এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ইতিহাসে উপেক্ষিতা কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও দুর্গা সোরেন

    Lipikaa Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৫ আগস্ট ২০২১ | ২৪৪৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ইতিহাসে উপেক্ষিতা কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও দুর্গা সোরেন!

    ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের সকালে উপেক্ষিতা নারীর কয়েকজনের কথা দেশমাতাকে লিখল এক সাধারণ মেয়ে -- “বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন/যার শাড়ি, কপালের টিপ, কানের দুল আর/পায়ের গোড়ালি আপনি রোজ দেখেন।“ -------সে লিখল -

    মা দুর্গাভারতী,

    আজ কোভিডবাতাসে দুলেউঠেছে তোমার সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা ক্ষেত আর তিরঙ্গা পতাকা। কল্পনায় তোমার বন্দনামন্ত্রে ভরে উঠেছে মোদের কোটি কণ্ঠ – “বন্দে মাতরম্…. সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলম্……” জানালা ধরে দাঁড়িয়ে শিশুরা পতাকা হাতে ছুটে চলেছে ভাবনায় আর ফাঁকা মাঠে বড়দের গালভরা ভাষণে ভরে উঠেছে তোমার আঁচল, ঠিক তখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তোমার পায়ের নীচে রক্তে ধোয়া বেদীটি। কত শত- সহস্র সন্তানের রক্তে ভিজে তবে গলেছে তোমার শিকল! তাঁদের আত্মত্যাগের কথা কতক হয়েছে আলোচিত, কতক রয়েছে উপেক্ষিত! শত-সহস্র সন্তানের মধ্যে তোমার দামাল মেয়েরাও ‘বীরপুরুষ’দের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন, বলেছিলেন-

    “তুই করবি যুদ্ধ আর আমি রইব বোকা!
    স্পষ্ট বলছি তা হবেনা আর,
    তুই ওদের তীর ছুঁড়লে আমিও দেব মার”।

    পুরুষের পাশে তাঁরাও কখনও আড়ালে কখনও প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করেছেন! কখনও বিপ্লবীদের মুখে অন্ন জোগাতে অন্নপূর্ণা হয়ে নিজের মুখের অন্ন তুলেদিয়েছেন, কখনও খড়্গ হাতে দেবীকালীকা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, কখনও নৃসংশ বর্বরের কাটামুণ্ড হাতে নিয়ে মুণ্ডমালিনী হয়েছেন, আবার কখনও বর্বর-শিকারে ‘সতী’ হয়ে মৃত্যুবরণ করে শত শত নবদুর্গার জন্মদিয়েছেন। না, এঁদের নাম দেশের ইতিহাসে থাকে না। ইতিহাসের পাতায় পৌঁছানোর জন্য যে ‘কোটা’র দরকার তা এঁদের ছিল না যে! তাই সেখানে জায়গাও হয়নি তাঁদের। দু’ একজনের মিলেছে স্থানীয় স্বীকৃ্তি, আর বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্তের বই থেকে তুলে স্কুলপাঠ্য বইএ স্থান দেওয়া হয়েছে বটে কয়েকজনকে! তবু আজও তাঁদের কারও নামে হয়নি সরকারি ভবন, হয়নি কোনও রাস্তা বা হিমঘরও। শুধু আমাদের বুকের মধ্যে হি--ই- ম হয়ে জমে আছে একচাঁই অনুভূতি। যেমন থাকে দুর্গাপ্রতিমার জন্য, নিরঞ্জনের পরেও ব –ছ—র ধরে তাঁর মহাতেজকে অনুভব করি, ঠিক তেমন! এঁরা সাধারণ ঘরের, অতি সাধারণ মেয়ে হয়েও নিজগুণে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ প্রভাময়ী। তাঁরা চিরনমস্য সাধারণী- “বিশ্বায়নে, পণ্যায়নে, খণ্ড খণ্ড মানচিত্রে, বাংলা বিহার রাজস্থানে সাধারণী নমস্তুতে!”

    সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে মুন্ডা বিদ্রোহ, আইন অমান্য আন্দোলন থেকে ঝাঁসির রানী বাহিনী হয়ে তেভাগা আন্দোলন, সবেতেই এই সাধারণীর তেজরশ্মীর উজ্জ্বলপ্রভা বিচ্ছুরিত হয়েছে। তোমার বেদীতে প্রাণ দিয়ে, মান দিয়ে তাঁরা সবাই হয়ে উঠেছেন আমার এক একটি দুর্গামা।

    আমাদের সাঁওতাল বিদ্রোহ বা তারও পঞ্চাশ বছর পরের মুন্ডা বিদ্রোহে একে একে উঠে এসেছে অনেক নাম। ফুলো আর ঝানো, এই দুইবোন ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের সামনের সারিতে থাকা মেয়ে। বাসবী কিরোর ‘উলগুলান কি ওউরতেঁ’ বই অনুযায়ী মুণ্ডা বিদ্রোহের মাকি, টিগি, নাগী, লেম্বু, সালি, চাম্পি- পুরুষের সঙ্গে সমানে তীর -কাঁড় চালিয়েছিলেন। আমাদের সাঁওতালজাতির কাছে ফুলো, ঝানো চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন। কিন্তু বহির্জগৎএ লড়াইয়ের কথা এখনও জানেনা অনেকেই, সার্বিকভাবে জানানোর কোনও দায়িত্ব নেয়নি কেউ। ১৭৯৩ এ বাংলা বিহার উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে নতুন জমিদারদের চড়া খাজনা, মহাজনদের মোটা সুদের চাপে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল ওরা, নিরাপদ জায়গার খোঁজে রাজমহলের কাছে পাহাড়ি জায়গায় চলে গিয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ও জমিদার- জোতদাররা মিলে সেখানেও তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে, নিরুপায় হয়ে ১৮৫৫ নাগাদ ওরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। আসল ব্যাপার হল, ওরা সেই বিদ্রোহের মধ্যদিয়েই কম্পানিকে দেশছাড়া করতে চেয়েছিল আর নিজেদের সুবা রাজত্বের কথা ঘোষণাও করেছিল। এই বিদ্রোহে সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈ্রব, ডোমন মাঝি, বীরসিং মাঝির পাশে মেয়েরাও যে দাঁড়িয়েছিল! মেয়েদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই ফুলো আর ঝানো মুর্মু। তীর-ধনু্ক‌ টাংগি, বর্শা, কুড়ুল সবই চালাতে পারতেন ওঁরা। যেদিন ফুলো, ঝানো সাঁওতাল মেয়েদের নিয়ে রাতে শত্রুশিবিরে ঢুকে কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছিল ২১ জন অত্যাচারীকে সেদিন শত্রুপক্ষ দেখেছিল “আমার দুর্গা কখনো ঘরোয়া, কখনো আগুন বহ্নি!”

    আর ঐ ব্রিটিশদের সঙ্গে দেশের দস্যুরা মিলে ফুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষনকরে, হত্যাকরে শোধ নিয়েছিল। কেউ যাতে আর বিদ্রোহ করার সাহস না পায় তাই বাকিদের দেখানোর জন্য ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল ফুলোর বিভৎস লাশটা রেল লাইনের ধারে। তুমি কি সেদিন কেঁদেছিলে? সে কথা অবশ্য ফুলো জানতে চায় নি। তবে বর্বরতা থামাতে পারেনি ওদের, এর পরেও হাজার হাজার সাধারণী এগিয়ে এসেছেন, প্রয়োজনে “আমার দুর্গা ত্রিশূল ধরেছে স্বর্গে এবং মর্ত্যে” ।

    আমার এক দুর্গা সৌদামিনী, মেদিনীপুরের মেয়ে, আইন অমান্য আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, ছিলেন বাগ্মী। ১৯৩২ এর ১১ ডিসেম্বরএ বাগবাজারে সভা করতে যাবার সময় পুলিশ সৌদামিনী পাহাড়ীকে লাঠিপেটা করে টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল। যাবার সময় পুলিশের সামনেই চীৎকার করে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন- ‘প্রতিটি জিনিস কিনবার সময় দেশবাশী চিন্তা করে দেখবেন সেটি ভারতে তৈরি কিনা’। শুধু তাই নয়, তাঁর বিচারের সময় তিনি বিচারককে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন –
    “আইন ভাঙ্গলে আপনারা যাকে খুশি গ্রেফতার করতে পারেন কিন্তু মহিলাদের প্রতি পুলিশ খারাপ কথা বলতে পারে কোন আইনে? জনতার ওপর লাঠি চালানো হয় কোন আইনে?”
    তাঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর বিচারক দিতে না পারলেও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।

    চামেলী গুপ্ত কলকাতার ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’র সদস্য হয়ে বড়বাজারে শোভাযাত্রা, পিকেটিং করতেন পুরুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে। বড় বাজারের বিলিতি বস্ত্রের ব্যবসায়ীরা রীতিমত ভয় পেত এই উত্তর প্রদেশের কন্যাকে দেখে। তিনিও গর্ভবতী অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। সরকার থেকে বন্ড লিখতে বললেও তিনি রাজী হয়নি, তাই ছাড়াও পায়নি। জেলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন চামেলী। জেলের মধ্যে একটি পুত্র সন্তানও জন্মেছিল তাঁর। কিন্তু ধীরে ধীরে শরীর আরও খারাপ হলে সরকার বিনা শর্তে যখন মুক্তি দিয়েছিল তখন অনেক দেরী হয়ে যায়, কয়েকদিন পরে চামেলী ও তার শিশুপুত্র দুজনেই মারা যায়। তুমি সেদিনও ছিলে স্থবির! দেশের জন্য চামেলীর আত্মত্যাগের কথা না স্মৃতিতে, না খাতাতে কোথাও লেখা রইলনা!

    আমার আর এক দুর্গা হওড়ার ননীবালাদেবী! বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর পিসিমা ননীবালা দেবী ষোল বছরে বিধবা হয়ে তাঁদের বাড়িতেই থাকতেন। নিজে উৎসাহী হয়ে ভাইপোর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন! ১৯১৫ তে বাঘাযতীন শহীদ হবার পর বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবের ঝড় উঠেছিল। যদুনাথ মুখার্জীর নেতৃত্ত্বে আবার অস্ত্র জোগাড় করে বিদ্রোহ শুরু হলে অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী, রামচন্দ্র মজুমদার, অতুল ঘোষ বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত। ননীবালা দেবী কখনো চন্দননগরে কখনো রিষড়াতে ঘরভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন গৃহকর্তৃ সেজে। কলকাতার শ্রমজীবী সমবায়এ হঠাত হাজির হয়েছিল পুলিশ। বিপ্লবী অমরেন্দ্র পালিয়ে গেলেও, ধরা পরেছিল রামচন্দ্র মজুমদার। রামচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘মসার’ পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন জানার জন্য বিধবা ননীবালা সধবা সেজেছিলেন। না রঙ্গমঞ্চে নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করলেন ননীবালা। রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে শাখা সিঁদুর পরে জেলে গিয়ে জেনে এসেছিলেন পিস্তলের খবর। সেযুগে বিধবাদের একাদশী সঙ্গী ছিল, চা খেলে জাত যেত, সাদা থান ছিল পরার জন্য বরাদ্দ তা বয়স যত কমই হোক। সিন্দুর তো দূরের কথা লাল রঙ থেকে দূরে থাকত তারা। অন্যের স্ত্রী সাজার জন্য শাখা সিঁদুর পরা অত্যন্ত দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল, সমাজের চোখে ছিল বেশ্যাবৎ কর্ম। পুলিশ জানতে পারার আগেই ননীবালা দেবী তাঁর ছোটবেলার বন্ধুর দাদা প্রবোধ চন্দ্র মিত্রের সঙ্গে পেশোয়া চলে গেলেন। সেযুগে একজন বিধবার পরপুরুষের সঙ্গে দেশছাড়া মানে সমাজের কাছে ‘চোখেরবালি’ হওয়া। তবু সমাজকে থোড়াই কেয়ার করলেন দেশের জন্য, তোমার শৃঙ্খল মুক্তি ছিল তাঁর একমাত্র কাম্য। এখানেই শেষ নয়, ধরা পড়লেন যখন তখন তিনি তিনদিনের কলেরার রুগী। স্ট্রেচারে করে আনা হয়েছিল হাজতে, তারপর কাশীর জেলে। জেরা করে কিছু জানতে না পেরে জিতেন ব্যানার্জী লংকা বেঁটে তাঁর যৌনাঙ্গে ঢেলে দেবার মত অত্যাচার চালিয়েছিল। যন্ত্রনায় ছটফট করেছেন, চিৎকার করেছেন তবু কারও সন্ধান দেননি। পরে আলো বাতাসহীন শেলেও সংজ্ঞা হারিয়েছেন বারবার তবু বিপ্লবীদের কোনো সন্ধান দেননি। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা রাজবন্দী। জেলের সুপার ইন্টেন্ডেন্ট গোল্ডির কথামত দরখাস্ত লিখেছিলেন জেলারকে সারদামায়ের কাছে যেতে চেয়ে কিন্তু গোল্ডি নিজে হাতে ননীবালার সামনে সেই দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেললে সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন গোল্ডির গালে। এমনই আত্মসম্মান বোধ ছিল তাঁর। আর ছিল মমত্ববোধ, দু কড়িবালা নামে এক বিপ্লবী ঐজেলে থার্ড গ্রেডের শাস্তি পাচ্ছেন জেনে দাবি করেছিল বামুনের মেয়ের হাতের রান্না না হলে অনশন ভাঙ্গবেন না। বামুনের মেয়ে বলতে দুকড়ি বালা দেবীর কথাই বুঝিয়েছিলেন যে! দুকড়িবালা দেবীর শাস্তি লাঘব করতে তাঁকে নিজের রান্না করিয়ে ঊনিশদিন পর অনশন ভাঙ্গেন। এহেন মহিলা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সকলের কাছে অবাঞ্ছিত হলেন। শেষ জীবনে রান্নার কাজ করে ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটালেন। তাঁর অবদান কি কম ছিল সে যুগের তুলনায়? তিনি তখনকার অন্য বিধবাদের মত দিব্য কাশীবাসী হয়ে নির্লিপ্ত জীবন কাটাতে পারতেন। আজ কজনই বা মনে রেখেছে তাঁর কথা? আর তুমি?

    এই বীরভূমের দুকড়ি বালা দেবী যিনি জেলে গিয়ে ননীবালাদেবীর জন্য রান্না করেছিলেন তিনি ছিলেন বিপ্লবী নিবারন ঘটকের মাসিমা। নিবারন ঘটক মাঝে মাঝে বিপ্লবীদের মাসির বাড়িতে আনতেন আশ্রয়ের জন্য। মাসি দুকড়ি বালা আশ্রয় দিতেন জ্যোতিষ ঘোষ, বিপিন গাঙ্গুলীর মত বিপ্লবীকে। সেবার গাড়োয়ানের ছদ্মবেশে বিপ্লবী হরিদাসদত্ত ৯ বাক্স কার্তুজ আর ৫০টি মসার পিস্তল চুরি করেছিলেন। চুরি কর সাতটি পিস্তল দুকড়িবালা দেবীর কাছেই ছিল। পুলিশ জানতে পেরে দুকড়িবালার বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল। হাতে নাতে ধরাও পরেছিলেন। শিশু সন্তানকে রেখে দু বছরের জন্য জেলে গিয়েছিলেন তৃ্তীয় শ্রেনীর কয়েদি হয়ে। অখাদ্য খাবার ছিল তাঁদের জন্য বরাদ্দ। যৌন নির্যাতন, মলদ্বারে রুল ভরে দেওয়া, চোখে পিন ফুটিয়ে দেওয়া, আঙ্গুলের নখ টেনে তুলে নেওয়ার মত অমানুষিক অত্যাচার করা হত তৃ্তীয় শ্রেণির কয়েদিদের। আর দিনে কুড়ি কিলো করে ডাল ভাঙ্গা ছিল তাঁদের কাজ। এ তো আর স্বাধীন ভারতের মন্ত্রীদাদার কারাবাস নয়! এ ছিল ব্রিটিশএর থার্ড গ্রেড।

    - আমি? সর্বশিক্ষা অভিযানে পেয়ে বৃত্তি, ‘আমি’ হয়েছি ইংরাজি স্কুলে ভর্তি। আমার এক হাতে সাঁওতালী গান, ইংরাজি ভাষা অন্যহাতে! কম্পিউটারে শিখেছি ই-মেল পাঠাতে।

    আবার দুর্গার কথায় আসি, আমার দুর্গা দুই ছাত্রী, শান্তি- সুনীতি! কুমিল্লার শান্তিলতা ছোটবেলায় সরোজিনী নাইডুর সভায় বাবার কাছে শেখা দেশাত্মবোধক গান গেয়ে নজর কেড়েছিলেন সবার। কুমিল্লার ফৈজন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী শান্তিলতা ঘোষ আর সুনীতি চৌধুরীর কিশোরীমন কুমিল্লার আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের লাঠিচার্জ দেখে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। ওঁরা ঔ বয়সে তোমার মুক্তির জন্য স্বাধীনতা- সংগ্রামে অংশ নেবেন বলে লাঠি ও ছোড়া চালানো শিখেছিলেন, ময়নামতি পাহাড়ে গিয়ে রিভলবার চালানো শিখেছিলেন। সেই বয়সে সকলের চোখের আড়ালে তাঁরা দেশবন্দনা শুরু করলেন। ১৯৩১ এ কুমিল্লায় ছাত্র কনফারেন্স হলে তাঁরা ৫০/৬০ জন ছাত্রী নিয়ে ‘ছাত্রী সংঘ’ গড়ে তুলেছিলেন। তোমার বুকের ওপর দাপিয়ে বেড়ানো ব্রিটিশ সরকারকে জব্দ করতে ১৯৩১ এর ১৪ই ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে তাঁর বাংলোতে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গুলি করে মেরেছিলেন। বাড়ির পাহাড়াদারের কাছে ধরা পড়ে গেলে অশ্রাব্য গালাগালি আর এলোপাথা্রী মার জুটেছিল। ১৯৩২ এর ২৭ এ জানুয়ারি তাঁরা প্রস্তুত ছি্লেন ফাঁসির মঞ্চে যাবার জন্য, কিন্তু নাবালিকাদের শাস্তি হয়েছিল যাবজ্জীবন জেল। এখানেও ওরা বিভাজন নীতি বলবৎ করেছিল, শান্তিকে দ্বিতীয় শ্রেনির আর সুনীতিকে তৃ্তীয় শ্রেনির কয়েদি করেছিল। সুনীতির দুই ভাইকে গ্রেফতার করে, বাবার পেনশন বন্ধকরে দিয়ে পরিবারটাকে শেষ করে দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। সাতবছর পর গান্ধীজির আবেদনে অন্য কয়েদির সঙ্গে তাঁদের মুক্তি হয়েছিল। এরপরেও মনের জোড়ে সুনীতি পড়াশোনা করে, ডাক্তার হয়ে গরিবের সেবা করেছেন। শান্তি সাহিত্যচর্চা করলেন, ‘অরণ্য-বহ্নি’ নামে জীবনকাহিনি লিখেছেন। এদিকে বেথুন কলেজের ছাত্রী বীণা দাস ১৯৩২এর ৬ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার সেনেট হলে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে বীণা গুলি ছুঁড়েছিলেন মাথা লক্ষ করে। কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি, কর্নেল সুরাবর্দি বীণাকে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। স্ট্যানলি একটুর জন্য বেঁচে গেলেও ব্রিটিশ সরকারের কপালে ভাঁজ পড়েছিল বীণার সাহসী পদক্ষেপে। শত অত্যাচার সত্ত্বেও সংগঠণের কোনও খবর বার করতে পারেনি তাঁর মুখ থেকে। একদিনের বিচারে ৯ বছরের জেল হয়েছিল। নোয়াখালি দাঙ্গার পর সেখানে পীড়িত মানুষের সেবা করতে ক্যাম্প তৈ্রি করেছিলেন। পরে নিজের জীবনকাহিনি লিখেছিলেন ‘শৃ্ঙ্গ্খল- ঝংকার’এ। একদিন স্কুল-কলেজ থেকে বেরিয়ে কলম ফেলে এই দুর্গারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তোমার জন্য! আসলে - “আমার দুর্গা পথে প্রান্তরে ইস্কুল ঘরে থাকে! /আমার দুর্গা বিপদে আপদে আমাকে মা বলে ডাকে”।

    কোনও অস্ত্র না ধরেও যে কত বড় আত্মত্যাগ করা যায় তা বুঝেছিলেন ত্রিপুরার আশিকাঠির সুশীলা মিত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পলাতক বিপ্লবীদের নিয়মিত আশ্রয় দিতেন তিনি। তাঁর ছোট্ট কুঁড়ে ঘর যতই ছোট্ট হোক যুগান্তর দলের বিপ্লবী সত্যেন বসু, শচী বসুর জন্য জায়গার অভাব হত না। দিনের বেলায় যে বিপ্লবীরা শ্মশানে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন তাঁদের জন্য হতদরিদ্র মায়ের রান্নাঘর থেকে ঠিক পৌঁছে যেত খাবার। সুশীলা রাতে বাচ্চাদের সঙ্গেই বিপ্লবীদের শোবার ব্যবস্থা করতেন। শুধু তাই নয় দেশকে ভালোবেসে নোয়াখালির মহিলাদের উন্নতির জন্য ‘নোয়াখালি সরোজনলিনী নারী মঙ্গল সমিতি’ গড়ে তুলেছিল। নিজেই সম্পাদিকার দায়িত্ব সামলেছেন। সেখানে মহিলাদের হাতের কাজ, ধাত্রীবিদ্যা শেখানো হত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে দেশের সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন এই দুর্গা। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৩২ এর ২৬ শে জানুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার সময় বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন আড়াই মাস, তিন বছর ও পাঁচ বছরের তিনটি বাচ্চাকে। তবু তিনি বন্ডে সইকরে মুক্তি পেতে আস্বীকার করে বলেছিলেন- “দেশের হাজার সন্তানের সঙ্গে আমার সন্তানরাও যদি বলি যায় তবে আমি গৌরব বোধ করব, চোখের জল ফেলব না”। সেদিন তুমি কি চোখের জল ফেলেছিলে?

    আরও এক দুর্গা বন্ড লিখতে রাজী হননি। তিনি হলেন কুসুম বাগদী! মেদিনীপুরের কুসুম বাগদী দশমাসের দুধের শিশুকে বাড়িতে রেখে জেলে এসেছিলেন আইন অমান্য করে। বাড়িতে ছেলে আর জেলে মা, দুজনেই কেঁদেছে দুই জায়গায়। তবু বন্ড লিখে ছেলেকে কাছে পেতে চাননি কুসুম। বন্ড লেখা আন্দোলনের জন্য ছিল অপমানজনক। তিনি কলুসিত করতে চাননি সে লড়াইকে। জেলের দরজা থেকে দুধের শিশুকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। শিশুপুত্রকে ছেড়ে থাকার, মায়েরদুধ না খওয়াতে পারার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন কোনও শর্তের কাছে মাথা নোয়াবেনা বলেই। কারণ “আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে”।

    আমার দুর্গা যশোরের দৌলতউন্নেষা। ১৯৩২ এ আইনঅমান্য আন্দোলনে যোগদিয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে। ‘গাইবান্ধা মহিলা সমিতি’র সম্পাদক হয়েছিলেন কম বয়সেই। তাঁর জ্বালামুখী বক্তৃতার টানে সাত আটটা গ্রামের মেয়েরা, মুসলমান মেয়েরাও পর্দা সরিয়ে ছুটে আসত তাঁর সভায় যোগ দিতে। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে পুলিশ তাঁদের বসতবাড়ি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, পরিবারকে গাইবান্ধা থেকে বহিস্কার করে একপ্রকার রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছিল তাঁদের। তবু আন্দোলন থামেনি। আন্দোলন জোরদার করতে সভার পর সভা করেছিলেন। ফুলছড়ি গ্রামের একটি সভা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল তাঁকে। শাস্তি ছিল এমনই যে রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি, বহরমপুর জেলে পাল্টে পাল্টে রাখা হয়েছিল। তবু মনের মধ্যে আগুন পুষে রেখেছিলেন, মুক্তি পাওয়ার পরও গোপনে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।

    কুমুদিনী ডাকুয়া ছিল সুতাহাটার মেয়ে। বাঘাযতীন, কল্পনা দত্তের মতই কঠিণ শরীরচর্চা করে শরীর ও মনকে শক্ত করে তুলেছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদেবার পর যেকোনও বিপদজনক কাজের জন্য তিনি তৈ্রি থাকতেন। ‘সুতাহাটা থানা জাতীয় সরকার’ বাহিনীরও প্রধান ছিলেন। তিনি মহিলাদের শেখাতেন ‘হায়না’ পুলিশের সঙ্গে মোকাবিলা করার কৌশল। ১৯৪২ এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর সুতাহাটা থানা ‘দখল’ করতে এলে পুলিশের নজরে পড়েছিল। পরে আত্মগোপন করেছিল পুলিশের নজর এড়াতে। নভেম্বর মাসে সুতাহাটা ক্ষুদীরামবাবুর মাকে দেখতে এলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। কিন্তু রাতে কিছুতেই পুলিশের সঙ্গে বাড়ির বাইরে যেতে রাজি হয়নি। এমন কি হাবিলদার জোর করলে তাকে ধারাল অস্ত্র দেখিয়ে থামিয়েছিলেন। বিচারে তাঁর এক বছর তিন মাসের জেল হলে জেলে অত্যাচারে এই সুঠামদেহী কন্যারও শরীর ভেঙ্গে গিয়েছিল। পরে শ্বাস কষ্ট হয়ে মারা যান। এমনই আর এক দুর্গা ছিলেন জ্যোৎস্না দাস বা মান্তু দাস ছিল ‘ওয়ার্ধা মহিলা আশ্রমে’র শিক্ষার্থী। মেদিনীপুরে এসে মহিলাদের নিয়ে ‘বাঘিনী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন। বিশেষ করে ধর্ষককে চরম শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেবার জন্য এই বাহিনী গড়া হয়েছিল। নিজে হাতে সেই সাজা দিয়েছেন অনেককে। ১৯৪১এ একটি মদের দোকানে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ন’ মাস ধরে ওয়ার্ধা, নাগপুর, জব্বলপুর জেলে ঘোরান হয়েছিল তাঁকে। ছাড়া পেয়ে মেদিনীপুরে সুশীল কুমার ধারার ‘গরম দল’ এ যোগ দেন। ১৯৪৪ এ গান্ধীজির কথায় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অবসান হলে তিনি আবার ওয়া্র্ধা ফিরে গিয়েছিলেন ঠিকই তবু এই মান্তু দাসকে ভুলে যাওয়া কি অপরাধ নয়?

    এদিকে বেলা মিত্র প্রথমে শ্বশুর বাড়ি থেকে, পরে কলকাতার বেহালার কাছে জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি ভাড়া নিয়ে গোপন রেডিও স্টেশন খুলেছিলেন। গোপনে বিদেশে সুভাষ চন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। তখন সুভাষ চন্দ্র ছিলেন বিদেশে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর গুপ্ত বিভাগের বিপ্লবীরা এখানে আশ্রয় নিতেন। ১৯৪৭ সালে বাংলায় ঝাঁসির রাণী বাহিনী গড়েছিলেন নেতাজীর ঝাঁসির রাণী বাহিণীর আদলে। ১৯৪৫ এ ১১ই সেপ্টেম্বর আজাদ হিন্দ ফৌজের কয়েকজনের ফাঁসির দিন ধার্য হলে বেলা মিত্রের তত্পরতায় বাইশ জনের মৃত্যুদন্ড রদ করা সম্ভব হয়েছিল।

    এবার তোমায় স্মরণ করাব সত্যবতীর কথা, মেদিনীপুরের যে বিধবার আসহায়তার সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষীরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁকে দেহপসারিনী করে তুলেছিল। এই অবাঞ্ছিত জীবনকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও তোমার শিকল পরা হাত দুটি তাঁকে ভাবিয়েছিল বড়! শরীর আর মনে ছিল তাঁর বিস্তর ফারাক-“আমার দুর্গা আত্মরক্ষা, শরীর পুড়বে মন না।/ আমার দুর্গা নারীগর্ভের রক্ত মাংস কন্যা”। তাঁর কাছে যৌনক্ষুধা মেটাতে আসা পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে গোপন খবর জেনে নিয়ে বিপ্লবীদের জানিয়ে দিতেন সত্যবতী। পুলিশের পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যেত বিপ্লবীরা। তাতেও শান্তি পাননি। পরে আইনঅমান্য আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিলেন। নন্দীগ্রাম ও আসাদতলায় প্রথম লবণ আইন অমান্য করেছিলেন সত্যবতী। ১৯৩২ এ ১১ই ফেব্রুয়ারি তেরপেখিয়া বাজারে মদের দোকানের সামনে পিকেটিং করার সময় পুলিশের লাঠির ঘায়ে জ্ঞান হারালে তাঁকে ঐ জেলহেফাজতে পাঠান হয়েছিল। জেল থেকে তিন মাস পর এসে আবার প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯ শে আগস্ট নন্দীগ্রামে রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে গিয়ে আবারও গ্রেফতার হয়েছিলেন। ততদিনে পুলিশ জানতে পেরেছিল যে তিনি পুলিশের গোপন খবর বিপ্লবীদের জানিয়ে দেয়। পুলিশের লাঠির ঘায়ে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর কিডনি আর অন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। হাসপাতালেও চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। দেশের দক্ষযজ্ঞে ‘সতী’ হয়ে প্রাণ গেল এই সত্যবতী দেবীর। অথচ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁর নাম পর্যন্ত রইল না। তোমার হৃদয়ে কি লেখা আছে তাঁর নাম?

