দিন কতক আগে রাশিয়া কোভিডের টিকা আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছে। তাই নিয়ে সাধারণ মহলে উৎসাহের শেষ নেই। উৎসাহ থাকারই কথা। এতদিন পরে যেন এক অন্তহীন সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, অবশেষে বিদায় নিতে চলেছে এই অতিমারি। শেষ হতে চলেছে এই আতঙ্কের। উৎসাহের আর-একটা বড়ো কারণ হল পুটিন তাঁর মেয়েকেও এই টিকা দিয়েছেন। যদি নিরাপদ না হত, তাহলে কি আর তিনি তাঁর আত্মজাকে এই টিকা দিতেন?
এই আশা সত্যি হলে আমরা সবাই খুব খুশি হব। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই উঠছে কিছু প্রশ্ন। রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে নির্মোহ দৃষ্টিতে আমরা সেই প্রশ্নগুলোকে বোঝার চেষ্টা করব।
যে-কোনো ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার একটা অপরিহার্য অঙ্গ হল ক্লিনিকাল ট্রায়াল। কথাটা টিকার ক্ষেত্রেও সত্যি। তবে টিকা আর ওষুধ যেহেতু এক নয়, তাই তাদের ট্রায়ালের পদ্ধতি কিছু কিছু জায়গায় আলাদা। ওষুধ কী? ওষুধ হল পুলিশ, যা চুরির পরে কাজে নামবে। অর্থাৎ, রোগ হলে তবে দেওয়া হবে। সে হয় রোগের কারণ নির্মূল করবে, অথবা রোগের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্যদিকে টিকার কাজ হল চুরি হওয়া আটকানো। অর্থাৎ, রোগ যাতে আদৌ না হয়, তা দেখা। টিকা কি তবে সিকিউরিটি গার্ড?
আসলে শরীরের সিকিউরিটি গার্ড হল আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম। সেই ইমিউনিটি সিস্টেম আমাদের জন্ম থেকেই মোটামুটি কিছু কিছু চোরকে চেনে। তারা শরীরে ঢোকার চেষ্টা করলে আটকানো হল ইমিউনিটির কাজ। তবে চোরের কি আর শেষ আছে? প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চোরের সঙ্গে আমাদের শরীরের মোলাকাত হয়। আর ইমিউনিটি সিস্টেম আক্ষরিক অর্থেই দিনরাত লড়াই করে চলে সেই সব চোরেদের সঙ্গে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “যা আমাদের শেষ করে দেয় না, তা আমদের শক্তিশালী করে”। সেইরকম ভাবেই, প্রতিটি নতুন চোরের সঙ্গে মোকাবিলার পর শরীরের সিকিউরিটি গার্ড সেইসব নতুন চোরদের ছবি তুলে রাখে। মনে করে রাখে পরিচয়জ্ঞাপক কিছু বিশেষ চিহ্ন যা দিয়ে সেই চোরকে শনাক্ত করা যায়। পরের বার আবার শরীরে ঢোকার চেষ্টা করলেই পাকড়াও হয়ে যায় সেই চোর, বেঁচে যায় আমাদের শরীর। তাই একবার পক্স হয়ে গেলে সাধারণত আর দ্বিতীয়বার পক্স হয় না। তবে এর ব্যতিক্রম আছে। কিছু চোর খুব চালাক হয়। তারা প্রতিবার নতুন নতুন ছদ্মবেশে আসে আর আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেমকে বোকা বানিয়ে দেয়। তাই আমাদের বছর বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা পেট খারাপ হয়।
কোভিডের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, মানবজাতির জন্য এ এক নতুন চোর। তাই এর নাম নভেল। শরীর একে চেনে না। তাই সব সময় শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম আটকাতে পারে না।
এইখানেই আসে টিকার প্রয়োজনীয়তা। টিকা হল সিকিউরিটি গার্ডদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম। সত্যি সত্যি অচেনা চোর আসার আগেই, কিছু নিরীহ চোরদের বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে টিকাকরণ পদ্ধতিতে সিকিউরিটি গার্ডদের শিখিয়ে দেওয়া হয় যে ওই বিশেষ চোর বাড়িতে ঢুকলে কী কী করতে হবে। অর্থাৎ, অচেনা চোরকে চেনা চোর করে দেওয়া হয়।
