https://share.icloud.com/photos/04GGWDUBgkJZc8gqc_LsBzRlA
১
আগুন জ্বলছে সারা আমেরিকায়। টীয়ার গ্যাস, মরিচের স্প্রে, আর আগুনের হল্কায় ছেয়ে গেছে আমেরিকার রাজপথ, গলি ঘুঁজি। এই গ্রীষ্মের দিন, করোনা সংক্রমিত দিন ও রাত্রির পরে, কোভিড সংক্রমণের একশ হাজার মানুষের মৃত্যুর পরেও এ গ্রীষ্ম আমেরিকার ষাটের, সত্তরের দশক মনে করাচ্ছে কেবলই।
কাল লস আ্যন্জেলেসের মানুষ কাতারে কাতারে রাস্তায় নেমে কার্ফিউ অমান্য করে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ডিসি’র রাজপথে মানুষে মানুষ। কোভিডের সংক্রমণের ভয় তুচ্ছ করে কালোর মানুষের পাশে সাদা মানুষের প্রতিবাদী ঢল। দাঙ্গার ভয় আন্দাজ করতে পেরে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে বাড়তি নিরাপত্তা দিতে রাখা হয়েছে বাঙ্কারে।
এসব খবর আপনারা জেনে গেছেন। জেনে গেছেন- কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডকে বুকের ওপর হাঁটু চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে খুন করেছে মিনেসোটা’র সাদা পুলিশ। আর উপস্থিত কিছু মানুষ তা নিখুঁত দর্শকের মত পর্যবেক্ষণ করেছেন ৮ মিনিট ছেচল্লিশ সেকেন্ড।
এও জেনেছেন যে- কেউ কেউ প্রচার করছেন- কালো মানুষরা প্রতিবাদের নামে দাঙ্গা ও লুঠতরাজ করছেন। সিবিএস সংবাদ একে বলছে- “সাবোটাজ। আসলে এ সাদা সুপ্রীমেসিস্টদেরই কারবার।” এরকম কিছু ভিডিও-ও বাজারে এসেছে। উন্মত্ত জনতা শতাব্দীর বঞ্চনায় বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছেন।
ল এন্ড অর্ডার নয়, মানুষ চাইছেন জাস্টিস।অতএব আইন ভাঙতে হলে হবে।
সুযোগের অপেক্ষায় ভাংচুর করতে চাওয়া মানুষ থাকে সবদেশেই। তবে কর্পোরেট ও রাজনীতিকদের বছরভোর লুটের কাহিনীর চাইতে এদের কথাই মিডিয়া প্রচার করে থাকে। এ তথ্যও কোন রকেট বিজ্ঞান নয়, তাও আপনারা জানেন।
আর এও জানেন- আমেরিকায় কিছু বছর ধরে কেন চলছে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন।
আপনারা কেউ কেউ ডক্টর কিং, ম্যালকম এক্স, ফ্রান্জ ফ্যাননের কথাও পেড়েছেন এই অবনমন, পীড়নের মুখ হয়ে আমেরিকায় তারা কি নির্মান বা বিনির্মাণ করলেন এই প্রশ্নে।
কেউ কেউ ভাবছেন- তাহলে কি বিপ্লব হয়ে গেল? কাল থেকে পরিস্থিতি শান্ত হলে- ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যাবে? খুল্লামখুল্লা হয়ে যাবে দুর্নীতি আর ক্ষমতাহীনকে শোষনের কিস্যা? কাল থেকে সব লিবারাল হি লিবারাল? সাম্যের কোরাস। যৌথ খামার?
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দীর্ঘ স্বেচ্ছা অবসরে থাকা এবার আমিও জানছি- সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙ্গালীরা ডক্টর কিং এর প্রসঙ্গ এনে গান্ধীর অহিংসার ভারতীয় ধ্বজা ওড়াচ্ছেন। আমি দেখছি- নিজেদের বাদামী বলা অপেক্ষাকৃত সন্তুষ্টিতে আমোদ পাওয়া ভারত বংশের মানুষ-মানুষী আমেরিকার সাদা মানুষের রেসিজম ( বর্ণ-বাদ ও বলব, তবে রেসিজম নিছক বর্ণবাদের অধিক) নিয়ে গলা চিরে ফেলেছেন।
মূলধারার বাংলায় সাহিত্য করেন এমন জনপ্রিয় এক লেখককে একবার এদেশের জনজাতিদের কথা প্রসঙ্গে ‘রেড-আমেরিকান’ শব্দটি লিখতে দেখলাম। কদিন আগে আরেক পরিচিতি প্রাপ্ত লেখক ভারতের জনজাতিদের প্রসঙ্গে ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহার করলেন।
দেখছি আর জানছি- ফরসা-কালোর ডিসকোর্স নিয়ে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন নিয়ে গোল গোল দক্ষিণ এশীয় কালো-ফর্সা দ্বন্দ্ব সমাস। জানছি, আহত ও চমকিত হচ্ছি আর ভাবতে বাধ্য হচ্ছি বা বলা ভাল বোঝার চেষ্টা করছি।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা মনে করাচ্ছে- সামাজিক মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে এ বিষয়ে সচেতনতার লেভেল হল অনেকটা এইরকম- দেখুন আমরা কিন্তু ফেয়ার আ্যান্ড লাভলি মাখিনা। দেখো আমাদের দেশে এই রং ফর্সা করার ক্রীমের কত চাহিদা। কই আমরা তো কালো রং নিয়ে ভাবিনা। আমরা বর্ণবাদী না। অতএব বর্ণবাদ খতম। এই বলেই দেখলাম ফেমিনিজম এর সব বুঝে নিয়েছি বলে সটান ঝাঁপিয়ে পড়লেন- আমেরিকা তথা বিশ্বের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের তাবৎ সমস্যার বিশ্লেষণ করতে। চাইলে বিশ্লেষণের জায়গায় পড়তে পারেন- আইসক্রীম ক্রন্দন। মানে ওরা গরীব, ওরা আইসক্রীম খেতে পায়না বলে ফেসবুকে কান্না জোড়েন যারা। ওদের কথা ভাবতে হবে বৈকি। যেভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভেবে ভেবে ভারত দেশে ভাত দিল ভারতের সরকার। ফেসবুক না ভাবলে ওনারা যান কোথায়। ফেসবুক যেখানে, সমাধান সেখানে।
তাই আজ ফেসবুকের সোফাসেটে বসে আমেরিকান পুলিশকে ফাঁসি দিতে চাওয়া বাঙালীর গণজাগরণ দেখে ( জেনারালাইজ করিনি, কিছু মানুষ ফেসবুকেও থাকেন, কাজও করেন) মনে পড়ল- এক গল্প। হার্ভার্ডে সেমিনারে গেছি। ২০১৬ সাল। আমার এক কড়া বামপন্থী আত্মীয় বারবার বলে দিয়েছেন- তার ছেলে হার্ভার্ডে পড়তে গেছেন এক সেমিস্টার আগেই, সে এদেশে নতুন, ঘরবাড়ী নিয়ে সমস্যায় আছে, আমি যেন অবশ্যই দেখা করি।
তার সাথে দেখা করার পর জানতে পারি, যে সে কালো ছেলের সাথে রুমমেট হয়ে থাকবে না।নির্বোধ আমি জানতে চাই ছেলেটি ঠিক কী সমস্যা করছেন, সেক্ষেত্রে কতৃপক্ষকে জানাতে পারি। বারবার বলা সত্বেও সে কোনো অভিযোগের বয়ান দিতে পারেনা, শুধু জানিয়ে চলে যে- কালো মানুষকে তার মানিয়ে নিতে অসুবিধা, এই তার সমস্যা। আমি যদি কোন ভারতীয় বা সাদা আমেরিকান জোগাড় করে দিতে পারি, তাহলে খুব সুবিধা হয়। তার বাবাও তাই চান।
হার্ভার্ড এর ছাত্র বলুন বা জনপ্রিয় লেখক, বামপন্থী বা রামপন্থী হিন্দুত্ববাদী, প্রাতিষ্ঠানিক অথবা রীতিবদ্ধ রেসিজম এর ধ্বজার কাছে উপমহাদেশীয় মননের বৃহৎ অংশ এভাবেই বর্ণবাদী। এদের কোন কালো বন্ধু বা প্রতিবেশী নেই। একজন সাদা মানুষের সাথে ‘হ্যাং আউট’ করতে পারলে ফেসবুকে ছবি দ্যান, অন্য পাশের কালো মানুষটিকে ক্রপ করে।
এদেরই অনেককে দেখলাম আবার আমেরিকার হোয়াইট সুপ্রীমেসিস্ট-দের নিন্দায় মুখর, ডক্টর কিং ও তাঁর ওপর গান্ধীর প্রভাব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনর্গল কথা বলছেন। এসবই জানতে পারার কথা বলছি।
