পুরনো প্রেম
যশোধরা রায়চৌধুরী
১
পুরনো প্রেমের কাছে অনেকটা 'আমি' রাখা থাকে। ঠিক পুরনো শাড়ির ভাঁজে লুকনো গিনির মত, আলমারির খোপে খোপে । গোপন, অগাধ। অদৃশ্য জানালা যেন, অথবা দরোজা, যার ফাঁক গলে চলে যাওয়া যায় চোরাছুপি। প্রাইমটাইমে, খেলাধুলোকালে।
তেইশ বছর আগে ছেড়ে আসা স্মল সাইজ জামাও ঠিক ফিট করে যায় অবলীলাভরে। এমনিই হবার কথা ছিল।
সেই সে ছেলেটি আর তুমি? হৃদয়ের ভাইবোন তোমরা দুজনে। নস্টালজিয়ার ভল্টে এক টুকরো অতীত শেয়ার কর বলেই না প্রেমের অক্ষয় স্বর্গ থেকে যায়, ব্যাংকে রাখা ডিপোজিট-এর মত।
দরকার মত, অচানক, ফিরে পাওয়া যায় সুদসমেত। সে রতন নিজস্ব, করুণ, রাতজাগা, ঘুমভাঙা...
২
প্রথম প্রেমের দিন অক্ষত রেখেছ। বাকি সব আঘ্রাত, আবিল...
না ঠিক তাও নয়, ফ্লার্টিশাস, অতি সচেতন।
সে ছিল না ওরকম। লজ্জা পেত। তাকাত না ভাল।
খুব মুখচোরা। আর প্রথম সেবারই
তুমিও পুরুষ চিনলে। সে সময়ে কাছে আসা, দূরে যাওয়া, সবটাই অনুভূত হত পায়ের পাতার মাপে... ছোট ছোট হেঁটে যাওয়াগুলো ঠিক ছাপ ফেলত গভীর গভীর।
সে সময়ে কেউ কাউকে চিপ ভাবত? ছি ছি করত মনে মনে? তুমিও কি দোষ দিয়েছিলে?
ভুলে গেলে। আপাতত পদ্মপাতায় মোড়া ইনোসেন্স। কাঁচা মধু, অবিচল চিত্র করে হলুদ, সংঘাতহীন। গাঢ়।
নৌকার গায়ে আলো
বিক্রম পাকড়াশি
নৌকার গা, তাতে রাত্তিরের আলো এসে পড়ে
এত আলো আলো চরাচরে
আমাদের জানা ছিল না
আলোর ফেনায় ধুয়ে মেজে দিচ্ছে নৌকার গা।
আর যত বন্ধ জানালা
তার ওপারে সেকি বৃষ্টি সেকি বৃষ্টি ভাবতে পারা যায়!
বাতাসে জলের শব্দ
আকাশে জরির সুতো গুমরোচ্ছে রুপালি পর্দায়
ছলাৎছল রঙিন নৌকা।
রঙিন দাঁড়, রঙিন পাল, রঙিন মাছ, রঙিন মাস্তুল,
প্লাবনের বৃষ্টি এসে ছাপিয়ে দিচ্ছে দুধারের কূল
পিপে ভর্তি আলো জমছে নৌকার গহ্বরে
এমন ঝড়বৃষ্টিভরা দিন এলে ঠিক মনে পড়ে
নৌকার গা, তাতে এসে পড়ে রাত্তিরের আলো
চমকে ওঠে, তার নীচে বয়ে যায় অফুরন্ত নদী
তারও নীচে বয়ে যায় আরও আরও নদী
আরও নদী তারও নীচ দিয়ে বহে যায়
রাত্তিরের আলো এসে পড়ে ওই নৌকার গায়।
আমার জানালায় ধুম জ্বরে
উত্তপ্ত কপালে, গায়ে, ঠোঁটে তাই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি
কই নৌকার পড়া ঐ রাত্তিরের আলো
কই তার নীচে বহে যাওয়া অন্তহীন নদী
তাদের মৎস্যসন্তান, তার উপলপ্রবাহ, দ্বীপ, বনজঙ্গল, পর্বতমালা
তার চর, তার বেলাভূমি, ঝাউগাছ, ঝিনুক
কোথায় রুপালি জ্যোৎস্না এসে ঝাঁপায় বালির প্রান্তরে
আমরা তো কিছুই দেখিনি এইসব-
রক্তচোখ আমাদের একদম মনে ছিল না,
রাত্তিরের আলো এসে ধুয়েছিল নৌকার গা।
শান্তি সম্পর্কিত
মাজুল হাসান
হে মিতব্যয়ী সাইকেল, এতদিনে তোমার গামবুট ও কাঠের পায়ের
পুরনো ব্যথাটা একটু হলেও সারবার কথা। আর তেমনটি হলে
প্লাস্টিকের সাপ হাতে তুমি চলে যেতে পারো মহামাণ্য
ফ্রয়েডের বাড়ি
স্বপ্নতত্ত্বর কয়টা ঠ্যাং? কি খায় তারা? অথবা পাটখালাসী?
কীভাবে সাড়ে ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটা পাটকাঠির উপর দিয়ে যেতে যেত
মানুষ লাফিয়ে পড়ে ক্রিস্টালের নদীতে? কীভাবে কেঁপে ওঠে
পৃথিবীর নাভি?
বিশ্বাস যাও জনার্দন, আমি তার জানি না কিছুই। তাই বলছি
আসো—আমরা বরং শান্তিতত্ব নিয়ে তাফালিং মারি—জানোই তো
'সম্রাট নেপোলিয়ন আক্ষরিক অর্থেই বিড়াল ভয় পেতেন'—এই তথ্যের পর
বিড়ালকে শান্তির দূত ভাবলে ক্ষতি নেই, তবে তার আগে,
শুধু একবার, শুনে নিতে হবে গৃহস্বামীর আর্তনাদ—
ইশ! খেয়ে গেল কি?
... দুধ!
দৃষ্টিবিভ্রম
দোলনচাঁপা চক্রবর্তী
আষাঢ়কে বৃষ্টি ভাবছ
এ তো একটা মানুষের নামও হতে পারে
যে আসে অথবা চলে যায় -
তোমাকে অবুঝের মত রেখে
নদী রইল ধারাপাতের কাছে
শিক্ষক জলের সামনে
দিনটি ক্ষেতের দরজায়
এইসব রোদঝাঁপ ফেলে বাইরে বেরোও
দ্যাখো, সকাতর আয়না ছাড়াও আমাদের কত কথা আছে
তোমাকে ছাপিয়ে যায় পালক বিক্রেতার হাসি
অরণ্য
যতদূর চোখ যায় নোনা জল আর জল। এ কোনো সমুদ্র নয়, হৃদয়ের চিত্র, দূষিত বাতাস শুষে হল শুদ্ধ। এ পারে নোঙর রয়েছে সুন্দর, রয়েছে জাহাজের পাল, সরাইখানা আর আরাম চেয়ার, অথচ শহরের গাড়িগুলো কেমন অন্ধ। পাখিরা যায়-আসে, হয়ত হারিয়ে যায় কিংবা মরে, অথচ পালক বিক্রেতা বলতে পারেনি কখনও, ডানারা কেন বার বার ফিরে আসে পসরার সাজে? আকাশেরও গন্ধ আছে, আছে মাটির নিঃশ্বাস, এ পারে যত এগিয়ে যাই, তত শেষ হয়ে যায় পথ।
ঘুমের ভান করে থাকি, যেনবা প্লাবনের ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছে বিক্ষুব্ধ জলরাশি। এ যেন প্রিয় মানুষের অভিশাপ, ঘরে ফিরে এলে নিজেকে মনে হয় নিভে আসা ঝাড়বাতি। আমি তো চেয়ে চেয়ে দেখি, কীভাবে কমে আসা আলোয় অস্পষ্ট হয়ে ওঠে মুখের কারুকাজ। যতদূর ভাবা যায় তোমাকেই খুঁজি, হৃদয় ওপারে বিশুদ্ধ নুপূরে এত যে তোমার ছুটোছুটি, তুমি কি জানো, এ পারে আমি তোমার বন্দরে নিজেকে ভাসিয়ে বাঁচি।
খয়েরী বাতাস
শাকিলা তুবা
এই দিনটার কোনো নাম দেয়া যাবেনা
হয়তো চেনাবার জন্যে বলা যায় আজ বৃহস্পতিবার
আদতে গাঢ় বৃষ্টিরঙা দিনের নাম থাকতে নেই।
বাতাসে খয়েরী রঙের লিপিস্টিক ঘঁষে দেয়া গাছগুলো
আপাতঃদৃষ্টিতে ওদেরও কোনো নাম নেই
সম্বোধনের প্রয়োজনে ডাকা যায় জারুল নামে।
গাছশরীরে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো দুই প্রাণের নামও অপ্রয়োজনীয়
এই বৃষ্টিতে সব ভিজে একাকার, প্রিয় স্পর্শগুলোও
পার্কের গাছ হরহামেশাই এসবের সাক্ষী, দিনটার নাম শুধু ওরা মনে রাখে।
না-মানুষ অধ্যায় অথবা নিছক ক্ষুধার গল্প
সায়ন্তন
পূর্বনির্ধারিত একটা সময়ে তারা সকলে আসত -
তখন কেউ জানত না কোথায় তাদের বাসাবাড়ি
শহর থেকে দূরে প্রত্যন্ত খনি অঞ্চল তার লাগোয়া গ্রাম থেকে -
পার্কের বেঞ্চ থেকে, হলদেমাটি নদীর বাঁধ থেকে -
নিষিদ্ধ পল্লী থেকে, সময় কালের গন্ডীর বাইরে থেকে
তারা আসত - যেমন পরে জানাজানি হয়েছিল
আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতক, উল্লেখযোগ্য কিছু মনে নেই
শুধু একসারি তেলচিটে মানুষ রেলিঙের ধার ঘেঁষে
ধীর, শ্লথগতি, স্খলিত পদক্ষেপে আগুয়ান
দেবোত্তর জমির উপর, অন্ধত্বের প্রাসাদে
মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি আমাকে এই সব মনে করিয়ে দেয়
কিছু সবুজ উদ্ভিদভুক কীটের দঙ্গল, ক্ষুধার্ত ঝোপে ঝাড়ে -
পাত্রভরা অন্ন - পচনের ঠিক আগের মূহুর্ত্তে -
গলিত সব্জি যা সব আসলে কারখানার বর্জ্য জঞ্জাল
তবু, ক্ষিধে কী ভীষণ প্রবল
আমার জমিনে গ্রীষ্মের স্মৃতি গলন্ত রাজপথের মত লেলিহান আগুন
সময়ের খামখেয়ালি কাঁটা কবেই ভেঙে হারিয়েছে
সাময়িক ঘটনাবলি খনিজ সাইরেনের তীক্ষ্ম কন্ঠস্বর হয়ে
নির্বাসিত শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে চলা পথের ধারে
ক্রন্দনরত, বাতাসহীন অশান্ত সন্ধ্যায় এক বুক ভরা চাপ অন্ধকার
চিত্রঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়