দাঙ্গাশ্রান্ত ভারতে বসন্ত এসে গেছে। চাঁদের নিজের কোন আলো নাই বলিয়া তাহার হসন্ত উড়ে গেছে। চারিদিক কড়া ও কনফিউজড রোদ্দুর। জবানীতে। উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়েদের পিঠে।
এভাবে শুরু হতেই পারত। কিন্তু প্রভূত ফেসবুকীয় আভালাঞ্চের পর কিন্তু শুরুতেই প্রশ্ন এসে যাচ্ছে। ঈষৎ, রঙ্গন চক্রবর্তী’র পোস্টটি পড়িয়া। তিনি লিখিয়াছেন- “রবীন্দ্রনাথের গানকে নিয়ে আবার আলোচনা হচ্ছে, কিছু ছাত্রীর শরীরে কিছূ কথা লেখা হয়েছে, যারা লিখেছেন তাঁরা বোধ হয় ভেবেছেন অচলায়তনে ধাক্কা দিয়েছেন। কথা হল নারী শরীরে পুংলিঙ্গের শব্দ দাগিয়ে দেওয়া খুব নতুন কিছু হল কি? … সেখানে এই ধর্ষক পুংলিঙ্গের ভার পিঠে বইছ কেন মেয়েরা? “
ঠিকই, নতুন কিছু হইলনা। কিন্তু কী হইল যে এতো হালচাল মচিল, সেখানে যাইবার পূর্বে ধন্যবাদ একথা বলার জন্য— মেয়েরা খোলাখুলিভাবে তাদের যৌন ইচ্ছা প্রকাশ করবেন। অবশ্যই করবেন। কেউ স্বাগত না জানালেও করবেন। এর জন্য মান্যতা মেয়েরা না মেনেই করবেন। এখন রঙ্গনবাবুকে ক্ষুদ্র প্রশ্নটি হল-- মেয়েদের পিঠে কি লিঙ্গধারীর নাম লেখা ছিল? এবং সেটি যে যে ধষর্কের তা উনি জানলেন কি করে?
যদি তা না হয় মানে নাম বা তথ্য যদি তার জানা না থাকে,ধরে নিচ্ছি তিনি তবে জেনারেলাইজ করেছেন। এবার সেক্ষেত্রে সেই জেনারালাইজেশনে ওনার নামও যুক্ত করা যায়, সকল পুংলিঙ্গের নামই যুক্ত করা যায় তবে। অতএব তার জবানী অনুযায়ী পুরুষাঙ্গ মানে ধর্ষকের লিঙ্গ এবং ভাইসি ভার্সা। অতএব এ বিশ্বে যারাই পুরুষের এই অঙ্গটির সাথে রমণ, সঙ্গম করছেন তারা প্রত্যেকেই আসলে তা প্রতি একে এক ধর্ষকের সাথেই করেছেন।
পুরুষাঙ্গ ও যোনীর মিলন ও জৈব রসায়ন আদি ইত্যাদিতে যদি সন্তান হয়, তবেতো সেসব সন্তানকে ধর্ষকের বলতে হয়। আমাদের পুরুষাঙ্গ-ধারী বন্ধু, স্বজন, আত্মজ, পিতা সব পুরুষাঙ্গ ধারকই তবে ধর্ষক?
যদি না হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল— যোনী যদি স্বাভাবিক নিয়মে পুরুষাঙ্গ ধারণ করতে পারে, তবে পিঠ সেই অঙ্গটির নাম অক্ষরে ছেপে রাখলে অপূর্ব কিম্বা মনোহর কিছু না ঘটুক, সমস্যা ঘটবে কেন? এবার রঙ্গন বাবু বাদ।
ঘটবে। মধ্যবিত্ত মানসিক অবস্থানে মাথায় কোলোনিয়াল মরালিটির জাজমেন্ট পোরা থাকলে ওরম মনে হয়। তাই ঘটে যায়। আর তাই এটি কোন ফেমিনিজমের উল্টোপিঠের পাঠ নয়। পিতৃতন্ত্রের ডাইনোসর-প্রাচীন বাঁধাবুলি পাঠসমূহ। ফেমিনিজম এসব শেখায়না। ফেমিনিজম যেমন পুরুষকে ঘৃণা করেনা, তেমনি তার যৌনাঙ্গকেও নয়। এটা নেহাতই হেট রেটরিক। ওটা পুরুষবাদ করে। যোনীকে ঘৃণা। যোনীর অধিকারীকে ঘৃণা।
কিছু মানুষ নিজের পিঠে কিছু অক্ষর লিখেছেন। অন্যের বাড়ীর দেওয়ালে না। সেটা নিতান্তই সেই মানুষদের, সেই মেয়েদের শরীরের রাজনীতি। সেটা ফ্যালিক ইমেজের দোহাই তুলে অন্যরা নিয়ন্ত্রণ করবেন কেন? এ প্রশ্নে আপাতত খাপ বসছে, কারা খুলছে, কৃষ্টি কাকুর ঘুম ফাটছে।
'কালচারকাকু
দিনে নানচাকু
যে মেয়েরা নিজের ইচ্ছেয় পিঠে পুরুষাঙ্গের ছোটলোকি ডাকনাম লিখেছেন, কথা সেই এক- তা বুঝে লিখুন বা হ্যাল খেয়ে, অস্বীকার করার উপায় নেই একটা কাউন্টারের ধাঁচায় ঠাকুর-মন্দির ভাঙ্গার সাহসটা তারা যোগাড় করে ফেলেছে। এইটা ভয়ঙ্কর। অর্থাৎ নারীর খিস্তি করার ক্ষমতা। যৌন আচরণ / ইচ্ছে জাহির করার প্রকাশ্য ক্ষমতা। একে আটকানোর দরকার। অসভ্যতার সংজ্ঞা, রবীন্দ্র-পুলিশিটা এখানে প্রিটেক্সট।
তাই তারা গারদে পুরলেন বা চাবকাতে চাইছেন। এদের প্রশ্ন করে দেখুন— ছেলে বা ভাই বা বাবা, কাকা, বর বা বন্ধু যখন কথায় কথায় ‘বাঁড়া কী মাল দেখলাম’, ‘বাঁড়া কী জিনিষ’ বলে তখন গারদে পোরেন তো?
আসলে অসভ্যতার, বেলেল্লাপনার সংজ্ঞাটা কালচার কাকুদের গুলিয়ে যায়। কারন নীতিপুলিশি ছাড়া আর কিছু কাজ নেই। চারিদিকে নানাবিধ জ্যাঠামশাই। এই মেয়েরাই যদি বিপদে পড়ে, সাহায্যর দরকার হয় তখন এই সাজা জ্যাঠামশাইদের টিকিগুলি দেখতে পাওয়া যাবেতো? বাড়িতে ছেলেকে মিসোজিনিস্ট হতে দেখলে ফেমিনিজমএর পাঠ পড়তে বলবেন তো? এমনকি মেয়েকেও? না বলবেননা। ফেমিনিজম খুবই ভয়ের ব্যাপার তাই জ্যেঠিমনিরাও নিজেকে ভুলক্রমেও ফেমিনিস্ট বলবেননা।
যেভাবে সোস্যালিজমের নামে সারা আমেরিকা চমকিয়ে যায়, তেমনি নারীবাদী শুনিলে, এখনো ভারতের শিক্ষিত, অশিক্ষিত ব্যতিরেকে সকলেই চমকাইয়া যায়। তাই বাঁড়ার মত ফেমিনিজমও এফ-ওয়ার্ড। কাঁচা বাংলায় "খিস্তি সমূহ"। যার ব্যবহার সমাজ-আচার সাপেক্ষে বর্জনীয়। এই শব্দ ব্যাবহারকারীদের, নারীবাদী তাত্বিকদের ও নারীবাদ অভ্যাস করা মানুষজনকে মূলধারার, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোনো সহজ চোখে দেখেনা। নারীবাদ সম্পর্কে তাদের ধারণাও অস্পষ্ট। ফলে অব্যর্থ যে সমাজে নানান মিসজিনি'র ধারা তৈরি হবে।মূলত অজ্ঞতার কারণে এরা নারীবাদ দেখলেই এড়িয়ে চলেন, এড়িয়ে চলেন নারীবাদীদেরও। নারীবাদীরা এই প্রবণতাকে কটাক্ষ করে ফেমিনিজমকে এফ- ওয়ার্ডের পান হিসেবে উল্লেখ করেন সময় সময়।
ফেমিনিস্ট-আতঙ্ক পোষেন কিন্তু জেন্ডার-রোল নিয়ে কথা বলবেননা- এই সাবান মার্কা, ডিটারজেন্ট মার্কা পরিবারগুলো হল এই জাতীয় মধ্যবিত্ত মানসিকতার আধা-শিক্ষিতদের অভয়ারণ্য। বাড়ীর মেয়েদের কথায় কথায় ছোট করা, টীকা, টিপ্পনী কেটে গ্যাসলাইটিং করা এদের একমাত্র শখের বিনোদন। এদের সংস্কিতি চচ্চার লিভিংরুম থেকে গ্যালন গ্যালন ফিনাইল, স্যানিটাইজারের গন্ধ ভেসে আসে। ভেসে আসে অস্পৃশ্যতা আর ছুৎমার্গের ব্রাহ্মণ্য মার্কা ন্যাকা বেসুরো টপ্পা।
শব্দবাজী: ভালোনাম, ডাকনাম, খারাপ নাম
এবার বলুন শব্দটা যৌন বিষয়ক বলে, নাকি মেয়েরা খিস্তি দিল বলে, নাকি বাঁড়া শরীরের পিঠে লিখল বলে, নাকি মেয়েরা কেন করবে বলে, নাকি এটি আপনার মতে বেলেল্লা বলে, নাকি মেয়েগুলো যাদবপুর নয় মফস্বল বলে বা ‘এইরে যাদবপুরের পথে হাঁটছে’ বলে, ডিক্-ফাক্ এর মত আমেরিকা স্মার্ট নয় বলে, প্রমিত নয় মজদুর বস্তিবাসীর ভাষায় বাঁড়া বলল বলে নাকি রবীন্দ্রনাথ বলে?