    দিনাজপুরের যশোদা ছিল ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র সদস্য। জোতদারদের শোষন থেকে মুক্তি পেতে দরিদ্র দিনাজপুরের চাষিরাও ‘কৃষক সভা’ তৈরি করেছিল। ততদিনে তারা ভাবতে শিখেছিল -

    “খেতের ফসল তিনভাগ হবে, দুই ভাগ গৃহমুষিকের/উনুনের চারপাশে বসে হাত গরম করেছি,/দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও/আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব।”

    একজোট হয়ে জোর গলায় বলতে শিখেছিল ‘জান দেব তবু ধান দেবনা’। ১৯৪৭ এর ২০ ফেব্রুয়ারি, চাষিদের খাঁ পুরের সভা শুরু হবার আগেই গ্রামে ঢুকে চাষিদের গ্রেফতার করতে চেয়েছিল পুলিশ। মহিলারা পুলিশের মুখোমুখি হয়েছিল। ততক্ষণে বিদ্রোহী চাষিরা পালাতে পেরেছেন। যশোদার স্বামী নীলকন্ঠও ছিলেন পলাতক। যশোদার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুলিশ। যশোদাকে বিবস্ত্র করে, ধারাল অস্ত্র দিয়ে খোঁচানো হয়েছিল তার নগ্ন শরীর, তবু যশোদা মুখ খোলেননি। দুই সন্তানের মা যশোদার ক্ষতবিক্ষত শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল, যন্ত্রণায় চিত্কার করছিল তবু তাঁর উপর অত্যাচার বন্ধহয়নি। পলাতক বিপ্লবীচাষিদের খবর না পেয়ে আরো হিংস্র হয়েগিয়েছিল পুলিশ। শেষে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল যশোদাকে। ‘সতী’র মত তাঁর শরীর একান্ন টুকরো হয়েছিল কিনা তুমি দেখেছিলে সেদিন? সাঁওতাল চাষিরা ছুটে এসেছিল পাশের গ্রাম থেকে, পুলিশের সঙ্গে জোর লড়াই হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে কৌশল্যা কামারণি নামে তাদের একজন মহিলাও শহিদ হয়েছিলেন সেই লড়াইএ।

    তেভাগার শহীদ রাসমণি রাণী রাসমণি নন। তেভাগা আন্দোলনে ইলা মিত্রের যেমন অবদান রয়েছে তেমনি এই রাসমণি দেবীরও অবদান রয়েছে। ময়মন সিংহ এর বাগমারীর এক টঙ্ক চাষীর ঘরে জন্ম তাঁর। বারো বছর বয়সে টংক চাষীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরেই বিধবা হলে ‘স্বামীখেয়েছে’ বলে ‘ডাইনী’ নাম হয়েছিল তাঁর। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল সংগ্রামের জীবন। বাঁচতে হয়েছে অন্যের সাহায্য ছাড়া। একাকী জীবনে নিজে হাতে ধান বুনে, ধানকেটে, চাল তৈ্রি করে, হাটে বেচে দিনপাত করতেন। গরম কালে কাঠ কুড়িয়ে, বিক্রি করে, শীত কালের খাবার জোগার করে রাখতেন। হাতে তাঁত বুনতেন, ধাত্রী মায়ের কাজ করতেন দক্ষহাতে। লাতাপাতার গুনাগুন জেনে অসুখ সারাতেন গ্রামবাসীর। নিজে হাতে তাঁতবুনে কাপড় দিতেন গরিব হাজংমেয়েদের। ধীরে ধীরে হাজঙ্গ, ডালু, গারোদের প্রিয় হয়ে উঠলেন রাসমণি। হতদরিদ্র ঠীকা চাষীরা তখন জমিদারদের অত্যাচারে নিপীড়িত। অর্থ আর পরিশ্রম দিয়ে ফলানো ফসল বেশির ভাগ তুলে দিতে হত জমিদার বা জোতদারকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসীবাদ বিরোধী লড়াই শুরু হলে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ তৈ্রি হয়েছিল শ্রমজীবী মেয়েদের নিয়ে। গ্রামবাসীদের জন্য নৈশবিদ্যালয় গড়ে নিজেও ছাত্রী হয়েছিলেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় লঙ্গরখানা খুলে মা অন্নপূর্ণা হয়ে তিনটি গ্রামের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছিলেন। হাজং চাষিদের নিয়ে একটি ‘স্কোয়াড’ তৈ্রি করা সাধারণ ব্যাপার ছিলনা। নিজেরা চা্ল আর টাকা জোগার তো করতেনই পাশাপাশি মজুতদারের গোপন গুদাম বায়েয়াপ্ত করতেন। হাজং চাষীরা বিরাট এক বাহিনী গঠন করেছিলেন। ১৯৪৬ এর ৩১ শে জানুয়ারি, ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাস্টিনের পরিচালনায় বহেরাতলি গ্রাম আক্রমন করেছিল ‘ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল’ বাহিনী। গুলি, হত্যা, লুঠ, ধর্ষন চালিয়েছিল গ্রামের মধ্যে। পুরুষ শূন্য গ্রামে মহিলারা ধর্ষিত হয়েছিল। সরস্বতীর অর্তনাদ কানে গিয়েছিল রাসমণির। তিনি আর পঁয়ত্রিশ জন চাষি তীর -ধনুক, কাটারি, বর্শা আর কুড়ুল হাতে ছুটে এসে বর্বর পুলিশের সঙ্গে সোমেশ্বরী নদীর ধারে লড়াই করেছিলেন। রাসমণি তখন ভয়ংকরী এক রণমূর্তি। তাঁর অগ্নিরোশ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল অল্প কয়েকজন পুলিশ। যখন কাটারি দিয়ে সরস্বতীর ধর্ষকের মুণ্ডুটা এক কোপে ধড় থেকে কেটে নামিয়ে দিয়েছিলেন তখন দেবতারাও হয়ত সমস্বরে উচ্চারণ করেছিলেন – “মহামেঘ প্রভাং, ঘোরং মুক্তকেশীং চতুরভুজাং/ কালিকাং দক্ষিণাং, মুণ্ডমালা বিভূষিতাং।“ সেই ভীষণ লড়াইএর পর কোনও চাষি বাড়ি ফেরেনি। ফেরেননি রাসমণিও, “আমার দুর্গা কাস্তে হাতুরি আউস ধানের মাঠে!” বলেই বেঁচে থাকার অধিকার, নারীর সম্মান রক্ষার অধিকারের লড়াইএ সোমেশ্বরী নদীর জল সেদিন লাল হয়েছিল। দশটা গুলির ধাক্কায় রাসমণির শরীর মাটিতে পড়ে গেলে হয়ত স্তব্ধ হয়েছিল দেবতারাও ! স্তব্ধ হয়েছিলে তুমিও!

    আর তোমার শৃঙ্খলমুক্তি পর স্বাধীনতার ছেঁড়া ভেলাই ভেসে মেয়েরা উদ্ভ্রান্ত, বাঁচার আশায় ভেলার জল ছেঁকতে ছেঁকতে এগোনোর সময় চলে যায় তাদের! সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় লিঙ্গসাম্যের কথা উল্লেখ থাকলেও তা কার্যকরী হয়না সব জায়গায়, সব সময়। উপেক্ষিতা রয়ে গেছে কিছু ‘ধারা’ও। আজও জাতীয় মহিলা কৃষক দিবসে(১৫ই অক্টোবর) তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করা হয় না। সেদিনের ধর্ষণ এখন গণধর্ষণে উত্তীর্ণ। তাই আজও “আমার দুর্গা মনিপুর জুড়ে নগ্ন মিছিলে হাঁটে”। কামাখ্যার যোনিপূজার ধুপেরধোঁয়ার সঙ্গে আজকের সতীর যোনি থেকে টেনে বের করা অন্ত্রের কুন্ডলীতে স্বাধীনতা পরাধীনতা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। এখনকার দুর্গার লড়াইটা সেখান থেকেই –লড়াইটা ধর্ষনের বিরুদ্ধে, লড়াইটা সম্মান আদায়ের, লড়াইটা সংবিধানের ‘পিছিয়েপড়া জাতি’ হিসেবে নারীকে চিহ্নিতকরার ‘কোটা’র বিরুদ্ধে, লড়াইটা সম্পত্তির অধিকারের। সেই লড়াইএ দুর্গা আর ভারতী মিলেমিশে এক হয়। আজ আমার দুর্গারা অসি হাতে, মসি হাতে দাঁড়ায় এসে সবার আগে- “আমার দুর্গা মেধা পাটেকর, তিস্তা শিতলা বাদেরা/ আমার দুর্গা মোম হয়ে …..”। বরং তোমার উন্মুক্ত হাতে তোমার বেদীর রক্তের কালিতে (হিন্দু-মুসলমান, শিখ--খ্রিস্টান, ব্রাহ্মণ-শুদ্র, নারী –পুরুষ সকলের রক্তে)তুমি নিজে লিখো ইতিহাস! ভারতের লিঙ্গসাম্যের, শ্রেণীসাম্যের ইতিহাস, যেখানে উপেক্ষিত হবেনা আর কেউ, হবেনা আমার আর কোনো দুর্গার সংগ্রাম। লেখা হবে-

    “আন্দোলনে উগ্রপন্থে, শিক্ষাব্রতে কর্মযজ্ঞে,
    রান্নাঘরে আঁতুরঘরে – মা তুঝে সেলাম!
    অগ্নিপথে যুদ্ধজয়ে, লিংগসাম্যে শ্রেণীসাম্যে,
    দাঙ্গাক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে- মা তুঝে সেলাম
    মা তুঝে সেলাম! মা তুঝে সেলাম!
    ইতি - তোমার দুর্গা (দুর্গা সোরেন)

    ***********
    ঋণ স্বীকার - বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মল্লিকা সেনগুপ্ত, শুভ দাশগুপ্ত। মল্লিকা সেনগুপ্তের “কন্যাশ্লোক” কবিতা থেকে ‘দুর্গা সোরেন’ নামটি নেওয়া।

    তথ্যসূত্র -
    ১) স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী।
    ২) মুক্তি সংগ্রামে বাংলার উপেক্ষিতা নারী।
    ৩) স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া।
    লিপিকা ঘোষ 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৫ আগস্ট ২০২১ | ২৪৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:d078:6e16:de7f:***:*** | ২১ আগস্ট ২০২১ ০২:৪২496928
  • এই বীরাঙ্গনাদের অনেকের কথাই জানতাম না। ভাল লাগল 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন