একটা অদ্ভুত মাথা ধরা নিয়ে ঘুম ভাঙ্গল গোপাল বাবুর। মাঝে মাঝে এমনটা হয়। আগে কম হত। আজকাল একটু বেশিই যেন হচ্ছে। ভাবেন এর পর শহরে ছেলের কাছে গেলে একটা ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। এখানে, মানে এই মফস্বল শহর শালদুয়ারির পাঁচ কিলোমিটার দূরের গ্রামে তার উপায় নেই। তবে দিন বাড়লে এটা নিজেই কমে যাবে জানেন উনি। তাছাড়া শরীরকে বেশী পাত্তাও দিতে চান না। গোপালবাবুর বাবা বলতেন “শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়”, তাই উনি আজ অবধি সেটাই মেনে চলেন।
গোপাল বাবু মানে গোপাল কুন্ডু, বয়েস হয়েছে পয়ষট্টি, চশমা পরেন, লম্বাটে চেহারা, এখনো যথেষ্ট কর্মঠ। বিপত্নীক এবং সরকারী চাকরীর উঁচু পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত। দেখলে এককালে যে বেশ সুপুরুষ ছিলেন তা এখনো বোঝা যায়। এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে ইপ্সিতা স্বামী পুত্র নিয়ে থাকে দিল্লীতে, বছরে একবার কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় আসে, ওখানেই দেখা হয়। ছেলে অনিমেষ কলকাতায় চাকরি করে আই টিতে। সেক্টর ফাইভে অফিস। বেলেঘাটায় থাকে। একই নাতি, ক্লাস টুয়ে পড়ে, নাম অভিমন্যু। বর্তমানে গোপালবাবুর জীবনের একমাত্র আকর্ষণ। নাতিও খুব নেওটা দাদুর। সেটা অবশ্য ছেলের সংসারে একটা অশান্তির কারণ, তা গোপালবাবু জানেন। পুত্রবধূ শিবানী শ্বশুরকে এক আধপাগলা জংলী বুড়ো ছাড়া অন্য কিছু মনে করে না। গোপালবাবু ওকে দোষ দেন না, ওর জায়গায় যেই থাকত, হয়তো একই কথা ভাবতো। এই বয়েসে শহর কলকাতার অবসরপ্রাপ্ত জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে যে এই অজ পাড়া-গাঁয়ে পড়ে থাকে, আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, নিজে রান্না করে খায়, তাকে কিই বা আর বলা যেতে পারে?
জানেন গোপালবাবু সবই, তবু কিছুই করার নেই। প্রত্যেকের জীবনে এমন অনেক কিছু থাকে যার ব্যাখ্যা হয় না, যা কিনা চুড়ান্ত ব্যক্তিগত। কাউকে বলা যায় না। মনে হয় বলে ফেললে বুঝি সেই কারনটাকেই অপমান করা হল। ছেলে হয়তো কিছুটা বোঝে, তাই আপত্তি সত্বেও শেষে মেনে নিয়েছে সব কিছু। মাঝে মাঝে ওই আসে। কখনো সখনো ছেলেকেও নিয়ে আসে। সেই সময়টা গোপালবাবুর খুব প্রিয়। নাতির সাথে খেলা, গল্প করা, নিজে হাতে রেঁধে খাওয়ানো, সময় কোথা দিয়ে কাটে বুঝতেই পারেন না। কপাল ভাল থাকলে হয় তো কালকে সেই সুখের দিন আসতে পারে। কাল ছেলের আসার দিন। ফোন করেছিলো নাতি নাকি খুব বায়না ধরেছে দাদুর সাথে খেলবে। পুত্রবধূর অনুমতি পাওয়া গেলে হয়তো আসতেও পারে।
নাতির কথা মনে হতেই মনটা যেন একটু ভাল হয়ে ওঠে গোপালবাবুর। শরীরের অস্বস্তিটা রয়ে গেলেও মনে মনে যেন চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। অনেক কাজ। আজ আবার তপোবনেও যেতে হবে। কাল আচমকা ওই অচেনা লোকটাকে নিয়ে যা ঘটেছে তা এখনো যেন পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ আবার আসবে বলেছে। তবে হতচ্ছাড়া আসলে হয়। কত কান্ডই তো হচ্ছে আজকাল। কে জানে? তবু এক অদ্ভুত আকর্ষণ জাগে মনে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দৈনন্দিন কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন গোপালবাবু।
