‘দুদিন আগেই তো বলতিস বাজপেয়ী সেরা, মোদী সেরা। আজ বিজেপির নামে গালাগালি দিচ্ছিস কেন?’ ‘ কমরেড বলে তো লোকে তোকে গালাগালি করতো , এখন হঠাৎ মমতার দিকে হেলে গেলি কেন? ‘ ‘শালা হিপোক্রেট কমিউনিস্ট , এতদিন কংগ্রেসের বুর্জোয়া রাজনীতির এগেনস্ট এ কথা বলতিস , হঠাৎ কি হলো কংগ্রেস কংগ্রেস করছিস।’ এরকম গালাগালি রোজ খাই। ভরপুর খাই। মন ভরে খাই। না কোনো পার্টি করি। না বাবা কাকা কেউ পার্টি তে আছে যাদের সাপোর্ট করি। কিন্ত দলবদলের রাজনীতির গালাগালি আদ্যোপান্ত খাই। লোকে মনে করে যে পার্টি বেশি ঘুঁষ দেয় সেই পার্টির হয়ে বলি। এখন তো আবার মিডিয়ার কেনা বেচা তো আছে। আমার এই ইন্টারনেট মুক্ত মঞ্চ এখনো এক পয়সাও দেয়নি , তো পার্টি কোন ছাড়।
লোকেদের মুখ বন্ধ করার কোনো দরকার নেই। তবু প্রচুর গালাগালির জবাব দেওয়া বাকি। তাই বলছি। আমি কোনো দলের নই। মন থেকে তীব্র বামপন্থী,যুক্তিবাদী আবার স্পিরিচুয়াল । কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মোদী কে সাপোর্ট করতাম। বাজপেয়ীর গোল্ডেন কোয়াড্রিলিয়টরাল প্রাণ দিয়ে সাপোর্ট করেছি। মমতা কে পাগলী মাগিও বলেছি। কিন্তু অগ্নিকন্যাও মানি। খ্যাপামি না থাকলে ওই লেভেল এর পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। জ্যোতিবসুর মৃত্যুতে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলাম। কিন্তু কমন স্ল্যাং “জ্যোতে পাঁঠা “ বলে খিল্লি করতেও ছাড়িনি। লালুর কেলেঙ্কারি নিয়ে এথিকাল প্রশ্ন তুলেছিলাম , কিন্তু রেলের ভাড়া কমানোতে সঙ্গে ছিলাম, যদিও সেটাও বড় গিমিক ছিল। মনমোহনের মৌনতা থেকে আসারামের যৌনতা সব কিছু নিয়েই আমি ভ্যাজাল বকেছি। তাহলে আমি কি।
আমি সদাই বিপক্ষে। আমি খুঁত ধরি। আমি চিৎকার করি। আমি যাকে আজ ভালো বলি কাল তাকেই গালাগালি দি। আমি স্তাবক নই। আমি প্রশংসাও করতে পারি , নৃশংস ঘৃণাও করতে পারি। কাউকে মেনে চলা মানে তার কাছে, তার চিন্তাভাবনার কাছে হেরে যাওয়া। ওরা কি বাবা , না মা। বাবা মার সমালোচনা যখন করতে পারি তখন এরা তো চাকর। কেউ ভালো চাকর , তাদের ভাল কাজকে সাপোর্ট করি। কেউ ভালো ছিল , এখন বার খেয়ে খারাপ হয়েছে , তাদের দিই ঠুকে। কেউ খারাপ ছিল কিন্ত লোকেদের মুরগি করে ভালো সেজেছে , দিই এক টানে তার মুখোশ খুলে।
কারো খুঁত বার করা খুব সহজ। খুব , খুব , সহজ। কিন্তু বিপক্ষে থাকা খুব কঠিন। আর সেটা যদি বস্তু বা ব্যক্তির বিপক্ষে না , তাদের কর্মকান্ডের বিপক্ষে। কারণ তারা অনেক সময় এমন কাজ করে যেটা তুমি বুঝতে পারছো মাথা ঘোরানোর জন্য করছে , কিন্তু তুমি বলতে পারবে না। কারণ সেগুলো দরকার। সবসময় সব কিছু ঠিক করা যায় না। আর আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখার। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা তাদের সামনে, যারা আসল কাজ করবে। যারা কাজ করে তারা কখনোও নিজের কাজ বিচার করতে পারে না। তাই রান্না করে অন্যদের দিয়ে টেস্ট করাতে হয়। আমাদের অস্তিত্ব যদি স্বাধীন থাকে তাহলে কোনো কাজ করতে সবাই ভয় পাবে। এই ভয় এনে দেবে পারফেকশন। আর তাতেই এগিয়ে যাবে সমাজ।
আমরা সমালোচনা করবো। আর সমালোচনা কে যারা ভয় করবে তাদের উপড়ে ফেলবো। কারণ যারা সমালোচনা কে ভয় করে তারা কাজের যোগ্য নয়। যারা সমালোচনাকে পাথেয় করে তারা উত্তম কর্মী। আমরা চাই আমাদের মুখ এরা বন্ধ করুক। কিন্তু গায়ের জোরে নয়। বৃক্ষ , ফলেন পরিচয়তে। করে দেখাক কাজ , আমরা চুপ করে যাবো। কারণ আমরা কন্সট্রাক্টিভ ক্রিটিসিজম এ বিশ্বাস করি। ভালো কে আরো ভালো , আরো ভালো করার রসদ যোগাই। পিঠ চাপড়ে “দারুণ” বলিনা। বলি , “আরো ভালো করতে হবে।”
গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ অবদান এই বিপক্ষবাদ। এর অস্তিত্ব যখন কমতে থাকে বা কমানোর চেষ্টা করা হয় তখন বাতাসে ভরে ওঠে একনায়কতন্ত্রের পচা গন্ধ। ঐসব যদা যদা হয় ধর্মস্য টাইপ কথার দিন শেষ। কেউ ধর্মী , কেউ অধর্মী নয়। সবাই চায় পৃথিবীর বুকে কিছু পদচিহ্ন রেখে যেতে। সবাই চায় , সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন। ভালো খাওয়া , ভালো পড়া আর শান্তি। কিন্তু সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট এর কারণে , পাঁঠার ঝোল রবিবারের শান্তি। আমরা সবসময় সেই পাঁঠাদের দলে। আমরা চিৎকার করি। হাত পা ছুঁড়ি , তাতে হয়তো কয়েক ঘন্টার জন্য এই পৃথিবীর বুকে নিঃস্বাস নেওয়ার অধিকার জিতে নিই। আমার রক্তে দুপুরের ঘুম আসবে বলে আমি গিয়ে হাঁড়ি কাঠে মাথা নিজে থেকে দেব না।
লোকে আমাদের গালাগালি দেয় , সব কিছুতে ফ্যাকড়া তোলার জন্য। “মানুষটা , একটু ভালো কাজ করতে চেয়েছিলো। সবাই মিলে বাঁধা দিয়ে কাজটাই পন্ড হয়ে গেলো।” যে কাজ , মানুষের বাঁধা দেওয়ার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সেই কাজ কখনো মানুষের স্বার্থে সুখকর হয় না। সে রাজনৈতিক দল হোক, বা গ্যালিলিওর সমসাময়িক বিশপরাই হোক। আমরা আমাদেরকেই বাঁধা দিই , বাঁধা দেওয়ার জন্য। আমরা মানুষ। আমাদেরও ভুল হতে পারে, তাই আমরা চাইনা আমাদের ভুলের জন্য কোনো বাঁধা সৃষ্টি হোক। আমরা মুক্তমনে চিন্তা গুলো গোল টেবিলে রাখি। এসো , বিচার কর , তর্ক করো, কিন্তু দেখিয়ে দিয়ো না এটাই পথ। আমরা থাকবো , আমরা বলবো , তোমরা করবে। কারণ আমাদের কাজই এটাই। আমরা ল্যাডারের সেই দিকে দাঁড়িয়ে আছি , যেখানে তোমাদের এসিড টেস্ট হবে। আমাদের ইগনোর করলে , তোমার কাজ সম্পূর্ণ হবে না। স্তাবকরা থাকে না দুর্দিনে , আমরা থাকি। আমরাই বলে দেব কোথায় কোথায় ভুল হয়েছিল। আবার লড়বে , আবার ঠিক করবে , আর নিজেকে তৈরী করবে সর্বজন গ্রাহ্য করে। তবেই না হবে গনতন্ত্র।
রাজনীতি খুব কঠিন। নিজের বাড়িতে নিজের পরিচিত দের নিজের কথা মানানো যায় না। সেখানে একটা গোটা দেশকে একটা পদক্ষেপে সামিল করা ভয়ঙ্কর কঠিন। সেটাই মসৃন হয়ে যায় যখন ইঁট গুলো আমরা বিচার করি। আমাদের দুঃখী করা যায় না। সুখ আমাদের চাইনা। আমরা চাই তোমরা এগিয়ে চলো। আর এমন এক সমাজ দাও যাতে নিঃস্বাস নিতে পারি।
এই আমি কখন আমার কথা লিখতে লিখতে আমরা হয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। কারণ আমি একটা সত্বা একটা চিন্তা, কিন্তু মৌলিক নই। আমার মতো অনেকই মনে করে , এই পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো। তাই আমি নই , আমরা - বিপক্ষ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।