আসলে কীভাবে শুরু করবো সেটা নিয়ে গড়িমসি হয়ে গেল বহুদিন। কিভাবে লিখলে লেখাটা চলবে...লোকে পড়বে...বলবে ভালো...তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য মাল মশলা মজুত করা নেই হাতে। তথ্য সন্ধানমূলক লেখার যে ব্যাপ্তি আশা করা যেত সেটাও পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। পড়া হয় না অনেক দিন অনেক কিছু...ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সব... ছড়িয়ে ছিটিয়ে সমকাল...আর কোথাও যেন সেঁধিয়ে থাকার মন্ত্রনা কানে এসে ফিস- ফিস, গুণ- গুণ করে। এলোমেলো পাতা উড়ে আসে...মোবাইলের রিং টোন...এস এম এসের বিপ বিপ...সূড়ঙ্গের অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে গন্ধ...মিলেমিশে একাকার কাব্যিক উত্থানের গলা টিপে ধরে।
জলের তোড় এগিয়ে আসে...অন্ধকারের মধ্যে ঠাহর করা যায় না...কিন্তু জলের তোড় এগিয়ে আসে...।
কতকগুলো মানুষ বেঁচে থাকার শেষ নিক্তিটা মেপে নিয়ে...জীবনের সব কিছু উচ্ছিষ্টকে স্বীকার করে নিয়ে জলের কাছে লিখে যেতে থাকে সময়ের ভাষ্য।
আলো আসে...আলো যায়...উইংসের আড়াল থেকে কুশীলবরা বিস্ময়ের চাহনিতে ঢেকে রাখে তাদের রঙে মাখা মুখ...তাদের হাড় হিম করা পরিশ্রম...তাদের ভেতরের তুমুল আলোড়ন।
এইসবই জলের তোড় হয়ে ঢুকতে থাকে মঞ্চে। মিনার্ভায় তখন দর্শক নৈঃশব্দ্যের নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গে করে নিয়ে শেষ মুহূর্তের প্রহর গোনায়।
আলো ক্রমে কমে আসে... সনাতন লিখতে থাকে...
সনাতনের কন্ঠ শোনা যায়...
“পৃথিবীর মানুষ, তোমরা আমাদের ভুলো না। মানুষের ঐশ্বর্য আহরণ করতে আমরা নেমে যাই ধরিত্রীর অতল গর্ভে। সেখানে আমাদের জীবন রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই...” (জলের ভীম গর্জনে প্রায় চাপা পড়ে যায় কন্ঠ, তবু দ্রুত লিখে যায় সনাতন) ঐশ্বর্যলিপ্সাই মানুষকে করে শয়তান আর সেই শয়তানরা হাসিমুখে আমাদের জলে ডুবিয়ে মারে। আমরা মরে যাই, ক্ষতি নেই, তোমরা দেখো এরপরে যেন আর একজন মানুষও এভাবে ইঁদুরের মতন না মরে। (চিঠিগুলি দ্রুত একসঙ্গে করে বারুদের বাক্সে পোরে, রেখে দেয় সেটা সযত্নে একটা ফাটলের মধ্যে। জলের গর্জন এবার যেন এই সুড়ঙ্গেরই অভ্যন্তরে অনুরণিত হয়ে ওঠে)।”
গর্জন এগিয়ে আসতে থাকে কাছে। জলের তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবাইকে।
সনাতনকেও।
এক বছর ধরে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে জ্বলতে থাকে অঙ্গার।
শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার পায় সনাতন।
সবার সামনে উঠে আসেন এক অপরিচিত মানুষ।
সবার সামনে তখন রবি ঘোষ।
কিন্তু কোথাও যেন বিচ্ছেদের সুর আবহে বইতে থাকে। এক নতুন জন্মের সূচনা লগ্নে রঙ মাখা মুখ গুলো কেমন যেন অপরিচিতের দাঁড় টানতে থাকে। কিন্তু মন তখন পাল তুলে দিয়েছে...কোন ঘাটে ভিড়বে তার তরী...অভিনেতা নিজেও জানেন না…তিনি লেখেন...
“অঙ্গার এল টি জি-র ভাগ্য ফেরালো এবং একই সঙ্গে তার কবরও তৈরী করে দিয়ে গেল। আমাদের কর্তারা সব কেমন যেন হয়ে যেতে লাগলেন। এক বছর পর প্রথম আমি এল টি জি ছেড়ে চলে এলাম। আসার সময় একটা কথাই শুধু উতপলদাকে বলে এসেছিলাম যে এল টি জি-র মধ্যে কোথায় যেন কী একটা ঢুকে গেছে এবং মাত্র এক বছরের মধ্যেই এল টি জি ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। হলও তাই...। সবাই আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম। ”
শুরুটা বেশ মজার ছিলো। শুরুটা ছিল খেলার। জিমনাস্টিকের কসরত দেখে লোকে বিস্ময় প্রকাশ করতো। গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী মাঠে তখন ছোট্ট রবিকে নিয়েই গুঞ্জন। আর হবেই বা না কেন? বাবার দিকের সবাই তো নাম করা প্লেয়ার। নিয়মিত খেলাধূলো করেন...ফুটবল, ক্রিকেট। তাঁরা সবাই ইষ্টবেঙ্গলের লাইফ মেম্বার। রবির মতি গতি যে খেলার দিকেই যাবে তা আর এমন কথা কি!
লোকের মুখে মুখে ছড়ালো জিমন্যাস্ট রবির কথা।
ব্যাপারটা এতোটাই, একদিন ডাক এলো সার্কাস থেকে। এক রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি...অতগুলো মানুষ...বাঘ, সিংহ, হাতি...তার মাঝে ট্রাপিজের খেলা...অত আলো...অত মজা...।
না... শেষ পর্যন্ত যেতে হয়নি সার্কাসে। বাবা রাজি হন নি। কোনো প্রশ্নই ছিলো না যাবার। বাঙালীর ছেলে সার্কাসে? অগত্যা সব রোমাঞ্চকে কালীঘাটের আদি গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে রবি তখন ক্লাস ফোরের ছাত্র। লেখাপড়া আর খেলাধূলো ছাড়া অন্য আর কোনো ভাবনা নেই।
কিন্তু ভাবতে হল...দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভাবতে এবং ভাবাতে বাধ্য করলো। জাপানি বোমার ভয়ে কালীঘাটের গলি ছেড়ে রবিরা তখন বছর তিনেকের জন্য কুচবিহারে মামারবাড়িতে। সরাসরি শহর থেকে মফস্বলের সবুজে ঘেরা বাড়ি রবির মনে আলোছায়ার আঁকিবুঁকি কাটলো। চারিদিকের উত্তাল জীবন স্রোত...ছুটে চলা...এখানে যেন কেন্দ্রীভূত হল মননে। দাদুর সেতার রবিকে শেখালো এক দুরন্ত ছন্দের গতি। যে ছন্দ জীবনকে অন্য ভাবে দেখায়...শেখায়। বড়মামা ছিলেন শচিন কর্তার ছাত্র। মায়ের অমন সুন্দর গানের গলা...
রবি একটু একটু করে সব চিনলো। আর কোথাও যেন পিছনে পড়ে থাকলো খেলার মাঠ...জিমন্যাস্টিকের স্বপ্ন...
ক্লাস ফাইভ, সিক্স, সেভেন কুচবিহারে কাটিয়ে এক অন্য মানুষ হয়ে ফিরে এলো কলকাতায়। তারো অনেক পরে লিখলো...
“তিনটে বছর আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ। আমার ছেলেবেলাকে ঘিরে যে নস্টালজিক ফিলিং, তা কলকাতা কেন্দ্রিক নয়, তার সবটা কুচবিহারকে ঘিরে। ...৫৩ থেকে ৬০ সাল। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তারপর আমি অনেক খ্যাতি পেয়েছি, আমার নাম হয়েছে, অর্থ হয়েছে, কিন্তু ওই অসাধারণ সময়টা আর ফিরে পাইনি। কী সময় ছিলো। দিনে কফি হাউসে আড্ডা, মাঝে নাম কা ওয়াস্তে চাকরি, নাটক, রিহার্সাল আর আবার অফুরন্ত আড্ডা। বাড়ি থেকে বাধা এলেও কিছু করার ছিলো না।”
বন্ধু মহল নাম ছিলো দলের।
কাজই ছিলো কোনো বাড়ির ফাঁকা ছাদ খুঁজে বেড়ানো...কাজই ছিলো রিহার্সাল দেওয়া...
শপথ ছিলো গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে দেওয়ার...এক্সপেরিমেন্ট করার...তারসাথে প্রচুর পড়াশুনো...আর এক নতুন পথের সন্ধান।
আর এরকমই পথ হাঁটতে হাঁটতে একদিন পৌঁছে যাওয়া উৎপল দত্তের কাছে। দীর্ঘ দশ বছরের স্মৃতি...মাঝে অসংখ্য সফল মঞ্চ প্রযোজনা। অভিনেতার জীবনের প্রাথমিক পাঠ নিংড়ে নেওয়া। মাত্র ষোল সেকেন্ডের মঞ্চাভিনয়ে মৃণাল সেনের এক প্যারা প্রশংসা উক্তি...। অঙ্গারের সাফল্যের পর আবার সব কিছু ছেড়ে দিয়ে একা।
এক দিকে প্রচন্ড আর্থিক অভাব অনটন অন্যদিকে পেশাদারী মঞ্চের রকম সকমকে মন থেকে মানতে না পারা... এই দোলাচলতায় চাকরি করাই স্থির হলো। বিষাদে ডুবে থাকা মন বললো চলে যাও দূরে...। বোঁচকা বুঁচকি বাঁধার প্রস্তুতি যখন প্রায় শেষ...আচমকা ডাক এলো তপন সিংহের কাছ থেকে। ছবিতে অভিনয় করতে হবে।
হাঁসুলি বাঁকের উপকথা।
একটা কনভেকস লেন্সের আয়না কেনা হল। মুখের সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য চলতে থাকলো কসরত। নাটক আর ফিল্মের অভিনয় আলাদা...জগতও...
আবার এক নতুন পথের সন্ধান পেলেন অভিনেতা...
এবার ডাক দিলেন সত্যজিত রায়... ডাক এলো অভিযানের।
তারপর আর ফিরে তাকাতে হলো না। প্রায় দুশোটির ওপর ছবিতে অভিনয় করলেন মহিম হালদার স্ট্রিটের ছোট খাটো চেহারার মানুষটা। নিজের কলমে লিখলেন...“ আসলে আমার নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার...। পিতা জিতেন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার, মাতা জ্যোতস্নারানী ঘোষদস্তিদার। সাকিন কলকাতা। আদি নিবাস বরিশাল। খাস বাঙাল। আমি হতে পারতাম সার্কাস দলের জিমন্যাস্ট, হতে পারতাম ওয়েট লিফটীং-এ বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন, পুলিশ কোর্টের কেরানি বাবু হয়েও জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম - এর প্রত্যেকটিরই তুমুল সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু হতে পারলাম না। সেই ছোট্টবেলাতেই থিয়েটার আর অ্যাক্টিং শব্দদুটো মাথায় গুবরে পোকার মত বাসা গেড়ে বসেছিলো। তাই আর পাঁচ জনের মতো জীবনের সহজ সরল গতিতে ভেসে যেতে পারলাম না। জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে, বহু উত্থান আর পতনকে অঙ্গীকার করে আজ আমি অভিনেতা রবি ঘোষ।”
একটু একটু করে আলো ফুটছে চারিদিকে...ভোর হচ্ছে...। লেখাটা শেষ হচ্ছে।
মাঘের শীতের সেই কামড় আর নেই...যদিও মাসটা ফেব্রুয়ারি নয় জুন । যদিও মাসটা মনকেমনের নয়...বৃষ্টির...তবু...সেই গল্প তো বলতেই হয়...।
ফেব্রুয়ারী মাসে এক দুপুরে... শ্যুটিং এর মাঝে হঠাতই অভিনেতা সকল কাজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। চলে গিয়েছিলেন নির্জন সৈকতে।
সারা রাতের ঘুম আমার চোখে চেপে বসছে না। আমার কমপিউটার বাংলা ওয়ার্ডে আর এরর দেখাচ্ছে না। শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে জনঅরণ্য...গুপীগাইন বাঘা বাইন...অরণ্যের দিনরাত্রি...আরো অসংখ্য ছবির সিডি...ডিভিডি...যেগুলো আমার দেখা হয়নি...যেগুলো ভেবেছিলাম ফিরে দেখবো আবার...জড়ো করবো...একটা বেশ বড়...বেশ ভালো...পরীক্ষার নোটের মত তাত্ত্বিক এবং তথ্য সমৃদ্ধ লেখা হবে।
কিন্তু হলো না।
এমনকি নেট থেকে রবি ঘোষ সার্চ দিয়েও একটা ভালো ছবি পেলাম না।
ভুলে গেলাম কি আমরা তাঁকে?
একটা দায়সারা ভাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলো গোটা শরীরে...লেখার অস্থি মজ্জায়। আমার সমকালে...।
গল্প হলেও সত্যি-র সেই ঠিকে চাকরের ম্যাজিক বাস্তবতা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।
পালামৌয়ের বেতলা জঙ্গলে বন বাংলোর সামনে প্রায় নগ্ন, সাবান মাখা একটা ছোটখাটো শরীর অতি বিনম্রের অছিলায় তির্যক ব্যাঙ্গোক্তিতে আমাকে যেন বলে গেলো “সো খাইন্ড অফ ইউ।”