নর্মা যে কবে থেকে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেছে ভাল মনে নেই। বছর আঠেরো-কুড়ি হবে। আমদের কর্তা-গিন্নির ফুল-টাইম কাজ করে বাড়ির কাজে যে পরিমাণ গাফিলতি হচ্ছিল, সেই গাফিলতি ঢাকতে বিবেকের তাড়নায় মঞ্চে নর্মার প্রবেশ। নর্মা মেক্সিকান। আমাদেরই বয়েসী। ভাঙা ভাঙা ইংরিজি জানে। অসম্ভব কর্মঠ। আসত বোনকে নিয়ে প্রতি দু-হপ্তা একবার। বদলি শনিবার। রান্নাঘরের সিংক, কাউন্টার টপ, ওভেন টপ, মাইক্রোওয়েভ, টোস্টার ইত্যাদি, ওভেনের ওপরের এক্সহস্টের হুড পরিস্কার করত। বেকিং ওভেনের বাইরেটা পরিস্কার করত। ফ্রিজের বাইরে-ভেতর। করত রান্নাঘরের মেঝে মপিং। বাথ্রুমের বাথটব আর শাওয়ার, সঙ্গে কাঁচের দরজা, টয়লেট, সিংক, বাথ্রুমের মেঝে। সারা বাড়ির মেঝে পরিস্কার - কার্পেট হলে ভ্যাকুয়াম, হার্ডউড হলে মপিং। সঙ্গে ফার্নিচারের ধুলো ঝাড়া। লিখতে গিয়ে ঠাহর হচ্ছে, কতটা কাজ করত। সময় লাগত ঘন্টা দুয়েক। নিত, যদি খুব ভুল না করি, পঁয়ষট্টি ডলার। মানে ঘন্টায় ষোল ডলার। তখন বোধহয় ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যুনতম মজুরি ছিল ঘন্টায় সাড়ে ছ'টাকা মতন। কিন্তু এখন যেমন, তখনও তেমন - এই স্যান ফ্র্যান্সিসকো অঞ্চলে ন্যুনতম মজুরি কেন তার তিনগুণ মজুরিতেও সংসার চালান প্রায় অসম্ভব। নর্মা যে কী করে চালাত, কে জানে। অথচ আমাদের কাছে বেশি চায়নি কখনও। পারমিতা আমাদের অনেক বন্ধুদের কাছে নর্মাকে রেকমেন্ড করেছে। তারা নর্মাকে বহাল করেছে। তাদের কাছে, শুনেছি আমাদের থেকে বেশি নিয়েছে, পরিস্কার করার জায়গা তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও। কেউ হয়ত অভিযোগ করেছে, তুমি পারমিতার থেকে কম নাও। নর্মা জবাব দিয়েছে, পারমিতা আমার পুরনো কাস্টোমার।
যে শনিবার নর্মা আসত তার আগের সন্ধ্যেবেলা আমাদের থরহরিকম্প - কাল নর্মা আসবে। নর্মা আসবে বলে বাড়ি পরিস্কার করতে হবে। শুনতে আশ্চর্য লাগবে যে যে বাড়ি পরিস্কার করতে আসবে তার জন্যে বাড়ি পরিস্কার করতে হবে (অনেকটা, "মনে রবে কিনা রবে আমারে - সে আমার মনে নাই"-এর মতন অবস্থা)। কিন্তু মেয়ে তখন ছোট। সারা সপ্তাহ ধরে সে তার ঘরে খেলা করতে গিয়ে মনের আনন্দে সব খেলনা ছড়িয়েছে, ছড়ানো কাগজে আঁকিবুঁকি কাটা, জিগস পাজলের টুকরো মেঝেতে ছড়ানো। সঙ্গে স্টিকার, প্লেডো - কী নেই! তার ওপর প্রায় প্রতি শুক্কুর সন্ধ্যেয় বন্ধুসমাগম হত বাড়িতে। তাদের মেয়েরাও আমার মেয়ের বয়েসী। কাজেই নিজেদের ঘরে তোলঘড়িমাত। গভীর রাতে, বন্ধুরা চলে যাবার পরে, রান্নাঘরে জিনিসপত্র তুলে, থালাবাসন - কিছু মেজে, বাকি ডিশওয়াশারে লোড করে - কর্তা গিন্নি মেয়ের ঘরে গিয়ে খেলনা পরিস্কার করে তবে শুতে যেতে পারতাম। মেয়ে তখন গভীর ঘুমে। এ জিনিস জীবনে এমন সাইকোলজিকাল স্কার রেখে গেছে যে এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি আমি আর পারমিতা মেয়ের ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে জিগস পাজলের টুকরো কুড়োচ্ছি।
এরপরে ২০১০ সালে দেশে চলে গেলাম। নর্মার পাট উঠল। যে জিনিস এখান থেকে নিয়ে যেতে পারব না, তার থেকে পছন্দমতন জিনিস নর্মাকে নিয়ে যেতে বলেছিল পারমিতা। অল্পই কিছু নিয়েছিল। ২০১৩ সালে আবার ওয়াপাস ফিরে এলাম অ্যামেরিকায়। পুরনো ঘর, ঘুরনো ঘাড়, কুড়নো জঞ্জাল। আবার নর্মা বহাল হল। ততদিনে নর্মার ছোটমেয়েও বড় হয়েছে। সেও চলে আসত মার সঙ্গে মাঝেমাঝে, আমার মেয়েদের সঙ্গে খেলতে। ততদিনে, নর্মার ব্যবসা বেড়েছে। অধিকাংশ দিনই নর্মা নিজে আর আসেনা। আসে তার বর আর, হয় বোন নয় কর্মচারী। তাদের কাজ মাঝেমাঝে পারমিতার পছন্দ হয়না। সে নর্মাকে ফোনে অভিযোগ জানায়। পরেরদিন নর্মা নিজেই আসে। এইভাবেই চলছে। ইতিমধ্যে আমরা বাড়ি বদল করি। নতুন বাড়িতেও নর্মাই বহাল। এতদিনে নর্মার মজুরি বেড়েছে। আজকাল সে আর তার বর আসে কাজ করতে। অভিযোগের কোন কারণই ঘটতে দেয়না।
এই করতে করতে হইহই করে এসে পড়ে কোভিড। সারা দেশ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লকডাউনে ঢুকে যায়। অন্ততঃ যাদের সেন্স আর সেন্সিবিলিটি ট্রাম্পে আচ্ছন্ন হয়ে যায়নি। আমাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বারণ করতে হয় নর্মাকে আসতে। শুধু আমরাই নয়, তার সব ক্লায়েন্টই লকডাউনে চলে যায়। রুজিতে টান পড়ে। আমাদের আর ক্ষমতা কত, তাও স্থির করি কাজ করলে যে মজুরি সে পেত, তা আমরা চালিয়ে যাব। নর্মা আসে প্রতি মাসে। মজুরি নিয়ে যায়। আর এই সময়ে তাকে নতুন করে আবিষ্কার করি আমরা। তার ওয়ার্ক এথিক্সকে। নর্মা নিয়ে আসে তার মেয়েকে। বাড়িতে ঢোকা বারণ, তাই সে মেয়ে নিয়ে পেছনের উঠোন, সামনের দাওয়া ঝাড়ু দেয়। বাড়ির চারদিকের একতলার জানলা সব বাইরে থেকে ঘষে ঘষে পরিস্কার করে। কেউ তাকে করতে বলেনি। কিন্তু কাজ না করে পয়সা নিতে তার এথিক্সে বেঁধেছে। সে, সরকারি ভাষায় যাকে বলে, আনস্কিলড ইমিগ্র্যান্ট। হয়ত কাগজপত্র ঠিক ছিলনা একসময়ে। কিন্তু তার এথিক্স দেখে শ্রদ্ধা জাগতে বাধ্য। আর মনে পড়ে, এই কাজ করে সে মেয়েদের বড় করছে। বড় মেয়ে স্যান হোজে স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছোটমেয়ে হাইস্কুলে যাবে। আর, এর বিপ্রতীপে মনে করতে বাধ্য হই, এদের মতন সৎ, কর্মঠ, খেটেখাওয়া, দেশ-গড়া ইমিগ্যান্টদের প্রতি ট্রাম্পকুলের মিথ্যে, তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা।
দু হপ্তা আগে, আমাদের ভ্যাক্সিন শুরু হয়ে যাবার পরে আবার নর্মা বাড়ির ভেতরে আসছে। বলল, তার আর বরেরও একটা ডোজ ভ্যাক্সিন হয়ে গেছে। তার অন্যসব ক্লায়েন্টও আবার দরজা খুলে দিয়েছে তার জন্যে। থিংস আরে গুড, অলমোস্ট ব্যাক টু নর্মাল। আমি নর্মাকে দিয়ে আরেক অ্যামেরিকা চিনি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।