জানতে পারছি- আমেরিকার খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও কোন কোন বঙ্গসন্তান মনে করেছেন- আমেরিকায় রেসিজম গত পঁচিশ বছরে ছিলইনা মোটে, সিভিল রাইটস জমানার পর সব ডাইনোসরের মত উবে গেছে। কেউ কেউ এর যুক্তিতে বলে ফেলেছেন- এ মূহুর্তে আমেরিকার শীর্ষ ব্যবসায়িক সংস্হাগুলিতে সি ই ও পদে থাকা ভারতীয় মুখগুলির কথা। তাদের কাছে এরাই আমেরিকা। একমাত্র অ-শাদা রঙীন মানুষ। যারা আদ্যন্ত প্রভিলেজড ও সফল। এবং সফল ও প্রিভিলেজড।
এভাবেই এরা নানা অবতারে বিচ্ছিন্নতাকামী, রেসিস্ট, অতিরিক্ত স্বাজাত্য বোধ নি:সরণ থেকে অপরায়ন করেন ও অপরকে নিকৃষ্ট, বর্বর ও অসভ্য বলে দেগে দিতে থাকেন। যেভাবে পশ্চিম বাংলার বাঙালীর ওপর ঘটে চলা হিন্দি-অঞ্চলের রাজনীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এরাই সামগ্রিকভাবে অন্য জাতি-কে, উড়ে, মেরো, গুটখা বলে চলেছেন, বিশুদ্ধ মৌলিক অশিক্ষা নিয়ে। এ জিনিষ এখন পশ্চিম বাংলায় এক নতুন স্বাভাবিক। তার চেয়েও বেশী, এ হল জনপ্রিয় সংস্কৃতি। এছাড়া প্রতিবাদের বিকল্প কোনো রেটরিক আর জানা নেই। এও এক প্রাতিষ্ঠানিক অথবা রীতিবদ্ধ রেসিজম।
এসব রাজনৈতিক শুদ্ধতা বা পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ব্যাপার নেহাৎ নয় যে শব্দের ব্যবহার শিখিয়ে ভাবনায় বদল আনা যাবে। এহল কালেক্টিভ রেসিজম, সমষ্টিগত বর্ণবাদের নির্যাস। একটি জাতি প্রায় সমষ্টিগতভাবেরেসিস্ট। রাজনৈতিক শুদ্ধতার বাইরে থেকে চাপানো কৃত্রিম জ্ঞান দিয়ে ফেসবুকে সচেতনতার সাময়িক পলেস্তারা নির্মিত পোস্ট রচনা করা যায়, রেসিস্ট মানসিকতার আগাছা তাতে নির্মূল হয়না। তাই এভাবেই মাঝে মাঝে পলেস্তারা খসে বেরিয়ে আসে রেসিজমের বয়ান, রেটরিক, ভাষা। সে ভাষায় সাহিত্য করে পুরস্কার লাভ হতে পারে, নিজেকে আ্যকভিস্ট বা বামপন্থী বলে আত্ম প্রচার করা যেতে পারে, কিন্তু মানুষসভ্যতায়, বিশ্ব-শিল্প-সাহিত্যে বা জাতিগতভাবে কোন সংযোজন সম্ভব হয়না।
যেমন হয়নি গান্ধীর স্বাধীন ভারতদেশে। আম্বেদকার বার বার দরবার করলেন- গান্ধীর কাছে- বর্ণাশ্রম প্রথা রদ করতে সামাজিক স্টেটমেন্ট চেয়ে। লাভ হলনা। গান্ধী শত চেষ্টাতেও আম্বেদকরের যুক্তি মেনে নিলেন না।জাতির জনক বর্ণাশ্রমে বিশ্বাস করতেন আজীবন। নিম্নবর্গের মানুষ, শুদ্র বলে দাগিয়ে দেওয়া মানুষ, নীচুতলার টীকা নিয়েই জন্মাবেন বংশের চালনায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই বানানো অসাম্য ও বঞ্চনা তিনি শেষ করতে চাইলেন না। জাতিকে আহ্বান করলেন না। ফলে সে জাতির জনকের সন্তান দলের ও স্বাধীন ভারতের মন-মজ্জায় কোন স্বাধীন সংযোজন হলনা। সাদাদের দাসত্ব করে আসা জাতির শূদ্রের ওপর, নিম্নবর্গ বলে দাগানো শ্রেণীর ওপর মূর্খ আধিপত্যের ধারণা বজায় থাকল। সংবিধানে বয়ান লিখে বা ‘অস্পৃশ্যতা অপরাধ’ স্লোগান তুলেও সংখ্যা গরিষ্ঠের সমাজজীবনে তা পাল্টালোনা।
আমরা জাতিগতভাবে সমষ্টিতে তারই বংশধর।
আত্মসংযম করে, অহিংসার আর বুদ্ধের আর আল্লার জাতপাতহীনতার কথা বলে বেলাগম চরকা চালিয়ে যাব, কিন্তু শুদ্রদের, নিন্নবর্গের জন্য দরজা খুলে দেবনা। বিধর্মী, নাস্তিককের বাক স্বাধীনতা গ্রহণ করবনা।
রেসিজম ও ধর্মান্ধতা তাই ভারত বংশের ও বাঙালীজাতের এক মৌলিক উপাদান।
আমেরিকার প্রতিবাদ উদ্বুদ্ধ করেছে জেনে খুব ভালো লাগার আগে তাই কালো-ফর্সা সরল রেটরিকে বর্ণবাদ বা রেসিজমের বিরোধিতা করা কিভাবে সম্ভব তা ভাবা দরকার। জনজাতিকে উপজাতি বলার আগে ভাবুন। দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করা আফ্রিকানদের কাল্লু বলার আগে ভাবুন। নেপালি বা পাহাড়ী মানুষকে চিঙ্কি বলার আগে ভাবুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বা সাহিত্য কাগজে মানবসভ্যতার উন্নতি প্রসঙ্গে আপনার দু পয়সা পোস্ট করার আগে নিজের সচেতনতার ভয়ঙ্কর অপূর্ণতা নিয়ে ভাবুন।
আমেরিকার চারশ বছরের রেসিজম বনাম দক্ষিণ এশিয়ার দুই বা তিন সহস্র বছরের রেসিজম নিয়ে ভাবুন। গান্ধী, ডক্টর কিং, উপমহাদেশের নিম্নবর্গ, বর্ণাশ্রম, আমেরিকা হলে লিঞ্চিং এসবের ইতিহাস মাথায় রেখে ভাবুন।
আমেরিকার শাদা ঔদ্ধত্য বনাম ভারতীয়দের বাদামী ঔদ্ধত্য। কে জেতে বলা মুশকিল, হে আমার বাদামী স্বজাতি-গণ।
২
রোদ্দুর ছিলনা কখনও কৃষ্ণরঙের।
শতশত বছর ধরে আমেরিকায় চলে আসছে কালো মানুষদের প্রকাশ্য নিধন এবং লিঞ্চিং। খুন ও শারীরিক নিগ্রহ ।
পুলিশের গুলিতে শুধু ২০১৯ সালেই মারা গেছেন এক হাজারেরও বেশি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ।
মানবিক বা নীতিগতভাবেই একান্ত দুর্বলদের পক্ষে ধর্ম, বর্ণ, জাত ইত্যাদির বৈষম্য থেকে উৎসারিত রাগ আসলে একটা জলের ওপর ভাসা তেলের মত উপর-স্তরীয় অছিলা। বা নিছক বদলা নেওয়ার বাসনায় তারা শারীরিক নিগ্রহের অভিলাষী। খুন ও শারীরিক নিগ্রহ এক্ষেত্রে আক্রমণকারীকে শান্তি ও স্বস্তি প্রদান করে। লিঞ্চিং তারই কালেক্টিভ এক্সটেনশন, সমবেত এক প্রয়াস। কিন্তু আরও মনোগ্রাহী। কারণ সেখানে দর্শক লাগে।
এক উপস্থাপনা। পার্ফর্মেন্স। তাই তার চাই হাততালি ও একইসাথে নীরবতা। এই নীরবতা লিঞ্চিংএর অতি অ্যাক্টিভ উপাদান। হিংস্রতার ইউফোরিয়া শেষে সমস্ত দর্শক নীরবে গৃহে ফিরবেন এই ভেবে যে প্রান্তিক মানুষটিকে, যাক, নিকেশ করা গেছে। এ আয়োজনের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল অনেক প্রস্তুতির। দর্শক হিসেবে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এ নীরবতা রাষ্ট্রের ও তার অ্যাপারেটাস এর অনুমোদন আকাঙ্ক্ষা করে।
মারব, টেনে হিঁচড়ে ভয় দেখাব, উলঙ্গ করব আর দর্শক বা পাঠক হাততালি দেবে এই কল্পনা থেকে লিঞ্চিং এর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সহজতর হয়।
সেই স্পেক্টাকল বা দৃশ্যের রাজনীতির কথা কিছু বলব। আর তার দর্শকদের।যাদের আমেরিকায় আমরা বলি, বাইস্ট্যান্ডার্স’ ।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন আমার তরুণ ছাত্রছাত্রীর দল সাদা, কালো, পীত, বাদামী নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে আইন ভাঙছেন।
আর আজ কোরোনা আক্রান্ত আমেরিকায় একশ হাজার মা ুষের মৃত্যুর ভয়াবহতার ওপর দাঁড়িয়ে এই সামান্য শিক্ষকের মনে হচ্ছে- আমেরিকা শুধুই ট্রাম্পকে জেতায় না। আমার মত সামান্য শিক্ষকদেরও খানিক জিতিয়ে দেয়- আজ পোড়া মোবিলের গন্ধ নিতে নিতে অন্তত বলতে পারি- আমেরিকা শোন, আমাদের ছাত্ররা অন্তত ‘বাইস্ট্যান্ডার্স’ নয়।
৩
‘বাইস্ট্যান্ডার্স’ প্রসঙ্গ যখন এলো, তখন জেমস এলেনের Without Sanctuary: Lynching Photography in America (২০০০ ) বইটি হাতে নেওয়া যাক। দেখছি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদেরকে খুন করার ছবি। ১৮৮২ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত। ৩৪৩৬টী খুন এর রিপোর্ট আছে। বাকী ঘটনা আর থাকলেও প্রমাণের অভাবে নথিবদ্ধ করা হয়নি । ফোটোগ্রাফ গুলিতে আক্রমণকারী ও বাইস্ট্যান্ডার্সদের সুনিপুণ অভিব্যক্তি ধরা আছে।দর্শক ও উপভোক্তার ভূমিকায়। এই ছবিগুলি একসময় পোস্টকার্ডে ছেপে বিক্রী হত। সামারের অনুপম সন্ধ্যেবেলা গুলো নারীদের সঙ্গে নিয়ে লিঞ্চিং ফেস্টিভ্যালে কাটালে বেশ ভালোই কাটে।
বেশী না। মাত্র একশ বছর আগের কথা। তারপর এই মার্কিন দেশেই এর একশ বছর পর এক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ রাষ্ট্রপ্রধান হবেন।
প্রায় তিনহাজার ও আরও বেশী সংখ্যক কালো মানুষ ও আফ্রিকান আমেরিকান এবং প্রায় ১৩০০ শাদা মানুষ প্রকাশ্য খুন হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আমিষ লিঞ্চিং-আগ্রাসনে।
১৮৮২ থেকে ১৯৬৮ এর মধ্যবর্তী সময়ে। আর তার বেশীটাই ঘটে গেছে ১৮৮২ থেকে ১৯২০'র সময়টার মধ্যে।
বেশীরভাগ ঘটনা-গুলি ঘটেছে কোন সামাজিক বা দেশদ্রোহিতার মত অপরাধের শাস্তি দেওয়া হবে এমন কোন মানসিকতা থেকে নয়। বরং সেগুলি ঘটেছে রেসিয়াল হায়ারার্কি'কে বা জাতিগত উচ্চাধিকার কে অতিক্রম করতে চাওয়ার অপরাধে। ধরা যাক- একজন শাদা মানুষের গায়ে অনিচ্ছাকৃত ধাক্কা লাগার 'অপরাধে। অথবা শাদাদের জন্যে নির্দিষ্ট মিলিটারি ইউনিফর্ম গায়ে চাপাবার দায়ে। আসল পাখনাটি হল আপাতত এই- লিঞ্চিং মারফৎ মেজরিটির তরফ থেকে মাইনরিটি কে পাঠানো এক সন্দেশ- আর তা এই যে, ক্ষমতা আমাদের হাতে। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আইন আমাদের কিছুই করতে পারবেনা। আর তোমাদেরও রক্ষা করতে পারবেনা ।
তাই লিঞ্চিং গরিষ্ঠ, ক্ষমতা-কায়েমী স্রোতের মানুষের কাছে এতো গুরুত্বপুর্ন। এর মাধ্যমে, প্রান্তিকের কাছে সরাসরি রবিনহুডীয় ভারী বার্তা দেওয়া যায়- আইন তোমাদের রক্ষা করতে পারবেনা। এর উদাহরণে আছে আঠের শতকে। আইনের পঙ্গুত্বকে মধ্য অঙ্গুলি দেখিয়ে আঠের শতকে জেল থেকে টেনে বের করে পর্যন্ত মানুষকে লটকানো হয়েছিল ফাঁসির ফান্দায়। জনসম্মুখে। দর্শক সাক্ষী করে । এক্সট্রা জুডিশিয়াল। মূলধারার হিন্দি ছবিতে যাকে বলে- কানুন কো আপনে হাথ লে লেনা। বহু মূলধারার ছবি, হলিউডের ওয়েস্টার্ন সহ এই ধরণের বাড়তি আইনকে সমর্থন করে আখ্যান তৈরি করেছে।
আমেরিকার বুকে প্রথম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে পারিস টেক্সাসে। হাজার হাজার দর্শক জড় হলেন প্রকাশ্য এই হত্যাকাণ্ড দেখতে। হেনরি স্মিথ নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক।হত্যা করা হবে তাকে। পুলিশ অফিসারের মেয়ে কে খুনের মিথ্যা অভিযোগে তার প্রাণদণ্ড হয়। স্মিথ পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে বলেন - হত্যা যদি করতেই হয় তবে যেন তাকে গুলি করে মারা হয়। সারা শহরকে হত্যার নির্ঘন্ট ও ভেন্যু জানিয়ে দেওয়া হয়। সুচারু ভাবে সফল এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। ঘোষণা করা হয় আগে চাবুক মেরে, তারপর এক এক করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে, তারপর তাকে খুঁটির সাথে বেঁধে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হব। এই বিস্তৃত হত্যাকাণ্ড শুনে লোকজনের মধ্যে দারুণ সাড়া পড়ে যায়। এমনকি শেষমেশ রেল কর্তৃপক্ষকে বাইরের দর্শকদের জন্যে স্পেশ্যাল ট্রেনের ব্যবস্থাও করতে হয়েছিলো। পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে প্রায় দশ হাজার মানুষ এই হত্যাকাণ্ড দেখতে জড় হয়েছিলেন। উঁচু মাচা বাঁধা হয়েছিল। যাতে দূর থেকেও দর্শকরা দেখতে পান।
১৮৯৩। মানে রবীন্দ্রনাথের বয়স ত্রিশোর্ধ। ভারতে সতীদাহ বন্ধ হয়েছে ১৮২৯ সালে। আইন করে।
এর কয়েকবছর বাদে ১৯০১ সালে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তার বক্তৃতায় মার্ক টোয়েন সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রকে বর্ননা করবেন- “The United States of Lyncherdom” বলে। এর একশ বছর এর মধ্যে আমেরিকার রাষ্ট্রনায়ক হবেন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ।
এর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে রাষ্ট্রপ্রধান হতে দেখে নিয়েছে এ দেশ।
আর ভারতে আফ্রিকান ছাত্রদের মারা হচ্ছে, গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে, গণপিটুনি দিয়ে খুন করা হচ্ছে খোদ রাজধানী দিল্লী শহরের বুকে।
বিচ্ছিন্ন ভাবে ছাড়া ভারতীয়রা প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলছেন না- কৃষ্নাণ্গ মানুষ আমার ভাইবোন, আমার সাথী, আমার কমরেড। বলেননি। কিন্তু আজ আমেরিকার বর্ণবাদ নিয়ে তারা মুখর হয়েছেন।
৫
কথা হচ্ছিল আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সেনেটর চেরী ব্যাকনরের সাথে এক প্রতিবাদ সভায়। সেনেটর চেরি, গান্ধীবাদী।
আমি তাকে বলি- গান্ধী আফ্রিকায় ভারতীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে আন্দোলন গড়ে তুললেন, সার্বিক বর্ণ- বৈষম্য বা আফ্রিকানদের পক্ষে তাকে কখনো আন্দোলন করতে দেখা যায় নি। বরং বয়ান উল্টো কথা-বলছে- আফরিকানদের প্রসঙ্গে গান্ধী বারবার কুলী, কাফীর এই শব্দের ব্যবহার করছেন।
১৮৯৪ সালে জোহানেসবার্গে থাকাকালীন, ন্যাটাল পার্লামেন্ট-কে লেখা এর চিঠিতে গান্ধী লিখছেন-
“general belief seems to prevail in the Colony that the Indians are a little better, if at all, than savages or the Natives of Africa.”
