নেহাৎ-ই ঘরোয়া একটা বাচ্চাদের কুইজের আসর ছিল সেটা। আজকাল যেমন হয় আর কি! ক্যুইজ মাস্টার একটা করে প্রশ্ন করছেন আর তার চারটে করে উত্তরের ‘অপশন’ দিচ্ছেন। কৌন বনেগা কড়োরপতি স্টাইল। তার মধ্যেই একটা প্রশ্ন ছিল ‘উত্তরবঙ্গের একটি অভয়ারণ্যের নাম বলো?’ চারটে বিকল্প উত্তর কী কী ছিল তা আজ আর মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, যে মেয়েটিকে প্রশ্নটা করা হয়েছিল, সে ওই ‘অপশন’-গুলোর দিকে একবারও না তাকিয়ে সপাটে উত্তর দিয়েছিল – ‘আমি জানি না’। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর দর্শকাসনে বসা মেয়েটির মা তাকে এই মারেন কি সেই মারেন। তাঁর বক্তব্য ‘এভাবে সরাসরি জানি না বলার দরকার কী? চারটে উত্তরের মধ্যে আন্দাজে একটা বলে দিলে তো নম্বর পেয়ে যাবার একটা চান্স থাকত। এরকম বোকামির কোনো মানে হয়?’
কাট টু। খুব সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তরের আয়োজিত ‘স্টেট অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে’ তথা পরীক্ষার অষ্টম শ্রেণির একটি পরীক্ষা-কক্ষ। প্রশ্নপত্রে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর খান পঞ্চাশেক সেই মাল্টিপল চয়েস বা এম সি কিউ। প্রতিটি প্রশ্নে চারটি করে উত্তরের বিকল্প। পরীক্ষার্থীদের কেবল সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন দিতে হবে। দেখা গেল, জনা চল্লিশেক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে অন্তত দশ জন খাতার উপরে নিজেদের নাম আর রোল নম্বরটাও ঠিক করে লিখতে পারল না। অবিশ্যি উত্তর তারা একটাও খালি রাখেনি। প্রশ্ন পড়তে পাড়ুক বা না-পাড়ুক, সঠিক উত্তর জানা থাক বা না-থাক, কোনো একটা উত্তরে টিক দিয়ে দিতে কে না পারে!
লেখাটা ‘ডি-ফোকাসড’ হয়ে যাবার ভয় থাকা সত্ত্বেও বলি, কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের তরফে বিভিন্ন রাজ্যের বুনিয়াদি স্তরের পড়ুয়াদের নিয়ে যে ‘ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে’ (ন্যাস) করা হয়েছিল, তাতে পশ্চিমবঙ্গ উল্লেখযোগ্য রকম ভাল ফল করেছে। ভাষা জ্ঞান বা অঙ্ক – সবেতেই আমাদের রাজ্যের পড়ুয়ারা সবকটি রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। সেই সমীক্ষাও করা হয়েছিল ওই এম সি কিউ প্যাটার্নেই। সেই সমীক্ষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমাদের রাজ্যের পড়ুয়াদের জন্য পৃথকভাবে একটি সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেটাই ওই ‘স্টেট অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে’, সংক্ষেপে ‘স্যাস’। একবার একটি অনুষ্ঠানে অধ্যাপক অর্মত্য সেনকে বলতে শুনেছিলাম, “কোনো বিষয়ে আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য গবেষণা করার পদ্ধতিতে আমি বিশ্বাস করি না।” তো এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন দেখে পাপী মনে কিন্তু তেমনই একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল।
আলোচনাটা ছিল এম সি কিউ বা আজকাল মুখের ভাষায় যাকে বলে মাল্টিপল চয়েস – পরীক্ষা বা শিক্ষামূলক সমীক্ষা করার সেই পদ্ধতিটা নিয়ে। গুগল বলছে, এই মাল্টিপল চয়েসের উদ্ভাবক হলেন মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ এবং শিক্ষাবিদ বেঞ্জাবিন ডি হুড। মূলত একযোগে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষা নেওয়ার এবং ফলাফলের মধ্যে সামঞ্জস্য আনার লক্ষ্যেই এই পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে স্ক্যানার এবং ডেটা-প্রসেসিং মেসিন এসে যাবার সুবাদে এই পদ্ধতি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষত আমেরিকা এবং ভারতের মত জায়গায় – যেখানে যেকোনো সরকারী পরীক্ষাতেই বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে, সেখানে দ্রুত সুসমঞ্জস মূল্যায়নের জন্য এই পদ্ধতি খুবই কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয়। তারই ফলস্বরূপ আজ মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক হোক বা সরকারী চাকরির পরীক্ষা, ন্যাস হোক বা স্যাস, টেলিভিশনে রিয়ালিটি শো হোক বা পাড়ার ক্যুইজ কনটেস্ট – সর্বঘটের কাঁঠালি কলা হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে এই এম সি কিউ বা মাল্টিপল চয়েস।
অথচ বিভিন্ন দেশে শিক্ষাবিদেরা বারবার এই পদ্ধতির গুরুতর ত্রুটিগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রথম এবং প্রধান সমস্যা হল -- পরীক্ষার্থীদের আন্দাজে টিক মারার প্রবণতা। মানুষ নামক প্রাণীটি অন্যান্য প্রাণীদের থেকে বুদ্ধিমান, তাই শারীরবৃত্তিয় এবং চরিত্রগতভাবেই অলস। চালাকির দ্বারা মহৎকার্য সম্পাদনের দিকে তার ঝোঁক সবসময়ই বেশি থাকে। লেখার শুরুতে উল্লিখিত সেই মেয়েটির মায়ের মত আমরাও সকলেই বিশ্বাস করি যে সমানে যখন উত্তরের চারটি বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে, তখন সঠিক উত্তর জানা না থাকলেও আন্দাজে যে কোনো একটা উত্তর বেছে নিয়ে ‘লাক ট্রাই’ না-করাটা নেহাতই মূর্খামি। কারণ, থিওরি অফ প্রবাবিলিটি অনুযায়ী এইভাবে আন্দাজে টিক মারলে একটি উত্তরটি ঠিক হবার সম্ভাবনা মোটামুটি পঁচিশ শতাংশ। আর একশোটি প্রশ্ন সম্বলিত কোনো প্রশ্নপত্রে সবকটি উত্তর আন্দাজে দিলে মোটামুটি পঁচিশটা ঠিক হয়ে যেতেই পারে। কাজেই এই পদ্ধতিতে করা ন্যাশনাল বা স্টেট এলিজিবিলিট টেস্ট -- কোনোটার ফলাফলকেই যে সম্পূর্ণ ভরসা করা যায় না, তা বলাই বাহুল্য। এখানে আরও একটা মজার ব্যাপার উল্লেখ না করে পারছি না, ন্যাশনাল লেভেল এলিজিবিলিটি টেস্টের একটা নিজস্ব ওয়েব সাইট আছে। সেখানে পরীক্ষার সিলেবাস, পরিকাঠামো, বিস্তারিত (একেবারে জেলা-ওয়ারি) ফলাফল সবই পাওয়া যায়, কিন্তু খুবই আশ্চর্যজনকভাবে তন্নতন্ন করে খুঁজেও প্রশ্নপত্রের কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। কেন রাখা হয়নি ওয়েবসাইটে প্রশ্নপত্রের নমুনা? সমীক্ষা-পদ্ধতিতে এই গুরুতর ত্রুটিটা ধরা পড়া যাবার ভয়েই কি?
এখন প্রশ্ন হল, এম সি কিউ-ই কেন? এর থেকে সরাসরি একটা শব্দে উত্তরটা জানতে চাইলেই তো হয়। তাতে পরীক্ষার্থী সঠিক উত্তরটা জানে কিনা, তা অনেক নিশ্চিতভাবে যাচাই করা যায়। যখন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল, তখন বিরাট সংখ্যক খাতা দেখা অনেক লোকবল এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সেখানে অবশ্যই ও এম আর (Optical Mark Recognition) শীট ব্যবহার করে এম সি কিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে হবে। যেমন সরকারী চাকরির পরীক্ষা। এতে মূল্যায়ন অনেক নিঁখুত হয়। তবে অবশ্যই নেগেটিভ মার্কিং রাখতে হবে। এবং সম্ভব হলে ‘প্রাইজ মার্কিং’-এর সংস্থানও রাখতে হবে। অর্থাৎ যদি কোনো পরীক্ষার্থী কোনো উত্তরে আন্দাজে টিক দেবার বদলে প্রশ্নটা ছেড়ে দিল, কোনো উত্তর দিল না, সেক্ষেত্রে তাঁকে সততার পুরস্কার হিসেবে প্রশ্নে বরাদ্দ নম্বরের অর্ধেক দেওয়া হবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের জন্য যে ‘টেট’ নেওয়া হল, তাতে কিন্তু কোনো নেগেটিভ মার্কিং-এর সংস্থান ছিল না। এদিকে মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকের মত স্কুলের পরীক্ষাতেও থাকছে কুড়ি নম্বরের মত এম সি কিউ। কেন? কেনই বা বুনিয়াদী স্তরে ছাত্রছাত্রীরা কতদূর কী শিখেছে সেই বিষয়ে সমীক্ষা করার সময়ও সেই একই এম সি কিউ প্যাটার্ন ব্যবহৃত হবে? বিশেষত যখন সেই সমস্ত পরীক্ষার খাতা সম্পূর্ণ ‘ম্যানুয়ালি’ দেখা হয়। পরীক্ষার ফলাফলকে নিজেদের স্বার্থে ‘ম্যানুপুলেট’ করার কিছু গোপন উদ্দেশ্য না থাকলে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়।
মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রোজেক্ট বা প্র্যাকটিক্যাল বাবদ দশ বা কুড়ি নম্বর তো সংশ্লিষ্ট স্কুল থেকেই দিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এরপরও পাশ করার জন্য যে দশ-পনেরো নম্বরের দরকার, সেটুকুও যাতে ছেলেমেয়েরা আন্দাজে টিক দিয়ে অথবা ‘হল কালেকশনের’ মাধ্যমে জোগার করে নিতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। বলাই বাহুল্য, এভাবে ‘পাশের হার’ বাড়তে পারে, কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়ন এক বিন্দুও হয় না।
‘ন্যাস’ বা ‘স্যাস’-এর মত সমীক্ষার ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়। প্রাথমিক হোক বা মাধ্যমিক – যে কোনো স্তরের পড়ুয়ারাই কতদূর কী শিখেছে তা বুঝতে চাইলে যাদের নিয়ে স্যাম্পল সার্ভে করা হবে, তাদের একটা ঘরে বসিয়ে তাদের হাতে কিছু এম সি কিউ সম্বলিত একতা প্রশ্নপত্র ধরিয়ে দিলেই কার্যসিদ্ধি হয় না। শিক্ষা জিনিসটাকে ওইভাবে মাপা যায় না। কিছু শুকনো তথ্য বা ইনফরমেশন কখনোই জ্ঞানের সমার্থক হতে পারে না। এর জন্য ওয়ান-টু-ওয়ান ইন্টার্যাকশন চাই। সমীক্ষককে যথেষ্ট ধৈর্য আর পরীক্ষার্থীকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। রাখতে হবে একাধিক ‘ওপেন এন্ডেড’ প্রশ্ন। খুব অল্প কথায়, দু-চারটে বাক্য হলেও কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জায়গা রাখতে হবে। এককথায়, শুধু ‘অবজেকটিভ’ প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীর অধীত বিদ্যার মূল্যায়ন হয় না, কিছু ‘সাবজেকটিভ’ প্রশ্নও লাগে।
এ প্রসঙ্গে বুনিয়াদী স্তরের শিশুদের শিক্ষার মান নিয়ে করা খুব বড় আকারের আরেকটি সমীক্ষার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দি অ্যানুয়াল স্টান্ডার্ড অফ এডুকেশন রিপোর্ট (সংক্ষেপে ASER) নামের এই সমীক্ষাটি এই বছরই করা হয়েছে। এতে সারা দেশের প্রায় ছ’লক্ষ শিশুকে নিয়ে সমীক্ষাটি করা হয়। কিন্তু বাচ্চাদের হাতে এম সি কিউ বোঝাই একটা প্রশ্নপত্র ধরিয়ে দিয়ে নয়, সমীক্ষাটি করা হয়েছে স্কুলে স্কুলে এবং বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, ওয়ান-টু-ওয়ান ইন্টার্যাকশনের মাধ্যমে। সমীক্ষার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন তিরিশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এই ‘ASER’-এর সমীক্ষার ফলাফল কিন্তু ‘ন্যাস’-এর সঙ্গে একেবারেই মেলে না। সেই ফলাফল যথেষ্ট হতাশাজনক। এতে করে একটা সহজ অনুসিদ্ধান্তে কিন্তু আমরা সহজেই পৌঁছতে পারি – শিক্ষার মান যাচাইয়ের জন্য যে সমীক্ষা, তা যত বড় আকারেই হোক না কেন, এম সি কিউ ছাড়াও তা করা সম্ভব এবং তাতে ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি হয়।
এম সি কিউ সম্পর্কে মতামত দিতে দিয়ে দার্শকিন জ্যাক দেরিদা খুবই তির্যক একটা মন্তব্য করেছিলেন -- “while the demand for dispensing and checking basic knowledge is valid, there are other means to respond to this need than resorting to crib sheets.”
এহো বাহ্য, আগেই কহি – এম সি কিউয়ের এত রমরমার কারণে তুলনামূলক শিক্ষার্থীরাও আজকাল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-অনুসন্ধানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কারণ তারা দেখতে পাচ্ছে যে স্নাতক স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ভবিষ্যতে চাকরি-বাকরির কোনো পরীক্ষাতেই আর তার দরকার পড়বে না। শুকনো কিছু ইনফরমেশন দিয়েই কাজ চলে যাবে। এইভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রশ্ন করার, উত্তর অনুসন্ধান করার, গবেষণা করার মনোবৃত্তিগুলোকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই এম সি কিউ-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা? ভবিষ্যতের কোনো বিপন্ন মুহূর্তে, যখন ভেবেচিন্তে কোনো জটিল সমস্যার সমাধান করতে হবে কিংবা কোনো বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে – তখন জীবন আমাদের সামনে প্রতিটা সমস্যার জন্য চারটে করে ‘অপশন’ রাখবে তো? কী জানি…