বর্ণমালার সাতকাহন : ষষ্ঠ পর্ব :
জয়িতা ভট্টাচার্য
নদী ও নারী
বালিগঞ্জ বাড়িতে থাকাকালীন এসেছিল আমার এক বোন। সে আমাকে একেবারে অজ্ঞ দেখে নারীর রজঃশলা হয়ে ওঠার বিষয়টা প্রথম আলোকপাত করে।আর ঠিক তার পরদিন কাকতালীয় ভাবে আমার প্রথম ঋতুমতী হওয়া।
আমি যেহেতু ছেলেদের সঙ্গে মিশে গ্রামের পথে বড় হয়েছি আমি অভিজ্ঞ ছিলাম কিভাবে বিভিন্ন গাছে ওঠার বিভিন্ন কায়দা,জানতাম পাখিদের নাম,সাপ ,কচুরিপানা ফাটানো সেই মেয়েটি,আমি, বলা বাহুল্য বিব্রত হয়েছিলাম এই ঘটনায়
।বিরক্ত। তৎক্ষণাৎ আমাকে গড়িয়া ফেরত দিয়ে আসা হলো।
সব কিছু গোপন ।
কেউ না জানতে পারে,কেউ না দেখতে পায়,বিশেষত পুরুষ যেন মোটেই টের না পায়।
সেই সময় কেবল কেয়ার ফ্রি ও এঞ্জেলা নামে দুটো কোম্পানি ছিল।বাবাই তো কিনে আনতেন।তবু কেন এই গোপনতা ,কেন পেতেই হবে লজ্জা বুঝতে পারিনি।
খুবই ছোটো ছিলাম ফলে অনেক সময়ই ম্যানেজ করতে পারিনি ,বিছানার চাদরে জামায় লাগত, বিশেষত জড়োসড়ো থাকার অভ্যাস ই ছিলো না আমার।সেসবই বাবাই সতর্ক করে দিতেন, প্রথম বছর মা সেসব দাগ পরিস্কার করে দিয়েছেন,বয়স বারো।
এখন তো আমাদের ছেলে মেয়েরা ক্লাস এইটেই এসব পড়ে বিস্তারিত।
সব চেয়ে মুস্কিল হলো , আমাকে যেন শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হলো।এটা কোরো না সেটা নয়,ওটা ছোঁবে না,যেন নিষিদ্ধ ব্যাপার। অপরাধ।অথচ দেখতাম অম্বুবাচির সময় কামাখ্যায় মন্দির বন্ধ। পুরুষরাই লাল কাপড় মাদুলি করে পরছে, বিক্রি করছে। পিরিয়ড হলে কেন ঠাকুরঘরে নয় এই প্রশ্নের উত্তর পাইনি তাই মানতে পারিনি।
যাইহোক,এই যে আমি মানুষ থেকে কেবল নারীর সংকীর্ণ পরিসরে প্রবেশ করলাম এর জন্য মনে মনে সতত বিদ্রোহ জেগে উঠল।
মায়ের প্রতি অভিমান যিনি কখনো ছেলে মেয়ে ফারাক করে মিশতে শেখাননি।তিনি হঠাৎ করে চাপিয়ে দিলেন কিছু বিধি নিষেধ।
আমরা যে সময় বড় হয়েছি তখন মূলত সাদাকালো টিভি। আর সবচেয়ে খারাপ হতো কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তি মারা গেলে ,ব্যস সাতদিন ধরে একনাগাড়ে এক ভদ্রলোক করুণ সুরে বেহালা বাজাতেই থাকতেন। যেটুকু বা অনুমতি ছিল শিশুসুলভ অনুষ্ঠানে অনুমতি তাও বন্ধ।
বৃহস্পতিবার চিত্রমালা বাংলা সিনেমার গান আর বুধবার হিন্দি, চিত্রহার।সেটাও উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে হতো। সিনেমা বলতে মা বাবার সঙ্গে গুপি গায়েন বাঘাবায়েন, ফেলুদা ,টেন কম্যাণ্ডমেন্টস, বর্ন ফ্রি এসব।
অথচ ছোটরা যে সত্যি অতটা ছোটো হয় না তা ছোটোবেলায় বুঝেছি।আমরা বন্ধুরা রীতিমতো প্রাপ্তমনস্ক আলোচনা করতাম মানুষ ও পৃথিবীর গুঢ় তত্ব নিয়ে।অনেক কিছুই বুঝতাম যা বড়রা কিছু বুঝতে পারব না ভেবে সামনেই বলাকওয়া করতেন।
ছোটরা অনেক বেশি বিবেচক বড় হয়ে বুঝেছি।
আমি তখন ইন্দ্রনাথের প্রেমিকা আর পড়ার সময় ভাবছি অনেক বিষবৃক্ষ র হিরা কে নিয়ে।ভারতীয় প্রণয় ও তার জটিল আবর্ত ধীরে ধীরে হাতছানি দিচ্ছে।
লোডশেডিং রোজ হতো বাম আমলের প্রথম দিকে।
সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত কলকাতা 'ক' এ নাটক শুনতাম।রেডিও সঙ্গী ছিল।বাবা কিনে দিয়েছিলেন ফিলিপ্সের ছোট্ট আয়ত একটি গ্রে সেট।শনিবারের বারবেলা তারপর হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স এর ক্যাঁচ করে শব্দটা,শ্রাবন্তী মজুমদারের মনের মতো গান মনে রাখার কথা এইসব মিস হতো না।
এমন একদিন চারিদিক হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল। মা স্তব্ধ, পাড়ায় গুঞ্জন, বাবা অনেক,অনেক রাতে পায়ে হেঁটে রেললাইন ধরে কাতারে কাতারে মানুষের সঙ্গে বাড়ি ফিরলেন।গম্ভীর পরিবেশ।ফিসফাস।আমার বয়স বারো।টিভি জানালো প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দেহরক্ষী দ্বারা খুন হয়েছেন। তাঁর দৃপ্ত ভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস, স্মার্ট নেস ছাপিয়ে মানসচক্ষে কল্পনা করলাম ছোট্ট খাট্ট শরীর,বক্ষ ভেদ করে চলে যাচ্ছে বুলেট।লুটিয়ে পড়ছেন তিনি।সেই প্রথম নিজের রাষ্ট্র সম্পর্কে শ্রদ্ধাহীন হয়েছিলাম।তা ক্রমশ বেড়েছে।কিন্তু আরো কিছু ও বাকী ছিল ঘটনা আরো তীব্র আরো অশ্লীল ব্যাপার,এই মৃত্যু পরবর্তী ক্ষণে..(ক্রমশ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।