"কালকের আগের দিন সন্ধে করে পিছনের ওই হাতোয়াপাড়ার রাস্তা দিয়ে রুগী দেখে ফেরার পথে ডাক্তারদাদু চুরি হয়ে গেছে।"
লেখাটা একবার পড়লাম, দু'বার, তিনবার পড়লাম। না, পড়ায় কোনও ভুল নেই। ডাক্তারদাদু চুরিই হয়েছে, স্পষ্ট লেখা। এদিকে আমার পেট ফেটে অসম্ভব হাসি পাচ্ছে এরকম কঠিন অবস্থাতেও। ডাক্তারদাদুকে আমি ভালোই চিনি। পাশের পাড়াতে থাকলেও এবং আমার বাহ্যজ্ঞান একটু কম হলেও, বীরেন বসু রোডের ডাক্তারবুড়ো তপেন সান্যালকে চিনব না, এমনও নয়। ৭০% পাকার সঙ্গে ৩০% কাঁচা চুলের মানুষটি দশাসই; কালো ফ্রেমের চশমা, বোঁচা নাকের নিচে খোঁচা ঝোপের মতো গোঁপ, কফ জড়ানো কণ্ঠ -- সান্যালবুড়োকে চেনার হাজারটা উপায় আছে। লোকে বলে সান্যালের বয়স নাকি ছিয়াত্তর পেরিয়ে আর এগোয় নি, এরকমই আছেন তিনি বহুকাল। তাঁর প্রজন্মের কাউকেই সান্যাল ডাক্তার নিজের ওষুধের জোরে আর ধরে রাখতে পারেন নি, কিন্তু নিজে টিকে আছেন, এবং চতুর্থ প্রজন্মের পেট ছাড়লেও ভোর ছটা কি রাত একটা -- মেরুন রঙের এক সুটকেস হাতে বুড়ো দাঁড়িয়ে থাকেন বেল বাজিয়ে। নরফ্লক্স থেকে শুরু করে নাক্স ভমিকা থেকে কালমেঘ পাতা, সবই বেরোতে পারে সুটকেস থেকে। বুড়ো ওপেন-মাইন্ডেড। ওষুধ দিয়ে, রাত দেড়টা বাজলেও এক কাপ চা খেয়ে পাড়া ফাটিয়ে তাঁর দীর্ঘকালীন "এবার সন্ন্যাস নিয়ে নেব, সব শেষ হয়ে গেছে! Corrupt, corrupt!" বাণীটি দিয়ে বিদায় নেন। এ হেন সান্যালবুড়ো নাকি 'চুরি' হয়েছেন! চুরি?
ডায়রি থেকে মুখ তুলে পুলির দিকে তাকালাম। ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে -- মাথার দুই দিকে দুটো ছোট্ট ছোট্ট ঝুঁটি করা প্রজাপতি ক্লিপ আটকে, একটা হলুদ ফুলছাপ ফ্রক পরে, হাতে পেন্সিল ধরে অসম্ভব গম্ভীর, চিন্তান্বিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে পুলি।
"তুমি ঠিক জানো? ডাক্তারদাদু চুরি হয়ে গেছেন?"
একটা বড় শ্বাস নিয়ে পুলি শুরু করলো, "হুঁ জানি। কালকের আগের দিন সন্ধেবেলা আমি ঐদিকের ঘরে দিদার সঙ্গে সাজ-সাজ খেলছিলাম, তখনই তো..."
"তখনই কী?"
পুলি থেমে গিয়ে বড় বড় দুটো পলক ফেলেছে। ছোট্ট নাকটা উত্তেজনায় ফুলে উঠেছে ওর; একবার ঢোঁক গিললো। কাঠবিড়ালীর সঙ্গে সাংঘাতিক মিল পাচ্ছি আমি।
"তখনই তো ... হাতোয়াপাড়ার মুখের পুকুরে ঝপাস-ঝুপ করে একটা খুউব শব্দ হলো।"
"আর ওমনি বুঝি তোমার মনে হলো ডাক্তারদাদু?"
সন্দেহের কোনও অবকাশ না রেখে একদম লম্বালম্বি ঘাড় নাড়লো পুলি, "হ্যাঁ তো, কারণ তার আগেই ডাক্তারদাদুর গলা শুনছিলাম ওই রাস্তায়, জোরে জোরে বকছিল কাকে। তাপ্পর ঝপাস-ঝুপ হয়ে এদ্দম চুপ।"
"কিন্তু চোর যদি ডাক্তারদাদুকে চুরিই করলো, তাকে নিয়ে জলে ঝাঁপালো কেন বলো তো?"
