এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • শিকারোক্তি

    শঙ্কর সরকার
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৪৮৭ বার পঠিত
  • শূয়োরের মাংসের নাম শুনলে আমার দেশের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। ছোটবেলাটা প্রায় শুধু শূয়োর খেয়ে বড় হয়েছি। মাসির হাতের রান্না, মামীর হাতের রান্না এবং দিদিমার হাতের রান্না, তবে বেশিরভাগটাই দিদিমার হাতের রান্না খেয়েছি ছোটবেলায় এবং ওনার কাছেই বড় হয়েছি। ছোটবেলায় অবশ্য আমার মা কে জানতাম না। কারণ আমার মা আমায় ছোটবেলাতেই দেশে রেখে কলকাতায় চলে এসেছিলেন, তারপর দিদিমা এবং মাসিদের কাছে মানুষ হয়েছি। আজ প্রায় বছর দশেক হল তাদের হাতের রান্না শূয়োর খাইনি তবে আমার এখনো মনে আছে সেই দিনগুলো যখন আমাদের কারুর থালায় একটু বেশি মাংস পড়লে ভাই বোনেরা মারামারি করতাম, যে ও বেশি পেয়েছে আমি কেন কম পেলাম? তবে বেশির ভাগটা আমিই পেতাম এতে কোনও সন্দেহ নেই। দিদিমা কত রান্না করে আমায় খাইয়েছে। তার হাতের রান্নাটা একটু আলাদা ছিল, একটু ঝোলটা বেশি থাকত, কিন্তু সেই ঝালটা থাকবেই তাতে যে রান্নাই করুক। হ্যাঁ স্বাদটা অবশ্যই আলাদা, কিন্তূ অসাধারণ!

    দিদিমা অবশ্য এখন আর বেঁচে নেই মাছ ধরতে গিয়ে জলে ঢুবে মারা গ্যাছেন থাকলে হয়ত শূয়োরের ঝোল খেতে পারতাম। সেই সময়ে গ্রামে প্রায়শই শূয়োর কাটা হত। তখন আশেপাশের গ্রামের লোকেরা এসে সব কিনে নিয়ে যেত অথচ গ্রামের লোকেরা ভাগে পেত না। মাঝে মাঝে এই মাংস নিয়ে কত যে মারামারি হত তার ঠিক নেই তবুও শূয়োর খাওয়া হত। তবে দেশের রান্নাটা আমার খুবই প্রিয় ছিল। মামাবাড়ির রান্নাটা বেশ হত, একদম ছোট ছোট টুকরো এবং মারত্মক ঝাল দেওয়া রান্না খেলে নাক মুখ থেকে জল বেরতই। পরে চিনি দিয়ে ঝাল তাড়াতে হত কিন্তূ রান্নার অসাধারণ সুস্বাদ সেটা ভোলা যায় না। তাছাড়াও আমরা বন্ধুরা মিলে নিজে রান্না করে কত খেয়েছি। বন্ধুদের নিয়ে একটা রান্নার গল্প আছে।

    সেদিন খুব ঠান্ডার দিন ছিল আমরা ৫ জন- জগা, সিবু, ছোট্ট, আমি এবং কেনতু, সব বন্ধুরা মিলে স্কুল ছুটির পর জঙ্গলে যাওয়ার প্লান করলাম বনভোজন করার জন্য। সবাইকে বলা হল বাড়ি থেকে চাল ডাল আনতে তারপর জঙ্গলে যাওয়া হবে। তারপর সবাই একটা জায়গায় জমা হলাম, তখন দেখা গেল যে বেশির ভাগ বন্ধুরা চাল ছাড়া কিছুই আনেনি। ঠিক করা হল যে পাখি শিকার করতে হবে, ফাঁদ নিয়ে আশা হোক। তারপর গেলাম জঙ্গলে পাখি ধরতে কিন্তূ পাখি আর কপালে জুটলো না বন্ধুরা সবাই বলতে শুরু করলো বাড়ি চল। আজ পাখি পাওয়া যাবে না। আর একজন বল্লো এসেছি যখন কিছু একটা করতে হবেই। জগা তখন বল্লো চল তালে আদিবাসীদের শূয়োর মারা হোক। বেশ গেলাম শূয়োর মারতে। সেখানে গিয়ে দেখি বাচ্চা বাচ্চা শূয়োরগুলো তাদের মায়ের কাছে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু কী করা যায়? সামনে গেলে হয়তো বুড়ো শূয়োরটা তেড়ে আসে। ঠিক করা হল সবাই মিলে লাঠি নিয়ে সবগুলোকে তাড়া করা হোক। যেই বাচ্চাটা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাবে, তাকে ধরা হবে এবং সে আমাদের ভোজন হয়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত ২টো বাচ্চা ধরা হয়েছিল এবং আমরা একটাকে ছেড়ে দিয়ে আর একটাকে জঙ্গলের ভেতর একটু দূরে নিয়ে গিয়ে সেটাকে কাটা হল। চাকু ছুরি ছিল না তাই ব্লেড দিয়ে মাংস টুকু কেটে নিয়ে নুন মাখিয়ে পুড়িয়ে খাওয়া হল।

    একবার তো আমারা শূয়োরের মাংস খেয়ে আসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম আর কত কি করেছি তার ঠিক নাই। লাস্টবার দেশে গিয়ে তো আমরা প্রায় ৫০ কেজি ওজনের শূয়োর কেটে বাজ?আরে বেচেছিলাম, তবে সেই দিনগুলোর মতন দিন এখন আর হয় না। এখন লোকেরা প্রায় শূয়োর খায় না কারন শূয়োর এখন প্রায় নেইই বললেই চলে। তাছাড়া সবাই বাবু হয়ে যাওয়ায় শূয়োর কম পোষে। তবুও এখনো আদিবাসীদের যা শূয়োর আছে সেগুলৈ অনেক। সেগুলোকে যদি মেরে খাওয়া যায় বেশ সুস্বাদু হবে। কিনে খেলে পড়তায় পোশাবে না তাছাড়াও কিনে খেয়ে সেই মজাটা পাওয়া যাবে না। কিন্তূ আবার তারা যদি ধরে ফেলে তাহলে আর এক ঝামেলা। কত টাকা গুনতে হবে ঠিক নেই। তবুও শূয়োর খাবার জন্য রিস্ক নেওয়াই যায়।

    আদিবাসীদের শূয়োরের স্বাদ খুব ভাল হয়। কারণ ওরা শূয়োরদের খুব ভাল ভাল খাবার খাওয়ায়। আমি দেশে গ্যালে শুয়োরটা একদিন মেনুতে থাকবেই। আমার মেসোমশাইকে আদিবাসীরা খুব শ্রদ্ধা করে। কারণ সে সব সময় আদিবাসী বসতিতে থাকে এবং তাদের সঙ্গে কাজ করে। আর প্রায়শই তারা শূয়োর কাটে। একদিন রাত্রে মেসোমশাই আমায় জঙ্গলের এক ইঁটভাঁটায় নিয়ে গ্যাছিলেন সেখানে আদিবাসীরা শূয়োর কেটে ছিল। এরকম প্রায়ই হয়। যখনই তারা কোনও ইঁটভাঁটায় ইঁট পোড়ায় তখন সেই আগুনে তারা শূয়োর বা মুরগি রান্না করে এবং গভীর রাত পর্যন্ত তারা মহুয়া আর মাংস খায়। আদিবাসীরা অদ্ভুত ভাবে এই সুস্বাদু রান্না করে। যদিও তারা মাংস খুব পরিস্কার করে না তবুও খেয়ে মজা আছে। আমার তো সেই দিনগুলো মনে পড়লে মনে হয় এখনই দেশে চলে যাই কিন্তু সেই সময়টা তো আর নাই। এক সময় ছিল যখন আমিও আদিবাসীদের ভাষা বলতে পারতাম এবং কত আদিবাসীদের সঙ্গে মিশেছি এক সঙ্গে কত কী করেছি! কোনও কোনও সময় শিকারও করেছি তাদের সঙ্গে। এখন অবশ্য পশু-পাখি কম হয়ে গাছে। আগে যা ছিল তার তুলনায় এখন কিছুই নাই। তখন আদিবাসীদের সাথে মিশে কত রকম মাংস খেয়েছি তা ভোলা যায় না। কিছু কিছু আমার এখনো মনে আছে যেমম ময়ুর, বুনো খরগোশ, হরিণ, পাখি তো প্রায় সবই খেয়েছি।

