কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রায় পুরো পরিবার করোনা আক্রান্ত ছিলাম। বাড়ির আটজন সদস্যের মধ্যে কেবল একজনকে ( আমার দাদুকে, বয়স ৮২) হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। বাকিরা বাড়িতে থেকেই সুস্থ হই। রিপোর্ট অনুযায়ী বাকি সাতজনের মধ্যে তিনজনের কোভিড কনফার্মড ছিল(আমার, আমার মায়ের, আমার জামাইবাবুর)। দুজনের রিপোর্ট ইনকনক্লুসিভ(আমার বাবা এবং দিদি ; যদিও এদের সিম্পটম ছিল)। দুজনের নেগেটিভ (আমার দু বছরের বোনপো এবং Alzheimer's আক্রান্ত দিদা, বয়স ৭৫) ।
কিন্তু এখন সব্বাই সুস্থ হয়ে গিয়েছি। একপ্রকার যুদ্ধজয় বটে! যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কিছু ক্ষেত্রে ভালো, কিছু ক্ষেত্রে খারাপ। আমরা যেহেতু প্রায় সবাই বাড়িতে থেকে সুস্থ হয়েছি, তাই প্রতিবেশীরা বিপুলভাবে সাহায্য করেছেন। দুই বেলা খাবার রান্না করে দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ এনে দেওয়া পর্যন্ত। আবার ওই কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ডে অন্য অনেক মানুষের দুর্ব্যবহারও কম সহ্য করতে হয়নি। কেউ বলেছেন জানালা বন্ধ করতে, কেউ বা গুজব ছড়িয়েছেন। এমনকি একদিন ছাদে উঠেও চিৎকার শুনেছিলাম,' ওই বাড়িতে করোনা!' অপরাধবোধ হচ্ছিল। একটা সময় পর মনে হচ্ছিল যে এই অপরাধবোধ আমাদের মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভেঙে পড়লেও উঠে দাঁড়িয়েছি। সকলে সুস্থ হয়েছি। কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ড পেরোলে বাইরে বেরোচ্ছি। কিন্তু এখনও বাইরের সমাজ সুস্থ হয়নি, মানসিকভাবে অসুস্থ এখনও। তার কিছু নমুনা রইল।
• বাইরে বেরোলে দেখি অনেক মানুষ মাস্ক ছাড়া ঘুরছেন। অথচ আমাদের দেখলে নাকে আঁচল চাপা দিয়ে দূরে চলে যান। অর্থাৎ এনারা এটুকুও বোঝেন না যে করোনা হয়নি ভেবে তাঁরা যাঁদের কাছাকাছি থাকছেন, তাঁরাও কিন্তু অ্যাসিম্পটমেটিক কোভিড পজিটিভ হতে পারেন! আমরা সেরে গেছি, তাতে ভয় কেন পাচ্ছেন জানিনা। তবে এই মুহূর্তে যে কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে সতর্কতা বজায় রাখা খুব জরুরি - সে আমরা হই বা অন্য কেউ!
• রাস্তায় বেরোলে ' করোনা ' বলে ডাকাডাকি চলছে প্রায়ই। মুখ বুজে সব সহ্য করে অগ্রাহ্য করতে হচ্ছে।
• ইতিমধ্যে আবার একটি ব্যাংকে আমার বাবাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কারণ গেট কিপার জানতে পেরেছে যে আমাদের করোনা হয়েছিল। কীভাবে? টিভিতে দেখেছেন বা পেপারে পড়েছেন বা লোকমুখে শুনেছেন। বাবা ব্যাংকের বাইরে দাঁড়িয়ে ম্যানেজারকে ফোন করলেন। তিনি বললেন বাবাকে ফিট সার্টিফিকেট ছাড়া নাকি ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া যাবেনা। ওদিকে শত শত মানুষ ব্যাংকে ঢুকছেন এবং অনেকে বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে। বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই সঠিকভাবে মাস্ক পরেন না, কেউ পরেন নাকের নীচে, মাথার ওপরে, কখনো বা এক কানে ঝোলান। থার্মাল স্ক্রিনিং চলছে। সবাই পাশ করছে। শুধু আমার বাবা পাশ করেনি। কারণ তাঁকে টিভিতে দেখা গেছে যে তাঁর করোনা হয়েছিল!
ওদিকে আমার বাবার রিপোর্ট এসেছিল ইনকনক্লুসিভ।
বাবাকে বোঝানো হল যে বাবাকে আর ব্যাংকে যেতে হবেনা। বাবা বাড়িতে বসেই অনলাইনে ডকুমেন্টস পাঠালে নাকি কাজ হয়ে যাবে। আমি সেসব পরে জানতে পেরে DMCHO ম্যাডামকে ফোন করি। তিনি DM control room এর নম্বর দেন। DM কন্ট্রোল রুম থেকে আমাকে জানানো হয় যে পরেরদিন যেন আমি আমার বাবাকে নিয়ে ব্যাংকে যাই এবং যদি আবার না ঢুকতে দেওয়া হয় তৎক্ষণাৎ যেন ওখান থেকে DM কন্ট্রোল রুমে ফোন করি। ওনারা তারপর যা বোঝানোর বুঝিয়ে দেবেন। যাই হোক, আমরা ব্যাংক ম্যানেজারকে ফোন করে জানাই যে আমরা DM কন্ট্রোল রুমে বিষয়টা কথা জানিয়েছি। পরের দিন বাবা খুব সহজেই ব্যাংকে ঢোকেন। কোনো বেগ পেতে হয়নি। ম্যানেজার খুবই ভালো ব্যবহার করেছেন। আমাকে ডেকে কথা বলেছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। সেদিন ফিট সার্টিফিকেট আমি এনে দেখাতেই পারতাম। ল্যাটা চুকে যেত। কিন্তু কেন দেখাবো! ব্যাংক কি তার সমস্ত কাস্টমারদের নাম নথিভুক্ত করে রেখেছে যে কার করোনা হয়েছে আর কার নয়? তাই যথাযথ স্টেপ নিয়েছি এবং পরে অন্য কোথাও কোনো অসুবিধা মনে করলে একইভাবে স্টেপ নেব।
• এর পরের ঘটনা বলি, সম্প্রতি বাবার ছবি দিয়ে whatsapp এ স্টিকার ঘুরছে, যাতে লেখা ' এসো তোমাকে একটা হাম্পু খাবো '
কেন বলুন তো? আমাদের করোনা হয়েছিল বলেই? মানে একটা চুমু খেয়ে আমার বাবা করোনা ছড়ানোর ভয় দেখাচ্ছে - এরকম একটা প্যানিক তৈরি করার চেষ্টা? মানুষ কতটা অশিক্ষিত, কতটা নির্লজ্জ হলে এরকম করতে পারে ভাবুন!