"জলেই তো থাকে ওরা..."
বিষম খেতে গিয়েও জোর সামলে নিয়েছি। হিমভরা, শিরশিরে গলায় পুলি যা বলেছে, তাতে ইয়ার্কির লেশমাত্র নেই।
"জলে কারা থাকে, পুলি?"
"জলের মানুষ ..."
"দেখেছো তুমি?"
"পাশের বাড়ির গলুই দেখেছে। আমি শুধু দেখেছি পুকুরের মাঝে জল গোল গোল মতো ঘুরে এক জায়গায় গর্ত হয়ে ঢুকে যাচ্ছে।"
"কিন্তু..."
"অন্ধকার, কতকতে মতো গর্তটা... ওখানেই ওরা নিয়ে গেছে ডাক্তারদাদুকে।"
আমি পুলির ডায়রিটা আরও একটু উল্টেপাল্টে দেখলাম, বেশিরভাগ দিনই এক লাইনের এন্ট্রি। ২১শে জুন লেখা "ফজলি আম কি ফাজিল হয়?" ১৩ই জুনে "আজ ডিম খেয়েছে কাক, আর কুসুম শালিক। আমি শুধু রুটি।" ১১ই জুলাই "ঘুঘু ঘু ঘু ঘু ঘু।" আর তারপর ১৮ই জুলাই ডাক্তারদাদুর চুরি যাওয়ার খবর। পুলির কনফিডেন্সের সামনে আমার দ্বিধা একেবারে ধোপেই টিকবে না। তাই আর কথা বাড়ালাম না; পুলি কেবল বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে এক দৃষ্টে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল আরও কিছুক্ষণ, বিশ্বাস করেছি কিনা বুঝতে চাইল হয়তো।
কিন্তু পুলির থিওরি যদি বাদও দিই, ব্যাপারটা বেশ চিন্তার। সান্যাল পরশু রাতে না ফেরায় তার একতলার ভাড়াটে আশেপাশে এক দুজনকে জানিয়েছিল বটে, কিন্তু গুরুত্ব দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। আসলে ডাক্তারবুড়ো পাত্তা পাওয়ার মতো যদ্দিন বাঁচার, বেঁচে নিয়েছেন -- ধারণা ছিল সবার। প্রায় তিন প্রজন্মের কাছে যে মানুষ 'দাদু', তার উপকারিতা নিয়ে সরাসরি না হলেও প্রশ্নচিহ্নের মতো মুখ করতো অনেকেই। জ্বরের ওষুধ হিসেবে সান্যাল আজও প্যারাসিটামল ৩০০ দিয়ে শুরু করেন, যেখানে চিকিচ্ছে-শাস্ত্র ১০০০-এর নিচে কথা বলে না। ৩০০-এ না কমলে সান্যাল বড়জোর ৫০০ দেবেন, তারপরেই শিফ্ট করে যাবেন ঘন-ঘন লেবুরজলে, আর সব শেষে ঝাঁঝালো হোমিওপ্যাথিক ইউপেটোরি পার্ফ ২০০-এ। আর সব কিছুর সঙ্গে সান্যালের অব্যর্থ ওষুধ, "ভয় নেই।" মাথা ধরা থেকে বাতে ধরা, ভয় সান্যাল কিছুতেই পান না। রুগীর বাড়িতে সকাল-বিকেল সেই মন্ত্র দিয়ে যান, থুড়ি, যেতেন। অবশ্য ভয় কেউ পেতও না, সে আলাদা বিষয়।
এ হেন গেঁয়ো যোগী হারিয়ে যাওয়ায় বীরেন বসু রোডে ডাক্তারি নতুন প্রাণ পাবে -- এই স্বপ্নে সবাই মাতোয়ারা হয়েছিল প্রথম দিন। পঁচিশ থেকে পঁয়ষট্টির অনেকেই নিজেদের স্বাস্থ্যপান করেছিল গতকাল সন্ধেতে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে আজ সকালে এসে! বাজার বুঝে পাশের পাড়ার তরুণ, ব্যাকব্রাশ করা সুজিত ডাক্তার চোঁয়া ঢেঁকুরের রুগী দেখতে এসে আধঘন্টার মধ্যে লিভার ক্যান্সার প্রেডিক্ট করে "খুবই ভয়ের ব্যাপার" বলে শেষ করেছেন। সেই থেকে ভিড় জমে গেছে সান্যালের আঙিনায়; গুমরে-ডুকরে বিলাপ উঠছে -- ডাক্তারবুড়োর সহজ কালমেঘের অঙ্কে যে সমস্যা মিটতে পারতো, এখন মনে হচ্ছে অঙ্কলজিস্ট ছাড়া গতি নেই। মুড়িমাসিও নাকিসুরে কেঁদে বললো, তার মুড়ির ধুলো চোখে ঢুকে করকর করছিল, সুজিত ডাক্তার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক দেখে নাকি বলেছে, রেটিনা ফেটে গেছে। ক্রমে ক্রমে আরও বেরোলো, তিমির কাকুর বুড়ি মায়ের জিভ সুজিত ডাক্তার দেখেছেন বারান্দার গ্রিলের এ পার থেকে টর্চ মেরে, কারণ করোনা-কালে মুখ খোলা পেশেন্টের কাছে যাওয়া এথিক্সের মধ্যে পড়ে না।
এসব চিন্তায় জর্জরিত সবাই, সান্যাল শেষ বয়সে এসে এভাবে চুরি হয়ে যাবেন, এমন পরিহাস ভাগ্যের -- এই নিয়ে যখন আলোচনা দানা বাঁধছে আরও, একটা গোলমাল, হইহই শোনা গেল সামনের দিকে। শাঁ করে রকেট স্পিডে ছুটে আসছে গলুই, দুই পায়ের ফাঁকে মাটির সঙ্গে সমান্তরাল করে ধরা একটা ধুলো ঝাড়ার ঝাড়ন, আর অন্য হাতে ধরা একটা ছোট্ট শুকনো গাছের ডাল। কাছাকাছি এসে থুপ থুপ করে নিজের পা দিয়ে ব্রেক কষে গলুই বললো, "ডাক্তারদাদু এসে গেছে!"
"সে কী রে", "বলিস কী", "কই", "আরে সান্যাল দা", "বাঁচালেন মাইরি" -- সমস্ত কথা আর চটাপট চটির শব্দে গলুই প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছিল, আমি হাতটা ধরে টেনে সরিয়ে নিলাম। কয়েক সেকেন্ড পরেই মেরুন সুটকেস হাতে হাঁফাতে হাঁফাতে সান্যালবুড়ো তার বিরাট লটর-পটর দেহটা নিয়ে এসে ঘরের তালা খুলে সটান গিয়ে আরামচেয়ারটায় বসলেন। ঢকঢক করে জল খেলেন পরশু রাতের গেলাসটা হাতে তুলে। ততক্ষণে ভিড় ঘন হয়ে এসেছে চারপাশে।
"কী হয়েছিল সান্যাল দা?" কে একজন জিজ্ঞেস করে উঠলো।
"হবে আবার কী! যতসব ইতর, চামারের দল! পুকুরের মাঝে আমায় টেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে, 'সত্যি করে বল্ রবি ঠাকুরের শেষ অপারেশনটায় নীলরতন সরকারকে ধাক্কা মেরে "ভয় নেই" বলে তুইই কাঁচি ধরেছিলি কিনা? নাহলে ঠাকুর আরও একশো বছর তো এমনিই হেসেখেলে...' যত্তসব!"
ঘরে পিন পড়ার শব্দও শোনা যাবে। সান্যাল ভ্রুক্ষেপ না করে বলে চললেন, "না কোনও মানে হয়, বলো! দেড় দিন ধরে তুমুল তর্কাতর্কি, বিচার! শেষে কিনা বেকসুর খালাস করে বলছে, সামনের বাইশে শ্রাবণে বিশেষ অতিথি হয়ে আসতে! সব শেষ হয়ে গেছে! কোরাপ্ট, কোরাপ্ট!"
আবার ঢকঢক শব্দ।
"তা যাগগে, কই কার নাকি চোঁয়া ঢেঁকুরের সমস্যা শুনলাম? চলো চলো, এট্টু কালমেঘেই... ভয় নেই!"
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সান্যালবুড়ো লড়ঝর করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন, যেন কিছুই অস্বাভাবিক কথা বলেন নি এতক্ষণ, যেন সদ্য মাছের বাজার থেকেই ফিরেছেন।
ঘরে তখনও সবাই স্তম্ভিত। এ কেমন ইয়ার্কি, কারুর মাথায় ঢুকছে না। সেই সুযোগ নেই সান্যালের পিছন পিছন গলুইও আমাদের সবার দিকে ওই ছোট্ট গাছের ডালটা তাক করে "পেত্তিফিকাস টোটালাস" বলে ওর ঝাড়নগাড়িতে থুপ থুপ করে পায়ে স্টার্ট দিয়ে, ছুট্টে বেরিয়ে গেল।
তোমার "গুরু" তকমা সার্থক, ভাইটি!