কাজের মাসী এখনো আসে নি। কাজের মাসী কথাটা মনে আসতেই একটু হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে। গোপালবাবুর থেকে বয়েসে অর্ধেক। গাঁয়ের মেয়ে বলে একটু বুড়ি বুড়ি ভাব, বড়বাবু ডাকে এবং তুই তোকারি করে। তবে খেয়াল রাখে খুব, বাচ্চা ছেলের মতই বকা ঝকা দেয় প্রতিদিন। গোপালবাবুর মেয়ের থেকে হয়তো একটু বড় হবে, তবু মাসী! বড় দুঃখী মানুষ, স্বামী বহুদিন ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোন মেয়ের সাথে। নিজের এবং একটিই মেয়ের পেট চালানোর জন্য বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে বেড়ায়। ঘরের ঝাড় পোঁছ, রান্নার তরকারী কেটে দেওয়া সবই করে। রান্নাটাও করে দেবে বলেছিল। তবে গোপালবাবুর আবার সবার হাতের রান্না পছন্দ হয় না, তাই রান্নাটা নিজেই করে নেন। আজও বোধ হয় ডুব মারল। খুব একটা অসুবিধে নেই তাতে। অভ্যেস আছে, মাঝে মাঝেই হয় কিনা।
রান্না করতে করতে বুঝলেন, শরীরটা যেন একটু বেশীই বেগড়বাই শুরু করেছে। দুএক বার একটু তাল হারালেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য, মাথার মধ্যে মাঝে মাঝে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মত একটা ব্যথা চিড়িক দিয়ে উঠল। খানিকটা জোর করেই শরীরের চিন্তাটা দূরে সরিয়ে দিলেন গোপালবাবু। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল গতকাল বিকেলের সেই অদ্ভুত লোকটার কথা। হঠাৎ কোত্থেকে দুম করে যে তপোবনে এল।
গোপালবাবুর বাড়ির পেছন থেকেই একটা ঝোপঝাড়ের জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। খুব ঘন নয় তবুও জঙ্গল। ঝোপ ঝাড়ের মাঝে মাঝে বেশ কিছু বড় গাছের এলোপাথাড়ি অবস্থান। ঝোপের মধ্যে সরু পায়ে চলা রাস্তা ছড়িয়ে আছে পুরো জঙ্গল জুড়েই। গ্রামের লোকেরা মাঝে মাঝে মাশরুম বা শুকনো কাঠ পাতার খোঁজে সে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। জন্তু জানোয়ার বিশেষ কিছু নেই, কিছু শেয়াল আর খরগোশ ছাড়া। কিছু সাপও আছে অবশ্য। আর আছে অনেক রকমের পাখি।
জঙ্গলের উত্তর-পশ্চিম দিকে, গোপালবাবুর বাড়ি থেকে চার পাঁচশ মিটার দূরে এই জায়গাটা এখানে আসার কিছুদিন পরেই উনি আবিস্কার করেছিলেন। বেশ কয়েকটা বড় বড় গাছ প্রায় জ্যামিতিক কোন মেপে বসানো। তার ফাঁকে খানিকটা জায়গা যেন হঠাৎ করে ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়া। এক পাশে বেশ বড় একটা ছড়ানো প্রাকৃতিক গর্ত, যেটা বছরের বেশীর ভাগ সময় শুকনো থাকলেও বর্ষাকালে দারুণ একটা পুকুরের মত হয়ে যায়। চার পাশে ফুটে থাকে নানা রকম নাম না জানা জংলী ফুল। এখানে এলেই অদ্ভুত শান্তি অনুভব করেন গোপালবাবু। ঝাঁকড়া একটা বুনোকুলগাছ আছে যার নিচে নিবিড় ছায়া। সেখানেই বসে থাকেন উনি। পাথর আর মাটি দিয়ে একটা গোল বেদী বানিয়ে নিয়েছেন গাছটা ঘিরে। নাম দিয়েছেন তপোবন। পুরো দিন জুড়েই গাছের ফাঁক দিয়ে আসা রোদ্দুর ও ছায়ার আলপনার খেলা চলতে থাকে ঘাসের ওপর। কত যে নকশা তৈরী হয় আর ভেঙ্গে যায়। ঠিক ভাঙ্গে না বোধ হয়, বদলে যায় নতুন নকশাতে ঠিক মানুষের জীবনেরই মত। গ্রামের লোকেরা পারতপক্ষে আসে না জায়গাটায়, কেন জানি ভয় পায়। বলে ওই নরম ঘাসের গালিচা, বাগানের মত করে সাজানো গাছগুলো এবং ওই বড় গর্তখানা সবই নাকি কোন অশুভ শক্তির লক্ষণ। আর এই অতি সাধারণ জঙ্গলেও, বেশ কয়েক জন লোকের নিখোঁজ হওয়ার গল্পকথা লোকের মুখে মুখে ঘোরে। তবে তাতে গোপালবাবুর ভালই হয়েছে। জ্বালাতন করার, একাকীত্বে ভাগ বসানোর কেউ নেই। তপোবনে গোপালবাবুর সঙ্গী হচ্ছে কিছু খরগোশ, কাঠবেড়ালী ও দুটো শেয়াল। সবাই ওখানে বা আশেপাশে থাকে। গোপালবাবুকে প্রতিদিন দেখে দেখে এখন নিজেদেরই একজন বলে মনে করতে শুরু করেছে। কখনো তো একদম কাছে এসে পড়ে, একটুও ভয় পায় না।
কাল বিকেলেও অভ্যেস বশে কুলগাছের বেদীতে বসে পাখির ডাক শুনছিলেন আর কাঠবেড়ালীটার চারদিকে দৌড়ে বেড়ানো দেখছিলেন, তখনই লোকটাকে প্রথম দেখলেন। বেশ একটু চমকেও গেছিলেন, একটা জলজ্যান্ত মানুষ এত নিঃশব্দে কি করে তার পাশে এসে পড়ল তাই ভেবে। পরনে চেক কাটা শার্ট আর খয়েরি রঙের প্যান্ট। পায়ে হাওয়াই চটি। মুখ দেখে বয়েস বোঝার উপায় নেই। আর মুখে একটা সবজান্তা টাইপের ফাজিল হাসি।
চোখাচোখি হওয়াতে মাথা ঝুকিয়ে নমস্কার করে বলে ওঠে “কেমন আছেন কুন্ডুসাহেব”। এবার সত্যিই অবাক হন গোপালবাবু। এ নামে তো আজকাল আর কেউ ডাকে না।
“কে আপনি” জিজ্ঞেস করেন প্রতিনমস্কার করে।
একহাত জিভ কেটে লোকটা বলে ওঠে, “আমাকে আপনি বলবেন না, ছি ছি, পাপ হবে। আমার নাম ফটিক। আপনি যখন সদরে চাকরী করতেন তখন কিছুদিন আপনার আপিসে পিওনের কাজ করেছি। সে আপনি চিনবেন না। তাছাড়া তখন আমার চেহারাটা একটু অন্যরকম ছিল। কয়েকবার আপনার বাড়িতেও গিয়েছি বাজার পৌছে দেওয়ার জন্যে”।
গোপালবাবু চেষ্টা করেন মনে করার, কিন্তু কিছুই মনে পড়ে না। বলেন “তা এখানে কি মনে করে, এখানে তো কেউ আসে না। আর তুমি জানলেই বা কি করে আমি এখানে”।
“আজ্ঞে আমি তো এদিককারই লোক। সব কিছুই চেনা। আর এ তল্লাটের কে না জানে আপনি এখানেই বেশী থাকেন? আপনার সাথে একটা বিশেষ দরকার ছিল।"
লোকটার মুখের হাসিটা এবার একটু যেন প্যাঁচালো লাগে গোপালবাবুর। খুব বিরক্তি জাগে মনে। ভুরুজোড়া কুঁচকে ওঠে। ভাবেন এই জঙ্গলে এসেও শান্তি নেই। মুখে বলেন “বল কি দরকার। তুমি নিশ্চয় জানো আমি এখন রিটায়ার্ড। এখন আর আমার কোন ক্ষমতা নেই কাউকে সাহায্য করবার। তবু বল।"
“ছি, ওভাবে বলবেন না, আপনার কত ক্ষমতা সে তো আমি জানি। তাছাড়া এমন কথা গিন্নিমা শুনলে নির্ঘাত কষ্ট পেতেন।"
আবার অবাক হন গোপালবাবু গিন্নিমার কথা শুনে। মুখে প্রকাশ করেন না, লোকটা যত তাড়াতাড়ি বিদেয় হয় ততই ভাল।
ফটিক যেন গোপালবাবুর মনের কথা বুঝতে পারে। বলে “সাহেব , দরকার আমার যতটা, আপনারও ততটা। আর আজ তো প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল। আপনি বরং কাল একটু তাড়াতাড়ি আসুন। অনেক কথা তো, সময় লাগবে। আজ আমি চলি।"
গোপালবাবু কিছু বলার আগেই লোকটা দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় এবং জঙ্গলে মিলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, “গিন্নিমা কিন্তু খুব ভালো ছিলেন সাহেব, আরেকটু যদি যত্ন নিতেন... কাল তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু”।
কিছু বুঝে এবং বলে ওঠার আগেই লোকটা জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায়।
রান্না করতে করতে নিজের পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গোপালবাবুর। এমনটাতো তিনি ছিলেন না, বরং ঠিক উল্টোটাই ছিলেন। বদলীর চাকরীতে থাকার সুবাদে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। যেখানেই গেছেন, মিশে গেছেন ওখানকার লোকেদের সাথে। নাটক, যাত্রা, সমাজসেবা কিই না করেছেন। বন্ধু ছিল প্রচুর। চটপটে সদাহাস্যমুখ গোপালবাবুকে পছন্দ করত না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। ছেলে মেয়েরা থাকতো হস্টেলে। সংসারে উনি ও স্ত্রী, নাম ইন্দিরা। স্বভাবে শান্ত, মিতভাষী, পরিপাটি। গোপালবাবুর উচ্ছলতা এবং ইন্দিরার স্নিগ্ধতা যেন ছিল একে অন্যের পরিপূরক। ছেলে মেয়েকে কাছে রাখতে না পারাটা ছিল ইন্দিরার বড় দুঃখের জায়গা। যখন সুযোগ পেতেন, গরমের অথবা বড়দিনের ছুটির সময় তাই সুদে আসলে উশুল করে নিতে চাইতেন। বর্তমান বাড়ির জায়গাটা, এখন যেখানে গোপালবাবু থাকেন এটাও ইন্দিরারই পছন্দ করা। তখন এখানে পোষ্টেড ছিলেন। মাঝে মাঝেই দুজনে বেড়িয়ে পড়তেন কোয়ার্টার ছেড়ে। ঘুরে বেড়াতেন এদিকে সেদিকে। এই ছবির মত গ্রামটা এমনি এক দিন চোখে লেগে যায় ইন্দিরার, আর গোপালবাবুকে দিয়ে প্রমিস করান যে রিটায়ারমেন্টের পরে এখানেই এসে বাসা বাঁধবেন দুজনে। বাসা শেষমেশ হল, তবে ইন্দিরার আর তা দেখা হয়ে উঠল না। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস গোপালবাবুর বুক চিরে উঠে আসে। আবার মাথার মধ্যে ব্যথাটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে একবার।
আজ একটু তাড়াতাড়িই দুপুরের খাওয়াটা সেরে ফেলেন গোপালবাবু। যদিও খাওয়ার ইচ্ছে একেবারে ছিল না, তবু খেলেন। এসব ব্যপারে আবার খুব কড়া নিয়ম মেনে চলেন উনি। খাওয়া ঘুমনো সব ঠিক সময়ে এবং দরকারমতো হওয়া চাই। এমনিতেই এই গ্রামে একা থাকেন, তাই অনিয়ম করে অসুস্থ হওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না উনি। তবে প্রতিদিন দুপুরের ছোট্ট ঘুমের প্রোগ্রামটা আজ ক্যানসেল করলেন। কি জানি যদি তাড়াতাড়ি ঘুম না ভাঙ্গে। অভ্যেসের বশে কয়েকবার ঢুলুনি এসেছিল, সেটা চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তাড়ালেন। বেলা তিনটে নাগাদ ঘরে তালা লাগিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন তপোবনের দিকে।
পায়ে চলা রাস্তাটার মাঝামঝি গিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হল গোপালবাবুর। রাস্তাটা একদম অন্যরকম লাগছে আজ। একটু থমকে দাঁড়ান কয়েক মুহূর্তের জন্য, ভাল করে তাকিয়ে দেখেন, নাঃ সব ঠিকই আছে, ওই তো দূরে অর্জুন গাছটা দেখা যাচ্ছে তার পাশে ছোট অশ্বত্থ গাছটা। তবে একটা তফাৎ অন্য দিনের চেয়ে চোখে পড়ে, সব গাছের ডালপালা, পাতা একটু বেশীই সবুজ লাগছে যেন। দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টিস্নাত, কিন্তু বৃষ্টি তো হয়নি আজকে! পুরো জঙ্গলটা যেন সেজে উঠেছে আনন্দে, খুশীতে। এই বিচ্ছিরি মাথা ব্যথাটার জন্যই বোধ আজ সব অন্যরকম লাগছে, ভাবেন গোপালবাবু। চিন্তাটাকে সরিয়ে এগিয়ে যান তিনি তপোবনের দিকে।
তপোবনে পৌছে অবাক হন গোপালবাবু, সবুজের তো বন্যা বয়ে গিয়েছে এখানে। অপূর্ব লাগছে জায়গাটা। কোন এক অজানা বুনোফুলের গন্ধ মাতিয়ে রেখেছে তপোবনকে। মনটা হঠাৎ করে সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত হয়ে ওঠে। ব্যথার কথা, শরীরের কথা বেমালুম ভুলে যান উনি। কুলগাছের বেদীটায় বসতে গিয়েও না বসে বসেন ঠিক উলটো দিকে দুটো বড় গাছের মাঝখানে পড়ে থাকা পাথরটার ওপর। ভাবেন লোকটা এলে তো কুলগাছের দিক থেকেই আসবে, কালকের মত আচমকা চমকে দিতে পারবে না আজ। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। আজকে বোধ হয় শুধু অবাক হওয়ার পালা। যে শেয়াল দুটো তপোবনের আশেপাশেই কোথাও থাকে, এবং গোপালবাবুকে দেখলেও না দেখার ভান করে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে, সে দুটো যেন কত দিনের চেনা পরিচিতের মত সামনেই এসে বসে। দূরে কোথাও একটা পাখি টিট্টিভ... টিট্টিভ... করে ক্রমাগত ডেকে চলে। তপোবনের এই রূপ, এই সৌন্দর্য ধীরে ধীরে গ্রাস করে গোপালবাবুকে, তিনি আবেশিত হন। ভাবেন ভাগ্যিস ইন্দিরা প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল এখানে ঘর বানানোর, তাই আজ তিনি মোহ মায়া বন্ধন থেকে দূরে সরে এসে এই স্বর্গীয় আনন্দের অংশীদার হতে পারছেন। কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে গোপালবাবুর তাঁর স্বর্গীয়া পত্নীর প্রতি। পুরনো দিনের কথা, ইন্দিরার কথা, ছায়াছবির মত গোপালবাবুর মনে পড়ে যায়।
গোপালবাবুর বিয়েটাই একটু অনরকম হয়েছিল, খানিকটা ফিল্মী স্টাইলে। তখন সবে বছর পাঁচেক চাকরী হয়েছে। আত্মীয় স্বজন সব এমন সুযোগ্য পাত্র পেয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন পাত্রী খোঁজার জন্য। দেখা শুনো চলছে জোরকদমে। তারই মাঝে একদিন বাড়ির সবার সাথে গিয়েছিলেন এক দূর সম্পর্কের তুতো দাদার বিয়েতে। বিয়ের আসরে সেই তুতো দাদার বাবাটি, মনের মত পণ না পাওয়ায় বিয়ে ভেঙ্গে দেন। মেয়ের মা তাই শুনে মুহুর্মুহু অজ্ঞান হয়ে পড়তে থাকেন। মেয়ের বাবা লজ্জায় ঘেন্নায় নিজেকে শেষ করে ফেলার উপক্রম করেন প্রায়, ঠিক তখন গোপালবাবুর বাবা ইশ্বরের ভূমিকায় নেমে, ছেলেকে আদেশ দেন তৎক্ষণাৎ বিয়ের পিঁড়িতে বসতে, যে আদেশ মেনে প্রথমে কয়েকদিন অনুশোচনায় ভুগলেও সারা জীবন বাবার কাছে কৃতজ্ঞ থেকেছেন গোপালবাবু।
ইন্দিরা প্রথমে খুব অপরাধবোধে ভুগতেন। ভাবতেন গোপালবাবু নেহাতই দয়া করে তাঁকে বিয়ে করে পিতৃ আদেশ পালন করেছেন মাত্র। পরে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। স্বভাবে দুজনে ছিলেন একদম বিপরীত দুই প্রান্তের। গোপালবাবু ছিলেন চঞ্চল, সব ব্যপারে অত্যুৎসাহী, প্রানবন্ত যুবক, আর ইন্দিরা ছিলেন ঠান্ডা, ধীর, স্থির প্রকৃতির। কিছুদিনের মধ্যেই গোপালবাবু সম্পূর্ণভাবে ইন্দিরা নির্ভর হয়ে পড়লেন। সব কিছুতেই তখন খালি ইন্দিরা আর ইন্দিরা। ধীরে ধীরে সংসার বাড়লো, ঘরে এলো পুত্র কন্যা। দেখতে না দেখতেই ওরাও বড় হল। গোপালবাবুর অত্যধিক বদলি হওয়ার কারনে ওরা গেল হস্টেলে।
দিন, মাস, বছর কেটে গেল। ছেলে মেয়ে বড় হল, মেয়ের বিয়ে, ছেলের চাকরী, সময়ের হাত ধরে যেমনটা সবার জীবনে হয় তেমনটাই হল। গোপালবাবুও পৌছে গেলেন চাকরী জীবনের প্রায় শেষে। তখন ছিলেন জেলা শহরে। একটা সময় এল যখন সংসারে প্রবেশ করল একঘেয়েমি। সব কিছুই সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। অফিস আর বাড়ি, বাড়ি আর অফিস। ইন্দিরার যদিও খুব একটা সমস্যা ছিল না শুরুতে, কারন তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী। সংসারের যাবতীয় কাজ এবং পতিসেবা, তাতেই পুরো সময় কেটে যেত। গোপালবাবুর ছটফটে স্বভাব কিন্তু এই একঘেয়েমিটাকে মেনে