আবার ১৯০৫ সালে লিখছেন -
‘Johannesburg that the council "must withdraw Kaffirs" from an unsanitary slum called the "Coolie Location" where a large number of Africans lived alongside Indians. "About the mixing of the Kaffirs with the Indians, I must confess I feel most strongly."
সব মহত মানুষদেরই কোন না কোন চারিত্রিক দুর্বলতা থাকে। সার্বিক ভাবে ভারতীয় মানসিকতাও এই লিগাসি বহন করছে বলছ? জানতে চান চেরি।
আলবাত! নিম্নবর্ণ, আদিবাসী, আফ্রিকান টুরিস্ট সকলেই এই বর্ণবাদের অভিমুখ। বলি আমি।
দিল্লিতে আফ্রিকান ছাত্র-দের দের মেরে ফাটিয়ে দিলেন ভারত প্রজাতন্ত্রের জনগন। ২০১৩ সাল |
ব্যাঙগালোরে আফ্রিকান ছাত্রী-কে জামা কাপড় খুলে রাস্তায় হাঁটানো হল। ২০১৬ সাল।
গণপিটুনীতে মারা গেলেন আফ্রিকান ছাত্র। ২০১৫ সাল।
আফ্রিকান মানুষরা যারা ভারতে সাময়িক চাকুরিরত তাদের বাড়ী ছেড়ে দেওয়ার জন্য দিল্লিতে একশর বেশী মানুষ জড় হয়ে বিক্ষোভ দেখালেন। ২০১৭ সাল।
চেরি শোনেন।
এ প্রসঙ্গে আবার আমার ফ্লোরিডা-বাসের দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল। ফিলান্ডো কাস্তিলকে গুলি করে মারে আমেরিকান পুলিশ। সাতই জুলাই। ২০১৬।
তার আগে আমার মেমোয়ার থেকে খানিক উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
৬
আমার ছেলের বন্ধু ভিক্টোরিয়া। পিঠময় লম্বা কালো চুল আর গভীর দুই চোখ। সেই চুলে সে মাথাময় ছোট ছোট বেণী বেঁধে রাখে। তারা বার্কলি থেকে ফ্লোরিডা এসেছে বছর কয়েক হোল। স্প্রিং ব্রেকের ছুটিতে একদিন সে তার বড় দিদির সাথে এসে বলে, তারা মাছ ধরতে যাবে সবাই মিলে, সে চায় বালুও তাদের সঙ্গে যায়। আমি 'হ্যাঁ' বলতেই তাদের দিদি জোরাজুরি করল, আমার মা তো জানো তোমার হাতের কারি বলতে অজ্ঞান, তুমিও চল আমাদের সাথে, মাছ পুড়িয়ে খাওয়া হবে, আর তুমি তার তদারকি করবে। নেহাতই উইকেন্ড। ওজর-আপত্তি খাটলনা।
বড় এক ভ্যানে চড়ে যাওয়া হচ্ছে ঘণ্টা দু'এক দূরের এক লেকে। সেখানে খাওয়ার উপযোগী মাছ মেলে। তাদের মোটর বোট আছে। গাড়ির মাথায় বোট বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই বোটে করে গিয়ে ওপারে বসে, চুপচাপ লেক-ধারে মাছ ধরা হবে। সঙ্গে যাচ্ছে বারবিকিউ এর যাকিছু সরঞ্জাম। আমি জিরে, ধনে, শুকনো লঙ্কা'র কৌটো গুছিয়ে ভ্যানে গিয়ে উঠলাম।
ভিক্টোরিয়ার বাবা, গ্যাব্রিয়েল, একজন সফটওয়্যার এঞ্জিনিয়ার। মা, জাডা, লাইব্রেরিয়ান। ভিক্টোরিয়ারা তিন বোন, এক ভাই। ভাইটি এখন কর্নেলে ডাক্তারি পড়ছে। লেকের পারে, গাছের ছায়ায়, মাছে মসলা মাখাতে মাখাতে গল্প জমে।
জাডা মজা করে বলে, - 'এরপর তো তোমায় অফিসে গিয়ে শুনতে হবে, তুমি ব্ল্যাকদের সাথে বেশি মেলামেশা করছ আজকাল। খুবই রেগে যাবে তোমার ভারতীয় কম্যুনিটি '।
-না না, কম্যুনিটির লোকরা রাগবে কেন ?
-আমি তো জানতাম তুমি বুদ্ধিমতী । তোমার এসব প্রেটেন্সানস সাজেনা। ভারতীরা আমাদের মোটেই পছন্দ করেনা। আমি অনেক খবর রাখি। ভারতে আমার চেনা দু'জন কালো ছাত্র পড়তে গিয়েছিল, তাদের সাথে কেউ মিশতনা। তারা বাচ্চাদের বিস্কিট দিলে, নিতনা। তারা কিন্তু এমনকি সিগারেটও খেতনা, অথচ লোকে ভাবত তারা ড্রাগ ডিলার। নো গুড প্লেস ফর আস । আমার দিদির ছেলের একটা কনফারেন্সে দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল, সে তো শুনেই না করে দিয়েছে।
এমন সময় জাডার বড় মেয়ে, কিয়ারা, যে গেইন্সভিলে জেন্ডার স্টাডিজে আন্ডারগ্রাড করছে, সে এসে বলে- সেটা কিন্তু খুবি স্টিরেওটাইপিং করা হবে মামা, এই নর্থ আমেরিকাতে এই যে মিশ্র আইডেন্টিটির গোঁড়ামি, সেখানেও সবাই কিন্তু এক না। আমিরি বারাকার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন কারা ?
বলে সে তাকায় আমার দিকে।
কথা বাড়াব কিনা ভাবতে গিয়ে বুঝি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে বারাকার ভূমিকা। তার কর্ম পরিচয়।
কবি, প্রাবন্ধিক, সঙ্গীত সমালোচক, উপন্যাসিক, এবং ছোট গল্পের লেখক বারাকা। জন্মনাম ছিল - লেরয় জোন্স। আর অর্ধ-শতাব্দী জুড়ে তিনি কবিতার উত্তর কে বেছে নিয়েছিলেন, তার রাজনৈতিক বক্তব্যের ব্যাবহারে।
বরং গ্যাব্রিয়েলের এই গল্পটা শুনে নেওয়া যাক।
'যখন আমি লুইসিয়ানায় বড় হচ্ছিলাম, তা তখন ছিল ব্ল্যাক মানুষদের জবরদস্ত ঘাঁটি। গ্যাব্রিয়েল বলে চলে - তখন আমরা ভাইবোনরা প্রায়ই একটা খেলা খেলতাম। সেটার নাম ছিল ঃ How Many Times Will We Get Pulled Over When Daddy Picks Us Up from School This Week । আমি হলুদ মাখাতে গিয়ে অল্প থামি। জাডা আমার চোখের ভাষা পড়ে ফেলে। গ্যাব্রিয়েল প্রায় না তাকিয়েই বলে চলে- আর প্রত্যেক সপ্তাতেই পুলিশের গাড়ি এসে আমাদের গাড়ি থামাত। সদ্য-ধরা মাছটাকে বঁড়শি থেকে হিঁচড়ে নামায় গ্যাব্রিয়েল। একটু দম নিয়ে বলে ঃ আর প্রায় প্রত্যেক বারই, প্রতিটি বারই একই অজুহাতে, যার বয়ান কখনো পাল্টায়নি ঃ 'একটা রবারি হয়েছে, আর গাড়িটা তোমাদের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।'
হোহো শব্দে লেক কাঁপিয়ে হেসে ওঠে গ্যাব্রিয়েল। জাডা, মাছ গুলো কেটে কুটে রাখছে। তার মুখ ভাঁজবিহীন।
"বাবা আমাদের হেনরি 'বক্স' ব্রাউনের গল্প বলতেন, যিনি আস্ত নিজেকে একটা বাক্সে মেইল করে পাঠিয়ে ছিলেন অন্য শহরে, স্লেভারি থেকে বাঁচতে। বলতেন বাস রিভসের কথা। "
কিয়ারা থামিয়ে দেয় বাবাকে, বলে ঃ আর অন্যদের কথা? আরও কিছু গল্প ?... কালো মানুষের সংগ্রামে শুধু কি করে যে মেয়েদের কথাগুলো বাদ পড়ে যায় কে জানে ?
রোসা পার্কস এর কথা তুমি বলনা কেন?
আমি আবার মনে মনে আউড়াই, সে'তো আমিরি বারাকা ও তার বীট বন্ধুদেরও একই সমস্যা। কিন্তু সে প্রসঙ্গে যাইনা এখন।
শোনার মন নেই গ্যাব্রিয়েলের কিছু। সে মনোলগের মত বলে চলে ঃ আমিতো প্রস্তুত থাকি, কখন না জানি পুলিশের গুলি এসে থামায় আমাকে। কালো মানুষরা সেই নেশা করে মরবে, আর পুলিশের গুলিতে।
আমি ভাবি- মার্কিন বিচার বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক, ও এশিয়ান মুসলিমদের ট্রাফিক তল্লাশির জন্য অন্তত পাঁচ ভাগ বেশি থামানো হয়। প্রতি তিনজন আফ্রিকান আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীদের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয় কৃষ্ণাঙ্গ স্কুল শিক্ষার্থীরাও।
ফ্লোরিডার ট্রপিকাল আকাশে মেঘ করে । মন কেমনের বিকেল বেলার মত আলো। বৃষ্টি পড়ার আগেই ডিনার সারতে হবে।
এই ঘটনার কদিন পরই গুলি চলল ফিলান্ডো কাস্তিলের ওপর। মেরে ফেলল পুলিশ । আমি তখন অরল্যান্ডোতে থাকি।
আর বঙ্গললনা আমি ব্ল্যাক লাইভস আন্দোলনের একজন কর্মী হয়ে পড়লাম।
কিছু অল্প সংখ্যার মেক্সিকান ছাড়া আর কোন বাদামী ভারতীয় বংশোদভূতকে কখনও কোন জমাএত বা মিছিলে দেখিনি।
একসময় আফ্রিকান ফুটবল খেলোয়াড় চিমা ওকেরি ছিলেন কলকাতার ফুটবলের স্টার খেলোয়ার। চিমার বিপুল জনপ্রিয়তাও তাকে ভারতীয় বর্ণবাদের থাবা থেকে বাঁচায়নি। যে কোন ঘন কৃষ্ণবর্ণ ভারতীয় মানুষকে ( আ্যফরো ডি এন এর আদি অধিকারী ) সদর্পে অবলীলায় ‘এই যে চিমাওকেরি’ বলে ডাকা হত। আর যাকে বলা হচ্ছে সেই অপমানিত ব্যক্তিও কুণ্ঠিত হয়ে মাটিতে মিশে যেতে যেতে তা মেনে নিতেন। কারন এ বর্বর সমাজ তাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে- সে হীন, সে নিম্নবর্গ, সে দাস মানুষ-দের প্রতিভূ, সে ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের সেবায় না হলেও মস্করার আমোদ জোগান দিতে বাধ্য। আর সে তা বিশ্বাস করে, তার সে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস্য ভাবে অন্তর্নিহিত।
এসবই আমাদের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস, উপনিবেশের ইতিহাস, নিজভূমে পরবাসীর ইতিহাস, ভাষা- জমি ছিনিয়ে নেয়ার ইতিহাস ও রক্ত সম্পর্কের জিন- কৌটোয় রাখা আমাদের পারিবারিক অশিক্ষা আর মুর্খামির অ-ইতিহাস।
আমার মেমোয়ার থেকে আরেক অংশ উল্লেখ করে শেষ করব এবার- এক ব্রহ্মণ্য-বাদী, রেসিস্ট, বানানো উচ্চ বংশে জন্মে এ অভিজ্ঞতা আমি প্রথম বচনে লিখে রাখলাম।
৭
“ এসব কথা আমার মেয়েবেলায় আমার অজানা ছিল। আমার মনে পড়ে গেল। আমাদের দেশের বাড়ীর সেইসব কথা। মুনিষ, মান্দার, বাগালদের শ্রম-ঘেরা চাষআবাদের কথা, গ্রামীন ব্রাহ্মন্য চাষীজিবীদের মূর্খ-ঔদ্ধত্য আর সুপ্রেমেসির কথা। আর 'ভিখু'দের কথা।
আমাদের দেশের বাড়ীর মান্দার ছিলেন ভিখুমামা। আর কাজ- মুনিষ খাটা।আমরা কলকাতা শহরে থাকতাম, আর বছরে দু তিনবার সে দেশে যাওয়া হত। সেখানে দেখতাম দুপুরে ভাত ফুটত দুটি ভিন্ন রান্নাশালায়। মুনিষ, মান্দার যারা, তাদের জন্যে খাওয়ার আলাদা সস্তার থালাবাটি ছাড়া ছিল আলাদা মাটির হাঁড়ি, হাতা-খুন্তি এইসব। বাড়ীর অন্য গৃহ-কাজের কর্মীরা তাকে 'যেন আলকাতরা' র ভুসি', 'ভাম বেড়াল' , 'মাগো যেন একটা হাফসি, আবার টেরি বাগানো হয়েছে' ইত্যাদি বলে প্রকাশ্যে "রঙ্গ" করতেন। আর বাড়ীর দিদা-কাকীরা অন্দরে। ভিখুমামাও তাদের সাথে নিজেকে নিয়ে মজা করতেন। আর আমরা তার গায়ের কাছ দিয়ে গেলে রেগে যেতেন ঃ ' হ হ, দিখ কাণ্ড বটেক, দিল্যান তো আমায় ছুঁইয়ে, দেখখ ইবার বাড়ীর মার খাও গিয়া ক্যানে ।
তার ছোট ছেলেটি, ভকত, একদিন বাগাল হয়ে কাজ করতে এলো। বাগালদের কাজ গরুদের খড় কাটা, জাব খাওয়ানো আর পুকুরে গিয়ে তাদের গা ধোয়ানো। তার বয়েস কোনমতে তখন দশ। তার সাথে আমাদের বেশ একটা ভাব-মত হয়ে গেল।সে আমাদের রঙ্গিন মার্বেলে গুলি খেলা শেখাত। আমরা লজেন্স দিলে লজ্জা-লজ্জা মুখ করে নিত।
ভকত চান করার সময় তেল চাইত। গায়ে মাখবে বলে। আমরা সবাই তাকে তেল দিতে এক পায়ে খাড়া। দেয়ার পদ্ধতিতে ছিল আমাদের যাবতীয় আগ্রহ। সে তার বাবার সাথে একটা সরু-মুখ বোতল এনে পাথরের দাওয়ার নীচে দাঁড়াত, বোতলের সরু মুখ ঘিরে থাকত তাদের হাত, যাতে হাত বেয়ে সেই সরু মুখ দিয়ে তেল বোতলে জমা হতে পারে। আর আমরা, দাওয়ার ওপর প্রায় চার-হাত মাপ উঁচু থেকে তাদের হাতে সোনালী রঙের সর্ষের তেল ঢেলে দিতাম। সেই কাজে উৎসাহ খুব, কিন্তু কড়া নিষেধ ছিল- দাওয়ার ওপর থেকে তেল ফেলতে হবে, কোনরকম " ছোঁয়া-ছানি " চলবেনা। বাউড়ি আর বাগদীদের ছোঁয়া কেন বারণ, একথার উত্তর কেউ আমাদের পুরোপুরি বুঝিয়ে দেয়ার আগেই ধমক মেরে কাজ সারতেন। আমাদেরও আর ব্যাখ্যা জেনে ওঠা হয়নি কখনো।
ভকত একদিন ছানি কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলল। ওইটুকু হাতে অত বড় বঁটি সামলাতে পারেনি। হাত কেটে রক্তা-রক্তি। আমরা ভাইবোনরা গিয়ে ডেটল, নেওস্পরিন নিয়ে ব্যান্ডেজ করতে লেগে গেলাম। ভকত ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ভকতের মা ও। সোনা কাকাকে খবর দেওয়া হোল। সোনাকাকা এসে ভকতকে সাইকেলে বসিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
রক্ত-টক্ত সাফ করে, হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতে যাব, ছোড়দিদা, বড়দিদা এসে হাঁই হাঁই করে কলতলায় টেনে নিয়ে গেলেন। তখনও দেশের বাথরুমে তোলা জলে চান করতে হত। উঠোনের কুয়ো আর টিউবওয়েলের জল ধরে বাথরুমে রেখে আসত বামুন বা বড়জোর কায়স্থ জাতের কেউ, কলকাতার বাড়ীতে যাদের আমরা কাজের মাসি বলতাম। বামুন বা কায়স্থ ছাড়া কাউকে স্নান বা খাওয়ার জল দিতে দেখিনি। আর দুর্গাপুজোর সময়, বামুন না হলে সব কর্মীদেরই রান্নাঘর, জলতোলা ইত্যাদি থেকে ডিমোশন হত। তাদের হাতে থাকত শুধু বিছানা করা, ঘর ঝাড়-পোঁছ আর এঁটো তোলার কাজ। তো, কলতলায় গিয়ে হুর-হুর করে জল ঢেলে দেওয়া হোল মাথায়। বাউড়ি জাতের ছোটলোক-কে আমরা ছুঁয়ে দিয়েছি। আমাদের মা-পিসি দের কোন ওজর-আপত্তি খাটলনা। উল্টে, দিদারা ভারি-ভারি চুরি পরা হাত ঘুরিয়ে ঝনন ঝনন আওয়াজ তুলে বলতে লাগলেন - কি ভাবে সেজ ( তিনি পেশায় ডাক্তার ) ও মেজ ঠাকুরপো ( আমার ঠাকুরদা ) আমাদের বিলিতি শিক্ষা দিয়ে সব ভুলিয়ে দিচ্ছেন। আর সেজ-দাদু'র তো দুর্গা-পুজোর পাটই উঠে গেছে, কবে নাকি তিনি বিলেতে পড়তে গিয়ে নিষিদ্ধ মাংস খেয়ে এসেছেন, তাকে হাজার বলেও প্রায়শ্চিত্ত করানো যায়নি, উল্টে দাদু দুর্গাপুজোয় আসা বন্ধ করে দিয়েছেন সেই কোন কালে । মোটামুটি এই ছিল তার ইমেজ-ঝলক, আমাদের কাছে। এহেন ডাক্তার দাদুর সাথে আমরা প্রায়ই বিফ-ভক্ষণে বেরোতাম পার্ক স্ট্রীট সংলগ্ন অঞ্চলে। যা দেশের বাড়ীতে থাকাকালীন আমাদের ভাইবোনদের কে.জি.বি'র ফাইলের মত বেমালুম হজম করে ঘুরে বেড়াতে হত ।
তো এহেন বাড়ীতে একবার হুলুস্থুল। গরমের সকাল। আমরা সব ইশকুলের ছুটিতে। পরীক্ষা শেষ হোল কি না হোল মামাতো, মাসতুতো, খুড়তুতো, পিসতুতো ভাইবোনদের রাতের ঘুম নেই। কতক্ষণে গ্রামের বাড়ী পৌঁছনো যাবে। তো একবার মিডসামারে, আমরা ভাইবোনরা উঠোনে দাগ কেটে খেলছি, বিডিও সাহেবের বাংলো থেকে লোক এসে খবর দিল, পরের দিন দুই আমেরিকান সাহেব আসবেন আম আর মাছ খেতে, তারা কি জানি কি কাজে রাঢ় বাংলায় ঘুরছেন এক মাস বাবদ। আম আর মাছের কারি খাওয়ার তাদের খুব শখ। এমন আম বাগান আর পুকুর যেহেতু চাটুজ্জে বাড়ীরই সেরা তাই বিডিও সাহেব চান এই গ্রামের হয়ে চাটুজ্জেরা এই অতিথি সৎকারের কাজটি করেন। গ্রামীন
পরিবেশে অতিথি সৎকার তখনও এমন পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে যায়নি। কারুর বাড়ী অতিথি এলে, পাশের বাড়ীর মুলোটা, কলাটা, পুকুরের মাছটা পাঠিয়ে দেওয়াটা ছিল দস্তুর। বটম লাইন হল: যা কিছু ভাল এ অঞ্চলের তা যেন বহিরাগত অতিথিটির পাতে অবশ্যই পরে। এমনই এক কালেক্টিভ ভাবনা। তো সাহেব আসবেন জেনে তো দুরগাপুজোর তোড়-জোড় চালু হয়ে গেলো। পাশের বাড়ির খুড়ি, কাকী, জ্যেঠি এসে ঢাউস সব লাউ-কুমড়ো কাটতে বসলেন। কার মাচায় ভাল পুঁই গজিয়েছে, চলে এলো তাও। পুকুরে বড় বড় জাল পড়ছে। মাছ উঠছে। সাইজ পছন্দ না হলে বড়দাদু-ছোড়দাদু আবার পুকুরে জাল ফেলাচ্ছেন।
কাঁসার বাসন তুলে কাঁচের বাসন নামানো হচ্ছে। সাহেব, বলে কথা। বড়দিদা বললেন ঃ 'মেজ ঠাকুরপো যদি থাকত সাহেবদের সাথে খেতে বসে মানাত। কি রং, ফেটে পড়ছে। সাহেবদেরও হার মানায়। " কাকী, পিসিদের উৎসাহ- সাহেবেদের মেমরা আসবেন কিনা এনিয়ে। ফুলপিসি বলল, মেমরা এলে তাদের খোঁপাটা দেখে একবার ভাল করে বুঝে নেবে। সোনা-কাকী বলল- 'আর খোঁপা, চুলই আছে কিনা দেখো, আর থাকলেও তো 'কটা' রঙের। কালো চুল ছাড়া খোঁপা মানায় নাকি কখনো ?' 'কটা' কেমন রং আমরা জানতে চাইলে, লেডি ব্রাবরনে পরা ফুল-পিসি তার ক্যাট-আই চশমা নাচিয়ে বল্ল ঃ 'ব্লন্ড। আবার লাল চুলকেও বোঝায় । '
তো জোগাড়-যন্তর সারা। এবার সাহেবরা এলেই হয়। দূর থেকে একটা শাদা আম্বাসাডোর গাড়ীকে ধুলো উড়িয়ে আসতে দেখা গেল। পেছনে খালি-গা ছেলেপুলেরা হই হই করে গাড়ির পেছন পেছন ছুটছে। গাড়ি এসে থামল।
বিডিও সাহেব চালক। পেছনের সীটে বসা হাফপ্যান্ট, হ্যাট পরিহিত, জংলা ছাপ জামা গায়ে দুই সাহেব। দাদুদের মুখে ভাবান্তর হোল। কাকী-দিদাদের মুখ এক হাত সমান হাঁ। ভিখুমামার মত পেটানো পেশীর ঘোর কৃষ্ণ-বর্ণ দুই সাহেব। গাড়িতে ঘেমে-নেয়ে মুখের ত্বক চকচকে হয়ে উঠেছে। ফুলপিসী সুপার শকড। মেম পর্যন্ত নেই! হইহই, হুরুম-দুড়ুম মুহূর্তে জল । দাদুরা সম্ভাষণ জানিয়ে বৈঠকখানায় নিয়ে গেলেন। নিস্তেজ শরীরে কাকী-দিদারা পথ করে দিলেন। পাথরের টেবিলে বসে খাওয়াদাওয়া হোল মন্থর তালে। পরিবেশনে কোন ত্রুটি থাকল না । সাহেবরা আহা-উহু করতে করতে হাত দিয়ে ভাত মেখে খেলেন । সোনা কাকা, দাদুরা বাতলে দিলেন কি পদ কি কি দিয়ে তৈরি। সাহেবরা
আমের খোসা সুদ্ধু মুখে পুড়ে আমোদে চিবোচ্ছেন, রান্নাঘরে সে খবর যেতেই, ছোড়দিদা কনুই বাঁকিয়ে বললেন: "জংলী আর কাকে বলে, আমেরিকা না হাতি, বিলিতি সাহেব হোত তো এমন হা-ঘরে পনা করতনাকো। "
রান্নাঘরের মাসী ও অন্য গৃহ-কর্মীরা চুপসে চ।
- তো বউদি, সাহেব কালো হয় ? এ আবার কেমন ধারা ...
সোনাকাকী বললেন ঃ না জেনে বোলনাতো, ওরা হোল নিগ্রো সাহেব। আমেরিকার সাহেবরা আফ্রিকা থেকে নিগ্রোদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস-দাসী করে রাখত। এখন দাস-দাসী করা উঠে গেছে, তবে ওরা থেকে গেছে।
- অমা, তাই বল। আমরাও তো দাসদাসী, কই অমন ভিখুর মত গা কি আমাদের। ভিখুকে ওর জামা কাপড় পরিয়ে দেখো, একই লাগবে।
সোনাকাকা রান্নাঘরে কি জন্যে যেন এসেছিলেন, এহেন কথা তার কানে গিয়ে থাকবে। তিনি সোনাকাকীকে আড়ালে ডেকে হাত নেড়ে রেগেমেগে কি একটা বললেন। সোনাকাকী এসে আলোচনা থামিয়ে দিলেন।
সাহেবরা আমাদের অনেক চকলেট আর মোটর গাড়ি'র খেলনা-টেলনা উপহার দিয়ে, উপরি উপরি ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমার দিদা-কাকী দের প্রশংসা করলেন। তারা কি সুন্দর, কি দারুণ কালো চুল, এইসব। ফুলপিসি' র প্রশংসা করতেই দিদারা ফুলপিসিকে পান সাজতে পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের ইংরেজি শুনে সাহেবরা বললেন; তারা দারুণ “ impressed”। আমার খুড়তুতো ভাই গেনু, লা- মার্টস এ পড়ত, সে এল্ভিসের মত কোমর বাঁকাতে পারত, বনিএমের গান জানত। তাকে তো সাহেবরা বলে দিল-' তোমার সাথে আবার দেখা হচ্ছে। তবে তখন তোমায় আমাদের জ্যাজ আর ব্লুজ গান শোনাব। '
সাহেবরা বিদায় হতেই, সেই রেশ ধরে দিদারা বল্ল- 'ওরা আবার পিছু না নেয়, ওই জ্যাজ না কি, ওই সব একদম শিখবেনা । তুমি কিন্তু ভাল ইশকুলে পড়। '
যাই হোক, বলতে দেরী করে ফেললাম- সেই কালো সাহেব দর্শনে যদি কেউ সবচে হতাশ হয়ে থাকে, সে হয়েছিল ভিখু মামা। সে সবার বক্তব্য শুনে টুনে অনেকক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে শুধু তিনবার বলেছিল ঃ এত কালো, এত কালো, এত কালো।
তারপর দীর্ঘদিন সে নাকি একথা ভুলতে পারেনি। মাঠেঘাটে বীজ বুনত, গরুদের জাব দিত, মাটি কোপাত আর থেকে থেকে আপন মনে হিজবিজ করে বলে উঠত ঃ এত কালো !
এর অনেক বছর বাদ, আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বেরুবে। জয়দা, জয় গোস্বামীকে একবার কোন কারণে দেখিয়ে নিচ্ছি । জয়দা একটি লাইন, দেখিয়ে আমায় জানতে চাইলেন, 'ভারী অদ্ভুত তো, ভাবলে কি করে?' । আমি বললাম 'ভাবিনি। জানি। '
সেই ছোটবেলাতেই সার জেনে গেছি-
" কথা বলা পাখী তার নিজের জাতকে ঘেন্না করে।”
শুধু শ্বেত না, সকল অসুস্থ ভারত-ভূত ও সংলগ্ন বাদামী জাতির মজ্জার নিরাময় হোক।
৮
People are trapped in history and history is trapped in them. — জেমস বল্ডউইন
চারিদিকে পোড়া মোবিলের গন্ধ আর কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁঝ নিতে নিতে চোখে পড়ে যাচ্ছে আমাদেরই ছাত্রদের হাতে ধরা স্লোগান-
“Antiracism is about doing and not just knowing,”
মনে আসছে শেষ জীবনে বলেছিলেন ডক্টর কিং। সিভিল রাইটস যখন তুঙ্গে, চারিদিক থেকে অভিযোগ আসছে, কালো মানুষরা প্রতিবাদের নামে লুট-পাট করছেন, দাঙ্গা বাঁধছে এতে। ডক্টর কিং তার জীবনের শেষ বক্তৃতাটি দিচ্ছেন। শিরোনাম- দ্য আদার আমেরিকা। “আমি সারা জীবন অহিংসার কথা বলেছি। হিংসা ধ্বংস আনে। আপনারা…. কয়েক মিনিট চুপ থেকে বল্লেন- মারটিন ল্যুথার কিং, আমেরিকার সিভিল রাইটস আন্দোলনের অবিসংবাদিত মুখ-“আ রায়ট ইজ দ্য ল্যাঙ্গোয়েজ অফ দ্য আনহার্ড। আ্যন্ড হোয়াট ইজ ইট দ্যাট আমেরিকা হ্যাজ ফেইলড্ ট্যু হীয়ার।”
আমেরিকা কী শুনতে ব্যর্থ হয়েছে? এটি শুনতে ব্যর্থ হয়েছে যে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি।
“ এবং আমেরিকা যতক্ষণ ন্যায়বিচার স্থগিত করে রাখবে ততক্ষণ আমরা বার বার এই সহিংসতা এবং দাঙ্গার পুনরাবৃত্তির অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকব।”
তিনি কি তবে গান্ধীর অহিংস প্রতিবাদের ধারণা থেকে সরে দাঙ্গার মনস্ত্বত্ব কে অন্যভাবে পড়তে চাইছিলেন?
একথা মনে হতেই চোখে পড়ল- ফ্রান্জ ফ্যাননের ভাষ্য লেখা পোস্টার।
আরও চোখে পড়ছে- জর্জ ফ্লয়েডকে দেওয়ার প্রস্তাব হল - গান্ধী পুরস্কার । জীবন কিঞ্চিৎ হলেও কৌতুকময়।
১৯৬৪ সালে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আইন। আজ আবার সময় পুলিশি বর্বরতার নিপাত যাওয়ার। আমরা আন্দোলনে আছি। থাকব।
এই ভরন্ত গ্রীষ্মে আপনি এসে দেখে যান- ডক্টর কিং- মহিয়সী রোসা- এই টীয়ার-গুলিকে বুক পেতে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে আমাদের ছাত্রছাত্রী এবং ছেলেমেয়েরা।
গমগমে গলায় কৃষ্নকায় কে বলে উঠলেন- দ্য আদার আমেরিকা। এক নারী অবয়ব চোখে চোখ রেখে কঠিন স্বরে বলছেন- নাহ্, সীট ছেড়ে দেবনা।
আমার বোধ খানিক আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।
কথায় বলে আমেরিকার গ্রীষ্ম মদের নেশার মত। এই গ্রীষ্ম আরও উত্তপ্ত । আমাদের ওয়েট হট আমেরিকান সামার ।
———————
লেখক ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের কর্মী
ছবি-১ আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সেনেটর চেরী ব্যাকনরের সাথে এক প্রতিবাদ সভায় লেখক।
অসাধারণ। এর পর আর কিছুই লেখার থাকে না। অনেক কিছু শিখলাম। বাইস্টান্ডার্স বা লিনচিং এর ওপর একটা নতুন শর্ট ফিল্মের কথা প্রসঙ্গক্রমে বলতে পারি- 'দা ফল'। ব্রিটিশ মুভি। যারা দেখে নি দেখতে পারেেন। মুবি এপে আছে।
@Dipak Pal আপনাকে ধন্যবাদ। লিঞ্চিং বিষয়ে আমার কাজ অন্যত্র আছে। একটি গ্রন্থে। এখানে বেশী লেখার সুযোগ হয়নি।
অভিবাধন। আপনার লেখা মুগধ করলো। দুটো বিনীত কথা জানাতে চাই। racialism, বাঙালির হিপোক্রেসি, গান্ধির জাতিভেদ প্রথার প্রতি নৈতিক সরব সমর্থন, যা আজও এদেশে রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যবহৃত, এগুলোর যোগসূত্রে আপনার আলোকপাত আর একটু পরিষ্কার চাই। ধন্যবাদ জানবেন।
বাহ। সবকটা পরিসর মুগ্ধ করেছে।
দীর্ঘ ও কিছু বিক্ষিপ্ত লেখা হলেও এর পরতে পরতে নির্মম বাস্তবতার উন্মোচন, যেন বারংবার সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো।
মার্কিন বর্ণবাদের স্বরূপের পাশাপাশি চলমান ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন, লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দেশের জাত-পাত, ধর্মের ভেদাভেদের অভিজ্ঞতা – এমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো লেখার খুব আকাল।
আন্দাজ করি, দেশগ্রামের ভিখুমামা ও শিশু ভক্ত বুঝি সান্তাল আদিবাসী, তাদের তত্ত্বতালাশ আরেকটু খোলাসা করলে ভাল হয়, কৌতুহল হচ্ছে।
লেখাটি পড়তে পড়তে এই গানটি শুনছিলাম, সেটাও এই খোপে থাক। আরো লিখুন
পুনশ্চ :
“কবিতা একটা ফর্ম, আকাডেমিক রাইটিং আরেকটা ফর্ম, সোশাল মেডিয়া আরেকটা ফর্ম, যেখানে অথেন্টিসিটি ট্রেড করা হয়েই থাকে, তো সেটাকে আলাদা করে আক্রমণ করতে হলে, তাতে বিশেষত নৈতিক বিশুদ্ধতার প্ল্যাংক থেকে আক্রমণ করা আদৌ যায় কিনা, সেটা সম্ভবত ভাবা দরকার।
আর ফাইনালি আরেকটা কথা, কোন সুস্থ মস্তিষ্কের লোক , যেখানকার ই হোক না কেন, আমারিকার রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা আশা এই আন্দোলন থেকে যেমন করবে না, তেমনি আমেরিকার ফরেন পলিসি তে খুব বিরাট বদল কিছু আনতে পারে নি বলে আমেরিকান সিভিল রাইট্স আন্দোলনের কোনো গুরুত্ত্ব নেই, এই অবস্থান ও বোকা বোকা। তেমন ই ব্যক্তিগত উৎকর্ষ বা নৈতিকতার শেষ ধাপে না পৌঁছলে আন্দোলন করা যাবে না, এই সব অবস্থান এর কোন অর্থ হয় না।”
আবার একই সঙ্গে বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত বাবুর এই কথাগুলোর সঙ্গেও এ ক ম ত। ভাবনার সংশ্লেষণ প্রায়োগিক স্বার্থেই জরুরি। অনামিকার কাছে বিতর্ক আশা করছি।
স্পেসিফিসিটি প্রসঙ্গে একটা ইন্টারেষ্টিং অবসার্ভেশন, যে 13th এমেন্ডমেন্টএ স্লেভারি এবলিশড হলো, তাতেই একটা এক্সেপশন লুপহোল ঢুকলো -- পেনাল সার্ভিচুড |
“Neither slavery nor involuntary servitude, except as a punishment for crime whereof the party shall have been duly convicted, shall exist within the United States, or any place subject to their jurisdiction.”
এর ফলে যে প্রিসন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স এর জন্ম, আর সবসময় কনসাসলি না হলেও, অবচেতনে জুডিশিয়াল আর ল এন্ড অর্ডার সিস্টেম গুলোতে "স্টেট্ স্লেভারি" চালিয়ে যাবার যে কালচার আর ইনসেনটিভ তৈরী হলো, সেটা খুবই আমেরিকান - এর প্যারালাল কলোনি বা ভারতের বর্ণবাদের ইতিহাসে নেই |
৫০ বছর আগে উৎপল দত্তর মানুষের অধিকারে নাটক পড়ে ভয়াবহ বিচার প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আলবামায় মিথ্যা ধর্ষণ মামলার বিচারই ছিল সেই নাটক। বাল্যকালে টম কাকার কুটির পড়ে শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ, দাস প্রথা জেনেছিল।। ব্যক্তিগত জীবনে সাঁওতাল, মুণ্ডারী গ্রামে থেকেছি অনেক। শুনেছি গ্রামবৃদ্ধদের কাছে সৃষ্টিতত্ব। অনেক বছর আগের কথা। ৪৫ হবে। আমার নিজের লেখা গল্প দানপত্র, মাঠ ভাঙেকালপুরু, ভারতবর্ষ, সন্তান সন্ততি, ডাইন, অন্ন, বিভূতিবাবুর দেশ, গল্পেে সেই দেশ ধরতে চেয়েছি। দানপত্র১৯৮০ তে লেখা, পড়তে অনুরোধ করি অনামিকাকে। এই গল্প হতে আমেরিকার জনজাতির সেই আবেদনপত্র যা তাঁরা লিখেছিলেন জাতিপুঞ্জেে হারানো পৃথিবী ফিরিয়ে চেয়ে। আমি যখন লিখেছি, ওই আবেদনপত্রের কথা জানা সম্ভব ছিল না। গ্রামে বসেই লিখেছিলা। আসলে সকলে বর্ণবাদী নন। সংস্কার ভয়াবহ। তা টিকে আছে বাংলায়ও। বাউরি ঘরে নেমতন্ন খেয়ে, সাঁওতাল পল্লীতে রাত কাটিয়ে খুবই তিরস্কৃত হয়েছিলাম, মনে পড়ে। গ্রামের বাবুরা খুব রাগ করেছিলে। উপজাতি, জনজাতি, আদিবাসী, সরকারি নথিপত্র বলে। লেখায় চলে আসা মানে ঘৃণা নয়। লেখা খুবই ভালো। কলম এবং স্পিরিটকে সম্মান করি।
@অমর মিত্র- ধন্যবাদ অমরদা। ‘দানপত্র’ অবশ্যই পড়ব।