    তবে ইচ্ছা ছিল ভল্লুক খাওয়ার সেটা খাওয়া হয়নি কারণ তখন ইচ্ছা ছিল না। এখন ভল্লুক এর মাংস পাওয়া খুব কঠিন আদিবাসীরা সবই খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। কিছু কিছু ভল্লুক এখন চালক হয়ে গাছে। তারা জঙ্গল ছেড়ে বের হয় না। কিন্তূ কতদিন থাকবে? বছর শেষে মহুয়া ফুলের নেশায় তারা ঠিক আসে। মহুয়া ফুল তাদের খুব পছন্দের ফুল। রাতে তারা দলে দলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে মহুয়া খেতে তখন যদি আদিবাসীরা দুই একটা মারতে পারে তাহলে তাদের আঙ্করা হয়ে যায় মানে পার্টি। কিন্তু বুনো শূয়োর এখনো প্রচুর আছে। সেগুলো আবার চাষের পর জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং তাদের ধরা মনে স্ট্রেট মৃত্যুকে ডেকে আনা। তাদের ধরতে গেলে তিন-চার জন লাগে এবং তীর দিয়ে মারতে হয় কারণ বুনো শূয়োর অন্যের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়। একবার কামড়ালে ছাড়তে চায় না।

    বুনো শূয়োর মারার অভিজ্ঞতাও আমার আছে, একবার গ্রামে একটা ঢুকে পড়েছিল এবং ধানের ক্ষেতের বারোটা বাজাচ্ছিল। আমরা কিছু বন্ধু মিলে ধরতে গ্যাছিলাম কিন্তূ সে উল্টে আমাদের তাড়া করে ছিল। শেষ পর্যন্ত আদিবাসীদের ডাকতে হয়েছিল। তখন তারা তীর ধনুক নিয়ে এসে সেটাকে মেরে ফেলে। তারপর তো তারা অঙ্করার খুশি ধরে রাখতে পারছিল না। খুশি হলে কী হবে আমরাও ঠিক করলাম ভাগটা তো নিতেই হবে। বুনো শূয়োর বলে কথা ছাড়াটা পাপ হবে। তাই ওদের কাছে ভাগ চাইতে গেলাম তারা কিছুতেই দিতে চাইছে না। আদিবাসী জাত অত সহজে ছাড়বেনা। তখন যার জমি সে এসে বলল তার জমির লোকসান হয়েছে সেটার কী হবে? তখন আদিবাসীরা বুঝতে পারল এখন থেকে বুনো শূয়োরের ভাগ না দিয়ে নিয়ে যাওয়াটা চাপ আছে। তাও দিতে চায়না তারা। তারা বলল রান্না করে দেবে আমরাও রাজি হয়ে তাদের সঙ্গে তাদের বসতিতে গেলাম। আমরা জানতাম ভাগ না নিয়ে ওদের বাড়ি গেলে লাভ ছাড়া লোকসান হবে না। বাকি বন্ধুরা মদ্যপান করত, মহুয়া নয়। তার মধ্যে জগ ছিল পাক্কা মাতাল সে সবই পান করত। সবাই তো মদ্যপান করছে আমি আর এক বন্ধু বসে আছি কখন মাংস আসবে তারপর সেটাকে খাব? বেশ মাংস আসলো। খাওয়া হল। খেতে বেশ লাগলো। দাঁড়াও আরও এরকম অনেক গল্প আছে একটু মনে করতে দাও।

    -২-

    যেহেতু আমি শূয়োর নিয়ে লিখছি তাই কচ্ছপ, খরগোশ বা ব্যাঙ-এর কথাটা লিখছি না। সেগুলো লিখলে হয়ত পুরো একটা বই লিখে ফেলা যায়। তবুও একটা না লিখে পারছিনা। যেটা হল তিত্তর পাখি, জানিনা ওটার এখানে কী নাম? পাখিটা মুরগির মতন দেখতে কিন্তু গায়ে চাক চাক দাগ এবং উড়তে পারে। স্বাদ মুরগির চেয়ে একটু বেশি এবং ওটাকে যদি নুন হলুদ লঙ্কাগুড়ো আর তেতুলের গোলা দিয়ে মাখিয়ে পড়ানো যায় সেটা খেলে আর মুরগির কথাটা মনে পড়বে না। সেই স্বাদ আমি এখনও ভুলিনি। তবে এগুলো বাড়িতে রান্না হত না, সমবয়সীরা মিলে এটা করতাম। একবার তো এক আদিবাসী প্রায় আমাদের ধরে ফেলেছিল, ভাগ্গিশ তীর ছোড়েনি। সে অনেক লম্বা গল্প, নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নদীর কূলে শূয়োর মেরে ফেলেছিলাম। সেটাকে প্রায় খেয়েও ফেলা হয়েছিল। কিন্তূ এমন সময় এক আদিবাসী আমাদের দেখে ফেলেছিলেন। ব্যাস তারপর গলাগালি কাকে বলে! মনে হচ্ছিল যেন মুখ দিয়েই তীর ছুড়ছে। আমরা তো দৌড় মারলাম। আর থামে কে? যে যেদিকে পারছে দৌড়ে যাচ্ছে, তবে সেটাও একটা আলাদা মজা ছিল। যেটা এখন আর হবে না হয়ত।

    তখন মসি বাড়িতে কত শূয়োর ছিল কিন্তূ সেগুলো খেয়ে, চুরি করে খাওয়ার মজটা পাওয়া যাবে না। সে সময় লোকের বাড়িতে বাড়িতে শূয়োর থাকত এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। তখন তো আদিবাসীদের কাছে কত শূয়োর ছিল সেটা তারাও জানত না। হ্যত তার থেকে দু একটা মেরে খেলে, ক্ষতি কী? হ্যাঁ একটু রিস্ক থাকে যদি দেখে ফেলে তো গন্ডগোল হয়ে যাবে। তাই আমরা আমাদের গ্রামের কোনও আদিবাসীদের শূয়োর খেতাম না। দল বেধে নুন মসলা নিয়ে চলে যেতাম জঙ্গলে। বনভোজনটা প্রায়ই হত আমাদের। কোনও সময় বক দিয়ে বা কোনও সময় খরগোস দিয়ে। শূয়োর তো থাকতই। সপ্তাহে একবার। সে কথা কী বলে আর বোঝানো যায়? এমনও দিন ছিল যেদিন আমরা শুধু পাখি খেয়ে বেড়াতাম। মাছের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তখন আর মাছ খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তাই শুধু বক, পাখি, খরগোশ, শূয়োর মেরে বেড়াতাম। তবে একটা জিনিস আমার খুব প্রিয় ছিল, দিদিমা খাওয়া শিখিয়ে ছিল, সেটা হল শূয়োরের মাথার ঘিলুর তরকারি। সেটা দিদিমা প্রায়ই রান্না করত। সেটা মাসিরা রান্না করতে পারত না। আর একটা জিনিস মাসি খুব ভাল রান্না করত সেটা হল শূয়োরের জিভ। সেটা আমার মেসোমশাইয়ের প্রিয় ছিল, মহুয়া দিয়ে খেত। মসি বেশ ঝাল মসলা দিয়ে ভাজা করত। সেসব লিখতে লিখতে আমার জিভে জল চলে আসলো।

    ছোটবেলায় চাষের সময় বন্ধুরা মিলে মাঠে লোকের গরু চরাতে যেতাম এবং চাষ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চরাতম। কারণ চাষের সময় গরু ছাড়া যায় না। চারিদিকে ধানের ক্ষেত থাকত তাই গরু ছাড়লে ধান ক্ষেতে ঢুকে পরত। তাই গরু চরানো। তবে চাষের পর ছিল আসল মজা। যেটা হল গরুর মালিকরা প্রত্যেকে মুরগি, ছাগল বা কেউ কেউ শূয়োরও দিত। বেশিরভাগ সময় সবাই শূয়োর দিত। বাড়ির লোকেরা বলত, শূয়োরটাকে রেখে দে খাস না। সে কথা কে আর শোনে? আমরা প্রতি সপ্তাহে বাজারে একটা করে শূয়োর কেটে বেচতাম এবং দুই তিন কেজি নিজেদের জন্যে রাখতাম। বাজার শেষে আমরা জঙ্গলে ক্যানালএর কাছে গিয়ে মাংস রান্না করে, ক্যানালে স্নান করে, সবাই নিজের নিজের শাল পাতা ছিড়ে আনা হত এবং পাতায় করে সবাই সেই মাংস খেয়ে দেয়ে মহুয়া গাছের তলায় ঘুম দিতাম। মহুয়া গাছের তলায় যে কী ঘুম হয় সেটা যে ঘুমিয়েছে সেই বুঝবে এবং জঙ্গলের বেশ পাখির ডাকের শব্দ আর একটা বনফুলের সুগন্ধ নাকে গ্যালে সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়। সেটা আর নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে আর একদিকে ভল্লুক এবং বুনো শূয়োরের ভয় থাকে। তাই পাশে একটু আগুন জ্বালিয়ে শুতে হয়। ঠিক আদিবাসীরা যেরকমটা করে।

    আদিবাসীরা বেশ মজাতে থাকে। খায় দায় আর শিকার করে বেড়ায়। আদিবাসীদের আসল খাবার দিনটা হল যখন ওদের কারুর বিয়ে হয়। একদিন গ্রামের ছেলেরা মিলে আর এক গ্রামে, এক আদিবাসীর গ্রামে বিয়ে খেতে গেছিলাম। ওদের বিযেতে যে কেউ যেতে পারে। কোনও নিমতন্ন করা লাগে না। সেদিন অনেক দূর গ্রাম থেকে সব লোকেরা আসে খেতে। আমরাও সেদিন গেলাম বিয়ে খেতে, শুধুমাত্র মাংস খেতে। কারণ আদিবাসী বিয়েতে তারা ঠিক আগের দিন শিকার করতে বেরোয়। আর নানা রকম জীবজন্তু ধরে এনে পরের দিন বিয়েতে রান্না করে এবং ওদের বিযেতে একটা অদ্ভূত নিয়ম আছে যে, সবাইকে মহুয়া খেতে হবে আর ওদের সঙ্গে নাচানাচি করতে হবে। কিন্তু আমরা তো গ্যাছিলাম শুধু খেতে, তাই আমরা সোজা খাবার জাগায় ঢুকে পড়লাম তারপর ওখানে দেখলাম শুধু মাংস লাইন দিয়ে সাজানো আছে এবং আমরা জানিনা কোনটা কিসের মাংস কিন্তু খেতে এসেছি যখন খেয়েই যাব ঠিক করলাম। তারপর আদিবাসীদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে হবে কারণ রাতে প্রচুর ভাল্লুক। রাস্তায় হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই আদিবাসীদের সঙ্গেই ফেরাটা ঠিক হবে।

    -৩-

    পরেরদিন আবার মামার সঙ্গে কীর্তনে যেতে হবে। সেখানে অবশ্য মাছ মাংস থাকবে না।অতবুও দল ভারি করার জন্য এবং অন্য গ্রামের মেয়েদের দেখতে যেতে হবে। এক গ্রামের থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে সারা রাত ধরে যখন কীর্তন চলছে তেমন অন্যদিকে আমরা গ্রাম ঘুরে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছি। তখন হয়ত মালকানগিরির সব গ্রামের উঠতি মেয়েদের নামগুলো মুখস্থ ছিল। মামাবাবু চিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের অন্ধ ভক্ত। ঠিক দিদিমার মতন। মালকানগিরির বাপনপল্লীর বাড়িতে মামাবাবু হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তদের একটা দল গড়ে তুলেছেন যেখানে তিনি ছিলেন সবার প্রিয়জন। আর একদিকে ছিলেন কৃষ্ণ ভক্তর দল তাদের হরিচান্দ ঠাকুরের সাথে কোনও সম্পর্ক নাই। কারণ তারা সবাই খুব চিন্তিত যে কোন ঠাকুর বড় হরিচাঁদ না কৃষ্ণ? যার কারণে দুই দলের মধ্যে হিংসা হিংসি লেগেই থাকে। মামাবাবু অবশ্য এগুলোর ওপর ধ্যান দেন না। দিদিমা ছিলেন আরও ভক্ত। তিনি হরিচাঁদের জন্যে পাগল ছিলেন এবং সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন কখনো ঠাকুরনগর বা কখনো তরকেশ্বর। আর হরিচাঁদ ঠাকুরের গানের বই কিনে বেড়াত। পড়তে না পারলেও গানগুলো সব জলের মতন মুখস্থ করে রেখেছিলেন।

    আমার দিদিমা খুব স্মার্ট বুড়ি ছিলেন আমার এখনো মনে আছে যখন তিনি আমায় কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন তখন তার কাছে ট্রেনের টিকিট কাটার টাকা পর্যন্ত ছিলনা। তিনি সারা রাস্তা ট্রেনে গান গাইতে গাইতে কলকাতা পৌঁছে ছিলেন আমাকে নিয়ে, আমার মাএর খোঁজে। তারপর কলকাতাতে এসেও তিনি মাস খানিক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন কারণ তিনি জানতেন না যে আমার মা কোথায় আছে। এভাবে তিনি আমাকে নিয়ে যে ভাবে কলকাতায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন সে কথা আর মুখে বলা যায়না। তবুও তিনি আমার মা কে খুঁজে বার করেছিলেন। কিন্তূ খুঁজে বার করাটা বড় কথা না। তিনি যেভাবে একমাস আমাকে নিয়ে টাকা পয়সা ছাড়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছেন সেটা ভাবলে আজ কেমন যেন লাগে। কলকাতায় আসার পর পুরো মজাটাই শেষ হয়ে গ্যেছে। দেশের সেই দিনগুলো আমি এখনো ভুলতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় এখনই চলে যাই। প্রায় বছর তিনেক পর আবার দেশে গেলাম কিন্তূ সেই দিনগুলোর মতন এখন আর কিছুই নেই। বন্ধুরা সবাই এখন বাইরে বাইরে কাজ করে বেড়ায়। কেউ অন্ধ্রা, কেউ চেন্নাই কেউ ভুবনেশ্বর। বিল্ডার্সের কাজ, বড় বড় বাড়ি, সাবওয়ে, ওভারব্রিজ। যার কারণে গ্রামটা একদম ফাঁকা হয়ে গাছে। এবং গ্রামে কারেন্ট আসার পর সেই অন্ধকারে ঘুরে বেড়ানোর মজাটা হারিয়ে গাছে। মানুষ জঙ্গল কেটে ফেলছে, পাহাড় ভেঙ্গে ফেলছে যার কারণে গরমের সময় বাইরে বেরনো যায় না এত গরম।অএবং আগে যে পরিমাণে পশু পাখি ছিল সেগুলো সব কম হয়ে আর শেষ হয়ে গ্যাছে। সব থেকে বড় কথা হল যে সেই বুনো শুয়োর, খরগোশ, ভাল্লুক, শিয়াল সেগুলোর আর কিছুই দেখতে পারলাম না। এই প্রথমবার দেশে গিয়ে আমি শুয়োরের মাংসের সেই ছেলেবেলা জোড়া গন্ধটুকু পাইনি, সেটা ভাবলে কেমন অদ্ভুত লাগে, যেখানে এক সময় শুধু শুয়োর খাওয়ার জন্যে যা মারামারি হত, মানুষে-মানুষে, ভাইতে ভাইতে, সেখানে নাকি আজ শুয়োরের কোন চিহ্ন নেই।

    ছবি- শঙ্কর সরকার
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৪৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন