ছেলেটা আর এলোনা। অথবা এসেছিলো, আমি গেলাম না। যেতামই বা কি করে! কোথায় যেতে হতো সেটা জানতাম না। জানলেও চিনতাম না। চিনলেও মনে নেই। শুধু মনে আছে কালশিটের চেয়েও গাঢ় একটা জঙ্গল। আর তার ভেতর দিয়ে ভেঙে পরা শিরদাঁড়ার মতো রাস্তা। ছেলেটা একজন ফেরিওয়ালা।
আমি ঈশ্বর মানিনা। ঈশ্বরও আমায় মানেন না। আর এই মানা, না মানার মাঝে কিছু অচেনা ইচ্ছে স্বপ্নকে মাধ্যম করে নিয়ে যায় ঈশ্বরের বাড়িতে। আর কিছু চেনা ইচ্ছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে।
ঈশ্বরের বাগানবাড়ি। অথবা তাঁর বাড়ির মতো দেখতে কিছু একটা বলা যেতে পারে। "মতো দেখতে" কারণ সেখানে কোনও ঈশ্বর নেই, কিন্তু প্রার্থনা করার জায়গা আছে। সেখানে পরিচিত-অপরিচিত গন্ধের-শব্দের-দৃশ্যের জমায়েত। কেউ গান গাইছে, কেউ ছবি আঁকছে, কেউ লিখছে, কেউ নেশা করছে, কেউ ভাবছে, কেউ বা ভাবতে শিখছে। সব দরজা-জানালা বন্ধ। সব মিলিয়ে যে পরিবেশ তার সাথে আমি বিন্দুমাত্র পরিচিত নই। অসম্ভব ভালো লাগা যেমন দম বন্ধ করে দেয়, ঠিক সেরকমই আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস একে অপরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। করে চলেছে। হঠাৎ ঈশ্বরের বাড়ির দরজা খুলে দুজনের প্রবেশ। না, ঈশ্বর নন। উনি বাড়ি ফিরলেন এখানে এরকম মনে করাটা আমার কল্পনার থেকেও কাল্পনিক। কারণ সেই দু'জন আমার অত্যন্ত পরিচিত দুই সত্তা। যদিও স্বপ্নে আমি তাদের চিনতে পারিনি। তারা দুজন নাকি আমার দুই স্বর্গীয় মুখোশ। দু'জনেই দায়িত্ব নিয়ে ইশ্বরের পারমিশন ছাড়াই তাঁর বাড়ির সব দরজা-জানালা খুলে দিতে লাগলো। ভাবলাম সব কানাকানি ঈশ্বরের কান পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার ভাবনার থেকেও বেশি ভাবিয়ে আমার স্বর্গীয় মুখোশরা জানালো, ঈশ্বর-ফিশ্বরের জন্য নয় বরং আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের বিবাদ মেটানোর জন্য এসব করা।
আমার মুখোশরা আমার মুখকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করেই বেরিয়ে গেলো। আমার দমবন্ধ করা ভালো লাগার কথা এই বাস্তবে চেনা স্বপ্নে অচেনা মুখোশ দুটো বুঝলো কি করে কে জানে! কৌতূহলী আমি তাদের পিছু নিলাম। তারা আসলে আমার কোন সময়ের মুখোশ জানার জন্য। ঈশ্বরের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে তাদের আর দেখতে পেলাম না। কিন্তু পেলাম সেই জঙ্গলটা। সব মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো। চারিদিকে পালক পড়ে আছে। কুড়োতে লাগলাম। এইখানেই সদ্য ইস্কুল শেষ করা বটগাছের মতো দেখতে ফেরিওয়ালার সাথে দেখা আমার।
একটা অদ্ভুৎ সুন্দর নীলরঙের শালপাতার মতো দেখতে পালক যখনই কুড়োতে গেলাম সাথে সাথে ছেলেটা রে রে করে উঠলো। বললো ওটা নাকি একটা শুঁয়োপোকা। কাল প্রজাপতি হবে। আর কয়েক ঘন্টা ওর মাটিতে ষোল পা রেখে চলার জীবনে আমি যেন আকাশ না দেখাই। আশ্চর্য! সে কি করে জানলো যে কালই প্রজাপতি হবে?! পরশু বা অন্য কোনও দিন নয় কেন?! খানিকক্ষণ সে ভবিষ্যতের ডানাওয়ালা পোকাটির দিকে তাকিয়ে পালকের মতোই হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলো আমি পালক কুড়োই কেন। পালক জমাতে ভালোবাসি বলায় সে তার কাঁধের ঝোলা নামালো। তার ওই ছোট্ট ঝোলাতে বৃষ্টির ফোঁটার মতো গিজগিজ করছে অসংখ্য পালক। ছেলেটা পালক ফেরি করে। আমার সাথে তার কি অদ্ভুৎ সুন্দর অমিল। ও পেটের দায়ে পালক বিক্রি করে বেড়ায়, আর আমি শখে পালক কুড়িয়ে বেড়াই। তবে আমার সাথে ওর মিল, অমিলের থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। পালক।
ছোট্ট ব্রহ্মাণ্ডের মতো গোল ঝোলাটিতে ছোট-বড় গ্রহ-তারার মতো কত রকমের, কত রঙের পালক। আমার জানতে ইচ্ছে করলো কারা কেনে এইসব পালক। ছোট্ট ব্রহ্মাণ্ডের মালিকের মুখ থেকে ছিটকে আসা উল্কাপিণ্ডের মতো উত্তর এলো, "যারা উড়তে চায়"। " যারা উড়তে চায় তারা পালক কিনে ডানা বানিয়ে নেয়"। তার ঝোলায় মিটমিট করছে কয়েকটা বিশাল বড় আর বাকি সব ছোট পালকেরা। মানুষের ওড়ার শখ থাকলেও রুচির অভাব। যেহেতু ছোট পালক গুলো সস্তা তাই তারা ছোট পালকই কেনে তার কাছ থেকে। তাও দরদাম ক'রে। তাদের ডানার বুনন কোনও দিন শেষ হয়েও ওঠেনা। আর তাদের ওড়াও হয়না। অথচ ওই বড় পালকগুলোর আটটা জুড়ে নিলেই একজোড়া ডানা হয়। ওই আট-টা বড় পালক কিনে নিলেই তারা অনেক উঁচুতে উড়তে পারতো। বড় পালকের দাম ছোটগুলোর দ্বিগুণেরও দ্বিগুণ। যেহেতু দাম বেশি তাই মানুষগুলো ছোট পালকের ডানায় বেশি দূর ওড়া যায়না জেনেও সেগুলো একটা দুটো করে কিনতে থাকে। ডানাও হয়না, ওড়াও হয়না। উঁচুতে ওড়াতো অন্যের স্বপ্নের মতো দুঃস্বপ্ন। তাদের টাকার অভাব?! না।
আমি তাকে আট-টা বড় পালকের দামের থেকে একটু বেশি দাম দিয়ে বললাম, বড় ছোট পালক মিশিয়ে কিনতে চাই। সে আমায় জানালো এই মুহুর্তে তার কাছে তিনটে মাত্র বড় পালক রয়েছে। তবে সে বাকি পাঁচটা কাল এনে দিতে পারবে। বলে সে আমায় বাকি টাকা ফেরত দিতে চাইলো। আমি তাকে ওটা রাখতে বলে বললাম, কাল তো বাকি পালকগুলো নেবই তখনই হিসেব-টিসেব করবো। সে বললো, আমি যে তাকে এত বিশ্বাস করছি যদি সে আর ফেরত না আসে! জানালাম, পালকে বিশ্বাস রাখি। সে না শোনা প্রার্থনার মতো হেসে আমার ঠিকানা চাইলো বাকি পালকগুলো পৌঁছে দেবে বলে। আমি প্রাণ মাথায় তুলে, চিন্তার স্বর্গস্তরে পৌঁছে গিয়ে, প্রজাপতিকে আবার শুঁয়োপোকায় পরিণত করেও নিজের ঠিকানা মনে করতে পারলাম না। স্বস্তির নিঃশ্বাস দূষিত হতে শুরু করলো। কিছুতেই আমার কোনও ঠিকানা মনে পড়লো না। স্মৃতিশক্তির হঠাৎ মৃত্যু দেখে পালকওয়ালা বললো, কাল তাহলে এখানেই দেখা হবে। আমি তার কাছ থেকে তিনটে পালক নিলাম। সে আরও দুটো ছোট পালক দিয়ে বললো, এগুলোর দাম দিতে হবে না। ওরা ডানার জন্য নয়, জমানোদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। দুটোই নীল পালক। একটা নীলের মধ্যে যে কত নীল থাকে সেটার প্রমাণ এই পালকদুটো।
আমার সাথে ছেলেটার আর দেখা হয়নি। হয়তো অন্য কোনও স্বপ্নে অন্য কোনও জঙ্গলে অন্য কোনও শুঁয়োপোকার প্রজাপতি হওয়ার শেষবেলায় ওর সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে। ততদিন আমি একটা এবং সেটাও অসমাপ্ত ডানা নিয়ে ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকবো, অপেক্ষা করবো। অপেক্ষা করবো নারকেলগাছের মাথায় কাকদম্পতির সদ্যজাতদের দেখার। পালকওয়ালার জন্য আর অপেক্ষা করবো না। আমার ডানা না হলেও আমাকে সে দুটো আকাশ দিয়ে গেছে। দুটো নীল পালক।
*আমার অন্যান্য একাধিক এটাসেটা জমানোর মধ্যে পালক জমানোটাও পড়ে। আমার পালকের খাতার একটা পৃষ্ঠার ছবি দিলাম। এই পালক দুটো আসলেই নীলচে রঙের। দুটোরই বয়স প্রায় দশবছর পুরনো।