নিতে পারে নি। নিজের অজান্তেই কখন যে তিনি বেশির ভাগ সময় বাইরে কাটাতে শুরু করলেন, তা নিজেও খেয়াল করেন নি। অফিস শেষে ক্লাব, সেখানে হয় নাটকের রিহার্সাল নাহলে ব্রিজ খেলার আসর। ফিরতেন বেশ রাত করে। ইন্দিরা যখন দেখলেন তার সব চেয়ে প্রিয় মানুষটাকে আর তিনি কাছে পাচ্ছেন না, দুটো সাংসারিক কথা বলতে পারছেন না, ভাল কিছু রেঁধে সামনে বসে খাওয়াতে পারছেন না, তখন এক চরম হতাশা তাকে গ্রাস করতে শুরু করল। তবে সারা জীবন যা করেন নি, স্বামীর কাছে কোন ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের আবদার বা অভিযোগ, তা এবারেও করলেন না, না কিছু ছেলে বা মেয়েকে বললেন। শুধু স্বামীর অভাব তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল সারা দিন রাত। ফলতঃ শুরু করলেন অনিয়ম, নিজের অজান্তেই বোধ হয়। খাওয়াতে অনিয়ম, ঘুমে অনিয়ম। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ফুরিয়ে গেল যেন।
এসবের পরিণামও মিলল কিছু দিনের মধ্যেই। অফিসে ব্যস্ত ছিলেন গোপালবাবু, হঠাৎ ফোন এল বাড়ি থেকে, ইন্দিরা পড়ে গিয়েছেন এবং কোন কথা বলতে পারছেন না, শুধু মাথার যন্ত্রনায় ছটফট করছেন। সেরিব্রাল অ্যাটাক। শুরু হল এক কষ্টকর সময়। ডাক্তার, হাসপাতাল, ওষুধ পথ্য। সে এক লড়াই। লড়াই ভবিতব্যের সাথে, নিয়তির সাথে। ছেলে মেয়ে দৌড়ে এল সব ছেড়ে এবং সবার প্রচেষ্টায় অনেকটা ভাল হয়ে উঠলেন ইন্দিরা। দিন পনেরো লড়াইয়ের পর ফিরে এলেন আপন ঘরে। যদিও শয্যাশায়ী তবুও তো নিজের ঘর, নিজের বিছানা। তার ওপরে সর্বক্ষণ গোপালবাবুর সান্নিধ্য। ভেবে নিয়েছিলেন ইন্দিরা, এবার ভাল হয়ে উঠবেন, আবার নিজের হাতে হাল ধরবেন সংসারের, আবার সামনে বসিয়ে খাওয়াবেন ভালবাসার মানুষটাকে। আর বলবেন যে তুমি আমার সাথেই থেকো, ছেড়ে যেওনা অমন করে কখনো।
সেদিনটা ছিল গোপালবাবুর জন্মদিন। প্রতিবারের মত যথারীতি সেটা গোপালবাবু ভুলে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা কাজের মেয়েকে দিয়ে চুপি চুপি কেক আনিয়েছিলেন পাশের বেকারি থেকে। অফিস থেকে ফিরলে একসাথে কেক কাটবেন। আর একটু ভাল মন্দ রান্না করিয়েছেন। জন্মদিনে এটুকু তো করতেই হয়। তার ওপর যা ধকল গেল লোকটার ওপর এই ক দিন।
গোপালবাবু প্রতিদিন যেমন কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন তেমনই ছিলেন। আচমকা ফোন এল প্রিয় বন্ধু এবং ব্রীজ খেলার পার্টনার আশুতোষের কাছ থেকে। শহরের আরেক প্রান্তে ব্রীজ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। যেহেতু আশুতোষ জানে এখন ইন্দিরা ভাল আছেন তাই তাঁকে না জানিয়েই নাকি নাম দিয়ে ফেলেছে। না গেলে কেলেঙ্কারি কান্ড। দুএকবার আপত্তি করেন গোপালবাবু, কিন্তু যখন শোনেন হাফডে ছুটি নিলে সন্ধ্যের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন, তখন রাজি হয়ে যান।
কপালের ফের। যখন কম্পিটিশন জিতে সে রাতে গোপালবাবু বাড়ি ঢোকেন, তখন প্রায় রাত সাড়ে দশটা। ইন্দিরা নাকি সেদিন তাড়াতাড়ি ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন, কয়েকবার ডাকাডাকিতেও সাড়া দেন নি। শুধু পাশের টেবিলে রাখা ছিল গোপালবাবুর জন্মদিনের কেক, ওপরে লেখা হ্যাপি বার্থডে। ঢাকা দেওয়া ছিল রাতের খাবার এবং পায়েশ।
সেই রাতেই আবার অ্যাটাক হয় ইন্দিরার, কিছু ভাল ভাবে বুঝে এবং করে ওঠার আগেই, এক বুক অভিমান নিয়ে ইন্দিরা বিদায় নেন গোপালবাবুর জীবন থেকে, শেষ বারের মত জন্মদিন পালন করে বা না করে। আর গোপালবাবুর জীবনটা চুরমার হয়ে যায়, পালটে যায় রাতারাতি। এক ভয়ঙ্কর অপরাধবোধ গ্রাস করে। নিজেকে মনে হয় একটা খুনী। বদলে যান গোপালবাবু, খুব বেশী বদলে যান।
“বলেছিলাম না সাহেব, গিন্নিমার আর একটু খেয়াল রাথা উচিত ছিল আপনার।"
চমকে ওঠেন গোপালবাবু, আরে কখন এল লোকটা! অবশ্য এতক্ষণ তো নিজের চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন, সেই ফাঁকে এসেছে বুঝি। সেই একই ড্রেস, সেই একই ফাজিল টাইপের হাসি মুখে।
“কখন এলেন আপনি” গোপালবাবু জিগ্যেস করেন। সাথে সাথেই বোঝেন আজ তাঁর আসাটা একেবারেই উচিত হয় নি। মাথার ভেতরে ব্যথাটা এখন লাগাতার হচ্ছে, এবং নিজেকে সম্পূর্ণ তালজ্ঞানহীন মনে হচ্ছে। হাত পা কিছুই যেন আর বশে নেই।
“আমাকে দয়া করে আপনি বলবেন না, আপনি সম্মানীয় লোক। আর তাছাড়া এখন তো একসাথেই বাস। কাজেই তুমি বা তুই করে বলুন সাহেব।“
গোপালবাবু সবটা বুঝতে না পেরে বলেন “ তো তুমি গিন্নিমাকে কি করে জানলে ফটিক”
“শুধু গিন্নিমা কেন? সবই তো জানি।“
“সবই?” গোপালবাবু বোঝেন ব্যথাটা আরো বাড়ছে। এরপর বাড়ি ফিরে যাওয়া মুস্কিল হবে।
"হ্যাঁ, সবি তো, এই ধরুন আপনার কথা, গিন্নিমার কথা, আপনার মেয়ের কথা, আপনার ছেলের কথা, নাতির কথা, দুঃখের কথা সুখের কথা সব সব জানি।“
“কিন্তু কি করে জানলে, সেটাই তো জানতে চাইছি” গোপালবাবু অবাক হয়ে ব্যথার কথা ভুলে যান।
“কেন? আপনার কাছ থেকে”
“আমি? আমি কবে এসব কথা বলেছি? কাকে বলেছি? তোমায় তো কালকেই প্রথম দেখলাম?”
“সব কথা কি আর মুখে বলতে হয় সাহেব? মন বলেও তো একটা জিনিষ আছে নাকি?”
“মন? মনের কথা তুমি কি করে বুঝবে হে?”
খুব রাগ হয় গোপালবাবুর। কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারেন না। নিজেকে হঠাৎ ভীষণ ভারি লাগে। ভাবেন এসব কথা বার্তা ছেড়ে এবার বাড়ি যাবেন।
“আরে রাগ করছেন কেন সাহেব? আর যাবারই বা এত তাড়া কিসের?”
এবারে খুব চমকান গোপালবাবু। লোকটা সত্যি তাঁর মনের কথা পড়তে পারছে যে...
বলে ওঠেন
“সত্যি করে বল তো তুমি কে, আমায় কেন ডেকেছ আজ, আমার শরীর ভাল নেই, বড় কষ্ট হচ্ছে, আজ আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাব, ভাল লাগছে না”
“বলছি সাহেব বলছি, একটু ধৈর্য ধরুন। আর ব্যথা নিয়ে চিন্তা করবেন না। পরিবর্তনের সময় ওটা হয়। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। তারপরে দেখবেন কি শান্তি।
আপনি জানতে চাইলেন না আপনার মনের কথা কি করে জানলাম? জানব না? এখানে আমরা সবাই সবার মনের কথা বুঝি, আপনিও সময় হলে বুঝবেন, কারন কথা বলার তো আর উপায় থাকবে না। আর এই আপনার কথা মত আমি তুমিও আর থাকবে না। আমরা থাকব। আমরা অনেক আবার আমরা এক। হেঁয়ালী লাগছে? একটু ভাল করে তাকান তো চারিদিকে, নতুন কিছু দেখতে পান কিনা।“
গোপালবাবু কষ্ট করে চারিদিকে দেখেন কিন্তু আর অবাক হন না। দেখেন সামনে ফটিক ছাড়াও চারিদিকে বড় বড় গাছগুলোর জায়গায় একেকজন লোক বসে আছে। তপোবন জুড়ে এক অদ্ভুত আলো। যা চোখে লাগে না অথচ বড় উজ্জ্বল। বড় স্নিগ্ধ। কোথা থেকে আসছে বোঝার উপায় নেই। লোকগুলো তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে। সামনে ফটিকও হাসে, কিন্তু ওর হাসিটাও আর কেন যেন ফাজিল ফাজিল লাগে না। বরং বেশ ভালই লাগে। ব্যথাটাও কখন যেন কমে এসেছে। গোপালবাবু লোকগুলোকে দেখে মাথা নাড়েন। কিছু বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন কথা বেরোয় না।
ফটিকের ঠোঁট নড়ে না, তবু আওয়াজ আসে
“স্বাগতম গোপাল, নতুন দুনিয়াতে স্বাগতম”
গোপালবাবুর দৃষ্টি পড়ে নিজের হাত পায়ের দিকে। দেখেন শুধু একটা বড় গাছের গুঁড়ি, আর তার পাক দেওয়া শিকড় বাকর যা নেমে গেছে মাটির ভেতর। মনের ভেতর জেগে ওঠা এক নৈসর্গিক আনন্দের মধ্যেই গোপালবাবু বোঝেন তিনি আর গোপালবাবু নেই, একটা গাছ হয়ে গেছেন। এক স্থবির, যার জীবনে আর কোন সুখ দুঃখ ব্যাথা নেই। ভাল লাগা, খারাপ লাগা নেই, লোক লজ্জা নেই। অপরাধবোধ নেই। শুধু নীচে মাটি আর মাথার ওপরে খোলা আকাশ।
এক ঘোরের মধ্যে গোপালবাবু, দেখেন ফটিক আর নেই। তবু মনের মধ্যে ফটিকের আওয়াজ ভেসে আসে। “সাহেব চিন্তা নেই, পরিবর্তন পুরো হয়েছে”। চারিদিক থেকে যেন অনেক আওয়াজ মনের মধ্যে ভেসে আসে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, পুরো হয়েছে”।
হঠাৎ চোখে পড়ে, সামনে ইন্দিরা দাঁড়িয়ে আছেন। সেই আগের মতই সুন্দরী। সেই মিষ্টি হাসি। বলে
“ভাল আছো? কোন চিন্তা নেই এবারে ভাল থাকবে। আমরা ভাল থাকব। তোমায় বলেছিলাম না এখানেই থাকবো আমরা। তোমার আর কোন কাজ থাকবে না। তুমি আর আমি একসাথে থাকবো চিরটা কাল”।
আনন্দ হয় খুব গোপালবাবুর। ইন্দিরাকে দেখে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে হয় সরি ইন্দিরা আমায় ক্ষমা করো। কিছুই বলতে পারেন না। বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। মনে হয় আনন্দে বা দুঃখে চিৎকার করে কাঁদেন। কিন্তু উনি জানেন, গাছেরা কোন দিন কাঁদে না...
গোপালবাবুর গল্পে একাত্ম হলাম। অসম্ভব ভালো এক সাদামাটা মানুষের কাহিনী...গল্পের নাম-ও ভীষণ মানানসই "তপোবন"...
গল্পের হঠাত্ আগন্তুক ফটিক-কে বেশ সন্দেহজনক লাগছিল শুরু থেকেই এবং পরে তা বোঝা গেল...আর অদ্ভুত ভাবে লেখা এ দৃশ্যকল্প...
"গোপালবাবু কষ্ট করে চারিদিকে দেখেন কিন্তু আর অবাক হন না। দেখেন সামনে ফটিক ছাড়াও চারিদিকে বড় বড় গাছগুলোর জায়গায় একেকজন লোক বসে আছে। তপোবন জুড়ে এক অদ্ভুত আলো। যা চোখে লাগে না অথচ বড় উজ্জ্বল। বড় স্নিগ্ধ। কোথা থেকে আসছে বোঝার উপায় নেই। লোকগুলো তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে। সামনে ফটিকও হাসে, কিন্তু ওর হাসিটাও আর কেন যেন ফাজিল ফাজিল লাগে না। বরং বেশ ভালই লাগে। ব্যথাটাও কখন যেন কমে এসেছে। গোপালবাবু লোকগুলোকে দেখে মাথা নাড়েন। কিছু বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন কথা বেরোয় না। ফটিকের ঠোঁট নড়ে না, তবু আওয়াজ আসে - “স্বাগতম গোপাল, নতুন দুনিয়াতে স্বাগতম”
বিউটিফুল শেষটা...
"আনন্দ হয় খুব গোপালবাবুর। ইন্দিরাকে দেখে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে হয় সরি ইন্দিরা আমায় ক্ষমা করো। কিছুই বলতে পারেন না। বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। মনে হয় আনন্দে বা দুঃখে চিৎকার করে কাঁদেন। কিন্তু উনি জানেন, গাছেরা কোন দিন কাঁদে না...
"
একটা অলৌকিক সত্য ঘটনার মত হু হু করে এগিয়ে গেল গল্পটা...
খুব ভালোলেগেছে।