চাঁদ উঠেছিল বলেছে। বাঁড়া মুখে আ্যসিড মারব, বাঁড়া খুন করবো এসব কিছুতো বলেনি মনে হয়। যৌন হ্যারাসমেন্টও ঘটায়নি। ‘মুসলমান কিনা বাঁড়া দেখা’ এসব বললে আপনারা স্রেফ মাফ করে দিচ্ছেন। ওই দাঙ্গাবাজগুলো আর তার সাপোর্টার-রা আপনাদের তৈরি করা অভয়ারণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছেনা তো? এতগুলো খুনী বাইরে ছাড়া রয়েছে। আসলে বেশীরভাগ মানব সন্তানেরই সমর্থন আছে। চেতনে না থাকলেও আছে। অচেতন আছে। মনে মনে আপনারাও ওই ‘প্যান্ট খুলে দেখান’ দলের মতই সাম্প্রদায়িক। তালিবান। মনুবাদী। ব্রাহ্মণ্যবাদী। পচা রক্ষণশীল। যৌনহিংসুক। বিদ্বেষবাদী। সবেরই উৎস খাঁটি বিদ্বেষ। মতে না মিললেই খতম।
মোদ্দা হল— কথাটা খুব সামান্য আর সহজ নয় কি? ওটা যে বিশ্বমানের (কোন মান এর-ই না) কাউন্টার-আর্ট নয়, সেটা বোঝার জন্য আর্ট-হিস্টোরিয়ান, ফুকো-তাত্ত্বিক, সেক্সিস্ট, ফেমিনিস্ট কিছুই হতে হয়না। এটা এমনকি কোনো ফ্যাৎরামোও নয়। এতটাই সিলি । পারফরমেন্স্ আর্টও একে বলেনা। কিন্তু তাবলে ফ্যাসি-দাদাগিরি করে গারদে পুরবেন? এইটা সভ্যতা? মধ্যযুগ পেয়েছেন? পছন্দ না হলেই ধরে চাবকাবেন??
শিল্প হয়েছিল কিনা এনিয়ে নিজের কপালে চাপ দেবেননা। আর্ট জিনিসটা কমই হয়। কিন্তু যেটা হয়েছে তাতে কিন্তু পশ্চাতে দমের লব্জ এসে যাচ্ছে। তালিবান সমাজে কাউন্টার করতে শুধু হ্যাল খেয়ে হয়না। পশচাতে দম লাগে। অনেকেরই মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে কারন টেবিল চেয়ারে বসে শিল্প করতে করতে, কেবলই মধ্যম হতে হতে, যেমন বেণী তেমনি রবে করতে করতে হঠাৎ বাহির প্রাঙ্গণে, ঠাকুর ঘরে এরূপ দুঃসাহস দেখিয়া ফেলিলে ভয় করিতে থাকে। মাথা গুলাইয়া যায়।
আসলে সেই ডাইনোসর বেত্তান্ত-- যৌনতা জিনিসটাই খারাপ। যেমন ২০২০ তেও মেয়েদের ঋতুস্রাব খারাপ। উহাতে দূষিত রক্ত থাকে।মেয়েরা যৌন খিস্তি দিলে রবি-মন্দিরের থেকে ভেসে আসে অশ্পৃশ্য ও পবিত্র / অপবিত্র বাইনারির রেটরিক।
এবং বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়— এসবই কী দারুন পাওয়ার পলিটিকসেরও বিষয়।
আমাদের সবার মতই বিশ্বভারতী, রবীন্দ্র-ভারতী রবীন্দ্র বেচে খায়। বাঁড়া হল- পুরুষের যৌনাঙ্গ। যৌনাঙ্গ র সমার্থক শব্দ কী? ‘খারাপ’? যৌনাঙ্গের নাম নিলে কি হয়? এইডস না ভূমিকম্প? রবীন্দ্রনাথের গান কি গাইগরুর দুধ? আর পুরুষ যৌনাঙ্গ যার ছোটলোকি ডাকনাম “বাঁড়া” তা ধারেকাছে লিখে টাঙ্গিয়ে রাখলে কি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছানা কেটে যাবে? কারা জানি দেখলাম— অক্ষরগুলো স্রেফ রবীন্দ্র দিয়ে রিপ্লেস করে দিয়ে গেছে। অর্থাৎ বাঁড়া চাঁদ উঠেছিল গগনে না বললে পরিবর্তে বলা যায় /- র বী ন্দ্র না থ ।
বলে ফেলুন। তারপর খোলা আকাশের নীচে গানটি গাইবার চেষ্টা করে দেখুন। গানটি গাইতে পারছেন? কিছু খোয়া যায়নি । দেখুন- লাইন, দাঁড়ি, কমা, কাম, ছিটকিনি, সেফটিপিন, সোম, ফাঁক, মীড় সবই বজায় আছে। থাকবেও। সে আগে বাঁড়া থাকুক, না থাকুক।
কথা হল মেয়েরা “মেয়েলি’ ভাষায় কথা কইবে। খিস্তি পুরুষের ভাষা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টোনি ম্যকেনরি দীর্ঘকাল এক নিরীক্ষা চালিয়েছেন- এফ ওয়র্ডস ও তার বিবিধ মর্ফোলজির ভ্যারিয়েশন নিয়ে। তাতে দেখা গেছে- নব্বই দশকে প্রতি এক লক্ষ নমুনার শব্দ ব্যবহারে পুরুষরা একহাজারটি বার এফ শব্দ ব্যবহার করছেন, যেখানে নারীরা একই নমুনা সাপেক্ষে এফ শব্দ ব্যবহার করছেন মাত্র দুশো বার। এই পরিসংখ্যান পাল্টে যাচ্ছে— দু দশক বাদ এসে, পাল্টে যাচ্ছে ছবি। পরিসংখ্যান। পাল্টে যাচ্ছে ব্যবহারকারীর আর্থ-সামাজিক শ্রেণী। বস্তির, মজুরদের খিস্তিবয়ান এখন এলিট গোত্রের ডালভাত লব্জ। এমনকি মধ্যবিত্তর। খবরটা খতরনাক। টোনি জানাচ্ছেন- পৃথিবী এখন এই পথে চলছে।
আর সার কথা হল, পৃথিবী এখন এই পথে চলছে
এলিট নয়, মজুর নয় এমন কে বা কারা সমাজকে মাঝের আঙুল দেখাতে চেয়েছে। গেল গেল, ধর ধর তো হবেই। হোকনা তারা রেবেল উইদাউট আ কজ। না বুঝে করেছে। কাউন্টার কালচার জানেনা। আ্যন্ডি ওয়রহোল দেখে উজ্জিবীত হয়নি কখনও। ফেমিনিজম মেনে পরিকল্পনা করেনি। হয়ত, ডেঁপো। ঈষৎ পেছনপাকা। নেহাত-ই ফক্কর। কথা হচ্ছে, আপনি যাই বলুন ঘটনা কিন্তু ঘটে গেছে। এখন যতই তর্জনী তুলুন, মাঝের আঙুলটা তারা কিন্তু এই ট্যাবু-পুষ্ট, কৃষ্টি-বিহ্বল বঙ্ বাজারকে সপাটে দেখিয়ে দিয়েছে।
ভগবান-ঠাকুর-আল্লা, এদের সাথে পাল্লা?
নো খিল্লী।
শেষ কতার এক কতা।
অতএব শ্রমিক নারীদিবসের প্রাক্কালে সক্কলে তেড়িয়া প্রমাণ করিলেন- আমেরিকা নয়, ধনতন্ত্র নয়, পিতৃতন্ত্র নয়, ঘুসপেটিয়া বুর্জোয়া কর্পোরেট নয়, আইসিস নয়, ফ্যাসিস্ট নয়, হিন্দুত্ব নয়, গ্রহের উষ্ণায়ন নয়, রেবেল উইদাউট আ কজ নয়- বাঁড়াই এ জগতে সবচে ক্ষতিকর বস্তু। তথাস্তু।
আসুন বাঁড়ামুক্ত সমাজ গইড়্যা তুলি।