টিকা সংক্রান্ত এই বেসিক কাঠামোটা মাথায় রেখেই শুরু করব টিকা আবিষ্কারের বিভিন্ন ধাপের গল্প।
এবার ভাবুন, সিকিউরিটি গার্ডদের যদি ট্রেনিং দিতে হয় তাহলে আপনার কী দরকার। আপনার প্রথম প্রয়োজন এমন একটা মানুষ যে চোরের মতো আচরণ করবে বটে কিন্তু আদতে যে চোর নয়। ঠিক একই রকম ভাবে টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও আমাদের প্রথম প্রয়োজন অচেনা ভাইরাসের এমন একটা রূপ, যার সঙ্গে মিলিয়ে শরীরের সিকিউরিটি গার্ড অর্থাৎ ইমিউনিটি সিস্টেম পরে দরকারমতো আসল ক্ষতিকর ভাইরাসকে চিনতে পারবে, কিন্তু ভাইরাসের এই রূপ আমাদের বিশেষ কোনো ক্ষতি করবে না। এই প্রথম ধাপটাই বা ভাইরাসের এই রূপ খুঁজে বার করাটাই খুব চ্যালেঞ্জিং। ভাবুন, যদি আপনি আসল ক্ষতিকর ভাইরাসের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য এই টিকার মধ্যে দিয়ে দেন, তবে সে নিজেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, যদি আপনি একে আসল ভাইরাসের যথেষ্ট কাছাকাছি না বানান, তবে সিকিউরিটি গার্ডদের ট্রেনিং কোনো কাজে আসবে না। তাই ঠিক কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্য এই টিকার থাকতেই হবে সেটা ঠিক করাই বৈজ্ঞানিকদের কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ।
এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে বৈজ্ঞানিকেরা কিছু কিছু ক্যান্ডিডেট টিকা তৈরি করেন। এরপর শুরু হয় আসল কাজ, অর্থাৎ ক্লিনিকাল ট্রায়াল।
এই ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তিনটে ধাপ।
স্টেজ ওয়ানে দেখা হয় টিকাটি সত্যি নিরীহ কি না, অর্থাৎ, মানবদেহে এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না। যদিও এর আগে অনেক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়, তবু এই পর্যায়ে রিস্ক সবথেকে বেশি। কেন না, এই প্রথমবার এই টিকা মানুষের শরীরে দেওয়া হচ্ছে। তাই ক্লিনিকাল ট্রায়ালের এই পর্যায়ে খুব কম সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নেওয়া হয় (ধরুন ৫০-১০০)। উপরন্তু, যেহেতু টিকাটির বিপদ সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নই, তাই এই পর্যায়ে শুধুমাত্র সুস্থ ও অন্য উপসর্গবিহীন মানুষদেরই টিকা দেওয়া হয়। অনেক সময় স্বেচ্ছাসেবকদের পারিবারিক ইতিহাস দেখা হয় তাদের অন্য কোনো অসুস্থতার সম্ভাবনা আছে কি না সেটা খতিয়ে দেখার জন্য। অনেক সময় অন্য কোনো নেশা যেমন সিগারেট খেলে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এই পর্যায়ে সাধারণত দুটি ডোজ কিছুদিনের (ধরা যাক দু-সপ্তাহের) ব্যবধানে দিয়ে দেখা হয় যে স্বেচ্ছাসেবকদের দেহে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এই সময় স্বেচ্ছাসেবকরা চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিকদের কড়া নজরে থাকেন। যেহেতু, এই পর্যায়ে কোনো বড়ো সমস্যা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে (যদিও সম্ভাবনা খুব কম), তাই সামান্যতম সমস্যা দেখা দিলেও তার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি টিকাটিতে কিছু বড়ো শারীরিক সমস্যা দেখা যায়, তাহলে টিকাটি এই পর্যায়েই বাতিল হয়ে যায়।
তাহলে আমরা দেখলাম যে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রথম পর্যায়ে দেখা হয় টিকাটি নিরাপদ কি না। এই পর্যায়ে কিন্তু টিকাটির কার্যকারিতা দেখা হয় না। যদি এই পর্যায়ে টিকাটি উতরে যায় তাহলে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল। এই দ্বিতীয় পর্যায়ে বা স্টেজ টু-তে টিকাটির কার্যকারিতা দেখা হয়। কার্যকারিতা মানে সে সিকিউরিটি গার্ডদের ট্রেনিং দিতে কতটা সক্ষম সেইটার পরীক্ষা করে দেখা হয়। যদি টিকাটি আমাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে, তবে ধরা হয় যে টিকাটি কার্যকরী। যেহেতু আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি যে টিকাটি বহুলাংশে নিরাপদ, তাই এই পর্যায়ে আর-একটু বেশি সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নথিভুক্ত করা হয়। এই পর্যায় মাস দুয়েক চলতে পারে। এইখানে বলার বিষয় হল এই যে আপৎকালে সময় বাঁচাতে অনেক সময় এই ফেজ ওয়ান আর ফেজ টু ক্লিনিকাল ট্রায়াল একসঙ্গে চালানো হয়। বুঝতেই পারছেন, যেহেতু টিকাটি নিরাপদ কি না সেটা আমরা ফেজ ওয়ানের আগে জানতে পারি না, তাই যদি ফেজ ওয়ান আর টু একসঙ্গে করা হয়, তাহলে খুব বেশি স্বেচ্ছাসেবক নেওয়া যায় না।
তাহলে আমরা ফেজ ওয়ানে জানতে পারলাম টিকাটি সুস্থ এবং অন্যান্য রোগবিহীন মানুষদের জন্য নিরাপদ কি না। ফেজ টু-তে আমরা জানলাম যে টিকাটি অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে কি না।
এরপর আসে ফেজ থ্রি।
প্রশ্ন হল, টিকা যদি নিরাপদ আর কার্যকরী এটা আমরা জেনেই যাই, তাহলে পরীক্ষা বা ট্রায়ালের আরও একটা পর্যায়ের প্রয়োজন পড়ে কেন। এই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে কেন তাড়াহুড়ো করে টিকা তৈরি করা যায় না।
আসলে ফেজ থ্রি হল একটি টিকার আসল পরীক্ষা। অনেকটা ওই ট্রেনিং দেওয়ার পরে সিকিউরিটি গার্ডদের আসল পাহারায় বসানোর মতো। ফেজ ওয়ান বা টু-তে কিন্তু আমরা টিকা দেওয়ার পরে স্বেচ্ছাসেবকদের শরীরে আসল করোনা ভাইরাস ঢুকিয়ে দেখিনি যে শরীর সত্যি সত্যি সেই ভাইরাস প্রতিহত করতে সমর্থ কি না। সেটা জানা যাবে এই বার। কী ভাবে? আমরা কি স্বেচ্ছাসেবকদের দেহে ভাইরাস ঢোকাব? না, আমরা সেটা করব না, সেটা অনৈতিক হবে। আমরা এইবার অর্থাৎ ফেজ থ্রি-তে টিকা দেব একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে। ধরা যাক সংখ্যাটা হবে এক লাখ স্বেচ্ছাসেবক। তবে তার মধ্যে হয়তো পঞ্চাশ হাজার আসল টিকা পাবেন, বাকি পঞ্চাশ হাজারকে না জানিয়েই দেওয়া হবে নুনজল। না, এখানে কোনো দুর্নীতি বা বোকা বানানোর খেলা নেই। গবেষণার পদ্ধতিটিই এমন। এই যে পঞ্চাশ হাজার (বা হয়তো দশ হাজার) মানুষ যাদের নুনজল ইঞ্জেক্ট করে দেওয়া হল, তাদের বলা হয় কন্ট্রোল। এদের সঙ্গে তুলনা করা হয় বাকিদের, যারা আসল টিকা পেয়েছেন। এইবার পরবর্তী ছ-মাস ধরে দেখা হবে আসল টিকাপ্রাপ্তদের মধ্যে ক-জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, আর কন্ট্রোল গ্রুপের ক-জন করোনা আক্রান্ত হলেন। যদি দেখা যায় যে আসল টিকাপ্রাপ্তদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য ভাবে কন্ট্রোলের থেকে কম, তখনই একমাত্র বলা যাবে যে হ্যাঁ, টিকাটি রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। তুলনা টেনে বলতে পারি যে ফেজ টু পাস করা টিকা যেন ডিগ্রিধারী চাকরিপ্রার্থী। তার সার্টিফিকেট দেখে মনে হচ্ছে যে সে কাজটি করতে পারবে, কিন্তু আসলে পারবে কি না সেটা একমাত্র বোঝা যাবে তাকে আসল কর্মক্ষেত্রের পরীক্ষায় ফেলে। শুধু এই নয়, আমাদের এটাও জানতে হবে যে টিকাটি কতদিন ধরে কার্যকরী থাকে। বিভিন্ন টিকার আয়ুষ্কাল বিভিন্ন হয়। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর না পেলে কিন্তু টিকা তৈরি হয়ে গেছে কখনওই বলা যাবে না।
ফেজ থ্রি ট্রায়ালের আরও একটি অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। সেটি হল নিরাপত্তা। মনে করে দেখুন, আমরা ফেজ ওয়ানের সময় কীভাবে স্বেচ্ছাসেবক বেছেছিলাম। আমরা বেছে বেছে শুধু সুস্থ, সক্ষম মানুষদেরই টিকা দিয়েছিলাম। ফেজ থ্রিতে কিন্তু সেটা আর আমরা করব না। আমরা এবার টিকা দেব সমাজের সকল স্তরের, সকল বয়সের মানুষকে। যেমন, কে সিগারেট খান আর কে খান না, তার বাছবিচার করব না। তাই শুধুমাত্র এই ফেজ থ্রি ট্রায়ালের পরেই আমরা বুঝতে পারব যে টিকাটা সত্যি সবার জন্য নিরাপদ কি না। উপরন্তু, আমরা আরও জানতে পারব যে ওই টিকাটির দীর্ঘমেয়াদে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না। এই পর্যবেক্ষণ খুবই জরুরি কেন না, যদি কোনো টিকা দীর্ঘমেয়াদে দেহে কোনো সাঙ্ঘাতিক বিরূপ প্রভাব ফেলে তাহলে সেরকম টিকা দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষকে দিয়ে দিলে তার ফলাফল ভয়ানক হতে পারে।
আপনি যদি এই পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি এইখানে এসে একটা প্রশ্ন তুলতে পারেন। এক, বিভিন্ন ওষুধের ট্রায়াল-এর সময় তো রোগীদের স্বার্থে অনেক সময় শর্টকাট নেওয়া হয়। পুরোপুরি ফেজ থ্রি শেষ হওয়ার আগেই তা রোগীর দেহে ব্যাপক হারে প্রয়োগের অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে এখন অসুবিধেটা কোথায়?
অসুবিধে তিনটি।
এক, আমরা এখানে ওষুধের কথা বলছি না, বলছি টিকার কথা। ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে, এখানে টিকা দেওয়া হবে সুস্থ মানুষকে। ওষুধের ক্ষেত্রে শর্টকাট খুব কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র নেওয়া হয়, যেখানে মরণাপন্ন রোগীর বাঁচার আর অন্য কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা হয়। কিন্তু টিকার ক্ষেত্রে কিছু ভুলচুক হলে, আমরা সুস্থ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারি।
দুই, ওষুধ যেহেতু শুধুমাত্র রোগীদেরই দেওয়া হয়, তাই তার প্রয়োগ হয় সীমিত। অন্যদিকে, যে-কোনো অতিমারি জাতীয় সংক্রামক রোগ আটকানোর জন্য টিকা যেহেতু বহু মানুষকে দেওয়া হয়, তাই কিছু ভুল হলে তার প্রভাব ব্যাপক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এর ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবধানতা প্রয়োজন।
তিন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রোগটির মারণক্ষমতার কথাও মাথায় রাখতে হবে। আজ যদি দেখা যেত যে কোভিড-এ আক্রান্তদের মধ্যে একশো শতাংশ মানুষই মারা যাচ্ছেন, তাহলে হয়তো সেই বিশাল মৃত্যুস্রোত আটকাতে কিছু রিস্ক নিতেই হত। যেমন নেওয়া হয়েছিল এইডস-এর ওষুধের ক্ষেত্রে। কিন্তু যেহেতু কোভিডে মৃত্যুহার কোনোভাবেই এক-দুই শতাংশের বেশি নয় (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে তো আরও অনেক কম), তাই এক্ষেত্রে অসম্পূর্ণভাবে পরীক্ষিত টিকা বহু মানুষকে দেওয়ার রিস্ক নেওয়া যায় না।
অসম্পূর্ণ পরীক্ষিত টিকা ব্যাপকভাবে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেওয়ার আরও দুটো সামাজিক সমস্যা আছে। এক, টিকা নেওয়ার পর অনেক মানুষ ভাববেন যে তাঁরা সুরক্ষিত এবং ফলে তাঁরা বাকি নিয়ম যেমন মাস্ক বা দূরত্ববিধি লঙ্ঘন করবেন। যদি টিকাটি কার্যক্ষেত্রে সুরক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হয় তবে এই নিয়ম লঙ্ঘনের মারাত্মক প্রভাব পড়বে এবং সংক্রমণ ও মৃত্যুহার সাংঘাতিক বেড়ে যাবে। দুই, যদি এই টিকা সুস্থ্ মানুষ, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে কোনোরকম বিরূপ প্রভাব ফেলে, তবে টিকার ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। এর ফলে অন্যান্য টিকাকরণ কর্মসূচি ভীষণভাবে ব্যহত হবে।
***
এইসব কারণেই টিকার ট্রায়ালের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাবধানতা নেওয়া হয় এবং কোনোরকম তাড়াহুড়োকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ভীষণ ফ্রাস্ট্রেটেড। এতদিন ধরে এই অস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হলে, সেটা হওয়াটাই প্রত্যাশিত। তার ওপর মাঝে মধ্যে খবর আসছে যে আমরা আমদের কোনো নিকটজনকে হারিয়েছি। ফলে টিকা হাতে পাওয়ার জন্য একটা প্রচণ্ড প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে। দেশবিদেশের বৈজ্ঞানিকেরা এই নিয়ে দিনরাত কাজ করে চলেছেন। কিন্তু, মনে রাখতে হবে যে বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতির আয়না। তাই প্রকৃতির মতো বিজ্ঞানও মানুষের প্রত্যাশা-হতাশার ধার ধারে না। তার যতটা সময় দরকার, তা সে নেবেই। ন-মাসের জায়গায় ক্ষেত্রবিশেষে সাত মাসে প্রসব হতে পারে, কিন্তু যত যাই হোক না কেন, প্রকৃতি সেই প্রক্রিয়া কখনোই দু-মাসে সম্পূর্ণ করবে না। একই রকম ভাবে টিকার কার্যকারিতা বুঝতে এই ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রতিটা ফেজকে তার প্রয়োজনীয় সময় দিতেই হবে। তাড়াহুড়ো করলে গর্ভপাত হতে পারে, সুস্থ জন্ম হবে না।
খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার গুছিয়ে লেখা।দু একটি প্রশ্ন পাচ্ছে। টিকায় ভুল চুক হলে কিভাবে প্রচুর মৃত্যু হতে পারে?
দুই, কোভিড এর মৃত্যু যদি এক শতাংশ ও হয়,তাহলেও তো সারা পৃথিবীতে সম্ভাব্য মৃত্যু সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
একদিকে ভারতের মতো দেশে আর কয়েক মাস ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। অণ্য দিকে,হুর হুর করে বেরিয়ে পড়লেও মুশকিল।
সুতরাং কি করা উচিৎ বলে মনে হয়?
একদম ঠিক বলেছেন। স্ট্রাটিজি বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া উচিত।আমার প্রশ্ন ছিলো,টিকার ক্ষেত্রে কি কি ভুলচুক এর জন্য প্রচুর সুস্থ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে?
ঘুরিয়ে প্রশ্ন করাযায়,কি কি স্ট্র্যাটেজি নিলে,এই টিকার ভুলচুক জনিত মৃত্যুর সম্ভাবনা স্বল্প সময়ে কমানো যেতে পারে? কারণ টিকার জন্য বছর খানেক অপেক্ষাও অনেক সময়।
দারুণ সহজ সরল সুন্দর লেখা, কী সহজে বুঝে গেলাম অনেক কিছু
নিজে ডাক্তার এবং জীবাণুবিদ হিসেবে বলছি - অসম্ভব ভালো লেখা। ভ্যাক্সিনকে তৈরী করা থেকে তাকে বাজারে নিয়ে আসা পর্যন্ত যতরকম বিঘ্ন ঘটতে পারে, তা সে জৈবিক, সামাজিক, নৈতিক, বা আইনগত, যেমনই হোক না কেন, লেখক তার প্রত্যেকটাকে প্রাঞ্জল বাংলায় সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। অভিজিৎ বাবুর লেখা নতুন নতুন আরো প্রবন্ধের অপেক্ষায় থাকলাম।