আসলে কি জানেন এখনও ট্রমা থেকে বেরোতে পারিনি আমি। অতজন অসুস্থ মানুষ একসঙ্গে.... দাদুকে নিয়ে অত রাত্রে বেরোনো, মাথার ওপর কেউ নেই কেউ নেই ভাবনা, সেই সময় বেশ কিছু কাছের মানুষের অসহযোগিতা - এগুলো মনে পড়ে যায়। এখনও মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যায়, ভাবি এই বুঝি বাবার জ্বর এল। এই বুঝি কারোর কিছু হল। তারপর ভাবি, নাহ্ সব তো কবেই মিটে গেছে! শুধু বাইরের কিছু মানুষ আমাদের অসুস্থ বানিয়ে শোকেসে তুলে রেখেছে।
যদি এইরকম দুর্ব্যবহার সবাই করতে থাকেন, কি হবে তাহলে ভাবুন! যে মানুষ আজ দুর্ব্যবহার করছেন, তাঁকেও যদি কেউ তা ফিরিয়ে দেয়, বাঁচা যাবে তো? তাই পাড়ায় কারোর করোনা হলে প্লিজ পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সতর্কতা বজায় রেখে যথাসাধ্য সাহায্য করুন। মানসিকভাবে হলেও পাশে থাকুন। সহানুভূতির খুব প্রয়োজন এই মুহূর্তে।
যাই হোক, অনেকে পাশে থেকেছেন, অনেকে থাকতে পারেননি, অনেকে থাকতে চাননি। না চাওয়াগুলো মনে পড়লে কষ্ট হয় ঠিকই, তবে সমাজকে তো এড়িয়ে যেতে পারিনা! সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ পালন করতে সম্প্রতি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্লাজমা দিয়ে এলাম।
এই প্রসঙ্গে প্লাজমা ডোনেশনের বিষয়টি জানিয়ে রাখি। সদ্য কোভিডমুক্ত মানুষ প্লাজমা দান করতে পারেন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এবং তাঁর প্লাজমায় সুস্থ হতে পারেন এমন মানুষ যাঁর পক্ষে কোভিড থেকে রিকভার করা খুব কঠিন। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র মেডিক্যাল কলেজেই প্লাজমা কালেকশন করা হচ্ছে, সঙ্গে যুক্ত আছে IICB, এটির মূলতঃ দুটি পর্ব। প্রথমে হয় স্ক্রিনিং। সেখানে উত্তীর্ণ হলে তবেই প্লাজমা দান করা যায়। বয়স হতে হয় ১৮-৫৫ এর মধ্যে। দৈহিক ওজন হতে হয় ৫৫ কেজির বেশি, স্ক্রিনিংয়ের দিন ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা করা হয় এবং আরও অনেক ফ্যাক্টর দেখা হয়, সবকিছু ঠিক থাকলে তবেই একজন মানুষ প্লাজমা ডোনেট করতে পারবেন। এই ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ঠিকঠাকভাবে হাতের ভেন পাওয়া। ডোনার প্লাজমা ডোনেট করার সময় তাঁর শরীর থেকে রক্ত নেওয়া হয় এবং প্লাজমা ও রক্তকণিকা পৃথক করা হয়। প্লাজমা নিয়ে নেওয়ার পর রক্তের বাকি অংশ অর্থাৎ রক্তকণিকা ডোনারের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। পুরো প্রসেসটার জন্য সময় লাগে মোটামুটি এক ঘন্টা।
আমি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দশম প্লাজমা ডোনার। তারমানে এটুকু স্পষ্ট যে রিকভারি রেটের তুলনায় প্লাজমা ডোনারের সংখ্যা খুবই কম। এটা লজ্জারও বিষয় বটে। তাই যাঁরা সদ্য কোভিডমুক্ত হচ্ছেন তাঁরা প্লিজ অন্য মানুষের জন্য এগিয়ে আসুন - IICBতে যোগাযোগ করুন।
এই প্রসঙ্গে একটা গানের লাইন মনে পড়ছে -
'বল কি তোমার ক্ষতি জীবনের অথৈ নদী
পার হয় তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি!'
কারণ মানুষ তো মানুষেরই জন্য! চাইলে আমরাই পারি আরো কয়েকজন মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে। আমরাই পারি এই দুঃসময়ে মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে।