এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • যুদ্ধ দিনের প্রথম কদম ফুল

    রোমেল রহমান লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৭ জুন ২০২২ | ১৪১০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সে বচ্ছর কদম ফুলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো! আমাদের এই শহুরে জ্যামের জীবনে বর্ষা এলে কদম ফুল বিক্রি করতে আসা মেয়ে গুলোর উছিলায় অন্তত মনের এক গোপন খোরাকের সাধ মেটে! কিন্তু সব কিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কদম ফুলের মূল্য বৃদ্ধিতে বর্ষা বন্দনায় এবার একটা লটঘট লেগে গেলো শহুরে মানুষদের শ্রান্ত জীবনে! ব্যাপারটা পত্রিকার হেডলাইন হবার  মতন একটা  ঘটনা বলে মনে হল মন্সুরের! নারিন্দার এক চিপা গলির চিমসা ঘিঞ্জির মধ্যে একটা দেড় রুমের বাসায় মন্সুর আর তার স্ত্রী ময়না ভাড়া থাকে! তাদের দেশের বাড়ি খুলনা। তারা দুজন প্রতি শুক্রবার খুলনা থেকে পাঠানো চুঁইঝাল দিয়ে বয়লার মুর্গির মাংস রান্না করে খায় আর গরুর মাংসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য ভৎসনা করে সরকারকে! মন্সুর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে আর তার বউ ময়না দিনরাত গুনগুন স্বরে বিসিএসের জন্য পড়ে! তারা স্বপ্ন দেখে একদিন তারা খুলনা ফিরে যাবে আর তখন তাদের জীবনে এই ঘিঞ্জিময়তা আর থাকবে না। এই পুরানা বাড়ির এক চিলতে উঠোনে আছে একটা প্রাচীন কাঠগোলাপ গাছ, যেটা অবিরাম ফুল দিয়ে যায়। সেই গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ময়নারও মনে হয় তার বাড়ি হলে সেখানে সেও একটা এমন কাঠগোলাপ লাগাবে। কিন্তু আজকাল তার কেন জানি মনে হয়, তার আর বাড়ি হবে না! তবে এইসব নিয়ে তাদের আফসোস থাকলেও হতাশা নেই তুমুল আকারে! ফলে প্রতিবছরের মত বউকে চমকে দেবার প্রবনতা থেকে কদম ফুল কিনতে গিয়ে মন্সুর যখন আবিস্কার করল ফুলের দাম আগুন, সে কৌতূহল চাপা না রাখতে পেরে ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেই ফেল্লো, তুই ফুলের দাম কচ্ছিস না সয়াবিন তেলের দাম? মেয়েটা বিরক্তি নিয়ে বল্ল, নিলে ন্যান না নিলে যান গা, ফাউ প্যাঁচালের টাইম নাই! ফলে সামান্য আহত স্বরে ব্যক্তিগত প্রথা রক্ষার তাগাদায় একটা মাত্র কদম কিনতে কিনতে মন্সুর আবার জিজ্ঞেস করে, তুই সত্যি কইরে ক দিনি ফুলের দাম এতো বাড়িছে ক্যান? মেয়েটা খুব নির্বিবাদে বলে ওঠে, ফরেনে যুদ্ধ লাগছে জানেন না? হতভম্ব মন্সুর বলে ফেলে, তুই কি এই কদম ফুল ইউক্রেন থ্যে আনিছিস নাকি রাশিয়ার থে? মেয়েটা চলে যেতে যেতে বলে, সরকাররে চাইল তেল নুনের দাম কমাইতে কন ফুলের দামও কইম্যা যাবো অটো! মন্সুর একটামাত্র ফুল কেনার মধ্যবিত্তিয় সামাজিক দ্বিধা নিয়ে ফুলটাকে যথেষ্ট পরিমাণে আড়াল করতে করতে বাড়ি পৌঁছায় এক আকাশ বৃষ্টি নিয়ে! ফলে বাড়ি ফিরে তারা দুজন খিচুড়ি রান্না করে এবং এর মধ্যে এক ফাঁকে দণ্ডিত পুরুষের মত সে আমতা আমতা করে বয়ে  আনা কদম ফুলটা তার বউয়ের হাতে দিতে দিতে বলে, এ বচ্ছর ফুলের দাম যম্মের, যুদ্ধ লাগিছে তো! কিন্তু ময়না যুদ্ধঅর্থনীতির দিকে কান না দিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সারাবাড়ি মাথায় তোলে! এবং  সে বলে ওঠে, যুদ্ধের বাজারে একটা কদমই হাজার কদম ফুলের মা! এই বাক্যটা মুন্সুরের মনে ধরে। বাইরে তখন আষাঢ়ের তুলকালাম বৃষ্টি! 

    সেই রাতে তারা তাদের মাঝখানে কদম ফুলটা নিয়ে ঘুমাতে যায়! সুখে মন্সুরের চোখ ভিজে ওঠে গোপন বেদনায়, আর আহ্লাদের যন্ত্রণায় ময়না বালিশ ভিজিয়ে ফেলে! সে রাতে তাদের ঘর তলিয়ে যায় কদম ফুলের ঘ্রাণে! মাঝরাতে তাদের ঘুম ভেঙে গেলে তারা আবিষ্কার করে তারা দুজন ঘরময় থৈ থৈ ঘ্রাণের মধ্যে সাঁৎরাচ্ছে! মন্সুর আনন্দে গদগদ স্বরে বলে ওঠে, বউ যুদ্ধের বাজারে কি  এতো বেশি সাঁতার দেয়া উচিৎ? ময়না ঘরের জানালা খুলে দিতে দিতে বলে,  বোমা বারুদের দুনিয়া ফুলের গন্ধে ভাইসে জারেজার হইয়্যে যাক! ফলে খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ফুলের গন্ধের স্রোতে ভেসে তারা বাড়ির উঠোন ভাসিয়ে সাঁতার দিতে থাকে! ময়না সেই কাঠগোলাপ গাছটাকে জড়িয়ে ঘুরে ঘুরে সাঁতার দেয় আর নাচে! মন্সুরও তার সঙ্গে নেচে নেচে ভেসে যায়! সাঁতারের তালে মাতোয়ালা হয়ে মন্সুর গেট খুলে দেয় আর ফুলের গন্ধের স্রোত গেট ডিঙ্গিয়ে গলি-ঘুপচি- ঘিঞ্জিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তলিয়ে যেতে থাকে! তারা দুজন ফুলের গন্ধের তোড়ে সাঁতার দিতে দিতে সমগ্র শহরময় কদম ফুলের ঘ্রাণের প্লাবনে ভেসে যেতে যেতে ভাসিয়ে যায়! আমরা জানি না যুদ্ধ থামলে আমরা আবার পার্কের চিপায় কিংবা জ্যামে আটকা অবস্থায় কদম ফুল কিনতে কিনতে তাদের দেখা পাবো কিনা আগামী কোন বর্ষায়!
    -*-

    ১৫ জুন ২০২২
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১৭ জুন ২০২২ | ১৪১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন