বিভিন্ন কারণে জোশিমঠবাসীদের তাদের অনন্তভূমিটি নিয়ে গর্বের সীমা ছিল না। প্রথম কথা, আদিগুরু শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষের চারটি জ্যোতির্মঠের প্রধানতমটি হল জোশিমঠ। প্রাচীনকাল থেকেই এটি সুবিদিত। অন্য তিনটি অবস্থিত হরিধাম, দ্বারকা ও শৃঙ্গেরিতে। তা ছাড়াও জোশিমঠ হল বদ্রীনাথ ধাম ও শিখ তীর্থক্ষেত্র হেমকুণ্ড সাহিব-এর প্রবেশদ্বার । অধিকন্ত, শীতকালে বাবা বদ্রীনাথ (বিষ্ণু) ভগবান নরসিংহ রূপে জোশিমঠের নরসিংহ মন্দিরে অধিষ্ঠান করেন। স্বভাবতই জোশিমঠ শহরের গুরুত্ব অসীম। শ্রদ্ধালু জনগন জোশিমঠকে সেভাবেই দেখে থাকেন। তদুপরি সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী, ধরচুলা, মুনসিয়ারি ও জোশিমঠের মধ্যে জোশিমঠই সর্বাপেক্ষা স্পর্শকাতর এলাকার মধ্যে পড়ে। কারণ ভূমি দখলে আগ্রাসী চিন-এর এলাকা থেকে জোশিমঠের দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার। এবং প্রায়ই তাদের অকারণ হামলার সামাল দিতে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে তৈরি থাকতে হয়।
এমন এক সময় হঠাৎ করে জোশিমঠ শহরের সর্বত্র বীভৎস আকারের ফাটল দেখা দেওয়ায় প্রশাসনের মাথায় হাত। আসলে মাথায় হাত দেওয়া প্রশাসনের কাছে এক প্রকার লোক-দেখানো অজুহাত ছাড়া অন্যকিছু নয়। এমনটা যে কোন একসময় ঘটতেই পারে তা তারা বিলক্ষণ জানতেন।
জোশিমঠ শহরের নড়বড়ে অবস্থান ও তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি নিয়ে সতর্কবার্তা বহু বছর পূর্ব থেকেই জারি ছিল। কিন্তু না প্রশাসন, না স্থানীয় জনগণ, না রাজনীতিবিদ কেউই সে সতর্কবার্তায় প্রভাবিত হয়নি। বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। ১৯৭৬ এ সব দিক খতিয়ে দেখে মিত্র কমিশন এক বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে। তাতে বিশেষভাবে বলা হয়, কোনো বড়োসড়ো নির্মাণের কাজ নেওয়ার উপযোগী নয় জোশিমঠ ও তার আশপাশ। ওই এলাকায় অরণ্যভূমি বিনষ্ট করা বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কোনো কারণেই হাতে নেওয়া যাবে না। সে সতর্কবার্তাকে কোনো পক্ষই গুরুত্ব দেয়নি।
আরও দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, পুরনো জোশিমঠের ছোট্ট পরিসর বাড়তে বাড়তে সহসা এক ভয়াবহ আকার নেয়। তার কারণ ততদিনে শহরটি রোজগার এর স্বর্ণখনি হয়ে ওঠে। পুরনো শহরটি মূলত জ্যোতির্মঠের চিহ্নিত বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল পরে যা গড়ে ওঠে তার পুরোটাই যে এক ভূমিধস এর উপর নির্মিত হচ্ছে তা কেউই খোঁজ করে দেখেনি। তখন সেভাবে পরিষেবা বা নজরদারিও চালু হয়নি। ফলে কয়েকটা পাথর ফেলে বৃহৎ অট্টালিকা সঠান সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কেউ বলার বা দেখার ছিল না। মিত্র কমিশনের কাছেও সব গল্প জমা পড়েনি। সুতরাং প্রায় পঞ্চাশ বছর পর (১৯৭৬-র পর) বর্তমানে যা ঘটছে তা বহুকাল পূর্বেই ঘটার কথা ছিল। ঠিক একই জিনিস ঘটেছে কেদারভূমির ছোট্ট এক টুকরো জমিতে। যাকে ২০১৩-র মহা বিপর্যয় বলে প্রশাসন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এরই মধ্যে একটা আলগা খবর হল, কর্ণপ্রয়াগ ও রুদ্রপ্রয়াগেও নাকি ছোটো মাপের ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে।
একটা গোটা শহর আচমকা মাটিতে বসে যাচ্ছে বা ভূগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে এর তো একটা কারণ থাকবে। মূল কারণ হলো ভূমি।দুর্বল ভূমিকে নিজেদের আখের গোছাতে দিনের পর দিন দুর্বলতর করার প্রক্রিয়া চলে আসছে বহু বছর ধরে। মুখ তুলে কথা বলার কেউ নেই। এমন দেদার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? করেনি কেউই -ই। সত্যি বলতে কি সারা শহরের জল নিকাশি ব্যবস্থা বলে কোথায় কিচ্ছু ছিল না। খোলা নর্দমা দিয়ে এনতার নোংরা জল বেরিয়ে হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ত। পরার জায়গা বলতে সেই মা অলকানন্দা। এ ছাড়াও ভূগর্ভস্থ জল ফাঁকফুকর পেলেই মাটির উপর উঠে আসতো। তার প্রভাবে কখন যে ভূমির তল দেশ ধীরে ধীরে ফোঁপড়া হয়ে পড়ছিল কেউ নজর করে দেখেনি – যাদের দেখার কথা তারাও না ।ওই নড়বড়ে ভূমিতে গড়ে উঠেছে দালানবাড়ি, হোটেল ও বৃহৎ ইমারত।
অনেকেই এন.টি.পি.সির সুড়ঙ্গ খনন করতে মহুর্মুহ ডিনামাইট ফাটানোকে ভূমিধস এর জন্য দায়ী করছে, যদিও তা প্রমাণিত হয়নি। সারা শহরের প্রতিটি ঘরে বিভিন্ন ধরণের ফাটল যার মধ্যে সেনা ছাউনি বর্তমান।সাধারণ মানুষ জোশিমঠ কে কেবল বদরিনাথ ধাম ও হেমকুন্ড সাহিবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তারা জানেই না, সীমান্তের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জোশিমঠ এর গুরুত্ব অপরিসীম। সীমান্তে সময় মতো সরবরাহ জারি রাখতে প্রয়োজন পড়ে উপযুক্ত রাস্তার। তাই করতে গিয়ে কেন্দ্র সরকার চারধাম প্রকল্পের নামে এক্সপ্রেস ওয়ের ধাঁচে জাতীয় সড়ক বানানোর কাজ হতে নিয়েছে। তাই-ই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে মূল বিপদের কারণ।কারণ সেই ভূমি। হিমালয়ের শিবালিক ও নিম্ন হিমালয় অঞ্চল( যা চারধাম প্রকল্পের মধ্যে পড়ে) যথেষ্ট পলকা।ওই ভূমি বৃহত পথনির্মানের জন্যে উপযুক্ত নয়।করলেও নিখুঁত হোমওয়ার্ক করতে হয়। এলাকার মানুষজনের ধারণা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে প্রশাসন।ফলে বিস্তর বিপদ দেখা দিতে শুরু করেছে।
প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ শহর খালি করতে বাধ্য হচ্ছে, বিশেষ করে জোশিমঠ কে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করার পর। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষের সামনে আসছেন না, যা করার পুলিশ ও আমলারাই করছেন। মানুষ চায় ক্ষতিপূরণ।সরকার সম্মত হলেও কবে কি পরিমান ক্ষতিপূরণ হাতে আসবে তা নিয়ে ধন্দে জনগণ।
তবে পরপর কমিটি গড়ে আলোচনা চলছে- কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও নাকি সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলে জানা গিয়েছে।কিন্তু তা থেকে কি সিদ্ধান্ত উঠে এল তা জানার কোনো উপায় নেই। শুধু অপেক্ষায় আছেন সাধারণ জনতা- তবে তা উঠে দাঁড়ানোর না তলিয়ে যাওয়ার সেটা তাদের কাছে এখনও পরিষ্কার নয়।
এরই মধ্যে আচমকাই এক সংবাদ বিস্ফোরণ ঘটলো ১৪ই জানুয়ারি সামনে এলো মত যোশীমঠ সংক্রান্ত এক তাজা ও ভয়ঙ্কর খবর। ইসরোর উপগ্রহ চিত্র থেকে জানা গেছে ২৭ ডিসেম্বর( ২০২২) থেকে ১৮ জানুয়ারি (২০২৩) পর্যন্ত মাত্র ১২ দিনে যোশীমঠের জমি বসেছে ৫. ৪ সেন্টিমিটার। স্যাটেলাইট চিত্র থেকে পরিষ্কার যে যোশীমঠ - আউলি রোড দ্রুত ধসে যাবে। তার অর্থ হল যোশীমঠ শহরের এক বিশাল অংশ ভেঙে অলকানন্দায় গড়িয়ে পড়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। পুরোপুরি না হলেও আড়াই হাজারের মধ্যে দুহাজার ঘরের মানুষজন ইতিমধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ের সরে গিয়েছে - এটাই রক্ষে।
কিভাবে বা কার মদতে এমন দুর্বল ভূখণ্ডে পাঁচ সাত তলার হোটেল গড়ে উঠেছে তা নিয়ে রাজ্য সরকার নিরব। সেসব ভেঙে ফেলতে নয়ডার টুইন টাওয়ার খসিয়ে ফেলার মাথা সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বেনী প্রসাদ কানুনগোকে আনা হচ্ছে। কারণ জেসিপি দিয়ে ভাঙতে গেলে নিচের ধাপের বাড়িঘর ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।
অর্থাৎ ছবিটা স্পষ্ট সরকারের কোন প্রয়াস ই আর সফল হওয়ার নয়। অযথা এনটিপিসির তপবন বিষ্ণু গর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে বিভীষণ ঠাওরানর অর্থ নিজেদের অপরাধ ঢাকতে তৎপর হওয়া সেটাই ঘটে চলেছে বহু বছর ধরে। এক অসৎ ও অসাধু চক্রের ফাসে পড়ে শহরটা অনেকটা অনেক আগেই ডুবতে বসেছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়টা হলো এমন একটা প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ ধর্মীয় স্থানের এ হেন দুরবস্থা চিন্তার অতীত হয়ে থেকে যাবে হয়তো - বা আরো দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো ইসরো প্রদত্ত খবরটা বেমালুম ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। কী বলবেন আপনারা?