আমার কাজ আছে গোছের কিছু। এত কাজের মধ্যেও আমার কথা খেয়াল রাখতেন, ভাবলে অবাক লাগে। কখনও নিজেও ফোন করে অনেক কথা ভাগ করে নিতেন। তাতে থাকত, পরিবেশ, দিনকাল, দেশ, বিশ্ব, রাজনীতি, সমাজ, মার্কসবাদ, ডিকেন্স, মার্ক টোয়েন, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, নেহেরু, অরুণ মিত্র, বিষ্ণু দে, মৈত্রেয়ী দেবী আরও কত কথা। কখনও কোনও মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন না আদ্যন্ত উদার এই প্রকৃত জ্ঞানী মানুষটি। আবার দেশে, রাজ্যে, শহরে, গ্রামে কোথাও অনাচার দেখলেই স্থির থাকতে পারতেন না। প্রতিবাদ করতেন জোড়ালো ভাবে। মার্ক টোয়েনের কথা উদ্ধৃত করে বলতেন, “Civilization is a limitless multiplication of unnecessary necessities.” আসলে উনি তো ভোগবাদের প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন।
যাদবপুর অবসরিকায় ওঁর ‘বিজ্ঞান ইতিহাসে’ বইয়ের উদ্বোধনে গেছি। অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন মনে করে। তাই আমিও অপেক্ষায় ছিলাম ওই সন্ধেটার। সেটা গত বছর হেমন্তের কোনও এক দিন। অনেকক্ষণ আগের থেকেই গিয়ে বসেছিলাম। সেখানেও এসেছিলেন অনেক অসাধারণ মানুষ। এসেছিলেন অভিজিত বর্ধন, শুভাশিস মুখোপাধ্যায় আরও অনেকে। দেওয়ালে টানানো ফ্লেক্স থেকেও আলো ছড়াচ্ছিল স্যরের হাসিমুখ। স্যর আসার পর ঘরের কৃত্রিম আলোগুলো ম্লান হয়ে গেল ওঁর আলোয়। অনেকে অনেক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন স্যরের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। একজন বললেন হাতে কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে স্যরের অবদানের কথা।
সমর বাগচী স্যর বাচ্চাদের বিজ্ঞান শেখানোর জন্য প্রথম থেকেই কাজ করে আসছেন। অনেকেই জানেন যে স্যর ১৯৮৩-৮৮ দূরদর্শনের পর্দায় ‘কোয়েস্ট’ নামের বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন। সারা দেশ জুড়ে প্রায় ৩০০ কর্মশালা করেন শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্য। লক্ষ্য ছিল ক্লাসঘরে সাধারণ জিনিসপত্র দিয়ে সহজভাবে বিজ্ঞানশিক্ষা। এরপর স্যরের নিজের কাছ থেকেই আমরা শুনলাম ১৯২৩ সালে “National Muslim University of Aligarh” এ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের দ্বিতীয় কনভোকেশনের বক্তৃতার কথা। তিনি বললেন “ওই লেখা পড়েই আমার হিস্ট্রি অফ সায়েন্সের প্রতি ইন্টারেস্ট বিরাট বেড়ে গেল।” স্যর জানালেন যে ওখানে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলামের যে কন্ট্রিবিউশান, তা তুলে ধরেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। স্যর ‘বিজ্ঞান ইতিহাসে’ তেও লিখেছেন, “আমি যখন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের ১২৫ তম জন্ম বার্ষিকীতে একটা প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করার সময় আচার্যের জীবনী নিয়ে পড়াশুনো করছি তখন এই বক্তৃতার খবর পাই। কলকাতায় এই বক্তৃতার হদিস না পেয়ে আমি বহু লেখালিখি করে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন লাইব্রেরিয়ানের কাছ থেকে এই বক্তৃতার কপি পাই।” তিনি আরও লেখেন, “আজ একদল মূর্খ ইসলাম নিয়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করছে তাদের এই বক্তৃতা পড়তে বলব।” এই অনুষ্ঠান হবার মাসকয়েক আগেই স্যর আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ‘কপোতাক্ষ’ পত্রিকার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ওপর বিশেষ সংখ্যা।
ওই অনুষ্ঠানের শেষে স্যর আমার পাওয়া ‘বিজ্ঞান ইতিহাসে’ বইটির প্রথম পাতায় লিখে দেন ‘আমার প্রিয় মঞ্জিসকে’। মুখে হাসি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওখানে উপস্থিত অনেকের সঙ্গে কথা বললেন। আমার হাত ধরে বসলেন। বাড়ি ফিরেছিলাম ওঁর স্পর্শ নিয়ে, ওঁরই সৌরভ নিয়ে। এর আগে আরেক জায়গায় মীরা সংঘমিত্রার মিটিং এও তিনি কাছে ডেকে নিয়ে হাত ধরে বসেছিলেন।
ওই স্পর্শের খোঁজে এখন পাতা ওলটাই ওঁর নিজের লেখা এই বইয়ের। ছুঁয়ে দেখি ওঁর দেওয়া পুরোনো বই যার মধ্যে আছেন টলস্টয়, বালজাক, দস্তয়ভস্কি, কডওয়েল আরও অনেকে। সেই শীতের সন্ধেটাও মনে রাখার মত। আমি, মা, মাসি, মেসো গিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে।এখানেও ওঁর সঙ্গে নানান বিষয়ে কথাবার্তা, উষ্ণতা বিনিময়, খাওয়া দাওয়া, ওঁর পড়ার ঘরে বই দেখা, এসবের মধ্যে কখন যে বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এল বুঝতেও পারলাম না। উপহার পেলাম বেশ কিছু বই। এই বইয়েরা অনেকেই তো ওঁর যৌবনের সঙ্গী, এখন আমার।
খবরটা এল সকালবেলায়। সমর বাগচী স্যর আর ফিরবেন না। বেশ কিছুদিন ধরেই ওঁর শরীরের অবস্থা খারাপ ছিল।কিন্তু এই দিনটার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিলনা একেবারেই। সেই মুহূর্তেই ছুটে যাই রানিকুঠিতে ওঁর বাড়ি। শুয়ে ছিলেন খাটে। নীরব, নিথর হয়ে যাওয়া স্যরের দিকে চেয়ে থাকতে পারছিলাম না, দেখছিলাম বাইরে বিষণ্ণ গাছেদের পাতাদের। একটি গাছের পাতা অসময়েই তার সবুজ হারিয়েছে! তাহলে কি ও বুঝতে পেরেছিল? অনেকেই এসেছিলেন। স্যর তো অনেক মানুষজনকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। সেজন্যই মনে হচ্ছিল এক্ষুণি উঠে বসে বলবেন, “আরে! তোমরা এতজন এসেছ! এসেছ যখন আজ আমার এখানে আমার সঙ্গে দুপুরের খাওয়াটা সেরে যাও।” ওঁর বাড়িতে যেই ভদ্রমহিলা বিভিন্ন কাজকর্মে সাহায্য করেন, তাঁর চোখে জল। বাইরে বোঝা না গেলেও অনেকেই হয়ত মনে মনে কাঁদছিলেন।স্যরের অনেক সহকর্মী, বন্ধুস্থানীয় মানুষ এবং আরও অনেক মানুষেরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, যাদের একটা অংশ হয়ত স্যরের সঙ্গেই কোথাও চলে গেছে। স্যর যে ঘরে নীরবে শুয়েছিলেন সেখানেই বইয়ের তাকে দেখলাম রবীন্দ্র রচনাবলী। এই সময়েও তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুর পর কোনও জীবন থাকেনা, কিন্তু যদি থাকত! স্যর যদি এমন কোথাও যেতেন যেখানে হয়ত তাঁর দেখা হত গান্ধী, মার্কস ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। তাঁরা অনেক গভীর বিষয়ে আলোচনায় বসতেন। স্যরের কন্যা এবং নাতনি অনেক কথা বলছিলেন স্যরের বিষয়ে। ‘বাবা অলওয়েজ এনজয়েড হিজ লাইফ’ বলছিলেন তাঁর কন্যা। আরও অনেকেও এই একই কথা বলেছিলেন। শীত, গরম, ব্যথা, জ্বর, জ্বালা কোনোকিছুকেই গ্রাহ্য করেননি স্যর। কেওড়াতলা শ্মশান পর্যন্ত গিয়েছিলাম স্যরের সঙ্গে। সেখানেও শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন অনেক বিদগ্ধ মানুষ। দেখা হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক পুনর্বসু চৌধুরীর সঙ্গে। দু চারদিন পরে স্যরের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বললেন, “ওঁকে আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি। আমার আরেকজন শিক্ষাগুরু ছিলেন মিহির সেনগুপ্ত এবং ওঁরা দুজনেই ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। মিহিরবাবু আমার ডায়রেক্ট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন এবং ওঁর (সমর স্যর) সঙ্গে আমার পরিচয় মিহিরবাবুর সূত্র ধরেই। পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি ওঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কলকাতায় একটা ক্লাইমেট স্ট্রাইক বলে ইভেন্ট অর্গানাইজ করা হয়েছিল। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। সমর বাগচী স্যর ছিলেন, মেধা পাটকর ছিলেন। গ্রেটা থুনবার্গরা যখন সারা পৃথিবীব্যাপী ক্লাইমেট স্ট্রাইক শুরু করেছিল, সেই মডেলটাতেই কলকাতাতে সমরদার নেতৃত্বে আমরা এটা অবজার্ভ করেছি।” শ্মশানে স্যর শুয়েছিলেন আর অনেকে গাইছিল “…আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…” আমিও গলা মেলালাম। হঠাৎ মনে হল যেন স্যরের কণ্ঠও শুনতে পাচ্ছি। তিনিও গলা মেলাচ্ছেন অন্যদের সঙ্গে। সেই দ্য টেলিগ্রাফ ইন স্কুল্সের সাক্ষাৎকার নেবার পরে একবার বলেছিলেন, “আমি গান করিনা। কেউ গাইলে গলা মেলাই। তবে আমি শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গেই গলা মেলাই, অন্য কোনও গানের সঙ্গে গলা মেলাই না। ” আমার সঙ্গেও গলা মিলিয়েছেন দু একবার। শ্মশানেও হয়ত তিনি গাইছিলেন সবার সঙ্গে। তারপরেই সম্বিত ফিরল, যখন স্ট্রেচারে করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাড়িতে আসতে আসতে অটোর সিটে বসে টালিগঞ্জের রাস্তায় চলমান শহুরে যাপন দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, স্যর আছেন এখানেই কোথাও। বাড়ি ফিরে এসে ফোনে কন্ট্যাক্ট্সে দেখলাম ‘সমর বাগচী স্যর’, যদিও ওপার থেকে তিনি আর বলবেন না, “মঞ্জিস, তুমি কি কাল ফোন করেছিলে? এখন বলো।”। তবুও ওই নম্বরটাতে কল না করে শুধু কনট্যাক্ট ইনফো অপশানে গিয়ে ফোনটা কানে দিই, মনে হয় যেন খুব মৃদু গলায় শুনতে পাচ্ছি, “আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,/ দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে…”
এই লেখাটার ক্ষেত্রেও হয়ত মনে হবে স্যরকে দেখিয়ে নিলে কেমন হয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে একবারের কথা। সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরে স্যরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ডঃ সমর বাগচী লিখব না অধ্যাপক সমর বাগচী? তখন বললেন, “নো, নো, নিদার এ প্রোফেসর বাগচী নর এ ডক্টর বাগচী। আই অ্যাম অ্যান অর্ডিনারি বাগচী।” মনে মনে হাসলাম। স্যর যদি অর্ডিনারি হন, তাহলে এক্সট্রাঅর্ডিনারি কে! অনুবাদের কাজের সূত্রেই স্যরের সঙ্গে পরিচয়। সেই সম্পর্ক এত গাঢ়, এত উষ্ণ হবে হয়ত ভাবিনি। স্যর আমার যাপনের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ সময় বাড়ি থেকে যখন বি আই টি এম এ নিয়ে যাওয়া হল স্যরকে, ওঁর নাতনি বলেন, দাদু অফিস গেল। আসলে স্যর আমাদের সঙ্গে রয়েছেন কোনওভাবে।
স্যর, কেন চলে গেলেন? আপনার ফোনের অপেক্ষায় আছি। মনে হয় আপনি হয়ত কোনও কাজের সূত্রেই অনেক দিনের জন্য বাইরে গেছেন। শরতের দিনে ফোন করে বলবেন, মঞ্জিস, জানো ওদের ওখানে একটা অসাধারণ ব্যাপার দেখলাম। দুপুরে ‘পুরোনো কাগজ’ বলতে বলতে হাফিজুল যখন উদাস হেঁটে যায়, বিকেলে যখন স্কুলবাস থেকে নেমে ঝুমঝুম দৌড়ে মায়ের কাছে যায়, যখন শহুরে সন্ধ্যার আকাশেও হঠাৎ দেখা যায় তারাদের, সব কিছুর মধ্যেই আপনাকে পাই স্যর। আমার মতই আপনার অপেক্ষায় জেগে থাকবে কদম, কাশ কিংবা পলাশ। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, ধানজমি, পুকুর, মেঠো রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবে আপনার কাছেই। আপনি তো বাঁকুড়া যাবেন বলেছিলেন। আমি বাঁকুড়ায় যাবার পর বলেছিলেন যাবেন। ওখানেও ফোন করেছিলেন। বাঁকুড়ার কোনও বায়েদ জমির পাশে সাইকেল দাঁড় করিয়ে দেখব, মাঠ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছেন, “আকাশ- ভরা সূর্য- তারা” গাইতে গাইতে।