জয়িতা ভট্টাচার্য
বর্ণমালা র সাতকাহন : সপ্তম পর্ব
যাত্রাপথের প্রম্পটার
রাজবাড়ির অন্দরে ঘুণপোকা। গুজগুজ ফুসফুস সারা দেশ রানীসাহেবার হাতে লেগেছে রক্ত নিজের ঔরসের রক্ত রাঙা হাত শাসন করছে দেশ।
অতি শৈশব ধূসর স্মৃতি উচ্চারণ করে ।সাপের মতো কুয়াশা অন্ধ গলিতে ঘুরপাক।সাম্রাজ্যবাদ চক্রাকার আবর্তিত হচ্ছে ঘর থেকে উঠোন হয়ে দেশময়।
আমার আদর্শ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর লাল গোলাপ ঢাকা দেহ শায়িত ,অন্যদিকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস। এমনকি কলকাতেও বিশেষ রাজ্যের মানুষগুলির লাশ পড়ছে। আমি ইতিহাস পড়ছি।মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি, অশোক ও বৌদ্ধধর্মের কথা।পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা মেলাতে পারছি না।ইংরেজরাও এমন করেই নাকি নির্দোষ ব্যক্তিদের হত্যা করেছিল।
আমি আজ অবধি অবশ্য কোনো স্বাধীন মানুষ দেখিনি আক্ষরিক ভাবে।
কষ্ট আমারও হচ্ছিল, রাগ আমারও হচ্ছিল। সব চিঠির আকারে আমার ডায়রিতে লিখছি।
একটা দৃশ্য মনে ছবি হয়ে আছে।জনহীন ধ্বংস উৎসবের পর পলাশীর প্রান্তরে একা এক বৃদ্ধা ন্যুব্জ নারী দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে।
নীলপাড় শাড়ি।তাঁর সম্পর্কে যেমন অনেক কু কথাও শুনতাম,যা সত্য হতেই পারে কিন্তু এই দৃশ্যটাও যে সত্য তাও তো ঠিক।
একবার আমাদের পাড়ায় বিদেশি বিনিয়োগ পোষিত চোখের হাসপাতাল পরিদর্শনে তিনি এসেছিলেন।বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম।কাছে ডেকে আদর করেছিলেন।কিছু কথা টুকটাক, মনে নেই।তিনি মাদার।মাদার টেরেসা।
ছোটোবেলা সাদাকালো ছিলো না অনেক রং খেলা করত চারিদিকে।
মৃতদেহের উজ্জাপনের পেছনে চলেছে গনিত। এক নিষ্পাপ সতেজ মুখ।কলুষহীন।মিলছে সব।তবুও কি সম্পূর্ণ কলুষহীন হতে পারে!
তবু মূর্খ ধর্মভীরু ধর্মবিভক্ত মানুষের সেন্টিমেন্ট উস্কে দিয়ে রাজ্যাভিষেক হয়ে যায়। যা হবে পরে দেখা যাবে গোছের ব্যাপার।বাড়িতে কানে যেত একজনের নাম।চানক্য।
ছোটোবেলায় গ্রামের সেই যাত্রাপালায় রানীর অল্প গোঁফ আর মাঝে অন্ধকারে বিড়ি খাওয়া।ধারে বসে কিছু মানুষ উচ্চকিত বাজনার মধ্যে বিড়বিড় করে সংলাপ বলছেন সেই সংলাপ যা স্টেজে বলা হচ্ছে।এভাবে আমার মনে হতো অসম্ভব অভিনয় করা।তাঁরা প্রম্পটার।
যাত্রা ছাড়াও প্রম্পটার এর কাজ করেছে বন্ধু রা পরীক্ষার হলে পরের দিকে।
নতুন ক্লাসে এখনের মতোই জানুয়ারি মাসে আসত নতুন বই খাতা।বাবা মলাট দিতেন আমি গন্ধ শুঁকতাম। ফুলের চেয়ে প্রিয় নতুন সেসব বইয়ের গন্ধ। ক্লাস শুরুর আগেই বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের বই পড়া শেষ হয়ে যেত। আবার স্কুল।কেউ কেউ নতুন। তাকে ঘিরে আলাপের পালা।
এর মধ্যে ক্লাস থ্রি তে আমার প্রিয় বন্ধু সুমনা স্কুল ছেড়ে চলে গেল আর ক্লাস ফোরে আরেক প্রিয়বন্ধু তিথি প্রখ্যাত সাহিত্যিকের কন্যা,চলে গেল পড়তে শান্তিনিকেতনে।
আবার একা হলাম স্কুলে।একা একা উদাস মাঠে ঘোরাঘুরি।ঠিকানা? নেওয়া হয়নি। মনে পড়ে ওদের।কেমন আছে কোথায় জানি না।
সেই সময় প্রতি রাতে বোমার আওয়াজ, সকালে প্রায় লাশ মিলত খালে।গড়িয়ার আদি গঙ্গার পচা জল।
নতুন বাস এলো। প্রশান্ত সূর এসেছিলেন।বাবাকে উদ্বোধনে ডাকা হলো।আমি পাশে।
মিস্টার দোকানে তখন এই পাড়ায় তৈরি হতো ঢাকাই পরোটা।বিরাট বড়ো গোল মুচমুচে সঙ্গে ছোলার ডাল,লাল দই ,পয়ধি।
সেদিন ফেরার সময় বাবা কিনলেন ঢাকাই পরোটা।
বাজারে সেই সময় বিরাট বিরাট কাছিম আসত।ওটা দেখার জন্যই মূলত বাবার হাত ধরে বাজার যেতাম ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের লাল সাজিব্যাগ নিয়ে।বিক্রেতারা মামনি বলতেন।কেউ একটা আলু,দুটো লঙ্কা, একটা পাতিলেবু স্নেহ করে ভরে দিতেন কোনো দাম ছিলো না তার।
মন পাল্টে গেছে সবার।সঙ্গতিও।
সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসলেই সন্ধ্যাপিসী প্রচণ্ড টাইট করে লাল ফিতে আর কালো দড়ি দিয়ে কলা বিনুনি, কখনো দোলা বিনুনি করে দিত।খুব লাগত।
মাথায় ডাবর আমলা অথবা নারকোল তেল।কিন্তু আমার প্রিয় ছিল লাল রঙের একটু চিটচিটে জমাকুসুম। গন্ধ টা সুন্দর নাকে লেগে আছে।
শীতকালে মায়ের জন্য বাবা আনতেন নিভিয়া ক্রিম।আর বালিগঞ্জ বাড়িতে দাদা আনতেন সুন্দর লম্বাটে বোতলে তুহিনা।জানি না তুহিনা পাওয়া যায় কিনা।(ক্রমশ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।